চিত্রকলা: এক বঙ্গজ সাহেব চিত্রশিল্পীর কথা । ঈশিতা সেনগুপ্ত
ফিরে গিয়েছেন সেই কোম্পানী পেইন্টিং-এর যুগে। শোনাচ্ছেন এক ব্রিটিশ শিল্পীর কথা যাঁর জন্ম মুর্শিদাবাদে। যাঁর ছবিতে আমরা এখনও খুঁজে পাই সেই আমলের কলকাতার চেহারা।
বহরমপুর শহরে থাকার সুবাদে মাঝেমাঝেই নানান আত্মীয় বন্ধু মুর্শিদাবাদ বেড়াতে এলে তাদেরকে দেখাতে নিয়ে যেতে হয় লালবাগের হাজারদুয়ারি প্যালেস। এতবার গিয়েও যেন পুরনো হয় না হাজারদুয়ারির পোর্ট্রেট গ্যালারি বা ল্যাণ্ডস্কেপ গ্যালারির ছবিগুলি। প্রতিবারই প্রথম দেখার বিস্ময় নিয়েই তাকিয়ে দেখি সাহেবদের আঁকা সেইসব তেলরঙের ছবিগুলি। একবার সেই শ্রদ্ধামিশ্রিত মন নিয়ে ফেরবার পথে হঠাৎই মনে হল এইসব ছবির ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিত একটু জানা দরকার।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত ধরেই এই সব শিল্পীদের আগমন আমাদের ভারতবর্ষে। টিলি কেটলকেই আমরা ধরে নিতে পারি প্রথম ব্রিটিশ শিল্পী হিসাবে। তিনি ভারতবর্ষে পাড়ি দিয়েছিলেন ছবি আঁকার নেশায়। মূলতঃ প্রতিকৃতি-শিল্পী হলেও যাঁর সবচেয়ে আশ্চর্য সৃষ্টি তিব্বতে না গিয়েও তিব্বতের এক অসাধারণ চিত্ররচনা।
কেটলের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এরপর এলেন উইলিয়াম হজেস ইনিই আক্ষরিক অর্থে এদেশের মাটিতে প্রথম নিসর্গচিত্রী। সেই সময়কার মুঙ্গের, বেনারস, ভাগলপুর, গোয়ালিয়র, লখনই, বক্সার, সাসারাম, কলকাতা উঠে এসেছে তাঁর ছবিতে। তাঁরই কিছু ছবি আমরা পাই তাঁরই একগ্রেভ করা বই ‘সিক্রেট ভিউজ ইন ইণ্ডিয়া’ বইটিতে।
ক্যাথরিন রীড প্রথম মহিলা শিল্পী যিনি এদেশে এসেছিলেন এই দেশটাকে দেখবেন বলে — আঁকবেন বলে। মহিলা হবার সুবাদে রাজ-অন্তঃপুরবাসিনীরাও ধরা পড়েছেন তাঁর ক্যানভাসে। এরপর পাশাপাশি এসেছিলেন জর্জ উইলিয়াম, জন থমাস সেটন, জর্জ ফেরিংটন, প্রমুখ শিল্পীরা।
এই ব্রিটিশ শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ড্যানিয়েল কাকা-ভাইপো। টমাস আর উইলিয়াম ড্যানিয়েল হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা ঘুরেছেন দীর্ঘ সাতবছর আর এঁকেছেন সেইসব সুন্দরের ছবি। ড্যানিয়েল-এর ‘ক্যালকাটা ভিউজ’ দেখলে সত্যিই বিস্মিত হয়ে যেতে হয়। তাঁদের ছবির দুটি অসাধারণ সংকলন ‘ওরিয়েন্টাল সিনারী’ ও ‘টোয়েন্টি ফোর ভিউজ অব হিন্দুস্তান’। রবার্ট হোমই একমাত্র শিল্পী, যিনি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণেই এদেশে আসেননি। ভারতবর্ষকে ভালোবেসে এখানেই থেকে গিয়েছেন আমৃত্যু। তাঁরই সমসাময়িক উইলিয়াম হিকি, চিনারি, চার্লস ডয়লি, কোলসওর্থি গ্রান্ট।
(২)
এই শিল্পীদের মধ্যে চার্লস ডয়লি ছিলেন ব্যতিক্রম। ইনি অন্যদের মতো বহিরাগত নন, ১৭৮১ সালে মুর্শিদাবাদে জন্মেছিলেন। বাবা স্যার জন হ্যাডলি ডয়লি ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব বাবর আলির কোর্ট রেসিডেন্ট। চার বছর বয়স অবধি এদেশেরই মাঠে ঘাটে খেলে বেড়িয়ে ১৭৮৫ সালে সপরিবারে তিনি ইংল্যাণ্ডে চলে যান। পড়াশুনা সাঙ্গ করে ষোলো বছর বয়সে ১৭৯৭ সালে কলকাতায় ফিরে এসে চার্লস ডয়লি প্রথমে হন আপিল কোর্টের রেজিস্টার, ও পরে ঢাকার কালেক্টর। তারও পরে তিনি কলকাতার কালেক্টর ও বিহারের অহিফেন এজেন্ট হয়েছিলেন।
ডয়লির ছবি আঁকার হাতেখড়ি হয়েছিল বেশ অল্প বয়সেই। পাশাপাশি শিল্পী চিনারীকে ঢাকায় বন্ধু হিসাবে পেয়ে তাঁর কাছে ছবি আঁকার তালিমও নিয়েছিলেন কিছুকাল। চিনারীর পাশাপাশি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী এলিজাবেথ জেন রসকেও আমরা তাঁর মেন্টর হিসাবে ভাবতে পারি।
একদা তিনি চালু করেছিলেন আর্টিস্ট সার্কেল বা শিল্পীচক্র ও লিথোগ্রাফিক প্রেস। সেই ‘বেহার স্কুল অফ এথেন্স’ প্রেস থেকে তাঁর আঁকা ঢাকা, কলকাতা, গয়া ইত্যাদি নানা জায়গায় লিথোগ্রাফিক ছবি ছাপা হত।
তাঁর ছবির কিছু বিখ্যাত সংকলন ‘অ্যান্টিকুইটিস অফ ঢাকা’ (১৮১৭), ‘দ্য বেহার অ্যামেচার লিথোগ্রাফিক স্ক্র্যাপ’ (১৮২৯), ‘ভিউজ অফ ক্যালকাটা অ্যাণ্ড ইটস এনভাইরনস’ (১৮৪৮), ‘স্কেচেস অফ আ নিউ রোড ইন আ জার্নি ফ্রম ক্যালকাটা টু গয়া’ (১৮৬০)। তাঁর একটি হাসির কবিতা ‘টুমরো দ্য গ্রিফিন’-এও আমরা পাই সেই অদ্ভুত ইওরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি।
তাঁর আঁকা ঢাকা ও পাটনার ছবিগুলিতে রয়েছে সেইসব অঞ্চলের ধ্বংসাবশেষের নানান রূপ। কিন্তু তারই পাশাপাশি কলকাতার ছবিগুলিতে আছে যথেষ্ট জনসমাগম। কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ আবার কোনো সৌধের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে — এমনই সব দৃশ্য।
ডয়লির ছবিতে আমরা অন্যান্য ব্রিটিশ শিল্পীদের থেকে একটু বেশি ভারতীয় গন্ধ অনুভব করি। তা হয়তো তাঁর এ দেশের জল হাওয়ায বেড়ে ওঠারই ফলশ্রুতি। তাঁর ছবিতে সাহেবসুবোর চেয়ে যেন নেটিভরাই বেশি জায়গা জুড়ে আছে। সেই সময়কার জামাকাপড়, যানবাহন সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যায় তাঁর ছবি থেকে। পাশাপাশি স্থানীয় পশুপাখিও তাঁর ছবিতে জায়গা করে নিয়েছে। মন্দির মসজিদ গির্জার সুন্দর রূপও তাঁর ছবিতে ফুটে উঠেছে। বরং সরকারি কর্মচারী হয়েও সরকার বাহাদুরের কাছারি বাড়ি ইত্যাদি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। তাঁর ছবি যেন ভারতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সাম্রাজ্য বিস্তারের এক নির্ভরযোগ্য দলিল। গার্ডেনরিচ, ফোর্ট উইলিয়াম, ময়দান, চৌরঙ্গি, চিৎপুর বাজার, টালির নালা, শিবপুর, ব্যারাকপুর, ভবানীপুর তাঁর তুলিতে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে বাঙ্গালির অতি আপন চড়ক পুজোও তিনি তাঁর তুলিকালিতে অতি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘ভিউ নিয়ার দ্য সারকুলার রোড’ তাঁর একটি বিখ্যাত ছবি। এই ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই একটি মন্দির ও তাকে ঘিরে কিছু নেটিভ মানুষজনের ঘোরাফেরা। এক গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি নিয়ে তিনি লক্ষ্য করেছেন প্রসাদের থালা হাতে সাদা থান পরা জনৈক বিধবা রমণীটিকে।
আর একটি বিখ্যাত ছবি ‘গার্ডেন রিচ’, এই ছবিটিতে রয়েছে তখনকার জাহাজ, নৌকার গড়ন, ঘোড়ায় চড়া সাহেবসুবো ও তাদের কর্মচারী হিসাবে বেশ কিছু স্থানীয় মানুষজন।
ধর্মতলা গির্জার ছবিটা দেখলে ভাবতে অবাক লাগে কলকাতা এক সময়ে এত ফাঁকা ছিল! এই ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই সেই সময়কার ল্যান্ডোগাড়ী। কিড স্ট্রীটের একটি ছবিতে আমরা দেখি স্থানীয় জীবনযাপনের রূপ ও ঘটনা।
সেন্ট পলস্ গির্জার ছবিটি দেখলেই বাজ পড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া চূড়াটির জন্য খুব দুঃখ হয়। প্রশান্ত নির্মল আকাশে সুউচ্চ চূড়াটি যেন প্রার্থনার প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে।
আলিপুরের টালির নালার ছবিটি যেন এক রঙিন ফোটোগ্রাফ, পালতোলা নৌকা, কলসি মাথায় দেশীয় নারী, ভেসে যাওয়া মৃত গরুকে ঘিরে কাকেদের চড়ুইভাতি — নিখুঁত দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন বঙ্গজ সাহেব চার্লস ডয়লি।
তাঁর সব ছবিতেই ফুটে ওঠে এক নির্মল সুন্দর আকাশ — যা হয়তো শিল্পী মনেরই প্রতিফলন। দেখি গাছপালা, গরু, ঘোড়া, বিশালাকার ছাতা — যা দেখলেই নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায় এ সেই আমাদের তিলোত্তমা কল্লোলিনী কলকাতা।
জলরঙের পাশাপাশি পেনসিল স্কেচেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। শিল্পীর নিজের সই করা ‘অন দ্য রিভার হুগলি’ ছবিটি অসাধারণ, ব্যারাকপুরের আর একটি পেন্সিল স্কেচে ধরা পড়েছে একটি গরুর গাড়ীকে ঘিরে কিছু দেশজ মানুষের কর্মব্যস্ততা।
ডয়লি যে সময় পাটনায় থাকতেন সেসময় পাটনার শিল্পীদের মধ্যে পরীক্ষানিরীক্ষার এক জোয়ার আসে। স্থানীয় ধোপা-নাপিত-ঝি-চাকর-জেলে জায়গা করে নিতে থাকে তাঁদের ছবিতে। ডয়লিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর লিথোগ্রাফেও আমরা দেখতে পাই পাটনার গ্রাম শহরের নানান দৃশ্য। গানবাজনার আসর, হাতি, বিভিন্ন পাখপাখালি ইত্যাদি জিনিস উঠে এসেছে তাঁর ছবিতে। এই সময় বাঙালি শিল্পী জয়রাম দাস তাঁর সহকারী হিসাবে কাজ করতেন। তাঁর সেইসব কাজ দেখে ক্যাপ্টেন স্মিথও মুগ্ধ হয়েছিলেন, স্মিথ নিজেও ছিলেন একজন বিখ্যাত শিল্পী।
এর পাশাপাশি ড্যানিয়েলদের মতো ডয়লিও ভারতের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়ে ছবির রসদ সংগ্রহ করেছিলেন। মুঘল ও দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার নানান খুঁটিনাটি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। নানান পেন্সিল স্কেচ, ওয়াশ, জলরং, তেলরঙে ধরা আছে সেসব ভ্রমণকাহিনী।
তথ্যসূচি :
১। চার্লস ডয়লি’স ক্যালকাটা, আর্লি নাইনটিনথ্ সেঞ্চুরি (সম্পাদনা : ডঃ জয়ন্ত সেনগুপ্ত, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল);
২। তুলি কালির কলকাতা (পুর্ণেন্দু পত্রী, পুনশ্চ)।
চিত্র পরিচিতি :
১। চিনারীকৃত ডয়লির প্রতিকৃতিচিত্র;
২। ভিউ নিয়ার দ্য সারকুলার রোড;
৩। গার্ডেনরিচ;
৪। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল;
৫। সাসপেনসন ব্রিজ অ্যাট আলিপুর ওভার টালি নালা;
৬। ভিউ ইন দ্য ভিসিনিটি অব ব্যারাকপুর।