৩০৪ নং কেবিন (শেষ পর্ব)
অবশেষে বাড়ি ফিরল মেঘ ।ঠিক ১০ দিনের মাথায় ।কখনো কখনো বুঝে উঠতে পা্রে না সে বাড়ি ভালো নাকি অন্য কোথাও ।এই যে ঢুকেই চারদিকে এত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখে বিরক্তি জন্মাচ্ছে, তার থেকে কী হাসপাতাল ভালো ছিল! কে জানে কোনটা ঠিক ঠিকানা ।
আসলে মেয়েদের বোধহয় কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা হয় না, সে যেখানে থাকে প্রয়োজন অনুযায়ী সেটাই তার ঠিকানা হয়ে যায়।
আসার পর থেকে কেন হাসপাতালের জন্য মন খারাপ করছে! সেকি সিস্টারদের, আয়া মাসিদের, বা আর সবাইকে ছেড়ে এলাম বলে! তাতো হয় না।তবু করছে, ভীষণ মন খারাপ করছে।এই দশ দিন ওটাই আমার বাড়ি হয়ে গেছিল।সিস্টার সুজাতা, মৌমিতা, সুস্মিতা, ঊষা দি, স্বপ্না দি, রূপা সবাই যেন খুব কাছের হয়ে গেছিল । মেঘ নিজের মনেই বলে।
আমি মিস করছি রিনাদি, পিয়ালি, রাজু সবাইকে ।নিজের মনেই উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করছি।অথচ সকালে ডাক্তার ছুটি দেওয়ার কথা নিশ্চিত করার পর কী ভীষণ আনন্দ পাচ্ছিলাম।মনে হচ্ছিল, এবার আমি নিশ্চিত।
বাড়ি ফেরার সময় যেন সেই আনন্দ খানিকটা ম্লান হয়ে গেল ।বুকের কাছটা বড্ড ভারী লাগছে ।এমন অনুভূতি তো হয় না কখনো।এই দশদিন আগেও তো চিনতাম না এদের।কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই।তবু কষ্ট হচ্ছে ।নিকটজন ছেড়ে যাবার কষ্ট। এরা কী আদৌ মনে রাখবে আমাকে? এমন পেশেন্ট তো রোজ রোজ কত দেখে ওরা।কতজনকে মনে রাখবে!
বাড়িতে আজ চিংড়ি মাছ ।দীনবন্ধুর বউ সোমা রেঁধে পাঠিয়েছে ।মেঘ ভালোবাসে বলে।যদিও ১২ টায় হাসপাতালে ভাত খেয়েছে সে ।জিয়া উচ্ছে আলু ছেঁছকি, ডুমুরের তরকারি , মুগের ডাল, ডিমের ঝাল পাঠিয়েছিল।পেট এখনো ভরেই আছে।
মেয়ে আর তনয় নিতে এসেছিল।
বাড়ি ঢুকেই ভোরাই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো ।আমি এবার মরেই যেতাম, তুমি কতদিন ছিলে না মা।খুব কষ্ট হচ্ছিল।সব একা একা সামলানো।তার মধ্যে ভয় করছিল, তোমার যদি কিছু হয়ে যায়! আমি তো বাঁচব না তুমি ছাড়া ।
দূর পাগলী! এই তো আমি বাড়ি এসেছি।কোনো চিন্তা নেই আর ।
মা তুমি ঠিক আছো তো? কোনো কষ্ট হচ্ছে নাতো! তুমি আর অনিয়ম কোরো না মা।তুমি না থাকলে সব ফাঁকা হয়ে যায়। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। দমবন্ধ লাগে আমার ।
ভোরাই ফোঁপাচ্ছিল।মেঘ বুকের মধ্যে ওর মাথাটা জাপটে ধরে থাকে।মায়েদের জন্য এত কষ্ট হয়! সে কখনো মায়ের জন্য কাঁদেনি।ছোট থেকে জেনে এসেছে সে বড়।বড়রা কাঁদে না।সে কষ্ট পেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত।বাবাই ছিল তার সব।
হঠাৎ মায়ের জন্য বুকটা টনটন করে উঠলো।নিজের মনেই ‘মা’ বলে ডেকে উঠল মেঘ।
মেঘের ক্লান্ত লাগছে ।মাথাটা ঘুরছে।শুয়ে পরতে চাইছে ।
ভোরাই এতক্ষণে থিতু হয়েছে ।তাড়াতাড়ি বালিশ এনে দিল। ঘর অন্ধকার। পর্দা টেনে দিয়ে এসি চালিয়ে চলে গেছে ভোরাই।
শুয়ে শুয়ে লিখছে মেঘ।
কাল থেকে আর হাসপাতালের ৩০৪ নং কেবিনের গল্প লিখব না।সিস্টার, এটেনডেন্ট সব ক্রমশ ফিকে হয়ে আসবে।আমি ফিরে যাব নিজের কাজে।তারাও নতুন পেশেন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে ।ধীরে ধীরে ভুলে যাবে আমাকেও।
জগত চলবে নিজস্ব ছন্দে। তারপরেও জানি কোনো এক শরীর খারাপের সন্ধ্যায় কিংবা দুপুরে রাধাচূড়ার হলুদ ফুলগুলো দেখে উদাস হব। ইচ্ছে করবে সিস্টার রূপাকে ডেকে গান শুনি।সিস্টার সুজাতাকে ডেকে ফেলে আসা শৈশবের গল্প করি, সেই মাটি মাখা সকাল , রেলে কয়লার ইঞ্জিন. . চোখ জ্বালা করা ভীষণ রোদের আদর। সিস্টার সুস্মিতার হাসি, মৌমিতার চোখের অজানা ভাষা, সিস্টার ঊষাদি, স্বপ্নাদির স্নেহময় সম্বোধন শুনতে কিংবা রিনাদি, পিয়ালি সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করবে।
তখন বসে বসে এই দিনলিপিগুলো পড়ব আর ভাবব, এমনও হয়! এত মন খারাপ হতে পারে!
তারপর হয়তো আবার একদিন অন্য কোনো কারণে ভরতি হবো, কিংবা অন্য কারোর জন্য যাবো ।কিন্তু তখন সব বদলে গেছে ।ঠিক যেভাবে হয়তো আমি আসার পরেই ৩০৪ নং কেবিনের বাইরে আমার নাম লেখা কার্ডের বদলে অন্য কোন নাম বসে গেছে ।
.

কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক