বিল্ডার্সকে যখন বাড়িটা বানানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো, ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিজে করবে বলেই কাউকে ডাকেনি। মনমতো করে সাজিয়েছিলো সব স্বপ্ন। বাস্তবতায়। এতোগুলো বছর অবশ্য তেমন কোন বৈষয়িক আশয়-বিষয় ভাবায়ওনি। একা জীবনে একাকী অনেক ক’টা বসন্ত পেরিয়ে যাচ্ছিলো, বাকী বসন্ত কিংবা শীতও তেমন হওয়ার কথা ছিলো। কিংবা ছিলোনা বলেই…
একেকটা ঘরের আদল ভিন্ন। রঙ ভিন্ন। নামও। খুব যত্ন করে একটু একটু সুখ জড়ো করে…
মায়াঘর,অসহ্য আরাম, ক্ষুন্নিবৃত্তি—
স্টাডি রুম তার … শব্দক্রন্দন।
প্রিয় স্নান ঘর। ময়ূরপংখী নাওয়ের মতো বাথ টাব। নাম- জল প্রণয়।
আজ শেষবারের মতো এ বাড়ির স্নানঘরে। প্রিয় ল্যাভেন্ডার সৌরভে মোম জ্বালালো চারিদিকে। পদ্মফুলের মতো বসে থাকলো সে। স্থির।
রূপোলি ফিতের মতো দৃশ্য একে একে ভেসে উঠছে পর্দায়…
মোমের আগুনের ওপর হাত রাখলো।
‘আগুনে পুড়ে সোনা খাঁটি হয়’ — কোথা থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বাবা!
কোন আগুন সে ! দৃশ্যমান নাকি অদৃশ্য?
দোলনায় দোল দিতে দিতে এক দৌড়ে কখন যে পালালো মা… কোথায় সে কোন কালে!
বাবা আর বিয়ে করেন নি। মায়ের স্মৃতি আর তাকে বুকে জড়িয়ে বেয়ে গেছেন জীবন তরী।
একটু যখন বড়, বন্ধু বাবা বলতেন,
‘কখনো কারো কাছে প্রত্যাশা করো না কিছু। প্রত্যাশার আর পাওনার পারদ এক না হলেই ঠোকাঠুকি। বিলিয়ে দেবে। ত্যাগী হবে’ …
সেই কোন ছোটবেলায় পুতুলের ঘরে হরেক রকম পুতুল। দিন কেটে যেতো মাতৃহীন। খেলতে আসা সাথী যদি পছন্দ করতো কোন একটা, দিয়ে দিতো তাকে। মনে হতো ওটা ওর প্রাপ্য।
ছুঁয়ে দেয়া পুতুল দিয়ে আর খেলতো না।
পড়াশুনা বইখাতা আর বাবা। একদিন বাবার হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে, হাত ছেড়ে বাবা প্রবেশ করিয়ে দেন একাকী জীবনপথে।
বাবার হাত আর ধরা হয়!
বরাবরের মতোই মেধাবী ফলাফল অব্যাহত বিশ্ববিদ্যালয়েও। ‘ক’ এর সাথে যোগাযোগটাও এই কারণে গড়ে ওঠে। পড়াশুনার নোট আদান প্রদানের এক পর্যায়ে মনের আদান প্রদানও। সে মাস্টার্স ফাইনালে। বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাই খুব খুশীই হোন একটি আপাত সফল মিলনের আভাস পেয়ে…
মোমগুলো গলতে শুরু করেছে… আলো আঁধারিতে উঠে আসা সেই ফেলে আসা দশ বছর আগের এক সন্ধ্যা— ‘ক’য়ের হোস্টেলের রুম।
— ‘ তুমি ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করবে আর কিছুদিন পরেই। নিজ যোগ্যতায়ই তো স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশে যেতে পারবে। কেন এখন বিদেশে যেতে চাইছো? আমার শেষ হতে আরো দু’বছর বাকি।”
নিরুত্তর ‘ক’।
প্রহর পেরিয়ে যায় নাকি থমকে থাকে!
‘ক’ বের করে হাতে দেয় বিয়ের কার্ড।
—‘অনেকবার বলতে চেয়েও আটকে গেছি। মেয়েটি নাগরিক ওদেশের। আর…”
—‘আর?’
—- ”আর… আমি ভালোবেসে ফেলেছি।”
দরোজাটা আস্তে ভেজিয়ে রিকশায় চড়ে বসে। বাইরে দস্যুর মতো বৃষ্টি। বৃষ্টির জল চোখের জলকে একাকার করে দিচ্ছে। মনে ভাসছে পুতুল ঘর…
ছুঁয়ে দেয়া পুতুল …
ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরে বাবার বুকে আছড়ে পড়ে হু হু কান্না…
মোমগুলো গলতে গলতে প্রায় নিভু নিভু…
স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশে পাড়ি। আবার বাবার হাত ছেড়ে দেয়া… বিমানবন্দরের কাচের দেয়ালের ওপাশে পড়ে থাকে এক পশলা জীবন।
পড়াশুনা ল্যাব এর যান্ত্রিক জীবনের ফাঁকে নেটে বসে। পড়ে কতো লেখা। একজনের লেখার ভক্ত হয়ে ওঠে। ইটের পর ইট সাজিয়ে দালানের নকশা … আর অন্যদিকে শব্দের পর শব্দ। রোপিত হয় যৌথ স্বপ্ন প্রজেক্ট।
এভাবেই হয়? নাকি হয়ে যায়! কবর চাপা বাসনাদের কলমের ছেনি শাবল অক্ষর দিয়ে ছিঁড়ে খুড়ে বাইরে বের করে আনে সে কোন অসীম ভালোবাসার পরশ!
মিলতে থাকে, মিলে যেতে থাকে …
মহাখুশি বাবা।
‘খ’ এর সাথে বিয়ে হয়ে যায়। আবার বিদেশে পাড়ি। কাগজপত্র প্রসেস হতে থাকে আর এদিকে স্বপ্নের জাল বোনা।
এক সাথে গৃহ প্রবেশ। একদিন।
–”বাড়িটা তুমি আমাকে কেন দিলে? আমি আলাভোলা মানুষ।”
—” তুমি আলাভোলা দেখেইতো এতো প্রেম। তুমি প্রতিদিন একটা করে কবিতা লিখে আমার বালিশের নীচে রাখবে। আমি ঘুম থেকে উঠে পড়বো।”
—”আর কিছু?”
—”আর কিছু কি?”
—”কামনার অগ্নি তুমি। এতগুলো বসন্ত একা কাটালে কী করে!”
—”তুমি যেভাবে। ভালোবাসার কাছে বিশ্বস্ত থেকে। তুমিও কখনো অবিশ্বস্ত হয়োনা। আর হলে আগে থেকে জানিয়ো।”
কোথাও কী ধাক্কা লাগে! ‘খ’ কেমন অন্যমনস্ক। সারাদিন পর অফিস করে ফিরে এসে স্টাডিরুমে ঢুকে দেখে, নেটে। বেরুবার সময়, চা খেতে ডাকলে, বা রাতে…
টেবিলে খোলা একটা খাম। চিঠি।
অস্বস্তি হয় ধরতে। তবুও…
” কবে আমাকে নিয়ে যাবে তোমার কাছে? আর যে পারছিনা।”
সম্বিত ফিরে আসে হাতে গরম মোমের ছ্যাঁকা খেয়ে। ‘জল প্রণয়’ থেকে বের হয়ে আসে সে।
যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ির সদর দরোজা সশব্দে বন্ধ করে বের হয়ে আসে ‘পরাণপুর’ থেকে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। জীবন ইতিহাসেরও?
সবই কি ছুঁয়ে দেয়া পুতুল!
ভেসে ওঠে বাবার মুখ…
—”কোন আগুন পোড়ালে কতটুকু পোড়ালে খাঁটি হওয়া যায়, বাবা?”
তুষার ধবল চারিদিক। চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করছে।
দূর থেকে ভেসে আসে আনমনা একাকী পথিকের আনন্দ সংগীত।
বুক ভরে শ্বাস নেয়।
