ব্রতচারী হয়ে দেখো
“ব্রতচারী হয়ে দেখো,
জীবনে কী মজা ভাই,
হয়নি ব্রতচারী যে সে,
আহা কী বেচারীটাই!”
এই গানের কথাগুলো পড়ে নিশ্চয়ই ভাবছো, এই যে বলা হলো ‘ব্রতচারী’ হয়ে দেখো, এই ব্রতচারীটা আসলে কী? আর ‘ব্রতচারী’ হওয়াই বা যায় কীভাবে? কারা এই ব্রতচারী?
সহজ ভাষায় ‘ব্রত’ শব্দটির অর্থ ‘প্রতিজ্ঞা’ আর ‘চারী’ শব্দটির অর্থ যে চলে। কোন ভালো কিছু করার প্রতিজ্ঞা করে যখন কেউ নিজেকে সেই পথে চালায় তখন তাকেই ব্রতচারী বলা যায়। ব্রতচারীর ভাষায় কেউ যদি তার সব কাজ জেনে-বুঝে করে, তার জন্য যথাযথ শ্রম দিয়ে করে, সততার সাথে করে, আনন্দ নিয়ে করে এবং তার সকল ভাবনায়, কাজে সকল মানুষ এবং তাঁদের মঙ্গল চিন্তা থাকে তবে সেই ব্রতচারী। ব্রতচারীরা দেশকে নিয়ে ভাবে, দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবে এবং কাজ করে। আর এভাবেই বিশ্বের সেবায় নিজের ভূমিকা পালন করে। এইবার নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে যে, ব্রতচারীর মত এত সুন্দর ভাবনাটি কার? কীভাবেই বা এলো এই ব্রতচারী?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা একটু পিছে ফিরে দেখি চলো। অনেক বছর আগে, যখন ব্রিটিশরা এই দেশে রাজত্ব করছিলো, তখন সিলেটের বীরশ্রী গ্রামে থাকতো খুব দুরন্ত একটি ছেলে। জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও দুরন্ত এই ছেলেটি সবার সাথে মেলামেশা করতো – গ্রামের সবাই ছিলো তাঁর বন্ধু। কিন্তু মাঠে-ঘাটে, বনে-বাদাড়ে, খেলে বেড়াতে গিয়ে বাঁধালো বিপত্তি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া শেষে গণিতে পাশই করতে পারলো না। ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো। কিন্তু সেই লজ্জা তাকে একটুও দমাতে পারেনি জানো? বরং তিনি পেয়ে গেলেন অন্যরকম আলোর পথের খোঁজ। তারপর থেকে সব পরীক্ষাতেই গণিত বিষয়ে তিনি প্রথম স্থানই অধিকার করতেন। পরবর্তীতে পারিবারিকভাবে নানা রকম জটিলতায় পড়তে হয় তাঁকে। তার মাঝেও তিনি জীবনের সকল পরীক্ষায় দারুণ ভাবে সফল হন। আর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য, নানা রকম কুসংস্কার পিছে ফেলে বিলেতে যান। জানো, নিজের দেশে ফেরার সময় তাঁর শুদ্ধির জন্য, ধর্মীয় রীতি মেনে, নানা রকম কাজ করতে হয়।
ব্যারিস্টারি পাশ করার পরে তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ভারতে নিযুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার জন্য আই.সি.এস. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এই দেশে তখন ব্রিটিশ অফিসাররাই সবচাইতে ক্ষমতাধর ছিল। তাঁরা তাঁদের এই ক্ষমতার জোরে বাঙালীদের খুব কষ্ট দিত, নানাভাবে অত্যাচার করতো। তো আমাদের গল্পের এই নায়কের লক্ষ্য ছিলো নিজে ক্ষমতাধর হয়ে যেন বাঙালীদের সাহায্য করতে পারে, পাশে দাঁড়াতে পারে। জানো, সেই পরীক্ষায় ব্রিটিশরাও তাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারলো না। সেখানেও প্রথম হলেন তিনি। সফলতার সাথে তখনকার ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করেন তিনি। অনেক সময়ই ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধেও যেতে হয় তাঁকে। আর শাস্তি হিসেবে কিছুদিন পরপরই তাকে বদলি করে দেওয়া হত, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়।
কিন্তু অসাধারণ এই মানুষটি এই শাস্তিকেও আশীর্বাদ হিসেবেই নিলেন। কীভাবে? বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করলেন বাংলার লোকসংস্কৃতি ও লোকশিল্পের নানা রকম উপাদান। তারপর ১৯৩১ সালে সেসব লোকসাংস্কৃতিক উপাদান সংরক্ষণ করার জন্য গড়ে তোলেন পল্লী সম্পদ রক্ষা সমিতি। সেই সমিতির কী কাজ ছিলো জানো? আমাদের যেসব লোকসাংস্কৃতিক নাচ-গান আছে, তা চর্চা এবং প্রদর্শন করা। আমরা, বাঙালীরা, যে কত বড় সম্পদের অধিকারী, কত বিশাল, বিচিত্র রত্নভান্ডার আমাদের আছে তাই তিনি জানাতে চাইতেন সবাইকে।
সেই কমিটি নানা রকম কাজের মাঝে প্রশিক্ষণ শিবিরের (ক্যাম্প) আয়োজন ছিলো অন্যতম। তেমনই একটি শিবির চলাকালীন তাঁর মনে হল, এই গানের সুর, এই ছন্দ, এই ভঙ্গিমা ব্যবহার করে যদি মানুষকে ভালো ভালো কথা বোঝানো যায় তবে কেমন হয়? তাঁর ইচ্ছে হল মানুষকে দেশপ্রেমের কথা, সংঘের কথা, সাম্যের কথা, নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতার কথা জানাবেন, শোনাবেন। এমনভাবে তিনি কাজ করবেন, যেন মানুষ মন থেকে দেশকে ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা করতে পারে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। তক্ষুনি তিনি তৈরি করলেন ‘বাংলার ব্রতচারী সমিতি’ নামের নতুন সংঘ। এই সমিতি পণ, প্রতিজ্ঞা, প্রনিয়ম এবং নানা রকম চর্চার ভেতর দিয়ে মানুষকে ব্রতচারী হয়ে ওঠার পথ দেখাচ্ছে সেই কবে থেকে!
যেই মানুষটি এই অসাধারণ কাজগুলো করেছেন, তাঁর নাম গুরুসদয় দত্ত। তিনি ১৯৪১ সালের ২৫ জুন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। কিন্তু এতো বছর পরেও তাঁর কাজগুলো যেন জ্বলজ্বল করছে, আলো ছড়াচ্ছে চারিপাশে। এত বছরেও এতটুকু মলিন হয়নি, মনেহয় ঠিক এই সময়টার জন্যইতো উনি কাজগুলো করেছেন।
ব্রতচারীতে সব বয়সী মানুষের জন্য নানা রকম কাজ আছে। শরীরকে ঠিক রাখতে যেমন নানারকম শারীরিক কসরত আছে, তেমনই আছে মজার সব ছড়ার ব্যায়াম, যা মনকেও রাখে ফুরফুরে। তোমাদের মত খুদে বন্ধুরা কিন্তু খুব আনন্দ নিয়ে সেই ব্যায়ামগুলো করে। জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য, আনন্দ – এই পাঁচটি ব্রত নিয়ে আছে নানারকম কাজ, আছে শিশু ব্রতচারীর বারো পণ। পণ, মানা, প্রনিয়মগুলো ঠিকঠাক মানতে পারলে জীবনটাই অন্য রকম হয়ে যাওয়ার কথা! জারি, সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, বাউল, ধামাইল, ঝুমুর, ইত্যাদি নাচ-গানের পশরাও আছে ব্রতচারীর ভাণ্ডারে। ধামাইলের ভঙ্গির সাথে যখন গুরুসদয় দত্তের ‘বাংলাভূমির প্রেমে আমার প্রাণ হইলো পাগল, আমি বাংলা প্রেমে ঢাইলমু আমার, দেহ মনের বল গো’ – গাওয়া হয় তখন দেশের জন্য ভালোবাসায় মনটা ভরে ওঠে। এছাড়াও এই তালিকায় আরো আছে রায়বেঁশে, রাইবিশে, কাঠিনাচ, লাঠিখেলা, ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী এবং চমৎকার সব কসরত। সবাইকেই যে ব্রতচারীর শারীরিক কসরত করেই ব্রতচারী হতে হবে তা কিন্তু না! ১৬ আলি (বিষয়/পর্যায়) চর্চার মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি কাজ সুন্দরভাবে করার মাধ্যমে ব্রতচারী হওয়ার দীক্ষা দেয়। জানো, নিজের ধর্ম, নিজের বিশ্বাস রক্ষা করে চলাও কিন্তু একজন ব্রতচারীর কাজ।
যদিও ব্রতচারীর শুরুটা অবিভক্ত বাংলায়, বর্তমানে গুরুসদয় দত্তের প্রতিষ্ঠা করা ‘বাংলার ব্রতচারী সমিতি’ পশ্চিম বাংলায় পুরো উদ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ব্রতচারী চর্চার সূচনা করেন কামরুল হাসান। তখন ওয়াহিদুল হক এবং সন্ জিদা খাতুন তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নেন এবং তাঁদের হাত ধরেই আমাদের বাংলাদেশে ‘ব্রতচারী’ সংগঠনটির কাজ শুরু হয়। বর্তমানে, এই সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সন্ জিদা খাতুন। এই সংগঠনটি সারা বাংলাদেশকে ব্রতচারীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার, ব্রতচারীর আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে সেই ২০০২ সাল থেকে। কত কিছু বলে ফেললাম! ব্রতচারীকে বোঝাতে আরো কত কিছু বলতে ইচ্ছে করছে! আমরা যারা ব্রতচারী হওয়ার চেষ্টা করছি, তারা কুচকাওয়াজ করতে করতে ব্রতচারীর কিছু গান করি। চলন গীত বলা হয় এগুলোকে। তেমনই একটি গান গুরুসদয় দত্তের মানুষ হ’। এই গানটির কথা দিয়েই লেখাটি শেষ করছি। গানের কথাগুলো মন দিয়ে পড়লেই ব্রতচারীর ভাবনা আরও ভালো করে বুঝতে পারবে।
” মানুষ হ’, মানুষ হ’, আবার তোরা মানুষ হ’,
অনুকরণ খোলস ভেদি, কায়মনে বাঙালী হ।
শিখেনে দেশ-বিদেশের জ্ঞান তবু হারাস নে মার দান,
বাংলাভাবে পূর্ণ হয়ে সুধন্য বাঙালী হ’, সম্পূর্ণ বাঙালী হ।
বিশ্বমানব হবি যদি শাশ্বত বাঙালী হ’।