| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ছোটগল্প: নীলছবি । মাহবুব আলী

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

শাফায়েত উৎকর্ণ হয়। বাইরে কেউ ডাকে। বদ্ধ চালাঘরের ভেতর দূরের ভেসে আসা কণ্ঠ স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবু মনে হয় কারও ডাক। অথবা মনের ভুল। এই রাত দুপুরে কে আবার ডাকবে? জ্বিন…ভূত? সে ওসব বিশ্বাস করে না। মনে মনে হেসে ওঠে। চোরের মন পুলিশ-পুলিশ! একটুপর আবার ডাক শোনা যায়। একবার। দু-বার। নিশ্চয়ই কেউ নাম ধরে ডাকছে।

ঘরের দেয়ালে নীল-লাল-হলুদ বর্ণিল আলোর প্রতিফলন। এরমধ্যে বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া বর্ণনাহীন স্বর্গরাজ্যের সৃষ্টি করেছে, নাকি নরক গুলজার? সে এখন ওসব দেখে না, ভুল করে ভাবেও না, শুধু ঝিমোয়; তন্দ্রায় মাথা ঝুলিয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ আগে ঝিমিয়ে পড়েছিল। সতর্ক ডাকে দ্রুত সচেতন। কে বাইরে ডাকে?

‘আ বে শাফাত তুই কুণ্ঠে আছিস বে? বাহির হ… বাহির হ। তুই শুনলি নাকি বে?’

শাফায়েত এবার নিশ্চিত কেউ ডাকছে। নূর মহম্মদ। অস্থির ডাক। ব্যাটা আবার কিছু ঘাপলা বাঁধিয়েছে মনে হয়। ধার-টার চাইলে সন্ধেয় চেয়ে নিতে পারত। কে জানে কোনো ইমারজেন্সি ব্যাপার কি না!

শাফায়েত দরজা সামান্য একটু খুলে মাথা বের করে। শরীর উঠতে চায় না। এবার অগ্রহায়ণেই শীত কাহিল করে দিয়েছে। তাই বিকেল থেকে চাদরমুড়ি দিয়ে তন্দ্রায় ঢলে পড়ে। ঝিমোয়। যখন চোখ মেলে ঠিকমতো দেখতে পায় না। চোখের কোনে আঠালো ময়লা। পিচুটি জমে থাকে। চোখ দুটো রগড়ে বাইরে তাকায়। সামনে ঝাপসা। সবকিছু আবছা। বেরোতে হয়। ঘরের দরজা ভেজিয়ে রাখে। ঘনীভূত অন্ধকারে কোনোমতো দাঁড়াতে পারে। মাথা টলায়মান। সরু দৃষ্টিতে নূর মহম্মদকে হাতড়ায়।

‘কেঠা বে নুরু-অ্যা? উ ফির কী করল?’

‘তইু খবর পাইসনি বে! চৌরঙ্গিতে মানুষ অ্যাসছে। হাঁর সনধো হোইছে, কুনু হারামজাদা তোর ব্যাপারে কথা রটালছে। শ্যাষে মাস্টার মানুষ…কি ক্যালেংকারি!’

‘হাঁ বে হামি তো সপ্তাহে সপ্তহে টাকা দিয়্যাছি।’

শাফায়েত ওজর তুলেও মনে তেমন জোর পায় না। ঘুম-ঘুমভাব কেটে গেছে। এবার অস্থিরতা সংক্রমিত করে বসে। হাতের আঙুল থিরথির কাঁপে। পুলিশ! পুলিশ মানে ঝামেলা। মহাফ্যাকড়া। আতঙ্ক।

মাস দুয়েক আগে দু-জন এসেছিল। সঙ্গে টিংটিঙে মার্কা এক লম্বু। সে নাকি সাংবাদিক। হবেও বা! এখন পথে ঘাটে অলিতে-গলিতে সাংবাদিক। শত শত পেপার…লক্ষ লক্ষ সাংবাদিক। নূর মহম্মদের পেছন-পেছন কয়েকদিন ঘুরঘুর করে। দাবি পাঁচশ টাকা। শাফায়েত কেন টাকা দেবে? প্রতি সপ্তাহে কমিশন দেয়। ইয়ার্কি? ওসব পেপারিং-এর ভয় দেখান যাবে না তাকে। সরকারি মানুষ পেছনে থাকলে দিনদুপুরেও খুন করা যায়। আর সে তো শুধু…সব জায়েজ।

সেবার তবু ঝামেলা হল। ক’জন সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় আছে। সামান্য জানাশোনা। বন্ধু মানুষ নয়। এমন ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না। অথচ সে হারামজাদা সাংবাদিক সদর থেকে পুলিশ আনে। সাংঘাতিক ফ্যাকড়ায় জড়ায়ে ফেলে। হাজার টাকা রসাতলে তো গেলই…সালামও ঠুকতে হল। সাহেবরা টাকা পেয়ে গদগদ। সেই থেকে নূর মহম্মদ ভয়ে পিছুটান। ধড়পড় করতে করতে বলে, এসবে আর সঙ্গে নেই। সে না থাকুক। শাফায়েত একাই একশ। পুলিশ ম্যানেজ তো সব ঠিক। তবু বুকের মধ্যে গোপন কাঁপুনি থাকে। শালাদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই। সে মাস্টার মানুষ। ছাত্র পড়িয়ে খায়।

বাইরে আলোছায়া অন্ধকার। কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ অনেক আগে আকাশ থেকে সরে গেছে। দূরের পান দোকানে টিমটিম করে জ্বলছে কুপি। দোকান খোলা থাকে শেষঅবধি। পাবলিকে বিড়ি-সিগারেট কেনে। পান খায়। শাফায়েত জবাবের জন্য অপেক্ষা করে। নূর মহম্মদ ঠোঁট চেপে চেপে বলে, –

‘মানুষগালাক বাহির কর। শালা বাহিঞ্চতরা কখন আসে তারই ঠিক নাহি।’

‘তা তুই ঠিক কোহ্যাছিস। এগুলা ফির বাড়ি নুকাবা হবি…হাটে ভ্যান-ট্যান কিছু আছে নাকি বে?’

‘এত রাইতে তুই শালা ভ্যানগাড়ি ঢুঁড়িস? তোর বাপ মাইক্রো লিয়্যা আসবে বে। এই শালা তুই কুণ্ঠে আছিস বে হ্যাঁহ্? শালা মাস্টার মানুষগালাই রাম-বোকাচোদা। এ ল্যাগাই হামি মাস্টার হোইতে যাইনি। লে লে ব্যাবাক ঘাড়ে উঠা…হামিও উঠাছি।’

ঘুম-ঘুম তন্দ্রা উবে গেছে। নূর মহম্মদ একেবারে নাড়িতে মেরেছে টান। শ্লেষোক্তি দুই কানে ভনভন বাজে। সে মাস্টার…মাস্টার মানুষ। মানুষ গড়ার কারিগর। অথচ কী করে? তার দু-চোখ তীক্ষ্ণ সরু। নূর মহম্মদ হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে। অসম্ভব রকম খারাপ অভ্যাস। তার গায়ের চাদর অন্ধকারে কালো দেখায়। কুয়াশার ভেতর দিয়ে মুখ শেয়ালের মতো। তা নুরু বেশ ধূর্ত হয়েছে। নাইট-গ্রিন চাদর গায়ে জড়িয়ে হারূন শেখের দোকানে আড্ডা দেয়। সারাদিন চা-বড়া-জিলেপি খায়। পান চিবোয়। ফচাৎ করে পিক ফেলে। বিড়ির মুড়ো দিয়ে অন্য বিড়ি ধরিয়ে আয়েশ করে ফোঁকে। মানুষের সঙ্গে বকবক করে। উসকে দেয় মগজের স্নায়ু। টগবগে ফুটতে থাকে মামলার তেজ। ওসবের মধ্যে চলে দিন-দুনিয়ার ধান্দা। তার দিনকাল এই করে ভালোই চলছে। শাফায়েত একসময় এসব ভাবত। ছোটবেলার বন্ধু। লোকে বলত মানিকজোড়। এখন দু-জন দুই প্রান্তের। বেসরকারি স্কুলে মাস্টারি করতে করতে নূর মহম্মদের পরামর্শে এই ব্যবসার শুরু। যাদুররানি হাটে সমবায় অফিসের পাশে দো-চালাঘর। পরিত্যক্ত। তখন দু-জনে যুক্তি করে ভাড়া নেয়। শাফায়েত সারাদিন রণহাট্টা স্কুলে ডিউটি করে। শেষ-বিকেলে সেখান থেকে বাড়ি। কোনোমতো নাকে-মুখে কিছু গুঁজে সন্ধেয় হাজির। নুরু আগে থেকেই ব্যবসা চালায়। দু-হাতে নগদ পয়সা। তারপর পটপরিবর্তন। যে পুলিশের ভয়ে নুরু তাকে ছেড়ে গেল, আজকাল তাদের কাঁধে হাত রেখে চলে। রেস্তোরাঁয় চা-মিষ্টি-দই বা ঠান্ডা ভাগাভাগি খায়। পুলিশের পাইলট কাপে চুমুক রাখে। আজ রাতে সেই নূর মহম্মদ পুলিশের ভয় দেখায়? হবেও বা ভয়ের কোনো বিষয়। সবসময় নেটওয়ার্ক কাজ করে না। শাফায়েত তাই তড়িঘড়ি করে।

রাতে ঘুমোতে পারল না। আজকাল ঘুম প্রায় হয় না। যে মানুষ ঝিমোয়, তার ঘুম হবে কেন? এমনিতে প্রায় প্রতিদিন অনেক রাতে ঘরে ফেরে। চালাঘরে রঙিন আলোর ঝলকানি দু-চোখে ঝিলমিল। রংধনুর সাতরং। নানান কথা-গান-নাদ-আর্তনাদ-সংঘর্ষ শব্দ-আওয়াজ কানে প্রতিধ্বনি তোলে। কান ঝালাপালা। তাই বসে বসে ঝিমোয়। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ক্লান্ত-অবসন্ন। মন চায় আরামের বিছানা। সে-সব হতে পারে। সে ঘরে ফেরে না। দেরি করে। টাকার দরকার…অনেক টাকা। চাহিদার শত ডালপালা। ক্লেদাক্ত জীবন। দিনরাত প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে সেই খেদোক্তি। তার সংসারে সুখী নয় পরিবানু। অনেক প্রত্যাশা-অনেক দাবি। বাস্তবিক শাফায়েত কিছু করতে পারেনি। এমনকি যখন গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরে, প্রায়শ ধাক্কা খায়। শ্লেষবাক্যে মরে যাওয়ার সাধ। ধিক্ জীবন! কানে বাজে প্রগাঢ় কণ্ঠের অস্ফুট ঝনঝন।

‘দম শ্যাষ! ভারি মরদ একখান!’

শাফায়েত নিজের দুর্বলতা গোপন রাখতে ব্যর্থ। চোখের পাতায় হীনম্মন্য কম্পন। ব্যর্থ পীড়ন। সেখানে অশান্তির বিষাদ কথা কালো চিহ্নদাগ তোলে। সেটি অকারণ অথবা অকারণ নয় কে জানে। অতৃপ্তির হতাশা কর্কটরোগের মতো অস্তিত্বকে যন্ত্রণা দেয়। আহা জীবন তো এমন হওয়ার কথা নয়! ভেবেছিল মনের গহিনে জমে থাকা ছোট ছোট আকাঙ্ক্ষা ভাগ করে নেবে। পরিবানু অন্য মানুষ। আবেগহীন। নিষ্প্রাণ। সে থাকে নিজের মধ্যে। শাফায়েত আবেগে ভরপুর, শুধু বেগ ছিল না; গতিশক্তি নেই। সেই একা থেকে গেল। একাকী মানুষ। হাজার মানুষের ভিড়ে পৃথিবী জনশূন্য। কোনো সাগর বালুকাবেলায় নিঃসঙ্গ একা একা জীবনকে আবিষ্কারে ব্যস্ত সে। সেও প্রকাণ্ড প্রশ্নবোধক বিষাদ ছাড়া কিছু নয়। একাকিত্বও লজ্জা দেয়। পীড়া দেয়।

রাতে পরিবানুকে অনেক ডাকাডাকি করে তোলে। কোনো কোনো রাত এমনই হয়। সে দরজা খোলে। ঘুম ঘুম ফোলা চোখ। ঢুলুঢুলু দৃষ্টি। তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে দুম্ করে বিছানায় আছড়ে পড়ে। কে এল কে গেল দেখার প্রয়োজন নেই। শাফায়েত ক্ষুধা পেলে ঠান্ডা ভাত তরকারি নিজে নিয়ে খায়। নইলে বিছানার একপাশে চুপচাপ শোয়। কখনো খুব আবেগে জড়িয়ে ধরে। ডানহাত তুলে দেয় নরম বুকের উপর। পরিবানু কখনো হাতখানা কাছে টেনে নেয়। কখনো ঝটকা মেরে সরিয়ে রাখে। সে ঘুমে একেবারে কাদা। তুলতুলে নরম বালিশ। শাফায়েত অনেককিছু বুঝে ফেলে। একদিকের প্রাপ্তি আরেকদিকে বঞ্চনা। এই-ই নিয়ম। প্রকৃতির বিচার বড় অন্ধ!

গতরাতে পরিবানু নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখে। চোখ দুটো পদ্ম-পাঁপড়ি ফোলা-ফোলা। ঠোঁটের হাসিতে মায়াময় রহস্য রং। শাফায়েত একপলক দৃষ্টিতে অহংকার স্ফীত। এই তার বউ…পরির মতো সুন্দর। পরিবানু। অনেকদিন বউকে ঠিকমতো দেখে না। তার দু-চোখ অদ্ভুত অব্যক্ত আদিম…মুগ্ধ ভাষা। আজ দেখবে। পরিবানুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নূর মহম্মদকে জিজ্ঞেস করে, –

‘কি হোয়্যাছে নুরু ভাই?’

‘কিছু লয় পুলুশ।’

‘পুলুশ! হি হি হি!’

পরিবানুর তীক্ষ্ণ হাসি না কি শ্লেষ? মধ্যরাত কেঁপে ওঠে। শাফায়েতের বুকে যে অহংকার ঢেউ তুলে যায়, কেউ দুরমুশ দিয়ে ভেঙে ফেলে; ইচ্ছে হয় গালে ঠাস করে এক চড় বসায়। ‘মাগি মাঝরাতে হাসছে কেমন!’ কিন্তু কিছু করে না। করতে পারে না। মায়া পড়ে গেছে খুব। ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাখে সে।

বছর দুয়েক আগে নূর মহম্মদের মামার বাড়ি গিয়েছিল। ওর জেদেই যাওয়া। বন্ধুর মন রক্ষা আর কি! রানিশংকৈল উপজেলার নিয়ানপুর গ্রাম। সবুজ গাছগাছালিতে সাজানো গোছানো ছায়া ছায়া পরিবেশ। গ্রামের মাঝখানে বাড়ি। চারপাশে উঁচু প্রাচীর। দক্ষিণ দেয়ালে দরজা। সেখান থেকে তিন-চার হাত নিচে বড় এক দিঘি। কাকচক্ষু টলটলে পানি। দেয়াল ধরে নেমে গেছে লাল ইটের সিঁড়ি। জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা। দিঘির পাড়। কতগুলো লাল-সাদা শাপলা ধারেকাছে ফুটে স্বপ্নময় পরিবেশ। শাফায়েত দিঘিতে নামতে গিয়ে চমকে ওঠে। বিস্ময় ধাক্কা। অভিভূত বিহ্বল দৃষ্টি। অপূর্ব সুন্দর এক মেয়ে দিঘির ডানদিক আলো করে রেখেছে। সেই পরি। উঁচু বুক ভেজা কাপড় ঠেলে উদ্ভাসিত। প্রখর দুপুরের মতো চোখ-ধাঁধানো উজ্জ্বল গায়ের রং। তখন সে ঠিক করে এই মেয়েকে চাই।

তিন মাসের মাথায় ঘরে নিয়ে আসতে পারে। নূর মহম্মদের মামাতো বোন। সন্বন্ধ গড়তে অসুবিধা হয়নি। শাফায়াতের মনে পড়ে সেই প্রাপ্তি রাতের কথা। পরির গায়ে বুনো ঘাসফুলের গন্ধ। সেই সুবাস আবিষ্কারের উদগ্র নেশায় দু-হাতে আলতো পরির মুখ তুলে ধরে। চোখের সামনে, খুব কাছে, একান্ত নিবিড়, কিন্ত হতাশ; সেই দিঘিপাড়ে দেখা দু-চোখ আর রাতের দৃষ্টিতে বড় ব্যবধান। সেখানে অতলান্ত কোনো গভীরতা নেই। নেই নিটোল ঢেউ। নেহাতই অতিসাধারণ নারী। সেই ধরে গেল বিছুটি দংশন। সে কি ভুল করেছে? হয়তো তাই…নাকি নিশ্চিত কে জানে। সে এও বুঝে নেয়, জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো কোনো ভুল পরে শোধরানো যায় না। ভুল হিসাবের বিষকাঁটা বুকে নিয়ে জীবন চলতে হয়। একসময় সেই দহন, হৃদয়ের ক্ষত; দিন চলে যেতে যেতে ফিকে হয়ে আসে। অনেকের জীবনে তাই হয়। তারও স্বস্তি হল না।

শাফায়েত পুলিশ আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দেয়। আতঙ্ক সবসময়। এই বুঝি দরজায় ঠকঠক ডাক পড়ে। তেমন কিছু হয় না। নূর মহম্মদকে মনে মনে গাল দিতে গিয়ে থেমে যায়। সে যদি সতর্ক না করত, যদি তারা সত্যি আসত; ক্ষতি হতো অনেক। সাবধান থাকা ভালো। এমন বন্ধু আর কে আছে? পরিবানু কি মনে করে ভাত সাজিয়ে দেয়। গরমভাত আর মৌরলা মাছের চর্চ্চড়ি। সদা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য দৃষ্টি অদ্ভুত কোমল। শাফায়েতের ভালো লাগে। বুকে আবেগ উথলে ওঠে। রাত দশটায় মফিজের দোকানে ভাত খেয়েছিল। ক্ষুধা নেই। তবু খেতে বসে। একটু আগে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা রাগ ভালবাসা দরদে গলে যায়। পরি পাশে বসে থাকে। অনন্ত সোহাগে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। শাফায়েতের জীবন পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

‘হামি কোহছি কি, এইগল্যা কাম আর করিয়েন না। যেঠে পুলুশ সেঠেই ঝামেলা। ওইব্যার কম ঝামেলা হোইলো না!’

‘আসল কথা কোহছি রে! মাস্টারি জিনিসটা ভালো, কিন্তু শালা বেতন যে ঠিকমতন সরকার প্যাঠায় না।’

‘দু-চাইর বিঘা জমি চুকানি লাও। হামারঘে দুইটা মানুষের ভালোই চোইল্যা যাইব। চিন্তা কিসের?’

শাফায়েত চুকচুক শব্দে ডালে চুমুক দেয়। নাকের ডগায় মেখে ফেলে। পরিবানুর আঙুলের মৃদু ছোঁয়া। মুছে যায় সব দাগ। তারপর আকস্মিক কোলে বসে পড়ে। শাফায়েতের চোখে যাদুররানি হাটের ছোট চালাঘর ভেসে ওঠে। নীল-লাল-হলুদ বর্ণিল আলো। পৃথিবী স্বর্গ…পৃথিবীই নরক। কেউ স্বর্গ সুখে আছে কেউ নরকের যন্ত্রণায়। সে নরকের কীট। পরিবানুর মতো টগবগে সুন্দরী ঘরে রেখে সে কি না গভীর রাত অবধি বাইরে, না না এ অন্যায়; এভাবেই দূরত্ব বাড়ে। বউ মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলে। কোনোকিছু শূন্য বলেই অমন হয়েছে। তার অনেক গলদ। শোধরাতে হবে। এখন থেকে আগে-আগে ঘরে ফিরবে। একজন অপারেটর রেখে দিলে বেশ হয়। সে চালাবে সবকিছু। যা আয় হয় সেখান থেকে এক-দেড় হাজার টাকা দিতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। পারতে হবে। তখন সকল ঝামেলার ইতি। সময়মতো ঘরে ফিরে আসতে পারবে। আদর সোহাগ চুমোয় চুমোয় ভরে দেবে রাত। পরিবানুর বুকে ফোটাবে পারিজাত ফুল। ভালবাসায় পাথর গলে আর পরিবানু তো এক নারী।

শাফায়েত অনেক রাত-অবধি জেগে থাকে। লন্ঠনের আলো দপ দপ জ্বলে আলো ছড়ায়। ঘরের দেয়ালে অদ্ভুত ছায়া-ছায়া আদিম ইতিহাস। আলোছায়া শরীর-মন জ্বালিয়ে দেয়। সেও জড়িয়ে চেপে চেপে ধরে। চোখের সামনে বুকের উপর কোনো মায়াপরি। একসময় পরি বুক থেকে ঝটাম নিচে নেমে যায়। ছোট ছোট প্রগাঢ় নিশ্বাস। পাঁজরের দু-পাশে মৃদু ঘুসি। কেউ কানের কাছে ঠোঁট এনে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় হানে তীব্র শ্লেষ।

‘শালার মরদ!’

শাফায়েত লজ্জার কোনো সমাধান খুঁজে পায় না। জাগ্রত দুঃস্বপ্নের মতো অক্ষম রাত চলে যায়। নিজের কাছে থেকে দূর সীমাহীন পলায়ন। একান্ত গোপন পীড়ন। সে কোনোমতো হাত বাড়িয়ে লন্ঠনের শিখা নিভিয়ে দেয়। অন্ধকার দেয়ালে হাজার কুৎসিত ছবি আঁকা হয়। স্লাইড শো। কারও নগ্ন শরীর ভেসে ওঠে। অথর্ব পুরুষ। কোনো সৌন্দর্য নেই। আকর্ষণ নেই। গরিলার মতো লোমশ কাঠামো। পেট খাই খাই বিশাল ভুঁড়ি। তাকে মানুষ মনে হয় না। এসব বীভৎস ছবি দেখতে দেখতে কোনো একসময় হারিয়ে যায়। ঘুম ঘুম বিবর চেপে ধরে হতাশার কাঁটা-গুল্মলতা। কখনো বুকচাপা অসহায় অস্তিত্ব বিলাস।


আরো পড়ুন: মাহবুব আলীর গল্প মুনিয়া এবং কাহিনী একাত্তর

নূর মহম্মদ চৌরঙ্গি বাজারের মসজিদ লাগোয়া রেস্তোরাঁয় বসেছিল। সেই পরিচিত নাইট-গ্রিন চাদর গায়ে জড়ানো। সুড়ুৎ সুড়ুৎ শব্দ তুলে চায়ে চুমুক দেয়। শাফায়েতকে দেখে জোরে ডেকে ওঠে, –

‘আই বে শালা…আয় আয়। এঠে বস। কোই বে ছোঁড়া, এঠে পরাটা আর ডিম ভাইজ্যা দে। বড় ডিমটা বাইছ্যা দিবি বুঝলি?…তারপর? রাইতে তো ঘুমাসনি মনে হোইছে।’

‘আ রে তুই থাকতে হামার কিসের ডর? পুলুশ কি হামার এইট্যা করবে নাকি? শুন ভাবছি একটা ছোঁড়া থুয়্যা দি। সাঁঝ থাইক্যা হিন্দি বাংলা চালাইবে। তারপর শালা পাবলিক চাহিলে…।’

‘সেটা করতে পারিস। তোর মতোন দরদ থাকলে ভালো, নাহিলে মানুষ টের প্যালে সব যাইবে। কালার টেলিভিশন ভিসিআর শালাদের পোঙ্গায়। ফিররা পাবিন্যা আর।’

‘লে লে থো! টাকা থাকলে শালার বিচার কিনতে পাওয়া যায়।’

শাফায়েত চায়ের কাপে চুমুক দিতে ছ্যাঁকা খায়। নূর মহম্মদের মুখে সবজান্তার হাসি। শাফায়েতের তিক্ত ভাবনা। এক মহাগাড়োলের সামনে বসে আছে। তারপরও উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে।

‘শুন হামি কোহছি কি ডহরের কাছিই তো চৌরঙ্গি বাজার। ওইঠে…নাহি তো ধীরগঞ্জ যা। যাদুররানি হাট সপ্তাহে একদিন। ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হয়?’

‘তু ফের এইগল্যা কি কহচিত রে! শালা দু-বচ্ছর একসাথে কাম করনু, এখুনো বাজার বুঝলি ন্যা? যেয়ঠে মানুষের ভিড় কম সেয়ঠে এই ব্যবসা চলে? মানুষ কি ঢোল বাজিয়ে ওইখ্যানে যায়?’

‘তুই গিয়েছিলি কুনুদিন? শালা মাস্টারি করেই তো তোর জীবন গ্যালো। মজা বুঝলি ন্যাকো।’

‘আ বে সেই লাইগ্যাই তো চালাছি। পাবলিক খায়ও খুব। তাহিলে একটা অপারেটর থ্যুয়া দিই…কি কোহছিস?’

‘বুদ্ধি ভালোই। আরাম পাবি ভেজালও কম।’

‘একটা ছোঁড়া দেখ তাহিলে।’

নূর মহম্মদের কানে কথা গেল কি না বোঝা যায় না। প্রায় ফাঁকা রেস্তোরাঁয় ছয়-সাতজন লোক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। তারা নূর মহম্মদের সামনে অনেকটা হাত কচলানো মোসাহেবি ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। শাফায়েত যেন প্রথমবার বুঝতে পারে বন্ধুর জনপ্রিয়তা। এমনি এমনি ইউপি মেম্বার হয়নি! ভেতরে মাল আছে বলেই এত খাতির।

লোকগুলো নিশ্চয় কোনো ঝামেলা বাঁধিয়েছে। ঝামেলা তৈরি করা ভালো। এতে পয়সা আসে। নূর মহম্মদের ইনকাম হয়। পুলিশ-উকিল-মুহুরি-ডাক্তার কোর্ট কাচারির লোকজন টাকা পায়। নূর মহম্মদ তো এই করে হরিপুরে কয়েক বিঘা জমি কিনে ফেলল। শাফায়েত কী করে? কিছুই করতে পারে না। বাইরের দুনিয়ায় পয়সা কামাই। ঘরে পরিবানুর জমিতে সার্থক একটি বীজ বপণ। সব ব্যর্থ। ধিক্ এ জীবন! মাস্টারি ভঙ্গিতে নিজের মূল্যায়ন দেখে সে। অস্থির মন হতাশায় খান খান।

সপ্তাহ শেষে একদিন যাদুররানি হাট। লোকে লোকারণ্য। দুপুর থেকে মানুষের কোলাহল। গমগম শব্দের ঢেউ। কেউ বলে হাটে জ্বিন নামে। শাফায়েত বোঝে মানুষজনের কথাবার্তা। হাজার হাজার মানুষ গিজগিজ করে। পা ফেলার জায়গা নেই। সে মফিজের রেস্তোরাঁয় আড়াই শ জিলেপি শেষ করে। দু-গ্লাস পানি খায়। পেটে চাপ বাড়ে। কোথাও খালি করতে পারলে আরাম। কিন্তু তেমন আড়াল নেই। হাটুরে মানুষজন দিব্বি লুঙ্গি তুলে…জিপার খুলে মাটি ভাসায়। সে অকারণ জড়সড়। লাজুক মানুষ। এসব মানুষ জগতে কিছু করতে পারে না। এখন কী করে আবুল ডাক্তারের কাছে যাবে? কথা বলবে? লজ্জা লজ্জা! কীভাবে নেবে তেমনকিছু? সে ক্রমশ আরও ফুলে উঠতে থাকে।

আশপাশে সকরুণ দৃষ্টি। সে পায়ে পায়ে চলে আসে চালাঘরের পেছন দেয়াল। দুপুর থেকে হিন্দি চলছে। জুঁহি চাওলা আর আমির খানের লাভস্টোরি। দু-জনই প্রিয় নায়ক নায়িকা। একসময় আমিরের লিপে গাওয়া ‘পেহেলা নাশা পেহেলা পেয়ার’ গান দোষ হয়ে যায়। সময়-অসময়ে ঠোঁটে আসে। এখন এদের বাজার নেই। মালাইকা-প্রিয়াংকা নানান হটশট নায়িকার। এই শো শেষ হলে তেমন হিট ছবি শুরু হবে। রাত গভীর হলে হাট ভেঙে যায়। কিছু মানুষ থাকে। তারা সারারাত জাগে। জেগে জেগে নিজেদের জাগায়। তখন চলবে গরম-মাশালা।

দেয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে সরু চিকন রেখায় ধোঁয়া বেরোয়। বিড়ি-সিগারেটের নিকোটিন পোড়া ছাই। ঘরের কোনা কোনা ছড়িয়ে আছে। বিষাক্ত গন্ধের মৌতাত। সে সবেগে ফেনায় ফেনায় মাটি ভাসায়। মনে অকারণ তৃপ্তি দোলা। সেদিনের মানুষগুলোর মুখে ঢেলে দেয়। ‘খা শালা খা। বেজন্মা কুত্তা…জীবনের মতো খা…হারামখোর।’ কিছুক্ষণ আগে যে দু-জন এসে দাঁড়ায়, তাদের মুখে মোতে। মন মানে না। উপায় নেই। রেস্তোরাঁয় নিজে বসে থেকে দুটো করে দামি বিস্কুট খাইয়েছে। গরম-গরম আমৃত্তি। ঘনীভূত দুধ-সর চা। হাতে ধরিয়ে দেয় গোল্ডলিফ। পীরগঞ্জ ফিরে যাবার বাসভাড়া। আধঘণ্টা ছবি দেখায়। ক্যাসেট রিউইন্ড-ফরোয়ার্ড করে মাধুরিকে কয়েকবার নাচায়। শালাদের সাধ মেটে না। যাবার সময় বলে, একদিন টিভি-ভিসিআর নিয়ে যাবে। শাফায়েত জানে কী দেখার শখ। দেখুক। দেখে মন-প্রাণ জুড়াক। সে ততক্ষণ অস্থির যতক্ষণ থাকে। যন্ত্রণা। বাঘে ছুঁলে এক ঘা…এদের আঠারো। বিশ্বাস করা যায় না।

এসব ঝামেলা সারতে প্রায়শ দেরি হয়ে যায়। সন্ধেরাতের পর পর ঘরে ফেরার কথা। গত বুধবার থেকে রেহাই। রাত আট-নটার মধ্যে ছুটি নিয়ে রাস্তায় নামে। এক ছেলে রেখেছে। অপারেটর। উনিশ-কুড়ি বয়স। অসময়ে পেকে ঝুনা নারিকেল। নারায়ণ বেশ ভক্তি করে সালাম ঠোকে। তার স্কুলে ক বছর পড়েছিল। বারবার ডাব্বা। অবশেষে রানিশংকৈলের এক ভিডিও লাইব্রেরিতে কাজ শুরু করে। সেই দোকান উঠে গেছে। এখন বেকার। শাফায়েতের ষোলো আনা লাভ। এমন নিডি লোকই দরকার। প্রথমে একটু মন কেমন কেমন। ঠিক হচ্ছে কি না। স্কুলের ছাত্র ছিল। জোর করে ভাবনা তাড়িয়েছে। এখন সবাই সেয়ানা মাল। নারায়ণ কাজ করে ভালো। একটু রূঢ়-রুষ্ট। পাবলিকের কাছে। মালিকের প্রতি বিনয়। শাফায়েতের ভালো লাগে। সে নিজে ঠান্ডা-শান্তশিষ্ট। কঠিন হতে পারে না। তাই একটু লাই দিয়ে ফেলে। ফলাফল অসহ্য। সেদিন শুটিং-এডিটিং-ডাবিং কাজে নেমে পড়ার জন্য বকবক। কান পচিয়ে ছাড়ে। পুরাতন এম সেভেন একটি মুভি ক্যামেরা দরকার। কম্পিউটার থাকলে আরও ভালো ব্যবসা। ইত্যাদি পরামর্শ। শাফায়েত শেষে ধমকায়। সেই থেকে নারায়ণ একদম চুপ। আমি নীরবে নিভৃতে জ্বলিতে চাই।

হরিপুরে ভিডিও ক্যামেরার ব্যবসা চলে না। মানুষজন রানিশংকৈল পীরগঞ্জ থেকে হায়ার করে। জন্মদিন-আকিকা-বিয়ের অনুষ্ঠান রেকর্ড হয়। ভালো উপার্জন। ক্যামেরা দিয়ে নাটক-শর্ট ফিলম কত কি! কেউ কেউ অন্যকিছু তৈরি করে। শাফায়েত এই লাইনে এসে অনেক খবর জেনেছে। গোপন ব্যবসার বিরাট চক্রজাল। দেশি মালের কদর আলাদা। এই করে কারও কারও গুটি-লাল। অবৈধ আয় না থাকলে, মানুষ কি এত দ্রুত ধনী হতে পারে? যে যত বড় পাপি…সে তত দামি।

আজ শাফায়েতের মন খুশি। সন্ধেয় আবুল ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হয়। প্রাণবন্ত বয়স্ক মানুষ। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। সামনে একগুচ্ছ সাদা। কালো আকাশে সাদা মেঘ। চোখে সোনালি ফ্রেমের সাদা চশমা। দোকানে তেমন ভিড় নেই। মনের সুখে কথা বলতে পারে। কথা বলে বড় সুখ। মাথা থেকে সকল টেনশন নেমে যায়। নারায়ণ আসেনি। শাফায়েত অগত্যা অনেক রাত-অবধি নীল-লাল-হলুদ বর্ণিল আলোছায়ায় বসে থাকে। ঝিমোয় না। তেমন ঘুম ঘুম তন্দ্রা নেই। শরীরে থেকে থেকে অগ্নি-ঝলক। মাথা ভার ভার। ক্যাপসুলের অ্যাকশন। সে দর্শক দেখে। দর্শক দেখতে দেখতে বারবার ওঠে। বাইরে ছুটে যায়। আশপাশে ভিজিয়ে ফেরত আসে। ইন্টার পরীক্ষা শেষ। হুমড়ি খেয়ে পড়েছে উঠতি মানুষজন। পাবলিক। আমোদ আর বিনোদন। সিনেমা হাউসফুল।

তার হাতে অপ্রত্যাশিত অঙ্কের টাকা। মাস্টারি করে তিন মাসে যা পায় না, তারচেয়েও বেশি। টাকা গুনতে গুনতে কত না ভাবনা-বোধোদয়। সরস্বতী আর লক্ষ্মী একসঙ্গে অবস্থান করে না। তার পেটে-মগজে সরস্বতী যথেষ্ট আকারে আছে…লক্ষ্মী নেই। অথচ তাকেই দরকার। সরস্বতীকে নয়। সমাজে ভালো মানুষের কোনো মূল্য নেই। অচ্ছুত সততা। ভালো থাকতে পারেনি। নর্দমার গাড্ডায় পড়ে আছে। নিজে থেকে বসবাস। সৎ পথে দু-টাকা আয় করতে অনেক পরিশ্রম। বেলাইনে সহজে দু-হাজার। দরকার শুধু সাহস। কথায় বলে, চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা…যদি না পড়ি ধরা। ফিলমের কোনো ডায়লগ মাথায় কিলবিল করে। কোনো অজানার উদ্দেশ্যে অস্ফুট বিড়বিড় ছেড়ে দেয়। মাথা ঝিমঝিম। ‘জিসকা পাস রুপেয়া হ্যায় উসকা সবকুছ্ হ্যায়…মান মারইয়াদা সবকুছ্…দুনিয়া মুঠ্ঠি মে হোতা হ্যায়।’

অনেক রাতে সবকিছু গুটিয়ে রাস্তায় নেমে যায়। জোছনা রাত। আলো-আঁধারের রহস্যময় প্রকৃতিতে হালকা কুয়াশা ঝরে। পঁচিশ-ত্রিশ মিনিটের পথ। আজ কেন ফুরোয় না? পকেটে অনেক টাকা। বুকে গভীর ভালবাসা। ঝিঁ-ঝিঁ ডাকা রাত প্রাণে গুনগুন উল্লাস তোলে। আজ খেলাতে জিতবে। কিছুতে হারবে না…ছাড়বে না। জীবন হল দাবা খেলা। সেখানে রাজা আর সৈনিক সমান, যেতে পারে একধাপ মাত্র; সৈনিকও কখনো রাজা হয়। সে আজ রাজা। রাজকীয় দাপট মন-মেজাজে। কাজে-কর্মে হোক আর বিছানায়। ভাবনার সুখানুভূতিতে আচমকা দীর্ঘ হতে থাকে। শিরশির সুখ। উত্তেজনায় মন ভোলে জীবনের চাওয়া-পাওয়ার খতিয়ান। এই একটি শুধু রাত তার জীবন। একপলক পরমায়ু। প্রজাপতির মতো আঁকড়ে-খামচে রক্তাক্ত সুখে সময় ভাসিয়ে দেয়।

রাতের ছায়া ছায়া দেয়ালে জানালার ফাঁকফোকর। আলো ঠিকরে বেরোয়। তার মানে ঘরে লন্ঠন জ্বলে। পরিবানু অপেক্ষায়। এমন নিশুতি হিমরাতে বসে আছে কেউ। শাফায়েত কত ভাগ্যবান! এমন তো হয় না। প্রতিদিন যখন ঘরে ফেরে, সবকিছু অন্ধকার…একরকম শ্রান্ত-ক্লান্ত। আজ তাকে ঘর টানে। পরিবানুর উদ্বাহু আহবান। জোর টান। শাফায়েত আদিম মানুষের মতো দোলে। অচেতন অজ্ঞান। নারীর নগ্ন শরীর ছাড়া কিছু দেখে না। দেখা যায় না। অনেকদিন তেমন করে দেখা হয়নি। চালাঘরের ভেতর কাচের ছায়া-দেয়ালে শুধু নানান দৃশ্যছবি। রঙিন শরীর। অদ্ভুত কাঠামো কসরত। সাত সুর শীৎকার। আর…আর সে-সব কী? বিকৃতি? সে প্রলম্বিত জিজ্ঞাসা নিয়ে ক্রমশ স্ফীত হতে থাকে। কান দুটো গরম ভাঁপ ছড়ায়। দৃষ্টির সামনে কোনোকিছু নেই…শুধু পরিবানু আর পরিবানু।

নতুন খড়ের ছাউনি। অগ্রহায়ণের কাটা ধান। মাথা উঁচু চালাঘর আকারে দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়ির দেয়াল আর দরজা অদৃশ্য-আড়াল। সে পথটুকু মাড়িয়ে দরজায় যায়। যেতে থাকে। তারপর আচমকা থমকে স্থির-স্থবির। ঘরের ভেতর অস্ফুট শব্দতরঙ্গ নাচে। নাচতে নাচতে ঢেউ দোলা ভেসে আসে বাতাসে। সেই ঢেউ কিসের নতুন করে বুঝতে হয় না। সে আকর্ণ মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করে। পরিবানু বলে, –

‘এই চাঁন্দেও তো কুনু খবর নাই, শ্যাষে কি যে…।’

‘দূর মাগি পোয়াতি হইলে হোইবি। তোর তো বিহ্যা হোয়্যাছে। ভাতার আছে ডর কিসের?’

‘নে থোহ্! অমন ভাতার হি হি হি!’

‘হে হে হে ছাওয়াল হোইলে তো ভালুই হয়।’

অনিচ্ছায় সুখক্লান্ত গোঁ গোঁ স্বর পুরুষের। শাফায়েতের বোঝার বাকি নেই। প্রচণ্ড অবিশ্বাস। সবকিছু ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন ভাবতে ইচ্ছে হয়। তার মতিভ্রম। যাদুররানি হাটে সেই চালাঘর। কাচের দেয়ালে ভেসে থাকা কোনো লাল-নীল-হলুদ বর্ণিল দৃশ্যকথন। শীৎকার-চিৎকার। কোনায় কোনায় ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ভেসে যায়। সে অসম্ভব অসূয়াকাতর অস্থির। সন্দেহবাতিক দহন নিয়ে জানালার কোনো ছিদ্র খোঁজে। সেটি দিয়ে ঘরের ভেতর উৎসুক উঁকি। বদ্ধ জানালার ওপাশে লন্ঠনের মৃদু আলো পৃথিবীকে একেবারে উদোম করে দেয়। তার মাথা আদিম উন্মাতালে দুলে ওঠে। নীলছবি। পরিবানুর খোলা চুল মেঝেয় নেমে গেছে। মাথা চৌকির কিনারায় দোল খায়। হালকা বিন্দু-বিন্দু স্বেদ ভেজা মুখ। ঘুম-কাতর ঢুলুঢুলু আধবোঁজা দৃষ্টি। একপাশে চেয়ারের হাতলে ঝোলানো নাইট-গ্রিন চাদর।

আলো-আঁধারিতে বীভৎস কালো।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত