লতার চোখেই পড়লো, অথচ সকলেই লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে এই নয়’তলা ফ্ল্যাটবাড়ির ছয় তলায় লিফট থামার অপেক্ষা করে। ঠিক লিফটের সামনেই একটি বিশাল এ্যাকুয়ারিয়াম রেখেছেন লতাদের সামনের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক। খুব সৌখিন মানুষ ভদ্রলোক, মাছ পোষেন, কচ্ছপ পোষেন, ছাদে শ’খানের ফুলের টবে লাগিয়েছেন নানা ধরনের ফুলের চারা, ফলও আছে কিছু, যেগুলো আজকাল ছাদেই ফলাচ্ছে নগরচাষীগণ।
এ্যাকুয়ারিয়ামটি যেদিন থেকে এখানে বসেছে সেদিন থেকেই লতা এটির দিকে তাকান, আশেপাশে কেউ না থাকলে এ্যাকুয়ারিয়ামের বাসিন্দাদের তিনি খাবার দেন। খাবারভর্তি কৌটোগুলো অবশ্য এর ওপরেই রাখা থাকে। দু’টো বড় বড় কৈ মাছ, দু’টো কচ্ছপ, বিঘতখানেক লম্বা একটি পাঙ্গাস মাছ এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। তবে কিছু দিন পর পর বাজার থেকে আনা যে কোনো তাজা মাছই এই স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগ দেয়, পরদিন কিংবা তারপর দিন সেটা মরে গিয়ে ফুলেটুলে ঢোল হয়ে ওঠা অবধি নতুন মাছটিকে এই পুরোনো বাসিন্দারা নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই তার জন্য যেন নির্ধারিত ছিল, হয় তরকারীর কড়াইয়ে কিংবা এখানে, এই ঢাউস এ্যাকুয়ারিয়ামে। কোথাওই হয়তো এই ক্ষুদ্র ও বেঁচে থাকা মাছেদের জায়গা হয় না। লতা ভাবেন। কিন্তু লতা আশ্চর্য হন অন্য কারণে, লক্ষ্য করে দেখেন যে, একটি কই মাছের লেজটা ক্রমশঃ ছোট হয়ে যাচ্ছে, একটুক্ষণ তাকিয়ে দেখেন যে, একটি কচ্ছপ সুযোগ পেলেই একটি কৈ মাছের লেজের দিকটায় কামড় বসাচ্ছে। কৈ মাছটা যেদিকে কচ্ছপটি থাকে সেদিকে যাচ্ছে না, কিন্তু কিছুক্ষণ পর কচ্ছপটি নিজেই এসে কৈ মাছের পেছন থেকে কামড় দেয়। লতা বুঝতে পারেন যে, কী ভাবে কৈ মাছটি তার লেজ হারাচ্ছে। এটা দু’একদিন আগের কথা। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখে লতা লিফট ধরে নীচে নামেন। কিন্তু নামতে নামতেই তার ভেতরটা কেমন করে ওঠে, নিজের জীবনের সঙ্গে কি তিনি মিল পান কিছু কৈ মাছটার?
লতার বয়স প্রায় পঞ্চাশ কিংবা তার একটু বেশি। অতোদিন আগেতো আর জন্মদিন মনে রাখার বালাই ছিল না, তাছাড়া মেয়েদের তো বয়স কমানোই রীতি। পারিবারিক অবস্থাভেদে হয়তো মেয়েদেরও জন্মদিন তখন ঘটা করে পালন করা হতো কিন্তু লতাদের মতো পারিবারিক আবহে বড় হওয়াদের জন্য সেসব সত্যি সত্যিই ছিল বিলাসিতা। লতার বাবা জুট মিলে ওভাশীয়ারের চাকরি করতেন। লতা অবশ্য জানতেন না ওভারশীয়ার কাকে বলে, এখনও জানেন না। কিন্তু সেই বয়সেই স্কুলের অন্যান্য মেয়েদের কাছ থেকে বুঝে গিয়েছিলেন যে, বাবার চাকরি দিয়েই পরিবারের সক্ষমতা যাচাই করা হয়। ওরও স্কুলে পরিচয় ছিল ওভারশীয়ার চাচার মেয়ে, কারণ যে স্কুলে ও লেখাপড়া করেছেন সেটা ছিল একটা জুট মিলের স্কুল। সব অফিসারদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কিছু শ্রমিকদের ছেলেমেয়েও সেখানে লেখাপড়া করতো, যদিও স্কুলের দপ্তরি থেকে শুরু করে শিক্ষক, সকলের কাছ থেকেই ওরা চাকরির পদ-পদবি অনুযায়ী ব্যবহার পেতে অভ্যস্ত ছিলেন। তারপরও স্কুল জীবনটা কী অপূর্বই না ছিল। কিন্তু বেশিদিন থাকলো কই? ক্লাশ নাইনে ওঠার পরইতো লতার বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে কেন? কারণ লতাকে ভালোবাসে পাড়ার সবচেয়ে বখাটে ছেলেটা, যার বাবাও ওই জুটমিলেই শ্রমিক নেতা, নাম ফিট্টু। ফিট্টু দেখতে খুব সুন্দর এবং খ্যাপে বল খেলতে যায়। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিল আগেই, এখন মিলের ফুটবল টিমে খেলে কিন্তু মূল কাজ বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খ্যাপে খেলা। লতার সঙ্গে তার কোনোদিন প্রেমট্রেম হয়েছে বলে কেউ জানে না, কিন্তু লতার মতো সুন্দর দেখতে মেয়েদেরতো কোথাও বিনা বাঁধায় বেড়ে ওঠার ইতিহাস এদেশে নেই, তাই লতার নামেও বদনাম রটে গেলো যে, ফিট্টুর সঙ্গে লতার প্রেম। আর লতার বাবাও কেন যেন ব্যাপারটাকে কোনো রকম ছ্যানা-ঘাঁটা না করেই লতার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে।
ফিট্টুর সঙ্গে লতার প্রেম নেই, একথা লতা ছাড়া আর কেউ জানে না। সকলেই জানে উল্টোটা। আর সেই কারণেই লতাকে ধরেবেঁধে একটা বয়স্ক ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা জুট মিলের গৎবাঁধা নিস্তরঙ্গ জীবনে বেশ আলোড়ন তুললো। শুধু লতারই মনে হলো, তার জীবনে এরকম ঘটনা ঘটতে দেওয়া ঠিক হবে না। কিছু একটা করতে হবে। কী করতে হবে? ভাবতে ভাবতেই একদিন ফিট্টুর সঙ্গে দেখা হলো ওর স্কুল গেটে। ওর একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল, স্কুলে এ্যাসেম্বলি চলছিলো, জানুয়ারি মাসের সকাল, সারা বছরতো আর এ্যাসেম্বলি হয় না, কেবল জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি এই দু’মাস হয়। লতা ফিট্টুকে দেখে কী করবে ভাবছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে ফিট্টু এগিয়ে এসে বললেন, “তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। তোর সঙ্গে প্রেমের কথাটা আমি নিজেই রটাইছি। কারণ, তোরে আমি ভালোবাসি। তোরে যেনো আর কারো কাছে বিয়া না দেয় সে জন্যই কথাটা রটাইছিলাম। কিন্তু এ্যাহনতো শুনতাছি তোর বিয়া ঠিক কইরালাইছে তোর বাপ। শোন, স্পষ্ট কইয়া দেই, বিয়া আমি তোরেই করুম”। লতা অবাক। এতো ঘটনা ঘটে গেছে তারই অগোচরে, অথচ তিনি কিছুই জানেন না। এখন যে ফিট্টুকে কিছু বলবেন, সেটাও ঠিক পারছেন না, এই সকালেই রোদ উঠে গেছে, জাতীয় সঙ্গীত বাজছে এ্যাসেম্বলিতে, ফিট্টুকে চোরা চোখে দেখলেন একবার, ফর্সা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, গোঁফের জায়গাটা নীল হয়ে আছে। ভালোই লাগলো তার, আর তখনই ফিট্টু বললেন, “চল আজকে স্কুলে যাওয়া লাগবে না। আমার সঙ্গে চল্”। লতা চারদিকে দেখলেন। রাস্তাটা ফাঁকা, আঁচারের দোকানগুলোও বসেনি স্কুলের সামনে তখন, সকালে বসে না তেমন একটা, দুপুরে বসবে। স্কুলের পাশেই নদী, অনেকখানি চর পেরিয়ে তবে জলের ধারা। ফিট্টু ততক্ষণে নদীর পথে নামতে শুরু করেছে। লতা ওর সঙ্গে যাবে কি যাবে না সে সিদ্ধান্তের ভার যেনো লতার একার, এবং লতা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন, হাঁটতে লাগলেন ফিট্টুর পেছন পেছন। টমেটো খেত, আলু খেত, কলই খেত, শর্ষে ক্ষেত, মূলো খেত, পার হয়ে ওরা নদীর পারে বড় বড় ঘাসের কাছে পৌঁছে গেলো। ফিট্টুই আবার কথা বললেন, “শোন্ আর কিছু না পারলে তোরে নিয়া ভাইগা যামুগা, বুঝলি? প্রথম প্রথম কষ্ট হবে ঠিক, পরে একটা ভালো কাজবাজ জুটাইয়া নিলেই হবে”। আশ্চর্য লতার ভেতর থেকে কোনো কথাই যেনো বেরুচ্ছে না। নদীর ওপারে অনেক চাষী কাজ করছে, মিষ্টি আলুর লতা কেটে দিচ্ছে, লতা না কাটলে নাকি আলু বড় হয় না; আর ঘোমটা পরা ছোটখাটো বউমতো মহিলা চালনিতে করে ছাই ছড়িয়ে দিচ্ছে মিষ্টি আলুর লতায়, জুনি-পোকারা যেনো আলু না খায় সে জন্য। লতা শুনছেন, হাঁটছেন ফিট্টুর পেছনে, লতা ভাবছেন, পাগলটা না আবার হাতটাত ধরে বসে, সে জন্য যতোটুকু দূরত্বে থাকলে হাত ধরার সুযোগ পাবে না, ঠিক সেটুকু দূরত্বেই হাঁটছেন। “শোন, আগামি শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর মিলের ইঁটখোলা গেটের কাছে থাকবি বুঝলি? স্কুলে যাবার নাম কইরা বাইর হবি কিন্তু স্কুলে যাবি না। আমরা পালাবো। এর মধ্যে তোর বাপেরে বোঝানোর চেষ্টা করবো, আমি লোক পাঠাবো তোদের বাসায়। তোর কিচ্ছু বলতে হবে না। যা বলার বা করার আমিই করবো। যা এ্যাহন স্কুলে যা”। যেনো কিছুই হয়নি, এরকম ভাবে ফিট্টু ওকে স্কুল দেখিয়ে দিলেন। তারপর কী মনে করে বললেন, “চল আমি আগাইয়া দেই”। লতা তখন ভাবছেন, এই যে দেরি হলো, মান্নান স্যারের প্রথম ক্লাশে কী বলবেন? ধ্যুৎ কিছু একটা বললেই হবে, এতো উত্তেজনাতো ওর এই জীবনে আর আসেনি কখনও তাই না? মান্নান স্যার তার কী বুঝবে!
শুক্রবারের মধ্যে লতার জীবনে যেসব ঘটনা ঘটেছিল তার বিবরণ অতি দীর্ঘ, সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে যে, সময়টা খুব ভালো কাটেনি ওর। বিয়ের প্রস্তাব বেশ অনেকগুলোই এসেছিল লতার জন্য কিন্তু সেগুলো নিয়ে কোনোদিন ওকে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি কিন্তু ফিট্টুর বাড়ি থেকে যেদিন প্রস্তাব এলো তারপর দিন থেকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ, সব দোষ যেনো লতার, ও প্রশ্রয় না দিলে নিশ্চয়ই ফিট্টুর এতোটা সাহস হতো না? লতা কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। কান্নাও পায় না ওর। আসলে এতো দ্রুত জীবনে কতো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, ভাবলেও কেমন যেনো এলোমেলো লাগে সব। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ফিট্টুর সঙ্গে নদীর পারে সেইসব কথার স্মৃতি ওকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কোনোভাবেই মন থেকে তাড়াতে পারছিলেন না লতা। সেই বয়সটাই বুঝি অমন ছিল, পরে খুব ভেবেছেন সেই সময়টা নিয়ে, ফিট্টুকে নিয়ে, নদীর পার নিয়ে, লতা এখনও চোখ বন্ধ করলে বেগুন খেতে ধরে থাকা বেগুনগুলির রোঁয়া গুণতে পারেন, এতোটাই জাগ্রত সে স্মৃতি। এমনকি সেই শুক্রবার দুপুরে ইঁটখোলা গেইটের সামনে গিয়ে যখন এক কাপড়ে লতা দাঁড়িয়েছিলেন তখন দুপুরের রঙ কেমন ছিল সেকথাও মনে করতে পারেন। ফিট্টু একটা বেবিট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, ওরা তাতেই উঠে সোজা আদমজী জুট মিলের ভেতর দিয়ে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে ওপারে একটা বাসায় গিয়ে উঠেছিলেন। সে বাসায় ফিট্টুর ফুপাতো বোন থাকেন, দু’টো ফুটফুটে মেয়ে ওদের। দু’টো কামরার বাসা, একটু ঘিঞ্চিমতো জায়গাটা। লতাকে এনে বোনের সামনে দাঁড় করিয়ে ফিট্টু বলেছিলেন, “বুবু তোমাগো বউ আনছি, বিয়ার ব্যবস্থা করো”।
বিয়ার ব্যবস্থা করুম মানে? কারে আনছস? কোইত্থিকা আনছস? ওই মাইয়া তোমার নাম কি?
মহিলার গলার স্বরটা কেমন তীক্ষ্ণ ছিল, বাবা! লতার মনে পড়ে। তারপর যে ক’দিন ওই বাসায় ছিলেন সেই ক’দিন একটাও কথা বলেননি ভদ্রমহিলার সঙ্গে তিনি। মোট ক’দিন? চারদিন নাকি পাঁচদিন এখন মনে করতে গিয়ে হোঁচট খান লতা। ফিট্টু ওকে রেখে বাইরে চলে গিয়েছিলেন কোনো কাজে, বলে গিয়েছিলেন বাজার-টাজার করতে যাচ্ছেন। আর খানিক পরেই মিলের কাজ শেষে বাড়ি ফিরেছিলেন ফিট্টুর দুলাভাই। একমুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, ভদ্রলোক ওকে দেখে কোনো কথা না বলে পাশের রুমে গিয়ে বলেছিলেন, “তোমার ভাইরে কইবা, এই ঝামেলার মইদ্যে আমারে না ফেলতে। দেশের অবস্থা ভালো না। চারদিকে ধড়পাকড় চলছে। হাজার হাজার মাইনসে চাকরি যাবার ভয়ে অস্থির, আর এর মইদ্যে বিয়া লাগাই দিছে তোমার ভাইয়ে। অরে কও, বিয়া নিজে নিজে কইরা তারপর আসতে, আমার এইখানে যতোদিন ইচ্ছা থাকুক, অসুবিধা নাই কিন্তু আমি বিয়া দিবার পারবো না”। বাচ্চারা ততোক্ষণে লতাকে নিয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছিল, পাশের রুমে বসে লতা সব শুনছিলেন। ভেতরে ভেতরে কেঁপে কেঁপে উঠলেও বাচ্চাদের কিছুই বুঝতে দেননি। তারপর বাকি দিনগুলিতো রীতিমতো আতঙ্কের। ফিট্্টু এসে সেদিন রাতে জানিয়েছিলেন যে, কাল-পরশুই কাজি ডেকে বিয়ের ব্যবস্থা করবেন ততোক্ষণ এই বাসায় থাকতে, আর ও নিজে অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে নিচ্ছে। কিন্তু ফিট্টুর দুলাভাই-ই খবর এনেছিলেন যে, লতা এখনও নাবালিকা, ওদের বিয়ে পড়ানো মুস্কিল হবে, এই সামরিক আইনের সময়ে কোনো কাজি ওদের বিয়ে পড়াবে না। এরপর ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। এক সন্ধ্যায় ওর বাবা আরো কয়েকজন মানুষ নিয়ে এসে লতাকে নিয়ে গিয়েছিলেন এই বাসা থেকে। ফিরিয়ে এনে ওর ওপর যে নির্যাতনটা চালানো হয়েছিল তার চেয়ে ওর মরে যাওয়া ঢের ভালো ছিল। শরীরে বিশেষ করে পিঠের ওপর সেসব মারের দাগ এখনও খুঁজলে দু’একটা পাওয়া যাবে। কিন্তু সেসব মারের দাগ ছাপিয়ে ওর জীবনের ওপর যে দাগ ও এই চার/পাঁচ দিনের কারণে বহন করছে গত পয়ত্রিশ বছর যাবত, তা কেবল মানুষের পক্ষেই সম্ভব, অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষেও সেটা সম্ভব ছিল না।
আজকে হঠাৎ এ্যাকুয়ারিয়ামের ভেতর লেজ খাওয়া কৈ মাছটার সঙ্গে নিজেকে লতা পুরোপুরি মিলিয়ে ফেলতে পারলেন যেন। তাহলে কি লতার স্বামী, ইমারত হোসেন ওই কচ্ছপটা? তাইতো। লতা ফিরে যান সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলির কাছে। মার খেয়ে দিনরাত অচেতন থাকেন তখন লতা। স্টাফ কোয়ার্টারের অনেকেই ওকে দেখতে আসে, এটা ওটা বলে। লতার মা কুউক পেড়ে কাঁদেন দিনরাত। মেয়ের বিয়ে হবে না, এটাই মূল কথা। কিন্তু না, ইমারত হোসেন এসেছিলেন দেবদূত হয়ে, অন্ততঃ সকলের কাছে ইমারত সাহেব তাই হয়ে উঠেছিলেন তখন, যখন তিনি লতাকে এক কাপড়েই বিয়ে করে বউ হিসেবে তুলে এনেছিলেন তার রামপুরার বাসায়। টিভি সেন্টারের পেছনে তখন আক্ষরিক অর্থে বস্তিই ছিল, মাঝে মাঝে দু’একটা দো’তলা বা একতলা বাড়ি। এরকমই একটি বাড়িতে এনে তুলেছিলেন ইমারত লতাকে। কিন্তু ওঠানোর আগে ইমারত লতার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন যে, তিনি কখনও লতার সদ্য করা ভুলের জন্য কষ্ট দেবেন না, এরকমতো হতেই পারে, এটা বয়সের দোষ। ওই ফোলা মুখ, ফোলা শরীর নিয়ে ব্যাথায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে লতা একটি গাড়িতে করে স্টাফ কোয়ার্টার ছেড়েছিলেন একটু রাত করেই, কেউ যদি দেখে ফেলে আবার ভাঙানি দেয়, সে ভয়েই কিনা কে জানে এই সতর্ক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন লতার ওভারশিয়ার বাবা। গাড়িতে ওঠার পর ইঁটখোলা গেইট দিয়ে যখন গাড়িটা বেরুচ্ছে তখন লতার বুকের ভেতরটা হুঁ হুঁ করে উঠেছিল, ভয়ে নয়, ভীতিতে নয়, নয় কোনো অজানা আশঙ্কায়ও, লতার মনে তখন নদীর পারে টমেটো খেতের ভেতর দেখা একটা অচেনা পাখির কথা মনে হয়েছিল। খুব নাটকীয় কিংবা গল্প-উপন্যাসের মতো শোনালেও লতার সত্যিই সেই পাখিটার কথা মনে পড়ছিল খুউব। পাশে তখন ইমারত হোসেন, সামনের সীটে তার বন্ধু আব্দুর রউফ কিন্তু নিজেই নিজের নাম বলেন, আব্দুর রব, পরে লতা দেখেছেন লেখার সময় ভদ্রলোক ঠিকই নাম লেখেন, আব্দুর রউফ।
কিন্তু লতা পরে যে সত্য আবিষ্কার করেছিলেন তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর ও সেই ভয়ঙ্করের ভেতরই ওকে নতুন একটা জীবন শুরু করতে হয়েছিল। ওর বাবা-মা, এমনকি গোটা স্টাফ কোয়ার্টারের মানুষের কাছে ফেরেশতা হিসেবে আসা ইমারত আসলে ছিলেন একজন আদম বেপারী। তখন মধ্যপ্রাচ্যে লোক পাঠানো সবে শুরু হয়েছে। সামরিক শাসকের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির তখন রমরমা সম্পর্ক। শ্রমিক যাচ্ছে দেদারছে সেখানে। ইমারতের লাইসেন্স ছিল না, ছিল আব্দুর রউফের, কিন্তু ইমারতের ছিল ব্যবসায়ী চোখ, কোত্থেকে লোক জোগাড় করে দু’জনে মিলে রমরমা ব্যাবসা ফেঁদে বসেছিলেন। বিয়ে করে নিয়ে এসেই এক অদ্ভ’ত কথা বলেছিলেন সে রাতে ইমারত লতাকে। বলেছিলেন, “শোনো তোমার সঙ্গে আমার আগামি এক মাস কোনো সহবাস হবে না। পরবর্তী মাসে তোমার মাসিক হওয়ার পর আমি তোমার সঙ্গে শুব। তুমি কি করছো না করছো আমি জানি না, জানবার চাই না। শুধু দেখতে চাই যে, তোমার পেটে কারো সন্তান নাই”। লতার তখনও সন্তান হওয়া কিংবা সন্তান ধারণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তেমন কোনো জ্ঞান হয়নি, ভাসা ভাসা যা জানতেন তা নিয়ে এক অদ্ভূত সংকটে পড়লেন তিনি ইমারত হোসেনের এই কথায়। কিন্তু তারপর দিন রাতেই দৃশ্যপট বদলে গেলো। ঘুমের ঘোরে টের পেলেন এক অশুরিক শক্তির, তাকে উল্টো করে শুইয়ে পিঠের ওপর চেপে বসেছে আর কোমরের নীচে কেউ যেনো অনবরত ছুরি মেরে চলেছে তাকে। চিৎকার করবেন সে জো নেই, মুখটা বন্ধ করা একটা হাত দিয়ে। গলার আওয়াজ না শুনলে বুঝতেই পারতেন না যে, ওর পিঠের ওপর কোনো জন্তু কিংবা জানোয়ার নয়, চেপে বসে আছেন ইমারত হোসেন আর বলে চলছেন, “এটাই তোর শাস্তি, আমার পছন্দ করা মাইয়া হইয়া তুই গেছস আরেক নাঙের কাছে। তোর জীবনে আমি শান্তি ভইরা দিব, তুই খালি দ্যাখ”। একেকটি বাক্য শেষে একেকটি ধাক্কা, লতার মাথার ভেতর অন্ধকার করে আসে, লতা জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরলে দেখেন বিছানা ভিজে গেছে রক্তে, কিন্তু এই রক্ত মাসিকের রাস্তার রক্ত নয়। কতোদিন যে ঠিকমতো তিনি পায়খানা যেতে পারেননি তার ঠিক নেই। কিন্তু কী করবেন? কী করার ছিল তার? সবার কাছেতো ইমারত হোসেন ফেরেশতার মতো মানুষ, না হলে কি আর ওর মতো পর পুরুষের সঙ্গে তিন/চার দিন কাটিয়ে আসা কোনো মেয়েকে কেউ বিয়ে করে? বাজারে কি মেয়ের অভাব পড়েছে? বাকি জীবনে যতোবার বাবা-মায়ের বাড়িতে গেছেন লতা প্রতিবার তাকে এই কথা শুনতে হয়েছে, এমনকি স্টাফ কোয়ার্টারের প্রতিবেশিরাও ওকে একথা শুনিয়েছে। ওর প্রথম সন্তানকে আদর করতে গিয়ে বলেছে, দ্বিতীয় সন্তানকে আদর করতে গিয়ে বলেছে, এখনও বলে, এখনও, মানে এই প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সেও। এখনও শুনতে হয় সেই বাক্য যা পয়ত্রিশ বছর আগেও শুনতে হয়েছিল, “ভালো লোকটার হাতে পড়ছিলি দেইখ্যা, নাইলেতো কুত্তায়ও ফিরা তাকাইতো না তোর দিক। পলাইয়া গেছিলি একজনের লগে, হ্যায় ছেইন্যা-ছুইন্যা ছাইড়া দিছে, আর কেউ তারে নেয়? ইমারত সাহেবের মতো লোক এই জামানায় আর দেখন যায়? যায় না। শইল্লের চামড়া দিয়া তার পায়ের জুতা বানাইয়া দিলেও তার ঋণ শোধ হইবো না, বুঝলি?” এমনকি তার ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত জানে যে, মা’কে বাবা প্রচ- ভালোবাসে আর সে জন্যই মা’র জীবনের অনেক বড় বড় ভুল বাবা ক্ষমা করে দিয়েছেন। শুধু লতা জানেন, ক্লাশ নাইনে পড়া লতার সে ভুলের জন্য কোনোদিন তিনি মাফ পান নাই। নিজের চামড়া দিয়ে লতা হয়তো ইমারতের পায়ের জুতো বানিয়ে দেননি, কিন্তু তিনি যা করেছেন তা ওই লেজ খাওয়া কৈ মাছটার চেয়ে কম কিছু নয়।
আজও যখন ঘর থেকে বেরুচ্ছেন, ডাক্তারের কাছে যাবেন, লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে তাকালেন এ্যাকুয়ারিয়ামটার দিকে। দেখেন কৈ মাছটা মরে পড়ে আছে। প্রায় অর্ধেকটা শরীর নেই ওর, কাছিমটা মহা আনন্দে পুরো এ্যাকুয়ারিয়াম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর বেচারা কৈ মাছের শরীরটা প্রায় পঁচে গেছে, অর্ধেক শরীর গেলে আর কিছু বাকি থাকে কিনা পঁচার জন্য সেটাও ভাবেন লতা। ভাবেন সামনের ফ্ল্যাটের ভাবিকে ডেকে বলবেন কৈ মাছের কথাটা। কিন্তু তিনি আর দাঁড়াতে পারেন না, কী হবে? মরেইতো গেছে। কৈ মাছের প্রাণ বলে যে বাক্য সারাজীবন শুনেছে, নিজের ভেতরেও তার শক্ত অবস্থান টের পান তিনি। গত তিন দিন ধরে তিনি দেখছেন এই কৈ মাছটাকে, কাছিমটা ওর পেছন পেছন দৌঁড়ে একটু একটু করে লেজ খেয়েছে, তারপর খেয়েছে শরীরটার কিছু অংশ, টিকতে না পেরে মারা গেছে মাছটা, লতা ইচ্ছে করলে বলতে পারতেন, বেল দিয়ে জানাতে পারতেন ব্যাপারটা, কিন্তু জানাননি। কেন? নিজেকে জিজ্ঞেস করলে, ভেতর থেকে কোনো উত্তর আসে না। একটু মুচকি হাসি বেরুলো কি? লিফটের চকচকে দরোজায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখার চেষ্টা করেন, তার আগেই দরোজা খুলে যায়। তিনি উঠে পড়েন, নীচে ড্রাইভার গাড়িটা দাঁড় করিয়ে রেখে থাকবে একেবারেই সামনে। কিন্তু ওদের লিফটটা বেশ ধীরে চলে। লতা ভাবতে থাকেন কৈ মাছটার কথা, কাছিমটার কথা এবং নিজের কথাও, এমনকি ইমারত হোসেনের কথাও। একবার মনে হয়, ওর ছেলেমেয়ে দু’টোকে একদিন বসিয়ে বলেন, “শোনো তোমরা, তোমাদের বাবা একটা পশু, পশুর চেয়েও ভয়ঙ্কর। আমাকে বিয়ে করে এনেছিলেন দয়া করে, ভালোবেসে নয়, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। আর গত পয়ত্রিশটা বছর ধরে আমার ওপর যে অত্যাচার তোমাদের বাবা করেছেন তার বর্ণনা আমি দিতে পারবো না। শুধু এইটুকু শোনো, তোমার বাবা আমার সামনে পাশের ঘরে কাজের মানুষের সঙ্গে শুয়েছে, আমাকে বিয়ে করেছেন বলে আমার ছোট বোনটাকেও বাসায় এনে তাকে ধর্ষণ করেছে, আমি চিৎকার করেছি পাশের রুমে, কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। পরে সবাই শুনেছে একথা, কিন্তু কেউ কিছুই বলেনি, বলতে পারেনি কারণ আমাকে তোমাদের বাবা দয়া করেছিলেন”। লতা ভাবেন, এইটুকুন বলেই বলবেন, গত তিন দিন ধরে দেখা কচ্ছপ আর কৈ মাছের ঘটনাটি। বলবেন যে, “আমি হলাম গিয়ে ওই কৈ মাছ, আর তোমাদের বাবা হোলো গিয়ে ওই কাছিমটা, আমার সমস্ত শরীর খেয়ে ফেলেছে তোমাদের বাবা, এখন শুধু প্রাণটা আছে, আর কিছুই নেই। বিশ্বাস না হয়, তোমাদের বাবাকে জিজ্ঞেস করো গিয়ে”।
লিফট্ ততোক্ষণে পৌঁছে গেছে নীচে। ছয়তলা থেকে নামতে এতো সময় লাগে! দরোজা খুলছে, যথারীতি গাড়িটা দাঁড়ানো। লতা ভাবেন, এইমাত্র লিফটে নামতে নামতে তিনি যেসব ভাবলেন, সেসব ছেলেমেয়েকে বললে, ওরা বিশ্বাস করবেতো? নাকি ওরা ভাববে মা পাগল হয়ে গেছেন? মেয়েটার কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে, ছেলেটা বাংলালিংকে চাকরি করে, ওর জন্যও মেয়ে দেখার সময় হয়েছে, এখন, এই বয়সে ওরা কি বাবার বিরুদ্ধে কোনো কথা শুনতে চাইবে? লতা ভাবতে থাকেন, গাড়ি চলছে, ডাক্তারের চেম্বারের দিকে, কিছুদিন যাবত শরীরটা ঠিক ভালো যাচ্ছে না লতার। প্রায়ই থোকা থোকা রক্ত যাচ্ছে পায়খানার রাস্তা দিয়ে। ব্যাথাও প্রচণ্ড, রাতে জ্বর হয়। কিন্তু লতা এসব কাউকে বলেন না, নিজেকে সামলে নিয়েছেন, সরিয়ে নিয়েছেন সবকিছু থেকে। চুপচাপ থাকেন, সংসারের সবার প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখেন। লতা থাকেন লতার মতো, কোনো গাছের পক্ষেই তার ওজন বইতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কেবল মাঝে মাঝে তার মনে পড়ে সেই নদীটার কথা, সেই টমেটো-বেগুন-মুলো-আলু খেতের কথা, পাখিটার কথাও, পানি কি আরো দূরে সরে গেছে? আর যাওয়া হয়নি কোনোদিন সেখানে। লতা সিদ্ধান্ত নেন, একদিন যাবেন সেখানে, কাউকে না জানিয়েই। মনে মনে ভাবেন, এখন কী মাস? নয় বৈশাখেই যাবেন, কৈ মাছ নাকি মেঘ ডাকলে তখন কানকো দিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেক দূর অবধি যেতে পারে। লতা হেসে ফেলেন, নিজেকে তিনি তাহলে কৈ মাছই ভাবতে শুরু করেছেন? বাহ্, বেশতো, ভাবতে কিন্তু একটুও খারাপ লাগছে না ওর।
