ব্রিটিশ উপনিবেশে বাংলার বাণিজ্যের অপমৃত্যু ও নববিকাশ
আজকের দুনিয়ায় আমরা যে বাণিজ্য দেখি তার রূপ কী সবসময়ই এক ছিল? বাণিজ্যের সাথে রাজ্যের কি সম্পর্ক এবং একটি বিশেষ রাজ্য কিংবা সাম্রাজ্য কীভাবে একটি বিশেষ শ্রেণির উদ্ভব কিংবা বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা দেখবো এই নিবন্ধে।
কৃষির পর বাণিজ্যই পৃথিবীর আদিমতম পেশা। এ বাণিজ্যের বিকাশের প্রক্রিয়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পর্যায়ে বিকাশ লাভ করেছে। বাণিজ্যের প্রাচীণ ব্যবস্থা যেখানে কিছু ব্যক্তির কাছে বাণিজ্য কুক্ষিগত ছিল তা থেকে বর্তমান প্রক্রিয়া অনেকটাই ভিন্ন। যোগাযোগ এবং পরিবহণ বিপ্লবের ফলে বাণিজ্য এখন অনেক বেশি গতিশীল। ছোট-বড় প্রত্যেক জাতির কাছে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ এ বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগতিা এখন পূর্বের “জোর যারমুল্লক তার” টাইপের কর্তৃত্বের বিপরীতে কঠোর নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়।
প্রাচীন বাংলায় বাণিজ্য:
বাণিজ্য বাসতি লক্ষ্মী (বাণিজ্য ভাগ্য আনে) বচনটি প্রাচীন বাংলায় প্রচলিত ছিল। খনা নামক একজন নারীর এরকম আরো অনেক বচন গ্রাম-বাংলায় প্রবাদ বাক্যের মত শোনা যায়। এগুলো “খনার বচন” নামে পরিচিত। আমাদের পূর্ব প্রজন্ম সারাবছর তাদের কাজকর্মের ক্ষেত্রে এসব বচনগুলো প্রবাদ আকারে ব্যবহার করতো, যা ভবিষ্যদ্বানী হিসাবেও বিবেচিত হতো। খনার বচনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে ব্যবসা ও বাণিজ্য।
সনাতন ধর্মের কাঠামোতে পেশাভিত্তিক যে শ্রম বিভাজন রয়েছে সেখানেও ব্যবসার ভিত্তিতে একটি বর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে। হিন্দুদের চার বর্ণের তৃতীয় বর্ণ বৈশ্যরা ছিল ব্যবসায়ী এবং এর পূর্ববর্তী বর্ণ ক্ষত্রিয়রা ছিল যোদ্ধা। বাহ্মণরা ধর্মকর্ম করতো এবং জাতিকে নেতৃত্ব দিতো। শুদ্ররা বাকি তিন বর্ণের সেবা করত। বাহ্মণরা বহিঃবাণিজ্যেও যুক্ত ছিল। কারণ এটা ছিল লোভনীয় এবং প্রসাশনিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য প্রয়োজনীয়। তখন একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল, বাকি তিন বর্ণ বাহ্মণদের উপরে কিছু করতে পারবে না।
বাংলা ছিল সমৃদ্ধ ভূমি। এই অঞ্চলের বণিকরা পূর্বাদিকে পণ্য এবং সংস্কৃতি নিয়ে একে অপরের সাথে হাতে হাত রেখে বিচরণ করতো। ব্যবসায় উদ্যোগগুলো বাণিজ্যের বাহিরেও প্রতিবেশী বিশেষত বার্মা, বালি দ্বীপ, কম্বোডিয়া, জাভা, মালয়, শ্যাম(থাইল্যান্ড), সুমাত্রা এবং শ্রীলঙ্কা প্রভৃতির উপর গভীর সাংস্কৃতিক প্রভাব তৈরী করতে পেরেছিল। এটাকে সম্পূর্ণভাবে বাণিজ্য, ধর্মপ্রচারক এবং বণিকদের শান্তিপূর্ণ প্রভাববিস্তার হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
গুপ্তদের শাসনামলে বিশেষত রাজা চন্দ্রগুপ্তের (৩২১ থেকে ২৯৭ খ্রিঃপূঃ) সময় বাংলার বাণিজ্যে বিস্তৃত কাঠামোর সাথে পরিচয় ঘটে এবং জাহাজসমূহের তত্ত্বাবধানের জন্য রাজার নেতৃত্বে “বোর্ড অব অ্যাডম্যারালটি” গঠন করা হয়। চন্দ্রগুপ্তের অর্থমন্ত্রী কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ এটার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের নৌ-অভিযান এবং বাণিজ্য থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠায় এবং জাহাজ পরিচালনায় তারা বেশ দক্ষ ছিল।
যেহেতু বাণিজ্যকে সেসময় ভূখন্ড জয়ের সমতূল্য হিসাবে বিবেচিত হতো তাই এই প্রক্রিয়ায় মালয় উপদ্বীপ, সুমাত্রা, জাভা, কম্বোডিয়ায় হিন্দু সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া মালাক্কা প্রণালীর উপর নিয়ন্ত্রণ এবং বেশকিছু দূরবর্তী দ্বীপের উপরও বাংলার কর্তৃত্ব বিরাজমান ছিল। এই ভূখন্ডগুলো তখন বাংলার দখলকৃত বাজার(captive market) ছিল।
আন্তঃবাণিজ্যে উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বাংলার স্থল ও নদী উভয়পথে এবং উপকুলীয় সমুদ্র পথে সমৃদ্ধ ব্যবসায়িক যোগসূত্র ছিল। বাংলা ছিল সকল ব্যবসায় কর্মকান্ড এবং পণ্য তৈরীর কেন্দ্র এবং অন্যান্য অঞ্চল বিশেষত গুজরাট(সুরাট), মালাবার/কেরালা(কালিকাট) ইত্যাদি থেকে বাংলার স্বতন্ত্রতা ছিল। ভুটান এবং নেপালের জনগণ মাথায় ভর্তি পণ্য নিয়ে বাংলায় আসতো এবং মাসের পর মাস এখানে বসবাস করতো। তারপর মাথা ভর্তি পণ্য নিয়ে বাংলা থেকে ফিরে যেতো। একইভাবে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এবং আফগানিস্তান থেকে পাঠানরা, যারা কাবুলি হিসাবে পরিচিত ছিল, তারা মাথাভর্তি দ্রব্য, বিশেষত শুষ্ক ফল এবং অন্যান্য পণ্য নিয়ে বাংলায় আসতো এবং বাংলায় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বসবাস করতো। তারা বাংলায় গরীব লোকদের ঋণ দেয়ার ব্যবসায় জড়িত ছিল কিন্তু তাদের অশোভন আচরণ ও ঋণখেলাপীদের প্রতি নিষ্ঠুর অন্যায় সাধন করায় তারা এই অঞ্চলে দুর্নাম অর্জন করেছিল। রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালার গল্পে আফগান-বাংলার ঐতিহাসিক সংযোগের পরিচয় পাওয়া যায়।
মধ্যযুগের বাংলায় বাণিজ্য:
গুপ্ত, মারোয়ান, পাল এবং সেন রাজ বংশের পতনের পর বাংলায় একটি রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল যা বহিঃবাণিজ্যের উপর মারাত্বক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল যদিও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য আগের মতই সচল ছিল। পূর্ববর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু রাজ্যসমূহ স্বদেশ থেকে দুর্বল যোগাযোগ এবং প্রসাশনিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। ইতোমধ্যে ৭ম এবং ৮ম শতাব্দীতে আরব বণিকরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলায় আসে এবং বাংলার সাথে বাণিজ্য শুধু করে।
বণিকদের সাথে সাথে মুসলিম ধর্ম প্রচারকরাও বাংলায় আসে এবং বাংলার মানুষদের উপর তাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে। আরবরা ছিল সাংযাত্রিকদের মত নির্ভীক ও দুঃসাহসী ফলে তারা প্রচলিত বড় বড় নৌকায় সমুদ্রযাত্রা করতো। তারা তাদের নৌকা চাঁটগায়ে(বর্তমান চট্টগ্রাম) ভেড়াতো। ধীরে ধীরে বাংলার বাণিজ্য যোগসূত্র বিস্তৃতি লাভ করে এবং এটা বলা হয় যে, মরক্কো ও ইউরোপের বণিকরাও বাংলায় ব্যবসা বা উদ্যোগে অংশ নিতো। তারা লোহিত সাগর অতিক্রম করে আরব উপদ্বীপের বণিকদের সাথে কলম্বিয়া হয়ে পূর্বদিকে চট্টগ্রামের পথে সমুদ্রযাত্রায় যোগ দিতো।
এসময় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য এবং উপকূলীয় সমুদ্র পথে বাণিজ্য আগের মতই ছিল। ভারতের অন্যান্য অঞ্চল হতে কাফেলাগুলো বহনকৃত পণ্যসমগ্র নিয়ে কোন বাধা বা বিপত্তির সম্মুক্ষীণ না হয়েই বাংলায় আসতো। অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও ব্যবসায় সক্রিয় ছিল এবং তারা চট্টগ্রামকেন্দ্রিক নতুনভাবে উদ্ভূত মুসলিম ব্যবসায়ীদের তুলনায় সম্পদশালী ছিল। গ্রাম-বাংলায় এবং বাংলার ছড়িয়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরে বিস্তৃত অধিকাংশ বাণিজ্য হিন্দু, মারোয়াড়ী এবং গুজরাটিদের হাতে ছিল। এটা উল্লেখযোগ্য যে, এই সম্প্রদায়গুলো কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ব্যবসা করতো।
বারো ভূঁইয়া এবং আফগান সর্দারদের(Chieftain) রাজত্বকালে বাণিজ্য দেশে এবং বিদেশে একটা ভালো সময় অতিবাহিত করেছিল। তারপর তুর্কি থেকে ব্যারনরা(Nobleman) আসে এবং বাংলায় সুলতানাত প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৫৩৭ সাল পর্যন্ত ২০০ বছরের অধিক সময় বাংলা শাসন করে। তারপর তারা মোঘলদের দ্বারা সিংহাসনচ্যূত হয়। মোগলরা বারো ভূঁইয়াদের মেরুদন্ড ভেঙে দেয়। কিন্তু বারো ভূঁইয়াকে গ্রাম বাংলা থেকে পুরোপুরি নিঃশেষ করতে পারেনি। বাংলার কোন রাজনৈতিক আক্রমণই বাণিজ্যিক কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করতে পারেনি। পক্ষান্তরে, মোঘলরা দস্যু এবং ডাকাতদেরকে, বিশেষত মারাঠা এবং পর্তুগিজদের, স্থলসীমান্তে এবং জলপথে বিতাড়িত করেছিল।
উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে এটা জোর দিয়ে বলা যায় যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর বাংলা (সুবহে বাংলা-বাংলা,বিহার,উড়িষ্যা) দখল করার আগ পর্যন্ত বাংলায় বাণিজ্যের সোনালী দিন ছিল।
বাণিজ্য এবং ব্রিটিশ সম্রাজ্য:
১৫ শতকের আগ পর্যন্ত কোন ইউরোপিয় রাষ্ট্রই বাংলার সমুদ্রপথ বা রুট জানতো না এবং যার ফলে তারা সমৃদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে কোন তাৎপর্যপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি। রোমান এবং বাইজাইন্টাইনদের শাসনামলে উপমহাদেশের এই অঞ্চলে স্থলপথে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ছিল এবং তা মধ্যপ্রাচ্য, লোহিত সাগর এবং আরব উপদ্বীপের নির্দিষ্ট পয়েন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
১৪৯৬ সালে ভাস্কো দা গামা উত্তমাশা অন্তরীপ (কেপ অব গুড হোপ) হয়ে ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিস্কার করেন এবং কালিকাটে তার জাহাজ ভিড়ান যা ভারতের দক্ষিনাঞ্চলীয় প্রদেশ কেরালায় অবস্থিত। এটা ছিল ইউরোপিয়ানদের জন্য বৃহত্তর বাণিজ্য এবং পরিশেষে এই অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে তাদের আকাঙ্খা পূর্ণ করার সূবর্ণ সময়।
এখানে এটা বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, কলম্বাস ইতোপূর্বে ভারতের সমুদ্র পথ আবিস্কার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার জাহাজ ভিন্ন রুটে ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপপুঞ্জে উপনীত হয় এবং তিনি ভেবেছিলেন এটা ভারতের পশ্চিম উপকূল।অবশেষে ১৪৪২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করেন। এজন্য ইন্ডিয়া থেকে অনেক দূরের দ্বীপপুঞ্জগুলো ওয়েষ্ট এন্ডিজ হিসাবে পরিচিত।একইভাবে কয়েক হাজার দ্বীপপুঞ্জ(ইন্দোনেশিয়া) ইস্ট ইন্ডিজ হিসাবে পরিচিত।
যাইহোক, মূল কথায় ফিরে আসি। ব্রিটিশ, ডাচ, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগীজ এবং অন্যান্যদের অসংখ্য বণিক জাহাজ ভাস্কো-দা-গামার আবিস্কৃত পথ অনুসরণ করে ভারতবর্ষে আসতে শুরু করে। তারা প্রধানত সুরাট এবং বাংলার কিছু অংশে বাণিজ্যে জড়িত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সুরাট এবং বাংলায় বাণিজ্য সুবিধা পাওয়ার জন্য দিল্লিতে মুগলকোর্টে উপঢৌকন পাঠায়। অবশেষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সফল হয় এবং ১৭শ শতকের শেষে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলায় তাদের কাঙ্খিত বাণিজ্য সুবিধা দিতে রাজি হয়।
উল্লেখ্য যে, বাৎসরিক তিন হাজার রুপি প্রদানের বিনিময়ে ব্রিটিশদের বাণিজ্যের স্বাধীনতা দেয়া হয়। সুরাটে কোম্পানীর ধূর্ত প্রতিনিধি দিল্লির মুঘলকোর্টের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে এবং বলিষ্ঠ সম্রাট জাহাঙ্গীরকে বর্ণনাতীত সন্তুষ্ট রাখে। সেসময় ব্রিটিশদের থেকে বাংলার মানুষদের মাথা পিছু আয় ছিল আনুমানিক ২০ গুন বেশী।
১৬৯০ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পাণীর জব চার্নক ব্রিটিশদের বাণিজ্য এবং গোপনীয় কার্যক্রমের জন্য সচেতনভাবে একটি জায়গা নির্বাচন করেন।কোম্পানী সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কালিকাতা নামে তিনটি বড় বড় গ্রাম ক্রয় করে।ওটাই ছিল কলকাতার জন্ম।
ইতোমধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পোর্ট উইলিয়ামে(কলকাটা) তাদের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে শুরু করে। নবাব সিরাজউদ্দৗলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে শুধুমাত্র বাণিজ্যে তাদের কার্যক্রম সীমিত রাখার জন্য হুশিয়ারি করেন কিন্তু কোম্পানী তা অস্বীকার করে। কোম্পানীকে বৃহৎ সেনাবাহিনী নিয়ে সরাসরি আক্রমণ করা ছাড়া নবাবের আর কোন উপায় ছিল না। সংখ্যায় খুব কম সৈন্য নিয়ে বৃটিশরা নবাবকে পরাজিত করে এবং তাকে কিছু বাঙালী বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগিতায় হত্যা করে, যার মধ্যে নবাবের সেনাপ্রধান মীর জাফর আলি খান অন্তর্ভুক্ত। এভাবে সুবাহ বাংলা(বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণে(সাবজুগেটেড) চলে যায়। ১৭৬৫ সালে বক্সারের যুদ্ধে বাংলা আবার স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করেছিল কিন্তু আবারও কোম্পানীর কাছে হেরে যায়। বাকিটা এখন কেবল ইতিহাস।
কোম্পানী বাংলার সকল বস্তুগত সম্পদ এবং অবস্তুগত সম্পদ চুরি করে নিয়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের পাঁচ বছরের মাথায় ১৭৭০ সাথে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ১৯৪৩ সালে আরো ৩০ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। ইতোমধ্যে মোঘল সম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে ভারতের সংস্কৃতি ও বাণিজ্য কেন্দ্র দিল্লি থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।
একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, ১০০ বছরে কোম্পানী স্থানীয় আইন ব্যবস্থা নিয়ে কোন হস্তক্ষেপ করেনি। ফারসি বাংলায় আদালতের ভাষা হিসাবে বহাল থাকে। মুসলিম সম্প্রদায় তখন কোর্ট বা কাচারিতে খুবই প্রভাবশালী ছিল কিন্তু উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা অধিকাংশই আইন পেশায় জড়িত ছিল যা তখন মোক্তার নামে পরিচিত ছিল। তারপর কোম্পানী কোর্ট কাচারিতে ইংরেজি ভাষা চালু করে। ফলে মুসলিম সম্প্রদায় একরকম বিতাড়িত হয় এবং এই শূন্যস্থান হিন্দু সম্প্রদায় পূরণ করেছিল। ইংরেজি শিক্ষায় উদাসীনতার কারণে মুসলিমরা হিন্দুদের পেছনে পড়ে যায়।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব ভারতের জনগণের উপর কোম্পানীর নিষ্ঠুর শাসনের দৃশ্যপট পরিবর্তন করে দেয়। মানিশ পান্ডে ছিলেন একজন সিপাহি যিনি বাংলার ব্যারাকপুরে প্রথম গুলি করেন। তারপর এটা মিরাট এবং দিল্লিতে সবচেয়ে বড় ক্যান্টনমেন্টসহ ভারতের সারা উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রথমে পরাজয়ের আশঙ্কায় ভোগে কিন্তু তারা দিশাহীন বিপ্লবী সিপাহীদের পরাজিত করে এবং পাঞ্জাব, রাজপুত,মারাঠা, ভোপাল এবং হায়দারাবাদ এর গুর্খী ,শিখ এবং মুসলমানদের সাহায্যে নিষ্ঠুরভাবে বিপ্লব দমন করেন, এমনকি এই ঐতিহাসিক বিদ্রোহে বাংলার মানুষ কোন সাহায্যের হাত পর্যন্ত বাড়ায়নি।
মুগল বংশধরদেরকে নিষ্ঠুরভাবে ফাঁসি বা হত্যা করা হয়েছিলে এবং শেষ মুগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয়েছিল, সেখানে তিনি ৮৭ বছর বয়সে মারা যান।
সিপাহী বিপ্লবের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাড়াবাড়ি এবং একইসাথে বেশকিছু সংখ্যক স্থানীয় রাজ্য কোম্পানী শাসনে অধিভুক্ত হওয়ায় রাণী ভিক্টরিয়া ভারতের শাসনক্ষমতা নিয়ে নেন এবং ১৮৮৫ সালের পহেলা নভেম্বর ভারতের সকল মানুষের প্রতি নায্য এবং সুবিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি ঘোষণা দেন। তখন থেকে ভারতের জনগণের উপর নির্যাতন কিছুটা কমেছিল। ব্রিটিশরা বাণিজ্যের স্বার্থে ভারতবর্ষের জনগণের ধর্ম, সংস্কৃতি, কৃষ্টির উপর হস্তক্ষেপ করেনি বটে কিন্তু নিজেদের শক্ত অবস্থানে রাখার জন্য হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরি সম্পর্ক সৃষ্টিতে তৎপর ছিল।
ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার প্রথম ভাইসরয় এবং গভর্ণর ছিলেন লর্ড ক্যানিং যার দায়িত্ব নেওয়ার সাথে সাথে দৃশ্যপট মৌলিকভাবে পাল্টে যায়। স্থানীয়দের অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃবাণিজ্যে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে ভারতীয়রা ব্যবসা-বাণিজ্যে পুনরায় সমৃদ্ধি লাভ করতে শুরু করে। বাংলার হিন্দু ও মাড়োয়ারিরা ব্যবসা-বাণিজ্যে এগিয়ে যায়। মুসলিমরা অবশ্য বিভিন্ন কারণে সুবিধাগুলি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। প্রকৃতপক্ষে বাংলায় কোন শিল্প স্থাপন করা হয়নি। এই অবস্থা ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ ব্রিটিশদের পতনের আগ পর্যন্ত বহাল থাকে।
[মূল লেখক: এবিএম আহসান উল্লাহ, ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস এর “ Evolution of Trade in Bengal” নামক প্রবন্ধ থেকে অনুদিত।]