দিল্লি ডায়েরি (পর্ব-৫)
দিল্লিতে প্রথম প্রথম শপিং করতে যেতাম সেই পালিকা বাজার।মাটির নিচের বাজার। সেখানে জিন্স কিনতে গিয়ে দেখি একটিও আস্ত প্যান্ট নেই।সবই ছেঁড়া এবং জোড়াতাপ্পি দেওয়া ।কি ভীষণ দাম সেগুলোর! এক একটা দুহাজার, তিন হাজার ।আবার বলে কী এর থেকে চিফ সারা ভারতে পাবেন না।আমি তো অবাক । একে ছেঁড়া তাও আবার এত দাম! লোক ঠকাবার জায়গা পাও নি!
তারা তো হেসেই যায় আমার কথা শুনে।বলে কিনা এখন এটাই ফ্যাশন।সত্যি বলতে কী কলকাতা শহরে তখন একটি মেয়ে বা ছেলেকেও দেখিনি এমন ছেঁড়া ফাটা জিন্স পরতে।আমার কথা তো বাদই দিলাম।২০০৫ সালের পর তো প্যান্ট পরাই শুরু করলাম । তাও আবার একটিই হালকা নীল জিন্স, পায়ের তলা মুড়িয়ে শ্রীদেবী স্টাইলে পরতাম।
যাহোক, দোকানদারদের কথায় আশ্চর্য হলাম।এতকাল জানতাম, গরীব লোকেরা এমন শতছিন্ন জামা কাপড় পরে।আর এখানে কিনা তেমনই প্যান্ট বিক্রি হচ্ছে স্টাইল বলে!
এর আগে এই মার্কেট থেকে এমন অনেক স্কার্ট নিয়ে গেছি যেগুলো কলকাতায় তখনো আসেনি।সকলেই জিজ্ঞাসা করত কোথা থেকে কিনেছিস! আমি বেশ ধীরে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতাম দিল্লি থেকে।তার মধ্যে অদ্ভুত এক ভালো লাগা জড়িয়ে থাকত।কিন্তু তা বলে এমন স্টাইল! এ আমার দ্বারা হবে না।ফলে না কিনেই ফিরে এলাম ঘরে।
এর পর আর ভালো লাগত না পালিকা বাজার।তাছাড়া পালিকা বাজারে নিচের দিকে জল জমে থাকত।ফলে আঁশটে একটা গন্ধ বেরত।সেটাও আর সহ্য হচ্ছিল না।ক্রমশ যাওয়া বন্ধ করে দিলাম।
কোটলার বাড়িতে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই জেনে গেলাম, পালিকা বাজার ছাড়াও আছে জনপথ, লাজপত নগর, সরজিনী নগর, যেখানে সস্তায় ভালো জামা কাপড় পাওয়া যায় ।জেনে গেলাম ইস্টার্ন কোন মার্কেটে সস্তা , ওয়েস্টার্ন কোথায় ।
সরজিনী ও লাজপত নগরে কুর্তি, স্কার্ট, রাপার, সোয়েটার স্টাইলিস্ট ও সস্তা ।কিন্তু হল্লাবোল লেগে থাকে ।মানে যেকোন মুহূর্তে পুলিসের গাড়ি এসে ফুটপাথে বসা দোকান গুলোকে ও হকারদের তুলে দিতে পারে।অবশ্যই বড় বড় স্থায়ী দোকানও প্রচুর।কিন্তু সেগুলোর দামও অনেক।
অন্যদিকে জনপথ মার্কেটে স্টাইলিস্ট সবই পাওয়া যায়, এবং বেশ সস্তা ।তবে হ্যাঁ প্রচুর দরদাম করতে হয় ।উদাহরণ স্বরূপ, একটি জ্যাকেটের দাম ১২০০ বলল, আমি কমিয়ে করলাম ৩০০।তবে হ্যাঁ , এখানে কিন্তু সবই ব্রান্ডেড।শুধু ভালো করে দেখে কিনতে হবে।
এছাড়াও আছে খান মার্কেট, চাঁদনী চক, গপ্পর মার্কেট প্রভৃতি।চাঁদনী চকে ইলেকট্রিক জিনিস সস্তা , আর সস্তা থান কাপড়। সিল্ক, মসলিন, কাপড়ের সম্ভার ।
পুরোনো দিল্লির চাঁদনী চক মার্কেটের আর একটা দেখার জিনিস মসজিদ, আর দুপাশে সারি সারি মোঘলাই খানার দোকান।রিকশার টুংটাং শব্দ, ঘোড়ার গাড়ি , সরু ঘুপচি গলি, বড় বড় তোরণ, যা ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে ভাঙাচোরা হয়েও দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো দেখতে হলে এর হাতছানি উপেক্ষা করা যায় না।
চাঁদনীচক বাজার পুরোনো দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই ।১৬৫০ এ মুঘল সম্রাট শাহ জাহান এই বাজার তৈরি করেন, আর এর ডিজাইন তৈরি করেন সম্রাট কন্যা জাহানারা। বাজারের মধ্যে ক্যানেল ছিল, যার উপর চাঁদের আলো এসে পড়ত। জ্যোৎস্নার আলোয় সম্রাট সেই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতেন।এখন অবশ্য এই ক্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ।
একসময় এখানে চিন, তার্কি, এমনকি হল্যান্ড থেকেও ব্যবসা করার জন্য ব্যবসায়ীরা আসত এখানে ।সেই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাজারে আমি সচরাচর যাই না।ভীষণ ঘিঞ্জি আর জ্যাম জটের কারণে।কিন্তু ইতিহাস বারবার টানে।তাই বারবার ফিরে যাই সেখানে ।
মনে মনে কল্পনা করি,সম্রাট বেরিয়েছেন বিশাল পারিষদবর্গ নিয়ে।শোভাযাত্রা চলছে এই পথ ধরে। ১৯০৩ সাল পর্যন্ত এই ধারা বজায় ছিল ।
যমুনা নদীর থেকে আগত জল বয়ে যাচ্ছে অর্ধ চাঁদের শেপে তৈরি বাজারের মধ্যে দিয়ে ।বজরা করে ব্যবসায়ীরা আসছেন সে পথে । ১৫৬০ টা দোকান, ৪০ ইয়ার্ড দৈর্ঘ্য, ১৫২০ ইয়ার্ড লম্বা সেই বাজারে বিশ্বের সব রকম সম্ভার নিয়ে হাজির ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে রূপোর জিনিস।তাই অনেকেই একে বলছে সিলভার স্ট্রিট। (হিন্দিতে সিলভার কে চাঁদি বলে , যার থেকেও অপভ্রংশ চাঁদনী বলেও মনে করা হয় ।)
এখন অবশ্য নেই ক্যানেল আর নেই।তার বদলে বসেছে ঘড়ি।এর বিস্তার এখন লাহোর গেট থেকে ফতেহপুরী মসজিদ পর্যন্ত। এখানেই পরে টাউন হল বানায় ব্রিটিশ রা।
এই রাস্তা টা তিনটে বাজারে তখন বিভক্ত হয়ে যায় । উর্দু বাজার লাহোরী গেট থেকে কোতোয়ালি চক পর্যন্ত বিস্তৃত ।এর সামনে গুরুদ্বার সিসগঞ্জ সাহিব।উর্দু ভাষার সঙ্গে এই স্থানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ।প্রসিদ্ধ উর্দু লেখক গালিবের লেখায় ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই স্থানের ধ্বংসাত্মক অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় ।
টাউন হলের সামনে দিয়ে যে রাস্তা সোজা চলে গেছে সেটা হল জহুরি বাজার। সেখানে এককালে সোনা রুপো হিরে জহরতের বিশাল বাজার ছিল।আজও গহনার বাজার রয়েছে সেখানে ।আর আছে ফতেহপুরী বাজার ।ঐতিহাসিক নানা স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই বাজার ।
এসব কিছু বাদ দিয়েও চাঁদনিচক আমাকে টানে আরেকটি কারণে । সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের মিলন স্থল এই জায়গা।যেমন আছে মসজিদ, তেমন আছে গুরুদ্বার, তেমনি আছে জৈনদের মন্দির।
সব মিলিয়ে মনটা অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে যায় ।

কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক