| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১৬) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
 
 
কীচক! কীচক! এই উদ্ধত নারীলোলুপ লোকটার কথা মনে হলে এখনও দ্রৌপদীর মনে জ্বালা ধরে। আবার তার মৃত্যুটি ভেবে হাল্কাও লাগে। জঙ্গুলে কালী হয়ে থাকতে পারলে নিজেই বধ করতেন তিনি এইরকম পাষণ্ডকে। কিন্তু এখানে তাঁর হাত পা বাঁধা। সম্রাজ্ঞী আর দাসী, তফাত কী! দুজনের কারুরই স্বাধীনতা নেই! একজনের সম্পদ, ক্ষমতা, সাজসজ্জা বাইরে থেকে দেখে হয়ত সাধারণের ঈর্ষা হয়। তবে তিনি নিজে বুঝেছেন, যদি নিজের উচ্চাকাঙ্খা না থাকে, তবে একটি মেয়ে চায় শুধু প্রেম। ভালোবাসার বাঁধনে নিজের পুরুষটিকে একান্ত ভাবে পাওয়া। দুজনে মিলে এক হয়ে যাওয়া। দ্রুপদ কন্যা রূপে এসে তিনি তা পেলেন না। ভীম তাঁকে বারবার বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন, তাঁকে ভালোবেসেছেন, এজন্য দ্রৌপদী কৃতজ্ঞ। আভূমি কৃতজ্ঞ। পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে, তবে এমন স্বামীই তিনি চাইবেন। কিন্তু এই জন্মে তাঁর আকুল ব্যাকুল ভালোবাসা নষ্ট হয়ে গেল। লোকে বলে নারীর মন বোঝা ভার! অথচ কী সহজভাবেই তিনি অর্জুনের প্রতি নিজের ভালোবাসাকে সবার সামনে প্রকাশ করেছিলেন। কৃষ্ণ থেকে যুধিষ্ঠির, সবাই জানতেন। ভালো করেই জানতেন। যুধিষ্ঠিরের তিনি ছিলেন রানি। হস্তিনাপুরের সম্রাজ্ঞী। সেখানকার সকলের ভালো মন্দের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। সত্যভামা একবার বনবাসকালে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “দ্রৌপদী, আমি তো একটি স্বামীকে নিয়েই নাজেহাল! তুমি পাঁচ পাঁচটি এমন মহাধর পুরুষকে কী ভাবে বশ রেখেছ”? 
দ্রৌপদী স্মিত হেসে বলেছিলেন, “দেখতে সহজ হলেও এই কাজটি সহজ ভেবেছ নাকি? প্রাসাদে সবার আগে আমি উঠি। সকলের শুতে যাওয়ার পর আমার শোওয়ার পালা আসে। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে রাজ্য পরিচালনার কাজ দেখতে হয়। তাঁর রাজকোষ যেন এত দানধ্যান করার পরেও খালি না হয়, সেই বিষয়টি আমিই দেখি। প্রজাদের ওপর বেশি কর চাপানো যাবে না। তাদের খুশিও রাখতে হবে। আমি সাধারণ মানুষ কিসে খুশি হয়, বুঝি। তারা বেশি কিছু তো চায় না। নিরাপত্তা আর জীবিকা। মাথার ওপর ছাদ। আর পরিবারের উষ্ণতা। সেটুকু যাতে তারা পায়, তা দেখে রাখতে হত আমাকেই। যুধিষ্ঠির খুশি। মধ্যম পাণ্ডবের খাওয়া আর খাওয়ানোর আনন্দ। সেখানে যাতে কোনও ফাঁক না পড়ে, আমি ছাড়া কে দেখবে বলো? আর সে ঝক্কিও কম ভেব না। মাঝে মধ্যেই প্রজাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা, প্রাসাদে উৎসবের ব্যবস্থা, সব তো আমাকেই করতে হত। অর্জুনের জন্য অবশ্য আমার পরিশ্রম কমই করতে হয়েছে। একে তো তিনি নানা অদ্ভুত কথা রাখার জন্য দূরে থেকেছেন বরাবর। তারপর তো তোমাদের বোনটিকে সঙ্গে নিয়ে এলেন এখানে। কিন্তু নকুল আর সহদেব? আমার ছোটদের মতো আরামে থাকা দুই স্বামী। সহদেবকে তো মা কুন্তী অতিরিক্ত যত্নেই রাখতেন। সেই ব্যবস্থা আমাকেও চালিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকী এই বনে বাসের সময়েও সহদেবের যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, তার জন্য কুন্তীমা বারবার বলে দিয়েছিলেন। এই পাঁচজনের প্রতি মুহূর্তের দেখাশোনা, প্রতিটি খুঁটিনাটির দিকে নজর রাখা সহজ ভেবেছ? এমনি এমনি তাঁরা আমার বশে থাকেন নি”!
 
এখনও ভাবেন তিনি। কী পরিশ্রমটাই  না করেছেন! অপমান লাঞ্ছনা বাদ দিয়েই। শুধু শ্রমটুকুই যদি দেখেন! শারীরিক মানসিক সব দিক থেকে নিংড়ে দিয়েছেন নিজেকে। হস্তিনাপুরের সকলে যাতে ভালো থাকে, শান্তিতে থাকে, তার জন্য কম ভাবনা ভেবেছেন! কম কাজ করিয়েছেন! পতিত একটা ভূমি, তাকে সুজলা সুফলা করে তুলেছেন। জঙ্গলে বড় হওয়া মেয়ে তিনি। মাটির গন্ধ তো মনেই। মাটির ধরণ বুঝতেন তিনি। গাছগাছালিরও। জলের ভাষাও। ময় দানব যখন ইন্দ্রপ্রস্থ গড়ে তুললেন, কী আশ্চর্য সব মায়া কৌশল দিয়ে; এমনকী পাঁচ ভাইও মাঝে মাঝেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতেন। তিনি কিন্তু সর্বদা বুঝেছেন নকল জল আর আসল জল কোনটা। যত হাল্কাই হোক, আসল জল তো কাঁপবেই। ঘরের মধ্যে উদ্যান, যেখানে মাটি নকল, গাছপালা নকল। সকলে ভুল বুঝলেও তাঁর কখনও ভুল হয় নি। মাটির তো গন্ধ আছে। গাছের ফুল ফল পাতার তো ক্ষয় আছে। যা এমন অক্ষয়, তা কখনও আসল হতে পারে না। তাই সেই জাঁক তাঁর মনকে ভরাতে পারে নি। বরং চাষের জমি দেখতে গিয়ে, নদীর জল বুঝতে গিয়ে, খোলা আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখে ঝড়বৃষ্টির আভাস বুঝতে চেষ্টা করে তিনি অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছেন। যখন নদীর ধারে বর্শা ছুঁড়ে তিনি মাছ ধরতেন, আশেপাশের মেয়ে বউরা অবাক হয়ে যেত। তিনি উৎসাহ দিতেন ছোট মেয়েদের। “নিজের খাদ্য নিজে যোগাড় করতে শেখ। নিজের শরীর সুস্থ রাখ। কোথাও থেকে কোনও আক্রমণ এলে যেন প্রতিরোধ করতে পারো”।

আরো পড়ুন: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১৫) । রোহিণী ধর্মপাল
 
 
তবে এইসব কাজ বা বনবাসের কষ্টকে কষ্ট বলে মনেই হয় নি কখনও। মানসিক যন্ত্রণাটাই অনেক বেশি। শুধু অর্জুনের থেকে প্রেমের আশা করে ব্যর্থ হওয়ার জন্য নয়। যুধিষ্ঠিরের ব্যবহারের জন্য। যেভাবে নির্লজ্জের মতো নিজে পাশা খেলে গেছেন বাজি রেখে, কীভাবে পারলেন! হস্তিনাপুর তো শুধু যুধিষ্ঠিরের নয়। বাকি ভাইদেরও। তাঁরও। তাঁদের বিশ্বাস করে যে সব মানুষ সেখানে বসবাস করতে এসেছেন, তাঁদেরও। এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারেন কোনও সম্রাট? যিনি নাকি আবার রাজসূয় যজ্ঞ করেছেন? আসলে নিজে তো বসে থেকেছেন। চার ভাই বিশেষ করে অর্জুন আর ভীম প্রায় গোটা ভারতবর্ষটাকেই জিতে এনে দাদাকে অর্পণ করেছেন। সেই সব কিছু এক এক বারে বাজি রেখে দিলেন? তারপর ভাইদেরও? তারপর তাঁকেও!!!! কই, মাকে বাজি রাখার কথা তো মনে হল না তাঁর! তাহলে ধৃতরাষ্ট্র তক্ষুণি সেই সর্বনেশে খেলা বন্ধ করতে বাধ্য হতেন! ভাইকে, স্ত্রীকে বাজি রাখা যায় তবে! যিনি নাকি ন্যায়নিষ্ঠ, যাঁর মাথা নাকি চরমতম সময়েও স্থির থাকে, সামান্য পাশাখেলার উত্তেজনায় তিনি এত অস্থির হয়ে গেলেন?? এবং একবারে হল না, স্ত্রীর এমন লাঞ্ছনাতেও এতটুকু আক্কেল হল না, আবার দ্বিতীয়বার গেলেন? আর আশ্চর্য হল এই পুরো সময়টাই কৃষ্ণ নেই! কীসের জন্য কৃষ্ণ তবে অসাধারণ? কই, বন্ধুদের, সখী কৃষ্ণার কোনও অপমান তো তিনি আটকাতে পারলেন না? রাজসূয় যজ্ঞের বিপুল সমারোহের পর আর ইন্দ্রপ্রস্থের চোখধাঁধানো ঐশ্বর্য দেখার পর দুর্যোধনের মতো মানুষের মনে যে চূড়ান্ত প্রতিহিংসা জেগে উঠবে, একথা তিনি বোঝেন নি? কিসের কূটনীতিজ্ঞ তিনি?
 
তবে যুধিষ্ঠিরের ওপর তাঁর রাগ এতো বেশি, যে কীচক যেদিন তাঁকে সবার সামনে ওইরকম অপমান করল, সেই রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনি নিঃসাড়ে উঠলেন। চললেন সোজা পাকশালের দিকে। যেখানে ভীমের থাকার ঘর নির্দিষ্ট। ভীম তো শুধু পাচক নন। রাজার অত্যন্ত প্রিয় কুস্তিগীর। যখন তখন বিরাট রাজার ইচ্ছে হয় কুস্তি দেখার। রাজ্যের কুস্তিগীরেরা আসেন। বিরাট রাজার পাচক বল্লবের কাছে একেবারে দুরমুশ হন। রাজার দারুণ আনন্দ হয়। দ্রৌপদীর কাছে খবর আসে। দ্রৌপদী মনে মনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কখনও কখনও বাঘ বা সিংহের সঙ্গেও বল্লবকে লড়তে হয়। প্রাসাদের সবাই দেখে। দ্রৌপদী আঁতকে ওঠেন। জানেন ভীম অবহেলায় এই অবলা পশুদের পরাজিত করবে। কিন্তু একী নৃশংস খেলা! তাঁর পাংশুমুখ দেখে অন্তঃপুরে খানিক ফিসফাসও শুরু হয়ে যায়। “দেখেছিস, বল্লবের সামনে সিংহদুটোকে ছেড়ে দেওয়া মাত্রই সৈরিন্ধ্রীর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল”। 
“আর সেদিন যখন ওই কুস্তিগীরটা রে, কী যেন নাম, বাহুবল, বল্লবের পিঠের ওপর উঠে পড়েছিল, সৈরিন্ধ্রীর তো প্রায় অজ্ঞান হওয়ার যোগাড়! দুজনের মধ্যে নির্ঘাত কিছু আছে। মুখে বড় বড় কথা সৈরিন্ধ্রীর! তলে তলে দেখো গে”!
দ্রৌপদীর কানে এসব গেলে তিনি শুধু সাবধান হতেন। কেউ পরিচয় না ধরে ফেলে! তবে সেদিন আর কোনও চিন্তা তাঁকে আটকাতে পারল না। ভীমের ঘরে গিয়ে সোজা তাঁকে জাপটে ধরলেন।
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত