পদসঞ্চার (পর্ব-২৪)
১২ মে, মঙ্গলবার
সব মানুষ সাহসী নয়। বরং বেশির ভাগ মানুষ ভীতু। নানা কারণে ভয় পায় তারা। বিপদ আশঙ্কা করে ভয় পায়। বিপদ কল্পনা করে ভয় পায়। এরই নাম ফোবিয়া। ফোবিয়ার তালিকা বিরাট। কেউ জলকে ভয় পায় (হাইড্রোফোবিয়া), কেউ রক্ত দেখে ভয় পায় (হেমোফোবিয়া), কেউ ঝড়-বিদ্যুতে ভয় পায় (আ্যাসট্রাফোবিয়া), কেউ উচ্চতায় ভয় পায় (আ্যক্রোফোবিয়া), আকাশে ওড়ার ভয় আছে কারও (এয়ারোফোবিয়া), নিঃসঙ্গতায় ভয় পায় কেউ (অটোফোবিয়া), কারও ভিড়ের ভয় (ক্লাস্ট্রোফোবিয়া), কীট-পতঙ্গ সম্বন্ধে কারো ভীতি (এনটোমোফোবিয়া), গাছ সম্পর্কে কারও ভীতি (ডেনড্রোফোবিয়া), ডাক্তারকে ভয় পায় কেউ (ল্যাট্রোফোবিয়া) ; এরকম নারীভীতি (গাইনোফোবিয়া), বিবাহভীতি (গামোফোবিয়া), কুকুরভীতি (সাইনোফোবিয়া), হ্যারিকেন-টর্পেডোভীতি (লিলাপসোফোবিয়া), কম্পিউটারভীতি (সাইবারফোবিয়া) ইত্যাদি।
করোনাভাইরাস মানুষের মনে যে ভীতি সৃষ্টি করেছে তার নাম জার্মোফোবিয়া বা মাইসোফোবিয়া। এই ভীতির কথা বলার আগে বহুদিন আগের একটি ছবি তুলে ধরি।
তখন কাঁথি প্রভাতকুমার কলেজে পড়ি। আমাদের এক ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন জার্মোফোবিয়ায় আক্রান্ত। তখন অবশ্য সেটা বুঝতে পারিনি। অধ্যাপককে খাপছাড়া, উদ্ভট প্রকৃতির বলে মনে হত। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন। চেয়ারে বসতেন না। টেবিল স্পর্শ করতেন না। রোল কলের খাতা বেয়ারা নিয়ে আসত। একজন ছাত্র তাঁর পাশে গিয়ে সেই খাতা খুলে ধরত। তিনি নাম ডাকতেন। সেই ছাত্রই পি বা এ লিখে দিত। তারপরে পকেট থেকে বই বের করতেন। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে পড়িয়ে যেতেন তিনি। ইংরেজিতে বলতেন। আমরা কিছুই বুঝতাম না। হাঁ করে তাঁর পোজ-পশ্চার দেখতাম।
একদিন এক ছাত্র সাহস করে বলে ফেলল, স্যার আপনার কিসের ভয়?
তিনি পড়া থামিয়ে একটু ক্ষণ চুপ করে বলে উঠলেন, তোমাদের কবে চেতনা হবে?
আমরা হতবাক। কোন প্রশ্নের কোন উত্তর ! ছেলেটি বলল. কেন স্যার?
-জার্ম—বুঝলে, জীবাণু। থিকথিক করছে চারদিকে। খালি চোখে দেখতে পাও না, তাই বুঝতে পারছ না, কিন্তু এখন থেকে সতর্ক হও। বি ওয়্যার অফ।
বিজ্ঞানের ছাত্র না হলেও আমরা জীবাণুর কথা জানি। লুই পাস্তুরের আবিষ্কারের কথাও স্কুলে পড়েছি। তবু থিকথিক করা জীবাণুর সঙ্গে আমরা তো সহাবস্থান করে আছি। ব্যাপারটা যদি এতই বিপজ্জনক হত, তাহলে সব মানুষইতো স্যারের মতো সতর্ক হত। তাই মনে হল, এটা স্যারের বাতিক।
কিন্তু করোনাভাইরাসকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে যে ভীতি জেগেছে, তা কাল্পনিক নয়। তার বাস্তব ভিত্তি আছে। কিভাবে এই ভাইরাস বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে, তা মানুষ সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছেন প্রতিদিন। বিজ্ঞানীরা ছাড়া এই ভাইরাসকে মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারছেন না। তবু এর অস্তিত্বকে অস্বীকারও করতে পারছেন না। শত শত, হাজার হাজের , লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, এটা তো বাস্তব। এর ফলে যে মৃত্যু হচ্ছে, সেটাও তো বাস্তব।
তাই ভীতি। জেরুজালেমের মনস্তত্ত্ববিদ মাইকেল টবিন বলেছেন করোনা ফোবিয়া করোনাভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক [ ‘The fear is more contagious than the virus itself’]। এখনও এই ভাইরাসের নাড়ি-নক্ষত্র জানা যায় নি। অজানা এই ভয়ংকরকে নিয়ে ভীতি স্বাভাবিক। টবিন বলছেন, ‘ I t is the fear of the unknown . It is the idea that my life is being intruded on, that anyone can be suspected of carrying the virus and I am vulnerable’. কোথাও কোন নিরাপদ জায়গা নেই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, কার মধ্যে এই ভাইরাস লুকিয়ে আছে, কেউ জানে না। তাই সন্দেহের তালিকায় সবাই আছে।
তাই খিটিমিটি লেগে যাচ্ছে পরিবারে। নীলকন্ঠবাবুর ছেলে বাজারে গিয়েছিল। ফিরে এসে ভালো করে হাত ধোয় নি বলে নীলকন্ঠবাবু রেগে গেলেন। বললেন, হ্যান্ড হাইজিন আ্যন্ড হেলথকেয়ারের নিয়মাবলি মানছিস না কেন? জানিস না, শুধুমাত্র সাবান-জল দিয়ে হাত ধোয়ার আভ্যেস আটকে দিতে পারে ভাইরাস ও ব্যাক্টরিয়াজনিত বহু সংক্রমণ। শ্বাসযন্ত্রের কোনও সংক্রমণ বা সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো অসুখও সাধারণ হাত ধোয়ার মাধ্যমে ঠেকানো সম্ভব বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে!
নীলকন্ঠবাবুর ছেলে তরতাজা যুবক। বাবার এসব কথা তার বাতিক বলে মনে হয়। তার কেয়ার ফ্রি মনোভাব দেখে আরও রেগে যান নীলকন্ঠবাবু, ঘরে বুড়ো মা-বাপ আছে সেকথা খেয়াল রাখবি তো! বৃদ্ধ বয়েসে সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক বেশি।
নীলকন্ঠবাবু কারণে-অকারণে বার বার হাত ধুয়ে ফেলেন। ব্যাপারটা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডিতে পরিণত হয়েছে।
সুনামি, ভূমিকম্প বা সুপার সাইক্লোনজাতীয় সব রকম বিপর্যয়ের পরে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেই সংক্রান্ত মানসিক আঘাতের রেশ থেকে যায় অনেকদিন। অনেকে প্যারানোইয়ায় ভোগেন। সেদিক থেকে কোভিদ-১৯এর আঘাতটা অনেক বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন এই ভাইরাস থাকবে অনেকদিন। তাই মানুষের ভয়-ভীতিও অনেকদিন থাকবে।
কিন্তু ভয়-ভীতির কাছে মানব জাতি আত্মসমর্পণ করে চুপচাপ ঘরের কোণে বসে থাকতে পারবে না। সে বাইরে বেরুবেই। আর এইভাবেই হয়তো হার্ড ইনিউনিটি তৈরি হয়ে যাবে।
[ক্রমশ]
আগের সবগুলো পর্ব ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।
গবেষক