| 10 মার্চ 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: উপহার । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

মৈনাক খুব বিপদে পড়ে গেল। অনেক পথ হেঁটে আসার পর সে রাস্তা চিনতে পারছে না। যখন সে বেরোল মা  রাস্তার হদিস দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সে গ্রাহ্য করে নি।  সে যাবে তার এক দুঃসম্পর্কীয় মামার বাড়ি। একটা কাজের সন্ধানে।

মৈনাক কাজের ছেলে। সে সব কিছুই   সারাতে পারে  কিন্তু দু;খের ব্যাপার তাকে কেউ কাজ দেয় না। কারণ সে কাজ যতটা জানে তার চেয়ে বেশী কাজে গোলমাল করে ফ্যালে । ছোটবেলা থেকে সে যত কাজ করেছে সব কাজই ভন্ডুল হয়ে গেছে।

গত পাঁচবছরে সে বাড়ির দশটা টিউলাইট ঘরে সেট করতে গিয়ে ভেঙেছে। দুখানা  রেডীও আর একটা টিভি তার জন্য খারাপ হয়েছে।  

দাদা কৌস্তভ তাকে সামাল দিত এতদিনে। পাড়াঘরেও মৈনাকের কাজের কম নমুনা নেই। পাড়ার সমুদ্রবাবু খুব নামকরা গায়ক। এখানে ওখানে তিনি গান করতে যান। কদিন আগে তিনি একটা মুস্কিলে পড়েছিলেন। তাঁর হারমোনিয়ামের একটা রিড খুলে গেছে। গাইতে গেলেই একটা বিদঘুটে আওয়াজ হচ্ছে। একদিন বাজারে গিয়ে সেই দু;খের বলছিলেন সমুদ্রবাবু। সেসময়ে বাজারে  মৈনাকও বাজারে উপস্থিত। সে উপযাচক হয়ে  বলল, কিছু যদি না মনে করেন আমি কাজটা করতে পারি।

সমুদ্রবাবু তেমন চেনেন না মৈনাককে। তিনি হিসেবী মানুষ। তিনি বললেন,- তা করবে? আমি কিন্তু বেশী টাকা দিতে পারব না।

-টাকার কথা ভাববেন না।

  কাজ করেছিল বটে মৈনাক! হারমোনিয়ামটা দেখে দুচারবার এদিকওদিক চাপড়া মারার পর বলেছিল,- বুঝলেন কাকু। আগে পুরো খুলতে হবে। তারপর ভাল করে সেট করতে হবে।

সমুদ্রবাবু মাথা নেড়ে বলেছিল, তোমার যা মনে হয় কর। টাকা কিন্তু বেশী দিতে পারব না।

সারাদিন ধরে বসে বসে মৈনাক সারিয়েছিল। সারানোর পর দেখা গেল হারমোনিয়ামের বয়স আরো বেড়ে গেছে। তার চার-চারটে  রিড খুলে গেছে। তাকে দাঁতফোকলা লাগছে।  সে রিড় গুলো  আর জোড়া লাগাতে পারল না।আর দুটো রিড কোথায় হারিয়ে ফেলল কে জানে।

ভাইয়ের হয়ে সেদিন ক্ষমা চেয়ে  কৌস্তভ ম্যানেজ করেছিল।

কিন্তু এবার মৈনাক আরো গোলমাল করেছে। কিছুদিন আগে  কৌস্তভ একটা মোবাইল কিনেছে। ফাঁকবুঝে মৈনাক মোবাইল হাতে নিয়ে দেখতে শুরু করেছিল। দেখার সময় তার কোন হুঁশ থাকে না। মোবাইলের ভেতরে কি আছে? কেমন করে তা কাজ করে তা দেখার জন্য সব খুলে ফেলেছিল। খুলে ফেলাই বিপদ হল তার। সে আর জুড়তে পারল না।

 তারপর বাড়িতে প্রবল ঝগড়াঝাটি। চিৎকার-হট্টগোল। মা শেষপর্যন্ত বললেন, মামার বাড়ি চলে যেতে। সেখানে যে কোনও কাজ সে জুটিয়ে নিতে পারবে।

 

মৈনাক তাই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছে। মামার নাম তার মনে আছে। কিন্তু অঞ্চল মনে নেই। ষ্টেশন থেকে সে হাঁটতে শুরু করল।  কিছদুর যাবার পর তার জল তেষ্টা পেল। সে একটা সুন্দর ছিমছাম বাড়ির  সামনে দাঁড়াল। বাড়ির মধ্যে শুধু একজন বুড়ো লোক বসে আছেন। আর কেউ নেই চারপাশে।সে জিজ্ঞেস করল,- জল পাওয়া যাবে?

বুড়ো লোকটা  বললেন, জল? হু! আছে। ওই যে।

মৈনাক  জলের বোতল দেখল। তারপর এক নিঃশ্বাসে জল পান করল।

  বুড়ো লোকটা বললেন,- তুমি ভায়া কোত্থেকে আসছ? একটা লোকের খোঁজ দিতে পারবে?

মৈনাক থতমত খেয়ে গেল। সে  নিজেই এখানে অচেনা। সে কাকে চিনবে? সে তবু কৌতুহলে বলল,- কাকে খুঁজছেন আপনি?

 -একজন গ্যাস-সারাইওলাকে। কাল থেকে উপোস করে ভায়া। রান্না করতে পারছি না।

 -গ্যাস শেষ হয়ে গেছে বুঝি?

-উহু। গ্যাসওভেনে গোলমাল হয়েছে। ওইজন্য গ্যাস জ্বালাতে পারছি না।

মৈনাক বেরোতে যাচ্ছিল। গ্যাস ওভেন খারাপ শুনে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে রান্নাঘরের দিকে তাকাল। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে গ্যাস-ওভেন সারাতে। কিন্তু বিদেশ-বিভূই। সে যদি না সারাতে পারে তাহলে খুব মুসকিল। কিন্তু কিছুক্ষন পর সে নিজেকে সামলাতে পারল না। সে বলল,- আমি একটু সারাবার চেষ্টা করব?

-করবে? তা বেশ তো।

মৈনাক ব্যাগ রেখে কাজে নেমে পড়ল। সে মাটিতে বসল। সে  গ্যাস ওভেনের পাইপ খুলতে যাচ্ছিল।  বুড়োলোকটা পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,-উহু। ওটা নয়। এদিকটা দ্যাখো।

 দাদাও তাকে এমন বাধা দেয়। সে গ্রাহ্য করে না। কিন্তু এ বুড়োলোকটা এখানকার । একটু শ্বাস ফেলে সে বুড়োলোকটার কথাই শুনল। সে বলল,- কোনটা?

-এদিকটা।

মৈনাক তাই করল।  সে আবার হ্যাচকা টানে  একটা কিছু খুলতে যাচ্ছিল। বুড়োলোকটা বাধা দিলেন। তিনি বললেন,- উহু। এটা নয়। এদিকটা।

 এরপর যতবার মৈনাক নিজের মতো কাজ করতে যায়। বুড়োলোকটা বাধা  দেন। তাকে নিজের মতো কাজ করতে দেয় না।  পুরো না খুলতে পেরে মৈনাক মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে ভাবে বুড়োলোকটা যখন নিজেই এতকিছু জানেন তিনি নিজেই করতে পারেন। তবু অচেনা জায়গা। সে গুম হয়ে বসে লোকটার কথামত কাজ শেষ করে। আর সে মনে মনে ভাবে  গ্যাস ওভেন কখনোই সারানো যাবে না। বুড়োলোকটা যা বলছেন তাতে গ্যাস ওভেন আরো গন্ডগোল হয়ে যাবে।

  অনেকক্ষন পর বুড়োলোকটার নির্দেশে মৈনাক কাজ শেষ করল। গ্যাস ওভেন জ্বালিয়ে দেখল দিব্যি জ্বলছে।  সে মনে মনে অবাক হল। বুড়োলোকটা তার পিঠে হাত রেখে বললেন,- বড় উপকার করলে। চলো রান্না চাপাই।

 মৈনাক শুনে খুব খুশী। লোকটা তাকে সাহা্য্য করেছে তা বেমালুম চেপে বলল,-এ  আর এমন কি। আমি সব পারি।

বুড়োলোকটা বললেন,-তাই তো। কি সুন্দর ধীরে ধীরে কাজ কর। বাহ!

মৈনাক  শুনে মাথা নাড়াল।

বুড়োলোকটা বললেন, তোমার ক্ষমতা আছে। রান্নাও পারো নাকি?

মৈনাক সানন্দে  মাথা নাড়াল। সে রান্না করল বটে সবই বুড়োলোকটার নির্দেশে। যা হোক একটু পরে খাওয়াদাওয়া হল। মৈনাক  চলে যাবার উপক্রম  করতে বুড়োলোকটা বললেন,- আজ থেকে গেলে  হত না?

মৈনাকেরও তাই ইচ্ছে। একদিন থাকলে কি আর আছে ! তাছাড়া বুড়ো লোকটাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। দাদুর নাম সে জেনেছে সোমেন সরকার।

  মৈনাক থেকে গেল। তবে একদিন নয়।  প্রায় এক মাসের বেশি থেকে গেল মৈনাক। সে যেদিন যেতে চায়   সোমেনদাদু বলেন,- তুমি কত করিৎকর্মা মানুষ। হারমোনিয়ামটা দেখবে নাকি? সারাতে?

   সোমেনদাদু যেন জাদুকর। রোজই একটা না একটা জিনিষ বার করে্ন। মৈনাক সারায়। তবে সোমেনদাদুই বলেন। মৈনাক এখন বুঝেছে সোমেনদাদু কাজ বোঝেন বটে। যেমন ভাবে বলেন তেমন করে করলেই যন্ত্রপাতি নিমেষে সারান যায়।সত্যি বলতে তার কাছ থেকে সে অনেককিছু শিখতে পারছে।   শেষদিন   দাদার মত একটা মোবাইল বার করলেন সোমেনদাদু। দেখে চমকে গেল মৈনাক। বাপরে! কত জিনিষ আছে সোমেনদাদুর !

  মৈনাক মোবাইল সারাতে ভয় পাচ্ছিল।  মোবাইল খারাপ করেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে।

সোমেনদাদু বললেন,- তুমি পারবে না তো কে পারবে?

-পারব?

-নিশ্চয় পারবে?

মৈনাক কাজে নেমে পড়ল।  সন্ধ্যে হবার আগে সে মোবাইলটা সারিয়ে ফেলল। সে অবাক হয়ে দেখল  সোমেনদাদু তাকে একবারও কিছু নির্দেশ দেন নি। সে নিজের বুদ্ধিতেই সারিয়েছে। সে আনন্দে লাফাতে শুরু করল।

 সোমেনদাদু বললেন, -এই ফোনটা তোমাকে দিলাম।আমার উপহার।

মৈনাক  অভিভুত হয়ে একটা প্রনাম করল সোমেনদাদুকে।

সোমেনদাদু বললেন,- ফোনে রিচার্জ করা আছে। তুমি ফোন করতে পার।

মৈনাক মা ও দাদার কথা মনে পড়ল। দাদার নম্বরটা তার মনে আছে। সে দাদাকে ফোন করল।

কৌস্তভ ফোন পেয়ে অবাক। তার গলায় উদ্বেগ।  সে জিজ্ঞেস করল,- তুই কোথায় ভাই? মামার বাড়ি তো যাস নি।

-উহু! আছি এক জায়গায়।শোন না।

-না শুনব না। তুই কোথায় বল। তোর খবর না পেয়ে মায়ের শরীর খারাপ। আমরা পুলিশে খবর দিয়েছি। কোথায় হাপিস হলি বল তো।

 মৈনাক  চিন্তিত হল মায়ের কথা শুনে। তার গলায় উদ্বেগ ঝড়ে পড়ল।সে বলল,-মাকে বলিস। চিন্তা নেই।আমি আজকালের মধ্যেই মামার বাড়ি যাব।

কৌস্তভ বলল,- না।না তুই বল। কোথায় আছিস।আমরা যাব।

মৈনাক সোমেনদাদুর বাড়ির অ্যাড্রেস দিল।

পরের দিন  দশটার মধ্যে হতে না হতেই  বাইরে থেকে দাদার গলার স্বর মৈনাক শুনতে পেল। কৌস্তভ আর সময় নষ্ট করে নি। তাড়াতাড়ি গাড়ি ঠিক করে ভাইকে খুঁজতে চলে এসেছে। মামাতো ভাইরাও হাজির তার সঙ্গে।

 কৌস্তভ বাইরে এল।

সে দাদাদের দেখে বলল,- তোরা এসে গেছিস। আয়।

কৌস্তভ বলল,- না। না। তুই চ এখান থেকে।

মৈনাক বলল, আরে দুম করে যাওয়া যায় নাকি?একটু বস জিরিয়ে নে।

 কৌস্তভ বলল, লক্ষ্মী ভাই আমার। তুই বেরিয়ে আয় বলছি।

-কেন?

কৌস্তভ তার দিকে চেয়ে বলল,-তোর কিছু হয় নি তো?

মৈনাক অবাক হয়ে বলল,-কি হবে?

 কৌস্তভ বলল, ভাল আছিস তো? তুই   এখানে একা এখানে ছিলিস কি করে?

-একা কেন থাকব রে? সোমেন দাদু আছেন তো।

কৌস্তভ  অবাক হয়ে তাকাল। তারপর সে চাপা গলায় বলল,  তিনি কোথায়?

-এই তো ভেতরেই আছে।

কৌস্তভ  বলল, ভেতরে মানে কোথায়? এই জঙ্গলে? এরমধ্যে কেউ থাকে নাকি? তুইও বা কি করে ছিলিস? এমন ভুতুড়ে জায়গায়।

-কি সব বলছিস। দাঁড়া। দাদুকে ডাকি।

  কিন্তু মৈনাক ঘুরে চেঁচিয়ে ডাকতে গিয়েই অবাক হয়ে গেল। সোমেনদাদুর  সুন্দর ছিমছাম বাড়িটার চিহ্নমাত্র নেই।   তার বদলে  ,গাছ-আগাছায় পরিপুর্ন একটা ভাঙাচোরা ঘর  পড়ে আছে।   সে  চুপ করে কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে এতদিন ধরে কোথায় ছিল?  তা কি স্বপ্ন নাকি অন্যকিছু!  সোমেনদাদু  বা কোথায় গেলেন? সোমেনদাদু কি  কোনো গোলমালের ভয়ে পালালেন?

 

 কৌস্তভ একটু এগিয়ে  এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,,-ভাই। শোন একটা কথা।

 মৈনাক চুপ করে রইল।

 কৌস্তভ বলল,–তুই কাল ফোন করার পর আমি সোমেনবাবুর  খোঁজ নিয়েছিলাম।

 মৈনাক অবাক চোখে তাকাল।

কৌস্তভ বলল,-উনি এলাকার খুব নামকরা মেকানিক  ছিলেন। ওটাই তাঁর বাড়ি ছিল।

-মেকানিক?

-হ্যাঁ। কিন্তু এখন উনি নেই রে।  বছর পাঁচেক আগে  ইনি মারা গেছেন।  

মৈনাক  বিশ্বাস করতে পারল না। সে চমকে উঠে বলল, কি বলছিস? এই তো সকালেই কত গল্প হল! তোদের কথা বললাম। আরে এদিকওদিক কোথাও গেছেন। আসবেন।

-না রে। শোন। আসবেন না। সত্যিই তিনি   এ পৃথিবীতে অনেককাল নেই।এ পাড়ার লোকদের তুই জিজ্ঞেস কর।

 মৈনাক বেকুব হয়ে যায়।  সে বলে, তাহলে আমার সাথে কে ছিল এতদিন? বল।এই মোবাইলটাই  আমি পেলাম কোত্থেকে?

কৌস্তভ বলে,- সেটাই তো ব্যাপার।  আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আবার অবিশ্বাসও করতে পারছি না। তবে একজন কেউ ছিল তোর সাথে  তা ঠিক। তিনি মনে হয়    সোমেনবাবু নন  তাঁর আত্মা। ভাবতেই কিরকম লাগছে রে!   তা  দাদুটা কেমন? কি করলি রে তার সাথে?এতদিন?

মৈনাকের চোখে জল।সে উত্তর দেয় না। সোমেনদাদু কোথাও নেই! তার বিশ্বাস হয় না। দাদু তাকে কি শিখিয়েছেন তা দাদাকে এখন বলার দরকার নেই। থাক। পরে দাদা বুঝতে পারবে।

মৈনাক মোবাইলটায় পরম মমতায় হাত বোলাল।  সোমেনদাদুর দেওয়া উপহার!

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত