ঘোড়ায় টানা থেকে বিদ্যুতে বিবর্তন
আজকের কলকাতায় যে ট্রাম দেখা যায়, তার উৎপত্তি একদিনে হয়নি। কলকাতা নগরীতে প্রথমে চালু হয়েছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। শিয়ালদহ আর আর্মেনিয়ান স্ট্রীটের মাঝে প্রায় আড়াই কিলোমিটারে শুরু হয় ট্রামের যাত্রা। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩ সেই ট্রামের যাত্রা শুরু, তবে বছর না ঘুরতেই তা বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর ১৮৮০ সালে ট্রাম চালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য লন্ডনে ‘কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি(CTC)’ নামে একটি কোম্পানি নিবন্ধিত হয়। সুদীর্ঘকালের চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে সেই কোম্পানিটি টিকে আছে এখনো, যদিও হাতবদল হয়েছে মালিকানার। আর কোম্পানিটির সঙ্গেই টিকে আছে কলকাতার ট্রাম-গাড়িও।
সেই আর্মেনিয়ান ঘাট থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত মিটারগেজ ট্রাম লাইন বসানো হয়। ঘোড়ায় টানা ট্রামে চড়তে শুরু করে মানুষ। প্রথমবার যাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে গেলেও এইবার তুলনামূলক ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে টিকে যায় ট্রাম। ট্রামে চড়াকে আভিজাত্যের মাপকাঠি বানিয়ে ফেলে ব্রিটিশ ব্যবসাদার ট্রাম কোম্পানি।
ঘোড়ার পাশাপাশি মানুষে টানা ট্রামের পরীক্ষাও চালিয়েছিল ট্রাম কোম্পানি! তবে শেষ দৌড়ে মানুষ আর ঘোড়া কোনোটাই টেকেনি। বিলেতি বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের তখন জয়জয়কার। ১৮৮২ সালের শেষ নাগাদ ট্রাম কোম্পানি কলকাতার বুকে ১৯ মাইল ট্রাম লাইন দাঁড় করায়।

১৯০২ সাল থেকে কলকাতায় আসতে থাকে ইলেকট্রিক ট্রাম। সেই উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে লাইন সংস্কার এবং লাইনের বিদ্যুতায়ন করা হয়। ট্রাম হয়ে উঠতে থাকে কলকাতার চলাচলের অবিচ্ছেদ্য এক মাধ্যম।
শহরের মাঝে চলাচল করার জন্য তরুণ থেকে বৃদ্ধ- সবাই ট্রামের জন্য অপেক্ষা করতেন। ১৯৪৩ সাল নাগাদ হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত ট্রাম লাইনের প্রসার ঘটানো হয়, যা সংখ্যার হিসেবে দাঁড়ায় সব মিলিয়ে ৪২ মাইলের মতো।
ভারতের স্বাধীনতার পরেও ব্রিটিশ কোম্পানিটিই ট্রামের দায়িত্বে ছিল। এরপর আইনের পর আইন তৈরি করা হতে থাকে ট্রাম কোম্পানি এবং এর সম্পদকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করার লক্ষ্যে।
তবে ব্যাপারটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জন্য খুব একটা সহজ ছিল না। স্বাধীনতা আর যুদ্ধ পরবর্তী কলকাতা শহরের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তখন মোড় নিচ্ছে ভিন্ন দিকে। শহরের তরুণেরা ফুঁসছে, বেকারত্বের কাছে মার খাচ্ছে স্বাধীনতার স্বপ্ন। নিখিল ভারতের মতো তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তীর্থ কলকাতাতেও স্লোগান উঠেছে-
ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।
ট্রামের ভাড়া ১ পয়সা বাড়বে!
