| 7 অক্টোবর 2024
Categories
ইতিহাস এই দিনে

একটি দুঃসাহসিক ভ্রমণ থেকেই বিপ্লবের পথে ‘চে গুয়েভারা’

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ ১৪ জুন বিপ্লবী চে গুয়েভারার জন্মতিথি তে ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।


আর্জেন্টিনার ‘বুয়েনোস আইরেস’ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়ণরত একজন অতি সাধারন মানুষ শেষ বর্ষে এসে যখন বন্ধুর এক ডাকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে চেঁচিয়ে বলে ফেললো – ‘ছুটলাম’, সাথে আরও কত নানান সামাজিক দায়ভার ও দেয়াল ভেঙ্গে যেদিন ঐ পেডরোসা-২ মোটর সাইকেলটায় তিনি চড়ে বসলেন, আর চোখে সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকা ঘুরে বেড়াবার দাবি যখন টলমল, তখন কে ভেবেছিলো মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চতুর্থ বর্ষের ছাত্রই সারা বিশ্বকে তখনই বুনছিলেন তিঁনি তাঁর নিজের মতন করে।

কে ভেবেছিলো এ ছাত্রই, মানে ‘আরনেস্তো গুয়েভারা দি লা স্যেরনা’ হয়ে উঠবেন চির রোমান্টিক, আদর্শিক, স্বপ্নবাজ, রঙ্গীন এক চিরবিপ্লবী গেরিলা ‘আরনেস্তো চে গুয়েভারা’। আজ কোটি মানুষের বুকের ভেতর এবং বাহির উভয় অংশেই ভেসে ভেসে ওঠে চে গুয়েভার বিখ্যাত সেই মুখ।

‘চে’ এর মূল অর্থ আজেন্টিনায় ইংরেজী শব্দে অনুবাদ করলে হয় ‘মি.’। মিষ্টি শুভ্র রোদের শহর রোজারিওতে জন্ম নেয়া এই মি. গুয়েভারা তার সাথে সাথে তার দেশের একটি শব্দকেও পরবর্তীতে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত করিয়ে দিলেন মি. অর্থে না, বিপ্লবী অর্থে।

‘চে’ মানেই চে গুয়েভারা, ‘চে’ মানেই বিপ্লব, ‘চে’ মানেই প্রেম, ‘চে’ মানেই গেরিলা, মানে কত রক্ত, কত যুদ্ধ, এখানে এ যুদ্ধে টিকে থাকতে হবে, তাই থাকা, লড়ে যেতে হবে লড়ে যাওয়া, এই মরে যাওয়া, আর যা শুধু মানুষেরই তাগিদে, কল্যানের তাগিদে এই মানুষেরই। এই পৃ্থিবীর তাগিদ জেগে জেগে ওঠে বারবার বুকের এত কাছে; আর যেখানে মহান উদ্দেশ্যই রইলো উন্নত মানুষ হয়ে মাথা উঁচু করে গর্বের সথে বুক ফুলিয়ে বেঁচে থাকা এই পৃথিবীতে আর যেটা যেন হয় খুব আনন্দে এবং খুব আনন্দে।

একটি ছোট্ট বাইসাইকেলে চড়ে ১৯৫০ সালেই একটি সুস্থ পৃথিবীর খোঁজে চে গুয়েভারা পাড়ি দিয়েছিলেন উত্তর আজেন্টিনার কত শত গ্রামীন প্রদেশ। ভেসে বেড়িয়েছেন সাড়ে চার হাজার কি.মি.। কি ছিল তার উদ্দেশ্য? ঘনিয়ে কি আসছিল বেলা?

এরপরের বছরই ১৯৫১ সালে সেই বন্ধুর পাগলা ঘন্টা মেশানো বিখ্যাত ডাক আসে চে গুয়েভারার কানে, তৈরী হয় বিপ্লবী বনে যাবার প্রথম দেহ ‘একটি মোটর সাইকেল জার্নি’।

সমগ্র দক্ষিন আমেরিকার ধুলো, সমুদ্ররে নীল জল, রাশি রাশি প্রেম, শহরের আনন্দ, তার ভিন্ন বৈচিত্র, মানুষের উজ্জ্বল হাসি হাসি মুখ, একি সাথে গভীর ভাবে ঢাকা কিছু পর্দার বাইরের গল্প, সাথে কান্না, কুষ্ঠ রোগ, ঘৃণা না করায় বিস্মিত মানুষ, ল্যাটিন আমেরিকায় পুঁতে রাখা অভিশাপ, মাথা নিচু মানুষের অপমান, পুঁজিবাদী মতলব, অশিক্ষা, কুশিক্ষা সব মিলেয়ে ৮০০০ কি.মি. শুষে নিয়ে ছিলেন তিঁনি।

আর এ যাত্রায় তার সঙ্গী ছিলেন সেই বিখ্যাত ডাকওয়ালা বন্ধু ‘আলবার্তো গ্রানাদো’। তাঁর ওই বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চেরিয়াস ডাকে চে গুয়েভারা তার পৃথিবী আবিস্কারের ক্ষুধায় তৃপ্ত হতে গিয়ে একে একে সন্নিকটে যেতে থাকেন দারিদ্রতা, রোগ এবং ক্ষুধার।

তিঁনি ভাবেন “Let the world change you and you can change the world”। হয়ে ওঠেন চিকিৎসক থেকে যোদ্ধা, ফের বিপ্লব, ফের বিপ্লব, ফের বিপ্লব। হয়ে ওঠেন এক অনুপ্রেরণার বীজ, এক বুক সাহস, ভালবাসার মানুষ, একজন পবিত্র মানুষ। শুদ্ধ এক পৃথিবীতে বাস করতে চাওয়া সকল মানুষের চোখে এ কথা সত্য।

Portrait of Che Guevara (1928-1967),, 20th century,, Cuba. (Photo by: Photo12/UIG via Getty Images)

পেডরেসো- ২ তে চড়ে সেই ল্যাটিন আমেরিকা জয় করার উদ্দ্যেশে বেড়িয়ে পড়ে তিঁনি নিজেই উপলব্ধি করেন যে বিপ্লবই পারে মানুষকে তার প্রাপ্য মান ফিরিয়ে দিতে। বিপ্লবই পারে এই পৃথিবীতে মর্জাদা সমেত উন্নত মানুষ হয়ে সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকার আনন্দ। চে গুয়েভারা হয়ে ওঠেন বিপ্লবী চেতনার উজ্জ্বল নক্ষত্র।

সংগ্রামী এই বিপ্লবীকে শেষে প্রাণ দিতে হয় এই বিপ্লবের স্বপ্নই বুনতে যাওয়াতেই, কিউবার পর আরো কয়েক দেশ হয়ে বলিভিয়ায়। জানা যায় ফেলিক্স রদ্রিগেজ নামের একজন কিউবান প্রতিবিপ্লবী সি.আই.এ এর স্পেশাল এক্টিভিটিস ডিভিশনের সাথে কাজ করে সাহায্য করেন বলিভিয়ান আর্মি ট্রুপ্সকে ‘দি হান্ট ফর গুয়েভারা’ কে সাফল্য এনে দিতে । এবং তারা সক্ষমও হন।

অক্টোবরের ৮ তারিখ তিনি ধরা পড়েন। ৯ তারিখ সকালে বলিভিয়ান প্রেসিডেন্ট তাঁকে হত্যা করার আদেশ দেন। দুপুরে তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর তাঁর হাতের কবজি কেটে তাকে কোথায় সমাধি দেয়া হয় তা গোপন রেখে দেয় বলিভিয়ান সরকার বহু বছর। শেষে বহু নাটকের পর ১৯৯৫ সালে বলিভিয়ান রিটায়ার্ড জেনারেল ‘মারিও ভারগাস” জানিয়ে দেন কোথায় আছে চে গুয়েভারার শব।

তারপর ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে একটি কিউবান জিওলজিষ্ট এবং আর্জেন্টাইন অর্থোপোলজিষ্টদের একটা টিম ভালেগ্রান্ডে বিমানবন্দরের খুব কাছে দুটো গনকবরে কবজি কাটা চে গুয়েভারা সহ আরো ছয়জন সহ যোদ্ধার অবশিষ্টাংশ পান। সাথে চে গুয়েভারার নীল জ্যাকেটের গোপন পকেটে থাকা পাইপ টোবাকোর থলে।

এই মৃত্যু সংবাদ চে’এর সংগ্রামী বন্ধু, কিউবার বিপ্লবী গুরু, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো ৫ই অক্টোবর জনগনের সামনে ঘোষনা দেন। কিউবায় পালিত হয় তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। কিউবার সামরিক জান্তা কে উচ্ছেদ করে তৎ্কালীন কিউবার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা আর্জেন্টেনিয়ান চে গুয়েভারাকে নিজের ভাবতে কিউবানরা ভুল করেন নি একটুকুও।

ফিদেল তাঁর আবেগ আর ভালবাসাময় ভাষণ শেষ করেন এইভাবে –

“If we wish to express what we want the men of future generations to be, we must say: Let them be like Che! If we wish to say how we want our children to be educated, we must say without hesitation: We want them to be educated in Che’s spirit! If we want the model of a man, who does not belong to our times but to the future, I say from the depths of my heart that such a model, without a single stain on his conduct, without a single stain on his action, is Che!

চে গুয়েভারা মরতে শেখে নি। কেউ তাঁদের মারতে পারবে নাহ। আর তোমাকেও ভালবাসা আলবার্তো গ্রানাদো। জয় হোক বিপ্লবের।

“The true revolutionary is guided by great feelings of love.” ― Ernesto Che Guevara

.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত