দশহরায় গঙ্গাপুজো
বিভূতিভূষণের আম আঁটির ভেঁপুতেও আছে দশহরা পুজোর কথা। “কাল দশহরা, লোকে আজ হইতেই মুড়কি সন্দেশ কিনিয়া রাখিবে” অথবা “সেজ–বৌ একখানা মাজা পিতলের সরায় করিয়া চিনিবাসের নিকট হইতে মুড়কি, সন্দেশ, বাতাসা দশহরা পূজার জন্য লইলেন“
চিনিবাস ময়রার কাছে দশহরা উপলক্ষে এসব মিষ্টি পাওয়া যাবে ভেবে উল্লসিত হয়েছিল দুর্গা এবং অপু। সেই সামান্য মিষ্টির জন্য তাদের মনের অসামান্য হাহাকার আবারও মনে করিয়ে দিল বাঙালীর এই উল্লেখযোগ্য তিথি কে।
জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লপক্ষে অরণ্যষষ্ঠীর পাঁচদিনের মাথায় যে শুক্লাদশমী তিথি সেদিনেই একত্রে দশহরা গঙ্গা ও মনসা পূজা র কথা লেখা দেখে আসছি বাংলা ক্যালেন্ডারে। আমার ঠাকুমা কে ঐদিন গঙ্গাস্নান করে মা গঙ্গাকে পুজো দিতেও দেখেছি।
দশহরা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকেও।
দশ + অহ = দশারহ = দশহরা। ‘অহ’ শব্দের অর্থ দিন। মা দুর্গার মহিষাসুর বধের বিজয়োত্সব কে সারা ভারতবর্ষে দশহারা বা দশেরা বলে। বাঙালীদের বিজয়া দশমী বা দশেরা হল দেবীপক্ষের দশম দিন বা নবরাত্রির দশম দিন। এই দিন লঙ্কায় দশানন রাবণকে হারিয়ে রাম যুদ্ধ জয় করে সীতা উদ্ধার করেছিলেন।স্থানীয় ভাষায় দশহরা শব্দের অর্থও তা–ই। দশ মানে এখানে দশানন রাবণ, আর হরা মানে হার। তবে জৈষ্ঠ্যমাসের এই শুক্লা দশমীর দশহারাও কিন্তু আমাদের বিজয়া দশমীও বটে কারণ দুর্গার মহিষাসুর বধের কথা শুম্ভ ও নিশুম্ভ জানতে পারলে তারা দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে বিন্ধ্যাচলে যায়। সেখানে দেবী বিন্ধ্যবাসিনী তাদের বধ করেন। যোগমায়া বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গা নাকি মহিষাসুর বধের পর দুর্গার তেজ থেকে আবির্ভূতা হয়েছিলেন এই পর্বত শিখরেই।
স্কন্দপুরাণ অনুসারে এই বিন্ধ্যবাসিনী দেবী দুর্গাসুরকেও বধ করেন। অতএব অরণ্য ষষ্ঠীর দিনে বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গার পুজোর পরে এই দশহরার তাৎপর্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
আবার শাস্ত্রমতে দশহরা তিথি পূর্ব দশজন্মের কৃত পাপ এবং এ জন্মের দশটি পাপ হরণ করে। গঙ্গাপুজোর সঙ্গে ঐদিন মনসামঙ্গলের গান করার রীতি। ঐদিন প্রধান ধর্মীয় কর্ম হল গঙ্গাস্নান এবং দশ ফুল, দশ ফল এবং দশ প্রদীপ জ্বালিয়ে গঙ্গার পুজো। দশহরার গঙ্গাস্নানে দশ জন্মের অর্জন করা সব পাপ ক্ষয় হয় আর অযুত অশ্বমেধ যজ্ঞের যে ফল তা লাভ করা যায়। এই যোগ ভগীরথ দশহরা নামে পরিচিত।
স্মার্ত মতে, জ্যৈষ্ঠের শুক্লা দশমীতে গঙ্গাস্নানে দশবিধ পাপের মুক্তি ঘটে। আর পুরাণ মতে, ওই দিনই নাকি ভগীরথ মহাদেবের জটাবন্দী গঙ্গাকে মর্ত্যে আনয়ন করেন। তাই ওই দিন তিনি আরাধ্যা দেবী। আমাদের কৃষি প্রধান দেশে কৃষি–সহ সভ্যতার নানা প্রয়োজনে মানুষ প্রবহমান জলধারাকে খাল কেটে নিয়ে আসে লোকালয়ে। এই কাহিনীর পৌরাণিক খোলসটি ছাড়ালে বর্ষার প্রাক্কালে দশহরার এই তাৎপর্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রমাণ হয়, নদীর সঙ্গে মানুষের এই অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আসলে প্রয়োজনের কারণেই। তাই বুঝি দশহরায় গঙ্গা পুজোর চল।
আবার জলজঙ্গল পরিবেষ্টিত রাঢ়বঙ্গের জনপ্রিয় লৌকিক দেবী মনসা একাধারে সর্পদেবী অন্যদিকে সন্তানসন্ততিরও বা সৌভাগ্যকামনারও। মনসামঙ্গল অনুযায়ী তিনি শিবের মানসকন্যা আর নাগরাজ বাসুকীর ভগিনী। বছরের নানা সময়ে বিভিন্ন স্থানে মনসাপুজোর চল হলেও জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লা দশমীতে দশহরার দিন বছরের প্রথম স্নানযাত্রা শুরু হয় মা মনসার ।
বর্ষার আগেই সর্পকুলের বাড়বাড়ন্ত হয় সেদিন থেকেই। তাই দশহরার দিনে মা মনসার পুজো করে তাঁকে তুষ্ট রাখা হয়। তবে আর পাঁচটি ব্রতের মতোই আত্মকল্যাণের সঙ্গে পারিবারিক কল্যাণেই এই পুজো।
বাংলায় সেন রাজাদের শাসনকালে গঙ্গা তীরবর্তী রাজধানী নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাট সেসময়ের আর্থ–সামাজিক ও ধর্মীয় মেলবন্ধনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। সেন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দশহরা তিথিতে সাড়ম্বরে গঙ্গা পুজো হত নবদ্বীপে। বড় বড় বাণিজ্যতরী নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বণিকেরা আসতেন। মা গঙ্গার মূর্তির পুজো হতো তাঁদের নৌকাতেই। ঘাটের ধারে ভোর থেকে বসত জমজমাট মেলা। সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলত দান–ধ্যান, ভুরিভোজ। সেন রাজারা উপস্থিত থাকতেন সেই মেলায়। বণিকেরা তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। পরস্পরের মধ্যে মত বিনিময় করতেন। ইতিহাসবিদরা জানান, আরও অনেক কিছুর মতো সেন রাজাদের আমলেই দশহরা তিথিতে দেশের প্রধান জলবাণিজ্য পথ গঙ্গা নদীর পুজো শুরু হয়েছিল। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেবের মতে, শঙ্করাচার্য গঙ্গাস্তোত্র রচনা করলেও গঙ্গাকে দেবী হিসেবে পুজো শুরু হয়েছিল সেন রাজাদের আমলেই। ফলে নবদ্বীপের ঘাটে গঙ্গাপুজোর ইতিহাস বহু প্রাচীন। পরবর্তী কালে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর নবদ্বীপ হয়ে উঠল গৌরগঙ্গার দেশ। তখনও গঙ্গাপুজোর রমরমা কিছুমাত্র কমেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন সেই উৎসবের জৌলুস আর তেমন নেই। তবু পুরনো রীতি মেনে এখনও নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, ঘূর্ণি, গোয়ারি প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষেরা নৌকা করে গঙ্গামূর্তি নিয়ে নবদ্বীপের রানির ঘাট, পোড়াঘাট–সহ বিভিন্ন ঘাটে আসেন। ঘাটেই পুজো–হোম হয়। বিতরণ হয় প্রসাদ। নদীর পারে মেলাও বসে। এ দিন গঙ্গায় স্নানও করেন বহু মানুষ।
(নবদ্বীপের গঙ্গা পুজোঃ তথ্যসূত্র – আনন্দবাজার পত্রিকা)

উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।
পূজায় প্রেম।
অসাধারণ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। ভালো লাগলো। আপনি ভালো থাকবেন।