সুলভ পরিবহন হিসেবে ছাত্র আর উঠতি বয়সের তরুণদের মাঝে ট্রামের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। অনেকটা ট্রেনের মতোই ট্রামেও প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল। প্রথম শ্রেণি ছিল ধনিক শ্রেণির জন্য। দ্বিতীয় শ্রেণিতেই ছিল ছাত্র, সাধারণ কর্মজীবী মানুষের যাতায়াত।
এরমধ্যে ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ মালিকানাধীন কলকাতা ট্রাম কোম্পানি মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের টিকিটের ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কলকাতার সমাজতান্ত্রিক ঘরানার দল সিপিআই (কমিউনিস্ট পার্টি অভ ইন্ডিয়া) এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে।
প্রথম থেকেই সিপিআই ঘোষণা দেয়, পশ্চিমবাংলার কংগ্রেস সরকারের যোগসাজশে এই ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে। আর সত্যিই যদি তা এক পয়সাও বাড়ানো হয়, তাহলে তারা রাস্তায় নামবে।
১৯৫৩ সালের ২৫ জুন কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানির বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া পয়লা জুলাই থেকে এক পয়সা বাড়বে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এতে সমর্থন দেয়। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ চরমে ওঠে, মধ্যবিত্ত বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ শুরু করে।
অল্প সময়ের মধ্যেই ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে পুরো কলকাতা কেঁপে ওঠে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক জোট হয় কলকাতার বাম ঘরানার সব দল। সিপিআই-এর সাথে যোগ দেয় প্রজা সোশালিস্ট পার্টি, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল, ফরোয়ার্ড ব্লক, সোসালিস্ট ইউনিটি সেন্টার।
গঠিত হয় ট্রাম-বাসের ভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ কমিটি। যা পরবর্তীতে শুধু ‘প্রতিরোধ কমিটি’ নামেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন ফরোওয়ার্ড ব্লকের নেতা হেমন্ত বসু, সিপিআই নেতা জ্যোতি বসু (পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী)। অন্যান্য বাম দল থেকে ছিলেন সুবোধ ব্যানার্জী, সুরেশ ব্যানার্জী, প্রিয়া ব্যানার্জী প্রমুখ।
কলকাতা নগরীর মোড়ে মোড়ে লিফলেট, হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করা হতে থাকে। বাড়তি ভাড়া না দিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন নেতাকর্মীরা। ট্রাম কোম্পানি বলতে থাকে, ট্রামের উন্নয়ন আর খরচ চালাতে ভাড়া বাড়ানো তাদের একান্ত দরকার।
তবে সিপিআই-এর দৈনিক স্বাধীনতায় বিস্তারিত তথ্য-উপাত্তের সাথে দেখানো হয়, কীভাবে ট্রাম কোম্পানি বছরের পর বছর মুনাফা করে যাচ্ছে, এক পয়সা ভাড়া বাড়িয়ে তারা মুনাফার পরিমাণ আরো বাড়াতে চায়!
জুলাইয়ের এক তারিখ, অর্থাৎ যেদিন থেকে ট্রাম কোম্পানি নতুন ভাড়া চালু করার ঘোষণা দেয়, একই দিন প্রতিরোধ কমিটি পুরাতন ভাড়া দিয়ে ট্রামে চড়ার ঘোষণা দেয়। ট্রাম কোম্পানি পুরাতন ভাড়া নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দিলে প্রথম দিন ফ্রি-তে ট্রামে চড়েন অনেকেই।
প্রতিরোধ কমিটির স্বেচ্ছাসেবক আর সাধারণ মানুষেরা দ্বিতীয় দিনেও একই পন্থা অবলম্বন করেন। অনেকেই ট্রাম কোম্পানি আর সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন ট্রামে চড়ে। প্রতিরোধ কমিটির স্বেচ্ছাসেবকেরা নিজেরাই ভাড়া তুলে ট্রামের কন্ডাক্টরের হাতে দিতেন, যাতে বেশি পয়সা থেকে নতুন ভাড়া কেটে নিতে না পারে।
ট্রামের কন্ডাক্টরেরা এই তরুণ যুবাদের সাথে টেক্কা দিতে গিয়ে পড়েছিলেন ভীষণ মুশকিলে। নতুন ভাড়া আদায় করা যাচ্ছেই না কোনোভাবেই। ফলে সেদিনই, অর্থাৎ ২ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের তরফে আসে হুঁশিয়ারী।
সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়- ট্রামের নতুন নির্ধারিত ভাড়া অমান্য করায় সৃষ্ট অরাজক পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার অলস বসে থাকবে না! মুখ্যমন্ত্রী সাফাই গান ট্রাম কোম্পানির সমর্থনেও। দাবি করেন, বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের গণপরিবহনের চেয়ে নাকি এই ভাড়া কম।
৩ জুলাই পিকেটিং এবং মিছিল চলে। ওদিকে পুলিশও পিকেটিং দমন করতে নামে রাস্তায়। পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ ঘটতে থাকে দুই গ্রুপের মাঝে। ট্রাম কোম্পানি তাদের সকল ট্রাম চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, আইন অমান্য আর পিকেটিং করার দায়ে প্রতিরোধ কমিটির নেতা জ্যোতি বসু, গণেশ ঘোষ, সুবোধ ব্যানার্জীসহ ছয়শ’ লোককে গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।
এর প্রতিবাদে ৪ জুলাই প্রতিরোধ কমিটি ডাক দেয় হরতালের। হরতালেও ব্যাপকভাবে জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দোকানপাট থেকে শুরু করে প্রাইভেট গাড়ি বাস সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। বামপন্থী নেতা কর্মীদের সাথে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীরা যোগ দেওয়ায় সরকারের জন্য আন্দোলন মোকাবেলা করা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে।
এর পরের কয়েকদিন শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। পুলিশের একটি দল স্যার আশুতোষ কলেজের ক্যাম্পাসে ঢুকে ছাত্রদের মারধর করে। এই ঘটনা চাউর হওয়ার সাথে সাথে সারা কলকাতায় ছাত্ররা বিভিন্ন দিকে ট্রাম লাইনে ব্যারিকেড দেওয়া শুরু করে, অনেকেই পিকেটিং-এ অংশ নেয়। প্রতিরোধ কমিটি ঘোষণা দেয় ট্রাম বয়কটের। ওদিকে ছাত্ররাও পুণরায় এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়।
কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় প্রথমবারের মতো চলতে দেখা যায় খালি ট্রাম। গুঞ্জন উঠতে শুরু করে, ব্রিটিশ ট্রাম কোম্পানি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেবে, ট্রাম চলবে না আর কলকাতার রাস্তায়।
এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধি আর ট্রাম বন্ধ করে দেওয়ার গুঞ্জন সব মিলিয়ে ট্রাম কোম্পানি তখন বেশ চাপের মুখে। তাই তাদের কাছ থেকে দাবি আদায় করে নিতে সদ্য জামিনে ছাড়া পাওয়া জ্যোতি বসু এবং প্রতিরোধ কমিটির নেতারা ট্রাম কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন।
জ্যোতি বসু ট্রাম কোম্পানির প্রতিনিধিকে আহ্বান জানান, সেকেন্ড ক্লাসে পুরাতন ভাড়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য। ট্রাম কোম্পানি কোনো আশ্বাস দিতে পারেনি, তবে বিবেচনা করবে বলে ঘোষণা দেয়। দাবি মেনে না নিলে জ্যোতি বসুও ট্রাম-বয়কট চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন।
সেদিন বিকালেই সদ্য জামিনে মুক্তি পাওয়া জ্যোতি বসু এবং প্রতিরোধ কমিটির কয়েকজন নেতা কর্মীকে আবার গ্রেফতার করা হয়। অবস্থার অবনতি দেখে মেঘনাদ সাহা, হীরেন মুখার্জির মতো পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান ব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান।
৫ জুলাই আসানসোলে ইন্ডিয়ান স্টিল কোম্পানির বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপরে গুলি চালায় পুলিশ। এতে পাঁচজন নিহত হয় এবং অনেকেই আহত হয়। ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠা কলকাতা নগরীতে আসানসোলের ঘটনা পৌঁছাবার সাথে সাথে তা ভিন্নরূপ ধারণ করে। ফুঁসে ওঠে পুরো কলকাতার শ্রমিক শ্রেণি। ক্ষোভের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক।
শ্রমিক ও মধ্যবিত্তদের পেশাজীবীদের নানা সংগঠন রাজপথে নেমে আসে; যোগ দেয় ছাত্র আর বাম রাজনীতিবিদদের সাথে। সবাই মিলে জুলাইয়ের ১৫ তারিখে সম্মিলিত হরতালের ডাক দেয়।
১৫ জুলাইয়ের এই সম্মিলিত হরতাল ঠেকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে কংগ্রেস সরকার। তবে এই হরতালে অভূতপূর্ব সাড়া দেয় সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। কলকাতা তো বটেই, কলকাতার বাইরে আশেপাশের এলাকায়ও দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। দিনভর রাস্তায় শ্রমিক আর ছাত্রদের সাথে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে।
রাস্তায় ব্যারিকেড বসিয়ে দেওয়া হয় সকাল থেকেই। ১৬ তারিখ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। সভা সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। পুলিশ আর সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে মারা যায় আঠার বছর বয়সের এক ছাত্র।
জুলাইয়ের ১৭ তারিখে ট্রাম কোম্পানির কর্মচারীদের সংগঠন ‘ট্রাম মজদুর পঞ্চায়েত’ যোগ দেয় প্রতিরোধ কমিটির সাথে। স্টেইটসম্যান আর কংগ্রেসের কয়েকটি পত্রিকা বাদে সংবাদমাধ্যম পাশে দাঁড়ায় আন্দোলনকারীদের। কড়া ভাষায় সরকারের সমালোচনা চলতে থাকে চারদিকে।
১৪৪ ধারা উঠিয়ে নিয়ে বন্দীদেরকে মুক্তি দিতে দাবি জানানো হয় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে। তবে সরকার এত সহজেই নতি স্বীকার করতে রাজি হয়নি। তাই ১৪৪ ধারা ভাঙতে ২২ জুলাই কলকাতা ময়দানে সমাবেশ ডাকা হয়। পুলিশের সাথে জনতার তো বটেই সাংবাদিকদের সংঘর্ষ হয়, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়।
এই ঘটনার পরে দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তড়িঘড়ি করে জ্যোতি বসু এবং বাকি বন্দীদের মুক্তি দেয়, ১৪৪ ধারা তুলে নেয়। ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধি করার যৌক্তিকতা নিয়ে কমিটি গঠিত হয়।
এক পয়সার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনে। সদ্য ব্রিটিশদের হাত থেকে পাওয়া স্বাধীনতা, দেশভাগের শরণার্থী- সব মিলিয়ে কলকাতা তখন কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়ে যেতে শুরু করে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠতে থাকে কলকাতা।
ছাত্র-শ্রমিক আর রাজনীতিবিদদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে ট্রামের ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ পায়নি ব্রিটিশ ট্রাম কোম্পানি। ট্রামের ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে প্রতিরোধ কমিটির প্রধান চরিত্র জ্যোতি বসু পরবর্তীতে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এছাড়াও ট্রামের কর্মচারী, ছাত্র, রাজনীতিবিদ আর সাধারণ মানুষের অভূতপূর্বভাবে একত্র হয়ে লড়াই করার অনন্য দৃষ্টান্তের সাক্ষী হয়ে থাকে কলকাতা নগরী। সমাজবিজ্ঞানীরাও তাই এই ‘আরবান প্রটেস্ট’ নিয়ে ব্যাপক কাঁটাছেঁড়া করেছেন।
১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ কোম্পানিকে হটিয়ে ট্রাম কোম্পানিটির জাতীয়করণ করা হয়, নেওয়া হয় উন্নয়ন-উদ্যোগ। তবে নগরায়নের চাপে একের পর এক ট্রাম লাইন বন্ধ হয়েছে। এরই মাঝে অবশ্য ট্রামবহরে যোগ হয়েছে কয়েকটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ট্রাম। এসি, এফ এম রেডিও, লাল নীল বাতি আর ফাইবার গ্লাসের সিলিং দেওয়া হয়েছে কোনো কোনো ট্রামে।

মোটরের চাপে আর শহরের গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় নাগরিক জীবনে ব্রাত্য হবার পথে ট্রাম। যে অল্পসংখ্যক ট্রাম তাও টেনেটুনে চলছে রাস্তায়, সেসব তাই প্রায়শ খালি-ই দেখা যায়। রাস্তার ট্রাফিক সিগনালে ট্রামের ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরের চুটিয়ে গল্প করবার দৃশ্যও পড়তে পারে চোখে!

আজকের কলকাতার রাস্তায় যখন ফাঁকা ট্রাম হুইসেল বাজিয়ে চোখের সামনে দিয়েই চলে যায়, কারো হয়তো মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত দুর্ঘটনার কথা; কারো মনে পড়ে যায়, এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধি আর তার জের ধরে পশ্চিমবাংলার রাজনীতির মোড় ঘুড়ে যাবার কথা।
Information Source:
1. Fare Hike and Urban Protest Calcutta Crowd in 1953; Siddhartha Guha Roy ( Economic and Political Weekly, December 29, 1990 )
2. Student Participation in the Calcutta Tram Fare Movement ( DOI: 10.9790/0837-2104065255 );IOSR Journal Of Humanities And Social Science (IOSR-JHSS); Volume 21, Issue 4, Ver. 06 (Apr. 2016); PP 52-55
Featured Image Source: India Times