আমার উপন্যাস ধ্রুবপুত্র-র কথা । অমর মিত্র
আমার উপন্যাস ধ্রুবপুত্র-র সময় ছিল ২০০০ বছর আগের ভারতবর্ষ। পটভূমি প্রাচীন উজ্জয়িনী নগর। এই উপন্যাস ছিল এক নগরের কাহিনি যা বহু বছর ধরে অনাবৃষ্টিতে পুড়ছে। উপন্যাসটিতে উল্লেখিত ছিল রেশম পথ, পুরুষপুর (পেশোয়ার, বর্তমানে পাকিস্তান), গান্ধার দেশ (আফগানিস্তান), হিন্দুকুশ পর্বতমালা, বাহ্লিক দেশ (বালখ), গ্রিক উপনিবেশ, অক্সাস নদী (ভারতীয় বায়ু পুরাণে যার উল্লেখ চাকসু নদী), এবং আমু দরিয়া, সির দরিয়া নামে দুই নদী, উরাল হ্রদ। যখন উপন্যাসটি লিখি, মনে হত ঐ সব জায়গায় যদি যেতে পারতাম, সম্ভব হয়নি। উপন্যাস প্রকাশের কুড়ি বছর বাদে আমি সেই মাটিতে পা রেখেছিলাম। আমি বিশ্বাস করি আমাদের জীবন বিস্ময়ের। এ জীবন কত ঐন্দ্রজালিক মুহূর্তে যে পরিপূর্ণ হয় তা আমরা ভাবতেই পারি না। আমি মিথোলজির কথা বলছি এই কিংবদন্তীর দেশে এসে। কিংবদন্তীই কল্পনার দুয়ার খুলে দেয়।
আমাদের দেশে প্রচলিত মিথ, যা কিনা স্মৃতিতে স্মৃতিতে বেঁচে আছে, শ্রুতি বলি যাকে, তার বেশিরভাগ জন্ম নিয়েছে দুই মহাকাব্য, রামায়ণ এবং মহাভারত থেকে। প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র এবং পুরাণ থেকেও জন্ম হয়েছে কিংবদন্তীর, মিথের। আর এই বিষয়ে আর এক বড় ঐশ্বর্য ধারণ করে আছে আদিবাসী পুরাণ। তা মুখে মুখেই বেঁচে আছে এত হাজার বছর। মিথ এবং কিংবদন্তীর ভিতরে বসবাস করেন ভারতের আদিবাসীরা, সংখ্যায় যাঁরা নেহাৎ কম নন। ভারতীয় আদিবাসি-জনজাতি ৬৪৫টি ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত। তাদের আলাদা ভাষা, আলাদা সংস্কৃতি। তাঁদের আছে ভিন্ন ভিন্ন পুরাণ, লৌকিক গল্প-গাথা। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতো ভারতীয় আদিবাসীদের ভিতর এই পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য, দিন ও রাত্রির জন্ম, আগুনের জন্ম- ইত্যাদি সংপৃক্ত কত অপূর্ব গল্প-কাহিনি আছে।
একটি গল্পে আছে, প্রাচীন কালে সূর্য আকাশের এক জায়গায় স্থির হয়ে আলো দিত। সূর্যাস্ত হত না। একদিন ঈশ্বর নেমে এসেছেন পৃথিবীতে। একটি শস্যক্ষেত্রে তখন একজন ফসল কাটছিল। ঈশ্বর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কখন ফসল রোপন করেছিলে ? মানুষটি উত্তর দেয়, এখন।
তুমি কখন ফসল কাটলে?
মানুষটি উত্তর দেয়, এখন।
ঈশ্বর তাকে জিজ্ঞেস করেন, সে কখন ঘুমাতে যায়? উত্তর পান, এখন। উত্তর শুনে ঈশ্বর বুঝতে পারেন মানুষটির ভিতরে সময়ের কোনো ধারণা নেই। তখন ঈশ্বর সূর্যকে বললেন, অস্ত যেতে। ঈশ্বরের কথামতো সূর্য অস্ত গেল। রাত্রির জন্ম হলো। দিন ও রাত্রি আলাদা হলো। সময়ের ধারণাও তৈরি হলো। মানুষ কাজের ও বিশ্রামের আলাদা সময় পেল।
প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র মতে জগতে চারটি যুগ। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগ। আমরা এখন কলিযুগে জীবন অতিবাহিত করছি। পুরাণে কলিযুগ এক ভয়ানক যুগ হিশেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই যুগ ধনলিপ্সা, পারস্পরিক ঘৃণা, অসহনশীলতা, লোভ এবং দুর্নীতির দ্বারা শাসিত হবে। ঠিক এই মুহূর্তে সমস্ত পৃথিবী এইভাবেই তো শাসিত হচ্ছে। পুরাণ মতে কলির এই অন্ধকার যুগে মানুষের আয়ু ক্রমশ কমে আসবে। সত্য যুগে মানুষ হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারত। এখন সত্তর বছর হয়েছে গড় আয়ু।
আমার বাংলাভাষায় যে বড় লেখকরা লিখেছেন, আমার পিতৃপুরুষের মতো যাঁরা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (মেঘমল্লার, দৃষ্টি প্রদীপ), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (আরোগ্য নিকেতন, হাঁসুলীবাঁকের উপকথা), সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, (লাল সালু) শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায় (তিস্তাপুরাণ), লৌকিক গল্প, কিংবদন্তী ও পুরাণকে ব্যবহার করেছেন অপূর্ব। উদাহরণ অনেক দেওয়া যায়। আমি সকলকে ব্যাখ্যা করে এখানে বলতে পারব না, সেই পরিসর নেই। তাই থেমেছি।
আমার অভিমত হলো মিথ, কিংবদন্তী ও প্রত্ন-পুরাণ দিয়ে ইতিহাস রচনা করা যায় না। বরং সাহিত্যে তা ব্যবহৃত হলে, সাহিত্যই জোগায় ইতিহাসের উপাদান। আমাদের গণেশ ঠাকুরের মানব দেহে হস্তীর মুন্ড। এইটির পিছনে পুরাণের কাহিনি যে আছে তা কে না জানে? শনির দৃষ্টিতে শিশু গণেশ মুন্ডহীন হয়। বিষ্ণু একটি হস্তীর মুন্ডচ্ছেদ করে গণেশের মানবদেহে স্থাপন করেন। অনেক কয়টি পৌরাণিক কাহিনি আছে এই বিষয়ে। প্রতিটিই অপূর্ব। যাঁরা রচনা করেছিলেন তাদের কল্পনাপ্রবণ মনের কথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। কিন্তু এই সব কাহিনি দিয়ে ভারতীয় শল্য চিকিৎসার কোনো ইতিহাস রচনা করতে গেলে তা হবে ভয়ানক ভ্রান্তি।
আমাদের সামাজিক জীবনে যে মিথ, কিংবদন্তী, লোক-কাহিনি নিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা, যা আমাদের যাপিত জীবনে অন্বিত, তা আমার লেখায় ছায়া ফেলেছে বারবার, সেই শুরু থেকেই। আমাদের মা, ঠাকুমা যে গল্প শুনিয়েছেন আমাদের, সেই গল্প নিয়েই তো এতকাল বেঁচে থাকা। প্রাচীন ভারতে গ্রামবৃদ্ধরা সন্ধ্যা বেলায়, তারাজ্বলা আকাশের নিচে বসে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে তাঁদের জীবনের গল্প শোনাতেন। কোন গল্প? বীরত্বের গল্প। কোন গল্প? উল্লাসের গল্প। কীভাবে খালি হাতে বাঘের মোকাবিলা করেছিলেন, কী ভাবে ভোজবাড়িতে একশো রসগোল্লা সাবাড় করেছিলেন। এইসব গল্পই লোকমুখে মুখে ছড়িয়ে যেত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। লোকমুখে তা বদল হয়েও যেত কিছুটা। কল্পনা যোগ হতো। জন্ম হতো কিংবদন্তীর। গ্রামবৃদ্ধের গল্প বলার কথা, কালিদাসের ‘মেঘদূতম’ কাব্যে আছে। গ্রামবৃদ্ধ বৎস্যরাজ উদয়ন এবং রাজকন্যা বাসবদত্তার প্রেমের কাহিনি বলত নবীন প্রজন্মের কাছে। অপূর্ব ছিল সেই কাহিনি কথন। মনে হতো যেন অলৌকিক। সেই প্রেমের কাহিনি ধীরে ধীরে কিংবদন্তীর রূপ ধারণ করেছিল।
আমাদের দেশে লক্ষ্মী হলেন ধন সম্পদের অধিষ্টাত্রী দেবী। তাঁর আরাধনার সময় তাঁর পদচিহ্ন আঁকা হয় গৃহের দুয়ারে। দেবী প্রবেশ করছেন গৃহে। সংসার সম্পদে পরিপূর্ণ হবে। ১৯৭৪-এর এপ্রিলে আমি যে গল্পটি লিখেছিলাম, সেই ‘মেলার দিকে ঘর’ এমন ছিল। হত দরিদ্র বাবা তার কিশোরী কন্যাকে মেলা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। সে ছিল এক অভুক্ত পরিবারের কাহিনি। অনেকদিন বাদে সন্ধ্যা-রাতে তাদের বাড়িতে ভাত ফুটেছিল। লক্ষ্মীর বাবা সহদেব চাল নিয়ে ফিরেছিল। মেলার গল্প করছিল লক্ষ্মীর কাছে। অপূর্ব বর্ণনা দিচ্ছিল। পরদিন লক্ষ্মী যাবে মেলায়। একটি পংক্তি লিখেছিলাম নিজের অজান্তে,
‘বাপের সঙ্গে লক্ষ্মী চলে মেলা দেখতে। উঠনের নরম ধুলোয় তার ছোট্ট নরম পায়ের ছাপ পড়ে। এঁকেবেঁকে সামনে চলে যায় লক্ষ্মীর পদচিহ্ন; নরম ধুলোর পরে বৈশাখের আকাশতলে তার পদচিহ্নের আলপনা আঁকা হয়।’
লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আমাদের দুয়ার অভিমুখীই হয়। মেলার দিকে ঘর গল্পে সেই পদচিহ্ন ঘর ছেড়ে বাহির অভিমুখী। গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে লক্ষ্মী। নিঃস্বতা আসছে। পুরাণ, কিংবদন্তীর ভিতরে মানুষ বসবাস করে। কখন কীভাবে তা চলে আসে লেখায়, বুঝতে পারি না। পরিকল্পনা করে এইসব মুহূর্ত রচনা করা যায় না। এই গল্পে মেলা দেখানর নাম করে মেয়েকে নারী পাচারকারীদের হাতে তুলে দেবে বাবা, তেমনই ছিল তার পরিকল্পনা। আগাম নিয়েছিল। সেসব তো পরের কথা ছিল। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মা-কাকিমারা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকেন দুয়ারে, ঘর ছিল তার অভিমুখ। গল্পে সেই ধারণা ভেঙে গিয়েছিল।
আমার নিজের গল্প ও উপন্যাসে কিংবদন্তী, পুরাণ-প্রতিমা বা প্রত্ন-প্রতিমা নানা ভাবে এসে গেছে। এখন মনে হয় সারাজীবন এই চর্চাই করেছি। প্রত্ন-প্রতিমা কিংবা কিংবদন্তী সব সময়ে জীবনের চেয়ে বড় হয়। বা অন্যভাবে বলি জীবন ও মৃত্যুর এক বৃহৎ প্রকাশই যেন কিংবদন্তী।
আমাদের পুরাণে কতসব লৌকিক কাহিনি লিখিত হয়েছে, সেই সেইসব কাহিনিতে প্রকৃতি, মেঘ, বৃষ্টি, জল ও বায়ুর কথা রয়েছে। ধ্রুবপুত্র উপন্যাসে দীর্ঘ দিন ধরে অনাবৃষ্টিতে শুকিয়ে যাওয়া এক নগরের কথা লিখেছিলাম। নগরের নাম উজ্জয়িনী। উজ্জয়িনী নগরই আমার কাছে এক কিংবদন্তীর নগর। পৌরাণিক নগর। উজ্জয়িনীকে ঘিরে অনেক পুরাণকথা আছে। উপন্যাসে সেই সব পুরাণকথা ব্যবহার করা হয়েছে। বায়ু পুরাণে আছে কত যে বিচিত্র মেঘের বিবরণ। মেঘের জন্ম কাহিনিও আছে। সূর্যের শত সহস্র রশ্মির কথা আছে। সেই রশ্মির অপরূপ ভূমিকা বিভিন্ন ঋতুতে। পুরাণ যেন কবি কল্পনা।
পুরাণের কথা বলি। জানি অগ্নিকুন্ডে পূর্ণ মহাতেজস্বী সূর্যদেব তার কিরণে জগতের জলরাশি শোষণ করেন। ওই জলরাশিই মেঘ হয়। মেঘ বায়ুর আঘাতে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। চাতকের তৃষ্ণা মেটে। পৃথিবী সিক্ত হয়, শস্যশালিনী হয়। পুরাণে কথিত আছে, স্থাবর জঙ্গম যখন দগ্ধ হয়, তার ভিতরের জল বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। এক সময় গভীর অন্ধকারে সর্বলোক আচ্ছন্ন ছিল। সৃষ্টিকাল আরম্ভই হয়নি যে সময়, তখনই অগ্নির আত্মপ্রকাশ। আলো হয়ে এসেছিল আগুন। অগ্নি সব সময় জলগর্ভ। অগ্নির শতসহস্র রশ্মি। সেই রশ্মি দিয়ে চারদিক থেকে, সমুদ্র, নদী, সরোবর, কূপ, গাছ-গাছালি, প্রাণ— সব কিছুর জল শুষে নেয়। হিরন্ময় সূর্যের জন্যই জগতের যত উষ্ণতা, যত শৈত্য, যত বর্ষণ। সূর্যের শুষে নেওয়া জলই মেঘরূপ ধারণ করে। যে মেঘ ছিল না সেই উজ্জয়িনী, অবন্তীরূপ দেশের আকাশে, সেই মেঘ আগ্নেয়, ব্রহ্মজ ও পক্ষজ। আগ্নেয় মেঘ জলজাত। এই মেঘ মহিষ, শূকর ও মত্ত হস্তির আকারে আকাশে ভেসে ওঠে, পৃথিবীতে নামে। এরাই জীমূত। এদের দিয়ে প্রাণবান হয় পৃথিবী। এই মেঘ নিঃশেষিত হয় পৃথিবীকে সিক্ত করতে করতে। এই মেঘ নিঃশব্দে ধারাবর্ষণ নামায়। আর যে মেঘ বিদ্যুতগুণ সম্পন্ন, গর্জন করে যায় আকাশ মন্ডলে, যে মেঘের ডাকে বলাকারা গর্ভবতী হয়, যে মেঘ ব্রহ্ম নিঃশ্বাসে উৎপন্ন, সেই মেঘই ব্রহ্মজ মেঘ। এই ব্রহ্মজ মেঘই পাহাড়চূড়ায়, হর্ম্য শ্রেণীর মাথায় ডেকে ডেকে ফেরে আষাঢ়, শ্রাবণ ও প্রোষ্টপদে (ভাদ্র মাসে)। ধরণী এই মেঘের ডাকে শস্যশালিনী হয়, সুন্দর হয়ে ওঠে। এই মেঘের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অতি গভীর। আর এক মেঘ আছে। পুষ্করাবর্ত মেঘ। পক্ষজ সেই মেঘেরই নাম। কথিত আছে, পুরাকালে পর্বতেরা ছিল পক্ষধর। ডানা মেলে উড়ে বেড়াত পর্বত। তাদের অত্যাচারে প্রাণীকূল দেবরাজ ইন্দ্রের শরণাপন্ন হয়। ইন্দ্র তখন ছিন্ন করেন পর্বতের ডানা। সেই ডানা, ছিন্ন পক্ষই হয়ে যায় জলভরা মেঘ। এই মেঘে নাকি বৃষ্টি হবে যুগান্তকালে। কিন্তু যুগান্তকালে পক্ষজ মেঘের অবিশ্রান্ত বর্ষণ তো কল্পনাই মাত্র, একবারই তা হয়েছিল, বাইবেলের পুরাতন সমাচারে তা আছে। নোয়ার নৌকো এই শুষ্ক খটখটে কোন পথে বয়ে যাবে। এই যুগান্ত হবে বুঝি অনাবৃষ্টির প্লাবনে। বৃষ্টিহীন অনন্তকালের প্রবাহে। চাতকের ডাকে। বৃষ্টিহীন পৃথিবীতে মানুষ করবে কী, মৃত্যুর পথ ব্যতীত অন্য কোনো বাঁচার পথ তার জানা নেই। মেঘ না এলে চাতক কেন সমস্ত পক্ষীকূল উড়তে উড়তে খসে পড়বে বায়ুমন্ডল থেকে এই ধুলোয় ধুসরিত মাটির পৃথিবীতে। মাঠ পাথার ভরে থাকবে পক্ষীর শবে।’ ধ্রুবপুত্র রচনায় ভারতীয় পুরাণ আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
আমাদের দেশে যে আদিবাসী পুরাণ, লোককথা, গ্রামজীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত, নানা আঙ্গিকে তা ব্যবহৃত হয়েছে সাহিত্যে। সেই ১৯৭৭ আদিবাসী জীবনে প্রচলিত করম পূজার কাহিনিকে অতি আধুনিক আঙ্গিকে আমি ব্যবহার করেছিলাম, গাঁওবুড়ো গল্পে। ধরমু ও করমু, দুই ভাইয়ের করম ঠাকুরের উদ্দেশে যাত্রার যে কাহিনি, তাইই অন্য আঙ্গিকে, অন্য কাহিনি হয়ে আসে ‘গাঁওবুড়ো’ গল্পে। ধরমু ও করমু ছিল ভাগ্যহীন দুই যুবক। তাদের জীবনের কোনো সাধই পূর্ণ হয়নি। তারা করম ঠাকুরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল যদি তাঁর কৃপায় তাদের ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের দুঃখ দূর হয়। কুসুমপুরের বুড়ো ফকিরচাঁদও ছিল দুঃখী মানুষ। সে বড়বাবুর উদ্দেশে রওনা হয়েছিল যিনি অনেক রকম উপায় জানেন যা দিয়ে বুড়োর শেষ জীবনের দুঃখ, মামলা-মোকদ্দমা, কচি মেয়েকে বিবাহ করার সাধ, জমি রক্ষা, ফসল রক্ষা করার উপায় বলে দিতে পারেন। বাকি থাক, গল্পের ভিতরে। আসলে পুরাণ কথা আমাদের সাহিত্যকে চিরকাল সমৃদ্ধ করেছে।
সেই ৪০-৪৫ বছর আগে, আরম্ভের দিনে, ভেরিয়ার এলুইনের বই আমাকে আদিবাসী পুরাণের এক অসামান্য পাঠ দিয়েছিল। আর যা শুনেছি গাঁওবুড়োদের কাছে। ১৭ বছর প্রায় একটানা গ্রাম-গঞ্জ ও মফসসলে বসবাস কত কিছুই না শিখিয়েছিল। সমস্তজীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল তা। আদিবাসী পুরাণে সৃষ্টির আদিতে সব ছিল জল। একটি কেঁচো জলের তলদেশ থেকে মাটি তুলে রাখছিল পদ্মপাতার উপরে। সবই ছিল ঈশ্বরের অভিপ্রায়। কেঁচো মাটি তোলে আর হাওয়ায় সেই মাটি সমেত পদ্মপাতা জলে উলটে যায়। মাটির পৃথিবীর জন্ম আর হয় না। তখন একটি কাছি্ম এসে পদ্মপাতার নিচে পিঠ পেতে দিল। পদ্মপাতা স্থির হয়ে থাকল। স্থলভাগের জন্ম হতে থাকে। এই কাহিনি নানা ভাবে নানা দেশের আদিবাসীর ভিতরে আছে। আমি একটি উপন্যাস লিখেছিলাম, ধনপতির চর। সেই বঙ্গোপসাগরের মোহনার পয়স্থিভূমি চরটিতে ছমাস মৎস্যজীবীরা বসত করে থাকে। আশ্বিনের পর থেকে চৈত্র অবধি। ছমাস তারা এই চর থেকে মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে যায়। চৈত্রে সমুদ্র অশান্ত হলে তারা মূল ভূখন্ডে ফিরে আসে। চরটির মালিক এক বুড়ো, তার নাম ধনপতি, সে বলে তার পূর্বপুরুষ, প্রপিতামহ কিংবা তারও আগের একজন ছিল পর্তুগিজ হার্মাদ। তার নাম ছিল পেদ্রো। যে কাছিম চরটিকে পিঠে করে ঘুমিয়ে আছে সমুদ্রের তলদেশে, তার নামও পেদ্রো। পেদ্রো ধনপতি। এক ধনপতি চরের মালিক, আর এক ধনপতি চর পিঠে নিয়ে ঘুমায়। যে কাছিম ধনপতি বা পেদ্রো ঘুমায় চর পিঠে নিয়ে সে এসেছিল পর্তুগাল থেকে। কথিত আছে ডিম পাড়ার জন্য বঙ্গোপসাগরের ছোট ছোট দ্বীপে আসে দূর ইওরোপ থেকে কাছিমের দল। তখন সুয়েজ ক্যানাল হয়নি। আফ্রিকা হয়ে যে পথে কাছিমেরা আসে, সেই পথ অনুসরণ করেছিল ভাস্কো-ডা-গামা, উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে সেই পথ। ইতিহাস ও কিংবদন্তী এই দীর্ঘ উপন্যাসে এসেছিল স্বাভাবিক ভাবে। বুড়ো ধনপতি স্বপ্ন দেখে ফিরে যাবে তার জন্মভূমি লিসবোঁয়াতে। সমুদ্রে চরের নিচে ঘুমিয়ে থাকা ধনপতি পেদ্রোর যেদিন ঘুম ভাঙবে সেও ফিরে যাবে লিসবোঁয়া। আমি কাহিনি কথনে যাচ্ছি না। তবে আদিবাসী পুরাণ, পর্তুগিজ হার্মাদ, তিন সাড়ে তিনশো বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলাঞ্চলে পর্তুগিজ জলদস্যুদের উপস্থিতি, তাদের লুন্ঠনের ইতিহাস আমার কল্পনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল এই উপন্যাস রচনার সময়।
ভারতীয় পুরাণ কবিত্বের সুষমায় পূর্ণ। ভারতীয় পূরাণ কল্পনার আকাশ উন্মোচন করে দিয়েছে যেভাবে, তার কোনো তুলনা নেই। গল্প-উপন্যাসে বাস্তবতার অতিমাত্রায় চর্চা যেমন তার সীমারেখা ছোট করে দেয়, পুরাণের ব্যবহার তাকে অনন্তে নিয়ে যায়।

কথাসাহিত্যিক
জন্ম :৩০ আগস্ট, ১৯৫১ বাংলা দেশের সাতক্ষীরার কাছে ধূলিহর গ্রামে। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কর্মজীবন কাটে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের এক দপ্তরে। তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। অশ্বচরিত উপন্যাসের জন্য ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চ শিক্ষা দপ্তর থেকে। এ ব্যতীত ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ( ভাগলপুর ), ১৯৯৮ সালে সর্ব ভারতীয় কথা পুরস্কার স্বদেশযাত্রা গল্পের জন্য। ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র পুরস্কার পান। ২০১৭ সালে সমস্ত জীবনের সাহিত্য রচনার জন্য যুগশঙ্খ পুরস্কার, ২০১৮ সালে কলকাতার শরৎ সমিতি প্রদত্ত রৌপ্য পদক এবং গতি পত্রিকার সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২২ সালে প্রথম ভারতীয় লেখক যিনি গাঁওবুড়ো গল্পের জন্য ও হেনরি পুরস্কার পেয়েছেন।