| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য

চোরাকাঁটা (শেষ পর্ব)

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

সুমনার মাথা নিজের অজান্তেই হেঁট হয়ে গিয়েছিল। লজ্জায় সে মুখ তুলতে পারছিল না। শান্ত চুপচাপ শুনছিল। মনে মনে সেও বিস্মিত হচ্ছিলো। এ কেমন অদ্ভুত কথা? একজন মানুষকে দেখে বা তার সামান্য হাত নাড়ানো কিংবা চোখের পাতার এলোমেলো ওঠা নামা… এসব থেকেও কি এমন ধারণা করা যায় নাকি? আর তাছাড়া অনিক তাদের বন্ধু ছিল। দিনের পর দিন তারা অনিকের সাথে ওঠাবসা করেছে। এমন কোনো সম্ভাবনার কথা তো তাদের একবারও মনে আসেনি!

আনিসুল হক বলে চললেন,

‘আমি বিষয়টাকে তেমন একটা পাত্তা দিলাম না। তবু একেবারে উড়িয়েও দিতে পারলাম না। আমার সাইকোলজিস্ট বন্ধুটির এক্সপার্টিজের ওপরে আমার ষোলআনা ভরসা ছিল। তাই অবচেতন মনেই অনিকের দিকে একটা বাঁকা দৃষ্টি আমি শুরু থেকেই লাগিয়ে রাখলাম।

আমি গোড়াতে রুমানার কেসটাকে তেমন সিরিয়াস কঠিন কিছু হিসেবে দেখিনি। একজন প্রতিবন্ধী মেয়ের জগত তো আসলে খুব বড় নয়। সে বাইরে যায় না। বাইরের জগতটাই তার কাছে ফাঁকা। অল্প কিছু মানুষ নিয়ে পরিবেষ্টিত একটা জগতে সে বাস করে। কাজেই প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজতে খুব বেশিদূর হয়ত যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না আমার, এমনটাই ধারণা ছিল।

প্রকৃত অপরাধীকে ধরতে সত্যিই খুব বেশি দূরে হাত বাড়াতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু অনেক নোংরা পাঁক ঘাঁটতে হয়েছে। অনেক জল কাদা ডিঙিয়ে আবার ঘাটে এসেই তরি ভিড়াতে হয়েছে।

সুমনার সাথে অনিক আমাকে কখনো পরিচয় করিয়ে দেয়নি। যদিও সুমনার প্রসঙ্গ মাঝে মধ্যেই এসেছে। যাদের সাথে তখন কথা বলেছিলাম, প্রত্যেকেই সুমনার খোলামেলা স্বভাবের কথা বলেছিল। কিন্তু অনিক নিজে থেকে কখনো সুমনার ব্যাপারে বেশিকিছু বলেনি বা সঙ্গে করে পুলিশস্টেশনে নিয়েও আসেনি। সম্পর্কের গ্যাপ ছিল ওদের মধ্যে, এমনটা আমার ধারণা হয়েছিল। যদিও সেরকম ইঙ্গিত কেউ কখনোই দেয়নি। আমিও তাই অনিককে অযথা চাপ দিলাম না। সুমনার সাথে আলাপ পর্বটা ফোনেই সেরে নিলাম। অসুস্থ ছোটবোনকে একা বাসায় রেখে সুমনা কোথাও যেতে পারে না। কাজেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ওর সাথে মুখোমুখি আলাপ করাটা হয়ে ওঠেনি সেসময়। রুমানার সাথেও দেখা হয়নি কখনো। যদিও এই দুজনের সাথে আমার মুখোমুখি বসে কথা বলাটা দরকার ছিল।

সুমনার কাছ থেকেই জানতে পারলাম, অনিক অনেক রাত পর্যন্ত কম্পিউটারে বসে কাজ করে। মাঝে মাঝে নাকি রাতে কখন ঘুমাতে আসে, সুমনা সেটা জানতেও পারে না। অনিকের চাকরির যে ধরণ, তাতে কম্পিউটারে এত কী কাজ সেটা বুঝতে পারলাম না। সুমনাও এই ব্যাপারে তেমন কিছু জানে না। এখানেও সেই সম্পর্কের গ্যাপ। টিপিক্যাল বাঙালী স্বামী। নিজের কাজ সম্পর্কে স্ত্রীকে বেশিকিছু জানাতে ভালোবাসে না। অনিক ঘুরেফিরে বারবার শান্তর নামটা বলাতেই সন্দেহ হচ্ছিলো। কিছুদূর যেতেই বুঝতে পারলাম, এখানে একটা অন্যরকম গল্প আছে।’

শান্ত এবারে মুখ খুললো।

‘কিন্তু অনিক যে আমাদের ব্যাপারটা জানে এটা আমাদের দুজনের কারো কখনো ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি।’

আনিসুল হক হাসলেন।

‘সেটা খুব বেশি আনপ্রেডিক্টেবল নয়। অনিক কিছু জানলেও তোমাদের জানাতো না। ও ভেতরে ভেতরে তোমাদের দুজনের গতিবিধির ওপরে নজর রাখতো। আচ্ছা সুমনা, তোমাকে তো অনিকের ল্যাপটপটা চেক করতে বলেছিলাম। তুমি কিন্তু আমাকে কিছু জানাওনি। ল্যাপটপে কিছু কি পাওয়া যায়নি?’

সুমনার মুখ কালো হয়ে গেল। অত্যন্ত কুন্ঠাভরা গলায় বললো,

‘বাদ দেন আংকেল। যে চলে গেছে, তাকে নিয়ে আর এত ভাবনাচিন্তা করে কী হবে? ওসব ঘাঁটাঘাঁটি করেও আর কোনো লাভ নেই!’

‘হুউম, বুঝেছি বলতে চাইছো না। কিন্তু, তুমি না বললেও পুলিশ তো তার কাজ কখনো বন্ধ রাখেনি। অনিকের বাসার জিনিসপত্র তল্লাশী চালানো হয়েছিল। বাড়িওয়ালাকে বিষয়টা গোপন রাখতে বলা হয়েছিল। কারণ আমরা জানতাম, অনিকের বাবা জানলে কাজটা এত সহজে হয়ত করতে পারতাম না। তাকে বোঝাতে হতো, কেন এই কাজটা আমরা করছি। সেটা উনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতো কী না, জানি না। নানারকম ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বাড়িওয়ালাকেও সত্য কথাটা বলতে পারিনি। উনাকে বোঝাতে হয়েছে, অনিকের মৃত্যুটা রহস্যজনক। আমরা এটার পেছনে অন্যকিছু আছে কী না সেটা যাচাই করে নিতে চাইছি। তাই তার বাসাটা সার্চ করে দেখা দরকার। সেই সাথে কথাটা তিনি যাতে কাউকে না বলেন, সেটাও নিশ্চিত করে নিয়েছিলাম। কিন্তু ছোট্ট একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল তারপরও…’

‘কী ভুল?’ আনিসুল হকের কথা শেষ হওয়র আগেই শান্ত আর সুমনা দুজনেই একসাথে বলে উঠলো।

‘সুমনা ঐ বাসায় অনিকের মৃত্যুর পরেও আরো দু’দিন ছিল। আমাদের উচিত ছিল, অনিকের এক্সিডেন্টের পরদিন গিয়েই বাসাটা একবার সার্চ করে আসা। নানা কারণে সেটা করা হয়নি। তাছাড়া ফজলুল ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানোটাও সেই সময়ে আমার মানবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়েছিল। যাহোক, সুমনা যে এত তাড়াতাড়ি বাসাটা ছেড়ে দিবে, এমনটা আমি মনে করিনি। ভেবেছিলাম হয়ত আরো অন্তত একমাস বাসাটাতে থাকবে সুমনা। তাই অন্যান্য কাজ সেরেই অনিকের বাসায় সার্চ করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি বাসা তালাবন্ধ। সুমনা চলে গেছে। সুমনা সম্ভবত আমার নাম্বারটাও ব্লক করে রেখেছিলে।

বাসার তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। সব জিনিস জায়গামতো আছে বলেই মনে হলো। কিন্তু অনিকের ল্যাপটপটাকে কোথাও পাওয়া গেল না! অনিকের গাড়িতেও ল্যাপটপ ছিল না। ওটা কি তুমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলে সুমনা?’

‘আমি? প্রশ্নই আসে না আঙ্কেল! অনিকের কোনো জিনিসই আমি সাথে করে নিয়ে আসিনি। বাবার টাকাতে কেনা কিছু ড্রেস ছিল আমার আর রুমানার। শুধু সেগুলোই সাথে করে নিয়ে গিয়েছি। অল্প কিছু টাকা বাবা দিয়েছিল আমাকে। সেটুকুই আমার সম্বল ছিল। অনিকের কাছ থেকে পাওয়া একটা ফুটোকড়িও সাথে আনিনি আমি। ওর ল্যাপ্টপ নিয়ে আসার তো প্রশ্নই আসে না!’

‘তাহলে? ল্যাপটপটা কোথায় হারিয়ে গেল?’

সুমনার ঠোঁটে বাঁকাহাসি খেলে যায়। বলে,

‘এটা বুঝতে পারা কি এতটা কষ্টের ব্যাপার আংকেল? আমার শ্রদ্ধেয় প্রাক্তন শ্বশুরসাহেবকে ফোনে সবকিছু নিয়ে যেতে বলেছিলাম আমি। অনিকের ব্যাংক ডিটেইলসও উনাকে বলে দিয়েছিলাম। কাজেই যা নেওয়ার, যা সরানোর উনিই সরিয়েছেন।’

‘কিন্তু আর কোনোকিছুতেই তো হাত পড়েনি সুমনা! শুধু ল্যাপটপটাই উনার নিতে ইচ্ছে করলো কেন?’

‘ঠিক যে কারণে আপনি আমাকে ল্যাপটপটা খুলে ভেতরের ফাইলগুলো চেক করতে বলেছিলেন, সেই একই কারণেই উনারও ল্যাপটপটা খোলার প্রয়োজন ছিল হয়ত। নিজের ছেলের সুকীর্তি কি আর উনার কাছে গোপন ছিল? সবকিছুই জানতেন। আর জেনেশুনেই আমার জীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। গরীবের মেয়ে পেয়ে গিনিপিগ বানিয়েছিলেন।’

ঘরের মধ্যে কিছু সময়ের নীরবতা। সুমনা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

‘কিন্তু বললেন না তো! অনিক যে অপরাধী এটা কীভাবে নিশ্চিন্ত হলেন আপনি?’

‘বলছি। আমি নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম ঘটনা পরম্পরা থেকে। অনিকদের গ্রামে যখন গিয়েছিলাম তখন ওদের গ্রামের লোকজন অনেক কথাই বলেছিল, ধাক্কা লাগার মতো। ফজলুল ভাই তার জায়গাজমি বিক্রি করে দিচ্ছেন এই খবরটা তো আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু কেন এই বিক্রি করার এত প্রয়োজন পড়েছে এটা আমার জানা ছিল না। গ্রামের লোকের ভাষ্যমতে, এই জমিদারবাড়িতে কিছু অসামাজিক কার্যকলাপ হয়ে আসছে বেশ একটা দীর্ঘ সময় ধরে। সেই অসামাজিক কার্যকলাপের শিকার হয়েছে এই বাড়িতে কাজ করা অল্পবয়সী মেয়েরা। তাদের কেউ কেউ সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। অনেকে গৃহত্যাগী বা গ্রামত্যাগী হয়েছে। কারো কারো আর সন্ধান মেলেনি। এদের মধ্যে একজন একবার জানিয়ে দিয়েছিল, এই বাড়িতে বাসকারী একজন পুরুষের দ্বারাই তারা ধর্ষিতা হয়েছে। কিন্তু তাদের জানা নেই কে আছে এই ধর্ষণের পেছনে। কারণ তাদেরকে অজ্ঞান করে কাজ সমাধা করা হতো। জ্ঞান ফেরার পরে তারা নিজেদের অজ্ঞান অবস্থায় একটা ঘরে আবিষ্কার করতো। জামাকাপড় এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পড়ে থাকতো। যেসব মেয়েদের সাথে এই ঘটনা ঘটতো, তাদের পক্ষে আর কাজে থাকা সম্ভব হতো না।

এত সব কিছু গাঁয়ের লোকজন জেনে গিয়েছিল অথচ কে এসবের পেছনে সেটাই তারা জানতে পারেনি, এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি আমার কাছে। হয়ত তারা জানতো ঠিকই, ভয়ে কেউ মুখ খুলতো না। যদি তাদের কোনো ক্ষতি হয়!

সেই গ্রাম থেকে ফিরে আসার আগে আগেই একটা পাগল এসে পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল। কিছুতেই রাস্তা ছাড়ছিল না। আমি দশটাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিতেই একগাল হেসে বলেছিল…পুত্রদায় বইলা কতা! একটাই পোলা। মানুষ হয় নাই। দেখতে শুনতে ভালা। আচার ব্যবহার ভালা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুইন্যার বদ। বাপের আর কী কাম? পোলারে কি ফালায় দিব? হের লাইগাই…ফেলো কড়ি দাও তেল।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কার কথা বলছো? পাগল মুখে কুলুপ এঁটে নিলো এরপর। আর কিছুতেই তার মুখ খুলতে পারলাম না।

এরপর আরেকবার সন্দেহ হয়েছিল রিয়াজের কথায়। রিয়াজ জানিয়েছিল, সে অনিকের বাবাকে একটা ছোট পোড়োঘর থেকে একজন মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখেছে। রিয়াজ সিগারেট খেতে বাইরে বেরিয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে পরে জানা গেছে, সেটা সিগারেট ছিল না। ছিল গাঁজা। অনিকের বাবা তার বন্ধুদের কারো সম্পর্কেই নেতিবাচক কিছু জানাননি। নেশাভাং এর স্বভাব কারো ছিল, এমনটা তিনি জানেন কী না একবার ফোনেও এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি স্পষ্টভাবেই না বলেছেন। কাজেই বোঝা গেল, রিয়াজ সেদিন যদি কাউকে দেখেও থাকে সেটা ফজলুল ভাই ছিলেন না। ছিলেন বা ছিল অন্যকেউ।

শান্ত ট্রেনের প্যাসেজে অনিক আর রিয়াজের যে ঝগড়া শুনেছিল সেটাকে একটু ভালোভাবে রিওয়াইন্ড করতেই বুঝতে পারলাম, যার সাথে রিয়াজের দেখা হয়েছিল তিনি অনিকের বাবা ছিলেন না। ছিল অনিক স্বয়ং।

কিন্তু এতকিছুর পরেও শতভাগ নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যই আরেকবার রিয়াজকে পুলিশস্টেশনে ডেকে এনেছিলাম। সে কি আর অত সহজে মুখ খোলে? আমি তার ড্রাগ ব্যবসার খুঁটিনাটি সব খবর জেনে গেছি, এমন কথা বলাতেও সে ভয় পায়নি। পরে খুব ঠান্ডা ভাষায় স্টিং অপারেশন আর সেখানে সাজানো নাটক বানিয়ে একেবারে এনকাউন্টার করে দেওয়ার ভয় দেখাতেই আর সাহস বজায় রাখতে পারেনি। সম্ভবত ভেবেছিল, কী দরকার আর ঝামেলা বাড়িয়ে? তাই একেবারে সব কথা লক্ষ্মী ছেলের মতো উগড়ে দিয়েছিল। যা ভেবেছিলাম তাই! ইন্টুউশন মিলে গিয়েছিল একদম খাপমত।

রুমানার মিসকারেজটার জন্য তুমি নিজেকে দোষী ভাবতে, সুমনা। অথচ তুমি কোনোদিন এতটা অসাবধান বা অপরিচ্ছন্ন ছিলে না যে, বাথরুমের মেঝেতে আস্ত সাবান ফেলে আসবে। তাহলে এই সাবান কে ফেলে আসতে পারে বলে তোমার কাছে মনে হয়? রুমানা? এই কাজ কি রুমানা আগে কখনো করেছে? তাহলে সেদিন হঠাৎ করতে গেল কেন? আর এটা করা হয়েছে, রুমানার গোছল করতে যাওয়ার ঠিক আগ দিয়েই। আর সেটাও ছুটির দিনেই। যখন অনিক বাসায় ছিল। তাহলে…কী বুঝলে?’

‘আমাকে ফোনে এসব আগে কেন জানাননি আংকেল? এত কিছু জেনে যাওয়ার পরেও?’ সুমনা বললো।

‘তোমাকে তখনই কিছু বলতে চাইছিলাম না। ইচ্ছে ছিল, সেদিন পুলিশস্টেশনে তোমরা এলেই সবকিছু বলবো। তারপর তো অনিকের মৃত্যুই সব এলোমেলো করে দিলো। তখন ভাবলাম, পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেই সবকিছু বলবো। কিন্তু তুমি তো আমার নাম্বারটাই ব্লক করে রেখে দিলে। না না…তোমাকে কিছু ব্যাখ্যা করতে হবে না সুমনা। আমি বুঝেছিলাম, লজ্জা থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলে তুমি। আর তাছাড়া মৃত্যুর পরে হয়ত অনিককে সবার সামনে আর ছোট করতে চাওনি।  কাজটা একদিক দিয়ে হয়ত ঠিকই করেছো। কারণ, তুমি মুখ খুললেও কে কে তোমার সব কথা বিশ্বাস করতো তা বলা মুশকিল। সাক্ষ্যপ্রমাণ সমেত কার কার কাছে যেতে? তোমার নিজের পায়ের নিচেই তো তখন মাটি নেই! কাজেই যা করেছো ঠিকই করেছো। অনিক বেঁচে থাকলে হয়ত ভিন্ন কথা ছিল। আর তাছাড়া যে অন্যায় সে করেছে, তার শাস্তি তো এক রকম পেয়েই গেছে।’

সুমনার চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠলো। কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে শেষমুহূর্তে সামলে নিলো। আনিসুল হক জিজ্ঞেস করলেন,

‘অনিকের বাবা-মা’র কোনো খবরাখবর জানো? তারাও তো নিজেদের সন্তান হারিয়েছেন। 

আনিসুল হকের মুখে আচমকা এই প্রশ্ন শুনেই সুমনার সারামুখে উষ্মার ছায়া ঘনালো।

সেই ছায়া কারো কাছে অস্পষ্ট রইলো না। মনে মনে আজো সে তার প্রাক্তন শশুর শাশুড়িকে ক্ষমা করতে পারে না। এই দুজন মানুষের কাছে নিশ্চয়ই কিছুই অজানা ছিল না তাদের ছেলের সম্পর্কে! তবু ছেলের অতীতকে ধামাচাপা দিয়ে কীভাবে তারা নীরিহ একটা মেয়ের সর্বনাশ করলেন? এই বিয়েটা হওয়া কি এতই জরুরি ছিল? অনিক অনেক আগে থেকেই দুষ্কর্মে লিপ্ত ছিল। অথচ তারা এই বিয়ের সময়ে কিছুই প্রকাশ করেননি!

সুমনা মনের রাগকে চাপা দিয়ে বললো,

‘না। উনি ফোন করেছিলেন কয়েকবার। আমি শুধু একবার ধরেছিলাম। পরে আর ধরিনি।’

আনিসুল হক খুব ধীরগলায় বললেন,

‘অনিকের মা নুরজাহান বানু এখন শয্যাশায়ী। নিজের স্বামীর সংসর্গ তিনি ত্যাগ করেছেন। তার নিজের পরিত্যক্ত বাবার বাড়িতে তিনি ফিরে গিয়েছেন। সেখানে কয়েকজন কাজের লোক আছে। তারাই উনার দেখাশুনা করে। আর ফজলুল আহমেদ ভাই অনিকের মৃত্যুর কয়েকমাস পর থেকেই মানসিক সুস্থতা হারিয়ে ফেলেছেন। সারাদিন নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন। একজন পারিবারিক ডাক্তারের পরামর্শে তার চিকিৎসা চলছে। বিশ্বস্ত চাকর-বাকরেরা আছে। তারাই দেখছে এখন। তবে উনার অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। সেরে ওঠার সম্ভাবনা এখন আর নেই বললেই চলে।’

সুমনা এসব জানতো না। সে শুধু জিজ্ঞেস করলো,

‘আমার শাশুড়ি মানে…অনিকের মা স্বামীর সংসর্গ ত্যাগ করেছেন মানে? বুঝতে পারলাম না।’

‘তারা দুজন এখন আলাদা থাকছেন। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ চলছিল ছেলের মৃত্যুর পর থেকে। সেই বিবাদ একসময় অনেক বড় কিছুতে রূপ নিয়েছে। একসাথে থাকা আর সম্ভব হয়নি।’

সুমনা আর কিছু বললো না। কী নিয়ে বিবাদ শুরু হয়েছে জিজ্ঞেস করতে মন চাইলেও জিজ্ঞেস করলো না শেষমেষ। করুক যা খুশি তাই নিয়ে…ওর কী আসে যায় তাতে? খুব সঙ্গোপনে অজানা এক প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল সুমনার মন। সেই প্রশান্তিতে পাপের গন্ধ জড়িয়ে আছে। তবু সেই পাপবোধ কেন যেন দগ্ধ করতে পারলো না তাকে। দু’জন নীরিহ এতিম মেয়ের জীবনকে কি নিজেদের ছেলের জন্য বিসর্জন করেননি তারা? তখন মনে হয়নি একবারও কাজটা ঠিক হচ্ছে কী না? নিজের সন্তানই সব…অন্যের সন্তান কিছুই না? এখন প্রকৃতির প্রতিশোধ তো পেতেই হবে।

আনিসুল হক আবার বললেন,

‘আমি জানি সুমনা তুমি উনাদের দুজনকে মনে মনে ক্ষমা করতে পারোনি। ক্ষমা না করতে পারাটাই স্বাভাবিক হয়ত। কিন্তু তুমি হয়ত জানো না, উনারা নিজেদের মতো করে চেষ্টা করেছিলেন। কিছু ত্রুটি হয়ত ছিল সেই চেষ্টায়। সে জন্যই খুব বেশি সুফল পাননি।

 

অনিকের এই সমস্যা শুরু হয়েছিল ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় থেকেই। কলেজের ছুটিছাটাতে বাড়িতে এসে সে এই কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়তে শুরু করে। অনিকের বাবা-মা খুব ধীরে ধীরে বিষয়টা বুঝতে পারেন। প্রথমদিকে তারা ভেবেছিলেন সাময়িক পদস্খলন হয়েছে। অল্পদিনেই কেটে যাবে। কিছুটা অন্ধমোহও কাজ করছিল হয়ত।

স্রেফ বকাঝকা দিয়ে আর দু’একজনকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করেই তারা সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। ভুলটা এখানেই হয়েছিল। সমস্যা এতে মেটেনি। ছেলে দিনে দিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে অতি ভয়ানক এক জীবনগ্রাসী মোহে। এক প্রচন্ড সর্বনাশী এডিকশনে অনিক তখন পুরোপুরি এডিক্টেড। সেক্স এডিকশন। সারা পৃথিবীতে কত কত ছেলেমেয়ে যে এই সর্বনাশা এডিকশনের পাঁকে পড়ে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তার কোনো ইয়ত্তা নেই! ফজলুল ভাই লোক লজ্জার ভয়ে ছেলেকে কোনো কনসালটেন্টের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি। জায়গা-জমি বেচে দিয়ে গ্রাম ছেড়েই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। মনে আশা ছিল, তাতে হয়ত এই লজ্জার হাত থেকে রেহাই পাবেন।

ছেলেকে ডাক্তার বা কনসালটেন্টের কাছে নিতে পারেননি, কিন্তু বিয়ে সমাধান হতে পারে ভেবে ছেলের অতি দ্রুত বিয়েটা দিয়ে দিয়েছিলেন। তোমাকে তাদের পছন্দ হলেও তোমার বাবার সামাজিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে তারা দ্বিধায় ভুগছিলেন। খুব বেশি সামাজিক পার্থক্য হয়ত সমস্যাটাকে নাও মেটাতে পারে, এমনটাই ভেবেছিলেন তারা। কিন্তু  তোমার অতি বুদ্ধিমান নানাজান অর্থের সীমাহীন লোভ দেখিয়ে অনিককে হাত করে নিয়েছিল। বিয়ের পর খুব সম্ভবত কাজের মেয়েদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যই অনিকের বাবা-মা তার ছেলে আর ছেলের বউকে নিজেদের বাড়িতে রাখার ব্যাপারে ইচ্ছুক ছিলেন না। হয়ত আশা করেছিলেন, ছেলে দূরে থেকে সংসার করলেই পুরনো দোষ আস্তে আস্তে কেটে যাবে। সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে তাই সন্তানের সাথে দূরত্বটাকে তারা খুশিমনেই মেনে নিয়েছিলেন।

কিন্তু ভবিতব্য কে কবে এড়াতে পেরেছে? সে তো চুপিসারে নিজের কাজ করেই যায়।রুমানাকে তারা কেউ খেয়ালই করেননি।

এবারে আসি গল্পের শেষাংশে।

এক্সিডেন্টের দিন বিকেলে আমি যখন অনিককে ফোন করি, ঠিক তার পরেই ফজলুল ভাইও অনিককে ফোন করেন। দুজনের মধ্যে অনিকের মায়ের অসুস্থতা নিয়ে কথাবার্তা হয়। সুমনাকে ‘মাকে দেখতে যাচ্ছি’ বলে বেরিয়ে যায় অনিক। তারপর রাস্তায় ঘটে যায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মেরে দিয়ে যায় অনিকের গাড়ি। সেই গাড়ি দ্রুতবেগে পালিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু এখানেও প্রকৃতির জোগসাজশেই বেরিয়ে আসে অন্য একটা তথ্য।

সেদিন রাস্তাতে একটা চেকপয়েন্ট বসেছিল। প্রধানমন্ত্রীর একটা জনসমাবেশ ছিল টঙ্গিতে। তাই প্রতিটি গাড়ি চেকিং করে নাম্বার লিখে এন্ট্রি করা হচ্ছিলো। নিছক রুটিন ফলোআপে সেই এন্ট্রিলিস্ট চেক করে জানা যায়, অনিকের গাড়ির ঠিক পেছনেই যে গাড়িটা তাকে ফলো করছিল, সেটা অনিকের বাবারই মারুতি। কিছুদিন আগেই গাড়ির রঙটা পাল্টিয়েছিলেন তিনি। সম্ভবত সেজন্যই অনিক গাড়িটাকে চিনতে পারেনি। গাড়িতে বসা ছিল অনিকের বাবার অতি বিশ্বস্ত কর্মচারী শহীদুল। একজন পাকা সব্যসাচীর মতো সে গাড়ি চালানোতেও ছিল পটু!’

এ পর্যন্ত বলেই দুজনের মুখের দিকে চাইলেন আনিসুল হক।

সেই ঘরটিতে যেন বজ্রাঘাত হয়েছে তখন। শান্ত আর সুমনা কারো মুখে টুঁ শব্দটিও নেই। সুমনার পুরোমুখ তখন কাগজের মতো ধবধবে সাদা। চোখের পলকটুকুও পড়ছে না আর! কিছু একটা বলতে গিয়েও বারকয়েক কেঁপে গেল ঠোঁটদুটো।

আনিসুল হক এই বিস্ময় উপভোগ করলেন। তারপর বললেন,

‘যে সন্তানকে শত চেষ্টাতেও ফেরাতে পারেননি, সম্মানের ভয়ে নিজের জায়গাজমি বাড়িঘর সবকিছু ত্যাগ করে দেশান্তরী হয়েছিলেন যে সন্তানের মানসম্মান রক্ষার দায়ে…  পুলিশ সেই সন্তানের সম্মান কেড়ে নেওয়ার সবটুকু আয়োজন করে ফেলেছে, এই খবরটা কীভাবে যেন জানতে পেরে গিয়েছিলেন ফজলুল ভাই। তাই নিজের একমাত্র সন্তানকে হত্যা করে সেই সন্তানেরই সম্ভ্রম বাঁচিয়ে দিয়েছেন তিনি।

অনিকের মা এই ভয়াবহ সত্য মেনে নিতে পারেননি। এতদিনের ঘর গৃহস্থালি সবকিছু ছেড়েছুড়ে চিরতরে স্বামীকে ত্যাগ করেছেন তিনি। আমৃত্যু স্বামীকে তার মুখ দেখতে নিষেধ করে দিয়েছেন।

ফজলুল ভাই আগেই অনেককিছু হারিয়েছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রীকে অন্তত পাশে পেতে চেয়েছিলেন। সেটাও তার ভাগ্য তার জন্য মঞ্জুর করেনি।

আমার কথাগুলো হয়ত অনেক বেশি জটিল মনে হচ্ছে তোমাদের কাছে। রহস্য আমি নিজেও খুব যে ভালোবাসি তা নয়, কিন্তু আমাদের জীবনটা মাঝে মাঝেই নানারকম রহস্যের গল্প শোনায় আমাদের। তা না হলে সহজ সরল একটি জীবন কেন এত আচমকা জটিল হয়ে যায়? এতটাই জটিল যে চাইলেও তাকে আর সহজ ছন্দে ফিরিয়ে আনা যায় না। হয়ত জীবন রহস্য ভালোবাসে। তাই মাঝে মাঝেই নিজেকে রহস্যের খোলসে মুড়িয়ে নেয়। আমরা রহস্য ভালোবাসি বা না বাসি… তাতে জীবনের কীই বা এসে যায়?’

 

আনিসুল হক থামলেন। ঘরের মধ্যে তখন শুনশান স্তব্ধতা। ওদের হৃৎস্পন্দনের শব্দটাও বুঝি কান পাতলে শোনা যাবে। এর মাঝে শুধু দেওয়াল ঘড়ির একঘেয়ে আওয়াজটা বড্ড বেরসিকের মতো নিজের কাজ করে যাচ্ছিলো।

হঠাৎই গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন আনিসুল হক। তারপর দুজনের দিকে চেয়ে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে উঠলেন,

‘চলো খাবার টেবিলে যাওয়া যাক। সবকিছু যে ঠান্ডা হতে চললো! ঠান্ডা মেরে যাওয়া সত্যকেই হজম করা যায় না। খাবার হজম করবা কীভাবে?’

 

 

 

 

আগের পর্ব ও লেখকের অন্যসব লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত