।।ত ন্ম য় ই ব্রা হি ম।।
জানি না আজকের অধুনা প্রজন্মের স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারী কিশোর বা তরুণদের মধ্যে কতজন তাঁর সম্পর্কে জানেন।আমাদের সময়েও বেশি ছেলে মেয়েরা চিনতো না, কারণ ভারতবর্ষে তাঁর নামটা নিষিদ্ধ নাম, তাকে নিয়ে চর্চা করলে রাত্রে বাড়ির দরজায় পুলিশ কড়া নাড়ে, আর জন সমক্ষে তাঁর নাম উঠলেই মধ্যবিত্তরা হা হা করে তেড়ে আসে।
এই সংগ্রামের স্ফুলিং পরে সারা ভারতে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পরে যখন যুক্ত ফ্রন্টের গৃহ মন্ত্রী জ্যোতি বোসের পুলিশ ২৫ শে মে ১৯৬৭ তে গুলি চালায় নকশালবাড়ি গ্রামের কৃষক রমণীদের উপর। ১১ জন কৃষক রমনী, কৃষক ও শিশুর রক্তে সিক্ত নকশালবাড়ির মাটি সারা ভারতবর্ষে নকশালবাড়ির পথে কৃষি বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দেয়, যাকে মাও জেদং এর নেতৃত্বাধীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি – ভারতে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ বলে অবিহিত করে।
ভারতবর্ষ ব্যাপী সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের মধ্যেই মার্কসবাদ -লেনিনবাদ মাও জেদং এর চিন্তাধারার ভিত্তিতে গড়ে তোলেন এক বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি – সিপিআই (এম-এল) এবং সমগ্র ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণীর কাছে এক আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠেন চারু মজুমদার, অন্যদিকে দেশের গরীব খেটে খাওয়া মানুষের জন্যে তিনি হয়ে ওঠেন মুক্তির অগ্রদূত। সিপিআই (এম – এল) এর নেতৃত্বে সারা ভারতে গড়ে ওঠে তীব্র সশস্ত্র সংগ্রাম, এবং এই সংগ্রামকে সঠিক ভাবে সার সংকলন করে চারু মজুমদার অতি বাম ও ডান দুই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন। কিন্তু অত্যাধিক ভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর প্রতিনিধিরা নানা জায়গায় পার্টির নেতৃত্ব দখল করে বসে এবং সৃজনশীল ভাবে মার্কসবাদী রাজনীতি প্রয়োগ করে জনগণকে বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত করার জায়গায় গড়ে ওঠে হঠকারী সামরিকবাদী রাজনীতি, যার এক প্রমুখ নেতা ছিল বর্তমানের গণতান্ত্রিক বাম মার্কা অসীম চাটুজ্যে। এই লাইনের ফলে তীব্র বিচ্যুতির শিকার হয় নকশালবাড়ির পথে গড়ে ওঠা সংগ্রাম। গরীব – ভূমিহীন কৃষকদের রাজনীতির মাধ্যমে জাগ্রত করার জায়গায় বেশি প্রাধান্য পায় অ্যাকশন এবং চারু মজুমদারের কথা কে বিকৃত করে পরিবেশন করে সিপিআই (এম-এল) এর এক বড় অংশ।
চারু মজুমদার এত সত্বেও সঠিক পথে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ার লাইনের পক্ষে সংগ্রাম করে গেছেন।তিনি সমরবাদী হঠকারী লাইনের সমালোচনা করে লিখেছিলেন রাজনীতি কে প্রাধান্য দেওয়ার কথা, বলেছিলেন অ্যাকশন বন্ধ থাকলেও ক্ষতি হবে না কিন্তু কৃষকদের রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত করে জাগিয়ে তোলার কাজ বহু বেশি জরুরি।
তাঁর কথার বিরুদ্ধে চলে সিপিআই (এম-এল) ৭১ সালের মাঝে এক বড়সর ধাক্কা খায়। বহু বিপ্লবীর প্রাণ যায় এবং শহীদের মৃত্যু বরণ করেন চারু মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সহ যোদ্ধা সরোজ দত্ত। এই সরোজ দত্তের মৃত্যুর পর চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্র করে ডান ও বাম দুই বিচ্যুতির উকিলরা, কিন্তু তার মধ্যেই চারু মজুমদার একাই সংগ্রাম চালান সমস্ত রকম সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে, গড়ে তোলা শুরু করেন পার্টিকে কৃষকের মাঝে, সবার উপরে স্থান দিতে বলেন রাজনীতিকে, এবং সেই রাজনীতির ভিত্তিতে গরীব – ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার শিক্ষা দেন বিপ্লবীদের।
চারু মজুমদারের শেষ প্রবন্ধ – “জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ” ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক অনবদ্য রচনা, যা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে কমিউনিস্ট কর্মীদের প্রচন্ড ভাবে সাহায্য করবে নীতি ও কৌশল বোঝার জন্যে।
১৬ই জুলাই দক্ষিন কলকাতার এক শেল্টার থেকে গভীর রাতে রুনু গুহনিয়োগী ও তার দলবল উঠিয়ে নিয়ে যায় চারু মজুমদার কে, এবং তীব্র অত্যাচার চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে ২৮ শে জুলাই। এর পর থেকে তাঁকে মুছে ফেলতে, তাঁর সৃষ্টি নকশালবাড়ির আন্দোলনকে ধ্বংস করতে ৪০ বছরের উপর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের শাসকশ্রেণী, তবুও চারু মজুমদারের আত্মা তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
চারু মজুমদারের নাম নেওয়া এই দেশে নিষিদ্ধ। চারু মজুমদার কে স্মরণ করা এই দেশের আইন মোতাবিক বিপদজনক। চারু মজুমদারের নীতিতে বিশ্বাস করা এই দেশের শাসকশ্রেনীর সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। তবুও প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ চারু মজুমদারের নাম প্রতিদিন নেন, তাঁর জীবন উত্সর্গ করা কে স্মরণ করেন এবং প্রতিবছর প্রচুর নতুন নতুন মানুষ চারু মজুমদারের নীতিকে সঠিক মেনে ক্ষেতে খামারে খেটে খাওয়া মানুষদের সংগ্রামের সাথে যুক্ত হচ্ছেন রাষ্ট্র ও তার প্রভুদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে। আজ তাঁরা আর বিচার চান না চারু মজুমদারের হত্যার, কারণ হত্যাকারীর কাছে কখনোই হত্যার বিচার আশা করা যায় না। এই নতুন সংগ্রামীরা বুঝেছেন যে শুধু মাত্র চারু মজুমদারের স্বপ্নের ভারত গড়েই তাঁর হত্যার সঠিক বিচার সম্ভব, কারণ চারু মজুমদার এই শাসক শ্রেনীর করুণা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন তাদের উত্খাত করতে।
চারু মজুমদার মধ্যবিত্তদের নায়ক হতে চাননি, তিনি কৃষককে – শ্রমিককে নায়ক তৈরী করার লড়াই করে গেছেন। তিনি ছিঁড়ে দিয়ে গেছেন সুবিধাবাদী সংসদীয় রাজনীতির মুখোস, যার ফলে আজ আর ভোট বাদী বাম ও ডান কেউই জনগণকে নির্বাচনী টোপ দিয়ে বেশিদিন ভাঁওতা দিতে পারছে না। চারু মজুমদারের ফলেই পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত ‘বাম’ সরকার ঠেলায় পরে নম: নম: করে ভূমিসংস্কারের কাজ সারে এবং কৃষকদের বিদ্রোহ ঠেকাতে তিন স্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বানায়। এই সব করা হয় জোতদার ও জমিদারদের কৃষকের বর্ষা মুখ থেকে বাঁচাতে।
অন্যদিকে চারু মজুমদারের নামেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আজ কৃষক ও শ্রমিক উঠে দাঁড়াচ্ছেন মার্কিন একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে, বহুজাতিক কর্পোরেটগুলির শোষণের বিরুদ্ধে, জোতদার জমিদারদের বিরুদ্ধে। রুখে দাঁড়াতে শিখছেন মহিলারা, আদিবাসীরা এবং দলিত জাতির মানুষেরা। তাই আজো চারু মজুমদার বেঁচে তাঁর রাজনীতিতে, তাঁর স্বপ্নের ভারত গড়ার সংগ্রামে, যা আজ অসংখ্য মানুষের স্বপ্নে পরিণত হয়েছে, এবং তিনি মানুষের মুক্তির ধ্রুবতারা হয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।