পদসঞ্চার (পর্ব-১৮)
২৫ এপ্রিল । শনিবার
করোনার নাম জপ করছে পৃথিবীর মানুষ। আসছে কে? করোনা। দেখছি কাকে? করোনা। দ্রূতপদে চলছে কে? করোনা। কাত করছে করোনা। তাক লাগাচ্ছে করোনা। করোনা, করোনা, করোনা। করোনাই এখন জপমালা। এমন করে প্রেমিক বা প্রেমিকাকেও ডাকে নি মানুষ। এমন করে ডাকলে ঈশ্বর সশরীরে নেমে আসতেন ধরাধামে।
আমিও নাম জপ করছি করোনার। আরতির সঙ্গে দিনে যে সব কথাবার্তা হয়, ছেলে-মেয়ে বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ফোনে যে কথা হয়, তার নব্বুই ভাগে থাকে করোনা। নাম জপ করতে করতে করোনাকে নিয়ে কবিতার মতো কিছু লেখা জমা হয়েছে। ‘কবিতার মতো’ বলার সঙ্গত কারণ আছে। আমি কবি নই, নিয়মিত কাব্যচর্চাও করিনা। তবু ভাবতে ভাবতে মাঝে মাঝে কিছু কথা উঠে আসে। সেগুলো কবিতা নয়, কবিতার মতো।
যেমন, খুব ভাবছিলাম করোনা-পরবর্তী পৃথিবীর কথা। বদলে যাবে অনেক কিছু। মানবিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক, রাষ্ট্রিক সম্পর্কের রদবদল ঘটবে। সেকথা বলছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। মানুষ কি খুব ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাবে? দেশগুলো উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়ে যাবে?
১.
পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবী, পাল্টেই যাবে পৃথিবী,
পরিবার সমাজ সংসার অনুষঙ্গ সব,
সম্পর্কের মাঝে শুয়ে থাকবে মৃত বা সুপ্ত অণুজীব,
সন্দেহের বাতাবরণে বদলে যাবে দৃশ্যপট,
তুমি সন্দেহ করবে আমাকে, আমি তোমাকে,
ব্যক্তির সীমার মতো সীমা্য়িত দেশ,
দেশে দেশে দেশ থাকার অলীক কল্পনা,
আমি শুধু, আমার জন্য আমি,
একবচনে শুরু, একবচনেই শেষ,
আর সব ঝুট হ্যায়, তফাৎ যাও, তফাৎ যাও……
আমার অনেক বই আছে। তিন-চারটে আলমারিতে। বহুদিন ধরে সংগ্রহ করেছি। মাঝে মাঝে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। এসবের আর কি কোন প্রয়োজন আছে? সন্দেহ হয়। আমি তো সাহিত্য নিয়ে চর্চা করি এক-আধটু। তাই বেশিরভাগ বই সাহিত্যের। করোনা আগ্রাসনে জীবন-জীবিকার সংকট হবে। হবেই হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন সেকথা। ক্ষুধার রাজ্যে গদ্যময় হবে যাবে পৃথিবী। তখন সাহিত্যের পাঠক থাকবে না। বই কেনার, পত্রিকা কেনার পয়সা থাকবে না মানুষের। তাই একবার ভাবলাম বইগুলো দিয়ে দেব।
২.
কেনা দূরের কথা, দিলেও নেবে না কেউ;
তাই ভাবছি বইগুলো দিয়ে দেব আরতিকে,
শেক্সপীয়র-রবীন্দ্রনাথ- টলস্টয়-জীবনানন্দ সব,
ছাদের গাছগুলোর জন্য জৈব সার তৈরি করুক সে,
ফুল নয়, ফলের গাছ, উচ্ছে-বেগুন-লেবু-ঝিঙে,
লকডাউনের দিনে বড্ড কাজ দিয়েছে সে সব।
আকালের দিনে বিশ্রুত মনীষীরা বিস্মৃতির অতলে,
শিল্পকলা-ধর্ম-প্রেম নির্জীব নিঃসাড়,
একমাত্র খিদে থাকে, থেকে যায় খিদে,
নীতিকথা শাস্ত্রবিধি ভাষণ মানে না,
হয়তো বা এ খিদেই প্রলম্বিত হতে হতে হতে
একদিন করোনাকে জুজুবুড়ি করে দেবে শেষে……..
সারাদেশে লকডাউন। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের খুব একটা সমস্যা নেই। সমস্যা দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষের। তারাই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ। ‘দেশের শ্রীবৃদ্ধি’তে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন এই সংখ্যাগরিষ্ঠের উন্নতি না হলে দেশের শ্রীবৃদ্ধি হয় না। এদের কতদিন আটকে রাখা যাবে? ক্ষুধার তাড়নায় এরা অস্থির হয়ে একদিন বিধিবিধানকে তুড়ি মেরে যদি বেরিয়ে আসে রাস্তায়? এইসব বুড়বক মানুষ হয়তি বলে বসবে : খিদের জ্বালায় এমনি মরতাম, নাহয় করোনায় মরব।
৩.
করোনা আছে শাসন আছে
আইসোলেশন মৃত্যু আছে
নির্দেশিকার বহর আছে
বদ্ধঘরের বাঁধন আছে
যা নেই তা এই সামান্য যে
সংখ্যাগুরুর চাল বাড়ন্ত
যে কয়জনা লক্ষ্মীমন্ত
নিজের নিজের বৃত্তে আছে
দরজা খোল বেরিয়ে পড়ো
করোনাকে হজম করো
এ-ও খাবে সে-ও খাবে
আমরা খাদ্য খাদক ওরা
বেঁচে থাকব যেকটা দিন
চেঁচিয়ে বলব শুনুন সবে
ভাইরাসেরা চরিত্রহীন
ঠিক যেমনটি মন্ত্রী নেতা
কবে করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার সম্ভব হবে কেউ জানে না। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিকরা লেগে আছেন। অতন্দ্র আছেন গবেষণাগারে। তেমনি একজন বৃটিশ বিজ্ঞানী সারা গিলবার্ট। তিনি কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ট্রায়াল শুরু। ফেজ ওয়ান শেষ।
৪.
বিমূঢ় বিশ্ব রুদ্ধশ্বাস তাকিয়ে আছে আপনার দিকে
সারা গিলবার্ট,
হাঁ করে তাকিয়ে আছে বিপন্ন বিশ্ব,
কখন ঝলসে উঠবে আপনার হাতের জাদু…
খোদার উপর খোদকারি দেখেছি অনেকবার,
অপূর্ববস্তুনির্মাণক্ষমপ্রজ্ঞা….
আপনাকে ঘিরে আছেন নিউটন আর ডারউইন,
ফ্যারাডে আর ফ্লেমিং, ডালটন আর রাদারফোর্ড,
রবীন শ্যাটক আপনার পাশে ছায়ার মতন,
ডাউনিং স্ট্রিট থেকে উৎসাহ দিচ্ছেন হ্যানকক…
আপনার স্মিতমুখে দুর্দান্ত শপথ ;
এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা-আমেরিকার
শত সহস্র মানুষের আকুল প্রার্থনায়
কখন ঝলসে উঠবে আপনার হাতের জাদু,
অপূর্ববস্তুনির্মাণক্ষমপ্রজ্ঞা….
নিউইয়র্কপ্রবাসী আমার স্নেহভাজন রাজন গুহ সারা গিলবার্টের এই প্রশস্তি শুনে আমাকে ফেসবুকে লিখেছিল যে একা সারা গিলবার্টকে হাইলাইট করা ঠিক নয়। কারণ পনেরো জনের একটা টিম নিয়ে কাজ করছেন তিনি। কথাটা বেঠিক নয়। এ যুগে বিজ্ঞান গবেষণায় একক কৃতিত্বের চেয়ে যৌথ কৃতিত্ব বেশি দেখা যায় পৃধিবীতে।
করোনা নামক বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে আমাদের রাজ্যে করোনাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পত্রযুদ্ধ শুরু হয়েছে। রাজ্যপাল বনাম মুখ্যমন্ত্রী। শাসক দল বনাম বিরোধী দল। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল বনাম রাজ্য প্রশাসন। আসলে লক্ষ্যটা পরের বছরের বিধানসভা নির্বাচন। তাই অভিযোগ, পালটা অভিযোগ।
৫.
চিঠি লেখার দিন শেষ, কিন্তু সে তো
শেষ হয়ে না হইল শেষ।
সবিশেষ কথা এই : করোনার মতো
ভেক বদলে চিঠি আছে মেলে ও টুটিটারে।
এবারে তারই যুদ্ধ বঙ্গদেশে, পত্রযুদ্ধ,
ঘন তমিস্রায় ;
বিশ্বযুদ্ধে পত্রযুদ্ধ নব সংযোজন।
৬.
মানছি করোনা বড্ড খতরনাক। কাত করে দিয়েছে তা-বড় বিজ্ঞদের।
ফাটিয়ে দিয়েছে ফুটুনির ডিব্বা। এ দেশেও বাড়ছে তার থাবা।
হুঁকোমুখো হ্যাংলারা ঘাবড়ে ঘোড়া।
কিন্তু মশায়, সব কিছুর একটা ভালো দিকও আছে।
কতবড় সুযোগ এনে দিয়েছে করোনা, ভাবুন তো !
দরজায় কড়া নাড়ছে নির্বাচন । করোনাকে হাতিয়ে
নির্বাচনী বৈতরিনী পার হবার সুবর্ণ সুযোগ।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
আক্রান্ত ও মৃতকে নিয়ে গরম গরম তরজা।
বাগযুদ্ধ। পত্রযুদ্ধ। চ্যানেল যুদ্ধ। ঠান্ডা ও গরম যুদ্ধ।
এগিয়ে এসো, চেঁচিয়ে বলো।
সকলের যুক্তি আছে। পরিসংখ্যান আছে।
কে সত্য, কে মিথ্যা! জান সাধু বুঝহ সন্ধান।
আরে ভাই, হিরন্ময় পাত্রে নিহিত সত্যের মুখ।
তুমি আদার ব্যাপারি, বুঝে তোমার কাজ কি!
রাজ্যপালের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর লড়াই, শাসক দলের সঙ্গে বিরোধী দলের।
টেস্ট নিয়ে। ত্রাণ নিয়ে। চিকিৎসা নিয়ে। সংখ্যা নিয়ে।
বাইরে করোনা করোনা রব। ভেতরে নির্বাচনের অঙ্কুরিত বীজ।
হ্যাঁ, নির্বাচন। গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
[ক্রমশ]
আগের সবগুলো পর্ব ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।
![দিলীপ মজুমদার](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2022/12/10806374_1509715065966249_665369-150x150.jpg)
গবেষক