৭মে চলে গেলেন বাংলাদেশের প্রবাদ প্রতীম শিল্পী সুবীর নন্দী। তার প্রয়াণে ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ছোটবেলায় তখন তাঁর বয়স ৭-৮ বছর।বড় ভাইকে দেখতো ওস্তাদের কাছে গান শিখছে। একদিন ছেলেটি তাঁর মাকে বললো আমিও ওস্তাদের কাছে গান শিখব। মা পুতুল রানী বললেন,এখন তুমি আমার কাছেই শেখ। আরেকটু বড় হও তারপর ওস্তাদের কছে শিখবে। বাসায় ছিল প্রচুর গ্রামোফোনের রেকর্ড। বাসায় থাকলেই বাবা সুধাংশু নন্দী রেকর্ড বাজিয়ে দিতেন। তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক ও সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ ছেলের আগ্রহ দেখে তিনি ছেলেকে নিয়ে গেলেন ওস্তাদজির কাছে। ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছেই তাঁর সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয়।সেইদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটি একদিন হয়ে ওঠে বাংলাদেশি গানের ভূবনের অন্যতম সেরা একটি ব্র্যান্ড।সুবীর নন্দী!
তৎকালীন সিলেট বেতারে কোনো এক গানের প্রতিযোগিতায় অডিশন দেয়ার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল তার মিউজিক্যাল জার্নি। শুরুতে লোক সঙ্গীত এবং নজরুল সঙ্গীতে দীক্ষিত হলেও পরবর্তী সময় মিশে যান বাংলা আধুনিক গানের জগতে। ধীরে ধীরে গানের পাখি সুবীর নন্দী ডানা মেলেন আধুনিক গানের আকাশে। কে জানতো, একসময়কার জনতা ব্যাংকে কর্মরত মানুষটিই জাদুকরী সুরের মন্ত্রে মাতিয়ে তুলবেন বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ব্রিটেনের ‘হাউজ অব কমন্স’র থিয়েটার হলো।
তার গানগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরালে, বিশেষ করে গানের লিরিকের দিকে তাকালে বুঝা যায়- গানগুলো ঘিরে রয়েছে মানুষ জীবনের অন্তর্বেদনা, প্রেম-বিরহ, ভালোবাসা না পাওয়ার হাহাকার। যার ফলে তার গানের এ বিষয় বাস্তবতাগুলোই আন্দোলিত করে শ্রোতাদের আবেগী মন। তাই হয়তো কোনো প্রেমিক, হতে পারে সে ব্যর্থ প্রেমিক কিংবা অব্যর্থ, অথবা জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় আটকা পড়া একজন বিবাগী যে আনমনে গেয়ে ওঠে- ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে, একটি কথাই শুধু জেনেছি আমি, পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’। আবার কখনোবা অভিমানী মন গেয়ে ওঠে- ‘যদি কোনোদিন আমার পাখি, আমায় ছেড়ে দূরে চলে যা, একা একা রব নিরালায়’।‘দিন যায় কথা থাকে ,সে যে কথা দিয়ে রাখলো না, ভুলে যাবার আগে ভাবলো না’ – বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় গানের তালিকায় এই গান নিশ্চিতভাবেই প্রথমদিকে থাকবে। খান আতার ‘দিন যায় কথা থাকে’ সিনেমায় এই গান গেয়েই তিনি শ্রোতাপ্রিয়তা পেতে থাকেন। এই গানের জন্য তিনি বাচসাস পুরস্কারও পেয়েছিলেন। একই সিনেমায় ‘নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে’র মত জনপ্রিয় গানটিও উনিই গেয়েছিলেন। কালজয়ী ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার সেই বিখ্যাত গান ‘ও মাস্টার সাব আমি দস্তখত শিখতে চাই’ তাঁরই গাওয়া। লাল গোলাপ সিনেমায় ‘পাখিরে তুই দূরে থাকলে’ গানটির মত কালজয়ী গানটিও তিনি গেয়েছেন। উছিলা সিনেমায় ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’র মত সাড়া জাগানো গান থেকে মাটির মানুষ সিনেমায় ‘বন্ধু হতে গিয়ে তোমার শত্রু বলে গন্য হলাম’ গানটির গায়কও তিনি।
যদিও পৃথিবীতে প্রেমই মুক্তি, প্রেমই শক্তি। স্বার্থপর পৃথিবীতে একমাত্র ভালোবাসা-ই মানুষকে বাঁচাতে শেখায়, আবার ব্যতিক্রমও হয়- অনেক কে ভালোবাসা নিঃস্বও করে দেয়। ব্যক্তি জীবনের অংশ হিসেবে আনন্দ-বেদনাও সমানভাবে জড়িয়ে থাকে কবিতা কিংবা গানে। তাই হয়তো রোমান্টিকতায় ভরে ওঠা মানুষটি স্মৃতির শহরে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে, কখনো বা গলা ছেড়ে গায়তে থাকে- ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ -বাংলা সঙ্গীতজগতের অন্যতম সুন্দরতম গান। আলমগীর কবিরের ‘মহানায়ক’ সিনেমায় এই গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এই গানের সুবাদেই সুবীর নন্দী অর্জন করেন প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। একই সিনেমাতেই ব্যবহৃত হয়েছিল তাঁরই কণ্ঠের আরেক বিখ্যাত গান ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’। দ্বিতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শুভদা সিনেমার ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’ গান গেয়ে।