৩০৪ নং কেবিন (পর্ব ৫)
খুব ভোরে ওঠার অভ্যাসটা প্রায় চলে গেছিল অনেকদিন ধরেই। ভোর বলতে মেঘের কাছে সকাল সাতটা সাড়ে সাতটা। কিন্তু গত কদিনে তার সব অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে।
হাসপাতালে ভোর মানে পাঁচটা, বড়জোড় সাড়ে ৫ টা। ডাক্তার আসেন, তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় ব্যস্ততা। বাসিমুখে কারোর সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস নেই কোনো কালেই। ফলে ওই ৫ টাতেই উঠে মুখ ধুয়ে নেওয়া। তারপর চলতেই থাকে ।ট্যাবলেট, ইনজেকসন, স্যালাইন, নেবুলাইজেসন. . . ।
রাতে বৃষ্টি হয়েছিল ।মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি কাচের জানলায়।সেই আলোয় ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল বারবার ।ছোটবেলায় এমন বিদ্যুতের আলো দেখলে মনে হত এই বুঝি তাদের ছোট্ট ঘরটা আলোয় ভরে যাবে। আরো পরে আজিমগঞ্জের বাড়িতে থাকাকালীন দেখেছিল তার শক্তি ।বাজ আর আলোর সেই দাপটে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছিল কতগুলো নারকেল গাছের মাথা।খুব কষ্ট পেয়েছিল মেঘঅদিতি ।কত যন্ত্রণা পেয়েছে গাছগুলো।সামান্য পুড়ে গেলেই মা মলম দিয়ে দেয়, আর দেয় পেস্ট কিংবা নীল।কিন্তু ওদের জ্বালা কে দূর করবে! ঠাম্মা বলেছিল, মাটি মা ওদের নিজের রস দিয়ে ক্ষত মেরামত করে দেয় ।মাটিই তো ওদের মা।
হবে হয়তো।কিন্তু গাছগুলো দেখে সত্যিই তখন কেমন একটা কষ্ট হত।
কাল রাতে হঠাৎ করেই এসব কথা মনে এল মেঘের।তারপর ভাঙা ভাঙা চাঁদের মতো তার ঘুমটাও ভাঙা ভাঙা , ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে গেল।
পিয়ালি ঘুমচ্ছে।ওর তিনদিন তিনরাত টানা ডিউটি চলছে ।মানুষ ঘুমলে কী অদ্ভুত সুন্দর লাগে ।মেঘ বেশ কয়েকবার ওর মুখের দিকে তাকালও। কেমন একটা লক্ষ্মীশ্রী।এমন বৌকেও বর ছেড়ে কিভাবে চলে যায়!
কাল একথা বলা মাত্র পিয়ালি বলেছিল, এক কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল।বলতো দিদি, যার মন যেখানে, সেতো সেখানেই যাবে।সুন্দর মুখ দিয়ে কী তাকে বেঁধে রাখতে পারা যায়, না পারলাম!
সত্যি তো! মন যেখানে যাওয়ার সেখানে যাবেই।কোনো শক্তি নেই তাকে বাঁধার ।পাগলা মনটারে তুই বাঁধ বলে যতই গান গাই, আসলে গান মানে জীবন নয়।
মেঘ কথা ঘুরিয়ে বলে , আরেকটা বিয়ে কর।এত অল্প বয়স তোর।
খুব শান্ত গলায় সে বলে, তুমি কী গ্যারান্টি দিতে পারবে, সেই বর ভালো হবে? একবার যে যাতনা পেয়েছি, বলতো কেন তাই আবার পাওয়ার পথে পা বাড়াব?
ভালোও তো হতে পারে, মেঘ বোঝাবার চেষ্টা করে।
দিদি, এই বেশ ভালো আছি ।আর ও পথে নয়।পিয়ালির কন্ঠস্বরে আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে।
মেঘ আর কথা বাড়ায় না।জীবনের কোন খাতে কী লুকিয়ে , কোন স্রোত লুকোচুরি খেলছে তার কতটুকু জানি !
আমিই কী দু সপ্তাহ আগেও জানতাম, এই ৩০৪ নং কেবিনে আমার ঠাঁই হবে! নিজেকে বোঝায় সে।
ওকে ঘুমতে দিয়ে বিছানা থেকে একাই নেমে আসে মেঘ।একটু আগে সিস্টার মৌমিতা এসে স্যালাইন বন্ধ করে দিয়ে গেছে। ফলে নামতে অসুবিধা হয় না।জানলাটা খুলে দিল সে।বৃষ্টি হচ্ছে ।ভাবল, ঠান্ডা হাওয়া আসবে।একটা দমকা হাওয়া এল ঠিকই।কিন্তু তার দারুণ তাপ।মাঝের থেকে ঘেমে গেল মেঘ। আবার বিছানায় ফিরে এল।
এসি টা বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করল।
ঘামছি।ভীষণ ঘামছি।আচ্ছা, আমি কী মরে যাচ্ছি ! দূর, রিপোর্ট আজকের মোটামুটি স্টেবল।ফলে মরছি না, নিশ্চিত।উঠে আবার জল খেয়ে ঘাড়ে জল দিল।
কাক ডাকছে। ভোর হয়ে গেল? ঘড়ির দিকে তাকালো।পৌনে পাঁচটা। বাথরুম গেল।ভিতরে ভিতরে একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছে সে। কিসের বুঝতে পারছে না।আজ এন্টিব্যায়োটিকের কোর্স বিকেলে শেষ ।তবে কী ছাড়া পেতে পারি রাতে ! কে জানে ! পুরো ৯ দিন হল এখানে ।নিজেকেই বলল সে।
কাল অনেকক্ষণ সিস্টার সুস্মিতার সঙ্গে গল্প হয়েছিল। রাতে খাবার পর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছিলাম ওদের ডেস্কে। নিজের
এক টুকরো কেবিনে কতক্ষণ বন্দী থাকতে ভালো লাগে ! এরাই তার বন্ধু, আত্মীয় পরিজন এখন।
মাঝারি গড়ন সুস্মিতার মুখে সবসময় হাসি। সোদপুরে শ্বশুর বাড়ি ।বাপের বাড়ি আগরপাড়া।প্রেম করে বিয়ে । একাউন্টেন্সির ছাত্রী , হঠাৎ করেই নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে এই পেশায় ।
সবচেয়ে অপছন্দ করি এই কাজটাকে।রক্ত, সিরিঞ্জ এসবে আমার হাত কাঁপে। তাও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে ।আগে তো মাথা ঘুরত। সুস্মিতা বলে।
তাহলে এলে কেন?
কী জানি ! তখন মাথায় কী ভূত চেপেছিল ।কিন্তু এখন আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না।
তাহলে বলো ভালো বেসে ফেলেছ এই পেশাকে।মেঘ বলে।
সে বলে, তা জানি না।তবে সব চাকরির পরিবেশ ভালো হয় না।এখানকার পরিবেশ খুব ভালো ।সিনিয়র থেকে জুনিয়র সবার মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক ।তারপর উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, জানো প্রতিবছর আমরা সবাই, যত স্টাফ আছি ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারি মাসে পিকনিকে যাই, খুব মজা করি।
আসলে এখানে মহিলাদের নিরাপত্তা বিষয়টা খুব স্ট্রং।তাই আর অন্য কিছু করতে ইচ্ছা করে না।
নিরাপত্তা শব্দটা মনের মধ্যে ধাক্কা দিল।জীবন কতটুকু নিরাপদ আমার মেঘ নিজেও জানে না। মাঝে মাঝে মনে হয় , প্রতিমুহূর্তেই অনিশ্চিত এ জীবন ।তবু তার মাঝে আলো খোঁজা।এই যে কী ভীষণ নিশ্চিন্তে শব্দটা ও উচ্চারণ করল, তাতে মনে হল, এই নিশ্চিন্তে ভাবাটাই আসলে নিরাপত্তা।
সিস্টারদের ডেস্ক থেকে উঠে এল মেঘ।এরপর শুরু হবে নেবুনাইজেসন, ইঞ্জেকসন আর স্যালাইনের মধ্যে দিয়ে এন্টিবায়োটিক।
.

কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক