উৎসব সংখ্যা: বিপ্রদাস বাবু ও আশ্চর্য লুডো । দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
বিপ্রদাস বাবুর চারপাশের কাউকেই ঠিক পছন্দ হয়না। এই যে এতো এতো বন্ধুবান্ধব , আত্মীয়স্বজন, বিদ্যায় বুদ্ধিতে কেউই বিপ্রদাস বাবুর মতো নয়। এদের সঙ্গে একটু কথা বলতে গেলেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। একা একা থাকতেই বিপ্রদাস বাবুর ভালো লাগে।তারপরে বিপ্রদাস বাবু ভীষণ কৃপণ। বাড়িতে লোক ডেকে আনলেই এটা সেটা কিনে আনো , খাওয়াও।মহা জ্বালা। তাই লোকসঙ্গ উনি ত্যাগ করেই চলেন।
বিপ্রদাস বাবুর সমস্যা হলো সময় কাটানো নিয়ে। গল্পের বই পড়ে টিভি দেখে কাঁহাতক আর সময় কাটে। তাই বিপ্রদাস বাবু নতুন বাজারে গিয়েছিলেন সময় কাটাবার কোনো একটা খেলা খুঁজতে।
একটা দোকানে এসে সবরকম বোর্ড গেম খুঁটিয়ে দেখছিলেন তিনি। একা, একা খেলার মতো কোনো ভালো গেম খুঁজে পাচ্ছিলেন না। যদি বা পাচ্ছিলেন দামে পোষাচ্ছিলো না। দোকানদার লোকটা মুচকি হেসে তেরছা দৃষ্টি হেনে বললো -” কী হলো বাবু একটাও পছন্দ হলো না ?”
-” না মানে আমি একা থাকি “
বুড়ো লোকটা হাত নেড়ে আশ্বস্ত করে বললো- ” আছে আছে একটা জিনিস আছে আমার কাছে। দাম লাগবেনা। পুরোনো জিনিস। এমনিই নিয়ে যান।”
বলে ধুলো ঝেড়ে একটা লুডো বের করলো।
-“লুডো ? ও তো দু চারজন মিলে খেলার জিনিস।”
লোকটা একটু রহস্যজনক হাসি হেসে বললো -” এটা হচ্ছে স্পেশাল লুডো। এ লুডো একাই খেলা যায় “
একটু অবাক হয়ে লুডোটা নিয়েই নিলেন বিপ্রদাস বাবু।
সন্ধেবেলায় খবর দেখা শেষ করে চা খেয়ে যেই লুডোটা খুলে বসেছেন অমনি ঘটলো এক অভাবনীয় ব্যাপার। ঠিক বিপ্রদাস বাবুর মতোই দেখতে একই পোশাক পরা আরও তিনজন যেন বাতাস ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো। বিপ্রদাস তো ভয়ে মূর্ছা গেলেন। চোখে মুখে জলের ছিঁটে দিয়ে তার জ্ঞান ফেরালো যে, সে খুব শান্ত স্বরে বললো -” তুমি এমন ভয় পেলে কেন ভাই ? আমরা তোমার সঙ্গে খেলতে এসেছি। খেলা হয়ে গেলেই আমরা চলে যাবো। আরেকজন রেগে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললো-” ধুত্তোর আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে হ্যাঁ? “
তৃতীয়জন বললো -” ইস তোমার এমন অবস্থা হবে বন্ধু , জানলে আসতাম না।”
বিপ্রবাবু কোনো ক্রমে তাদের সঙ্গে লুডো খেলে তবেই ছাড় পেলেন।
পরদিন সকালেই বিপ্রদাস বাবু ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। মাথা বা মনের ডাক্তার ছাড়া আর কেউ এই রকম রোগ সারাতে পারে বলে বিপ্রদাস বাবুর জানা নেই ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর অশোক দাশগুপ্ত খুব মন দিয়ে বিপ্রদাস বাবুর গল্পটা শুনলেন। তারপর বললেন ” আপনার কী রোগ হয়েছে সেটা আন্দাজ করতে পেরেছি। সমস্যাটা হয়েছে দীর্ঘদিন একা থাকার জন্য।”
-” কিন্তু ডাক্তার বাবু আমি বহুদিন ধরেই একা আছি। সমস্যাটা হলো ওই অলক্ষুণে লুডোটা আসার পর। সারাদিন তো ওই তিনজন আসেনা। লুডো খুলে বসলেই ওই তিনজন এসে হাজির হয়। তা আবার তিনজনের যে একরকম স্বভাব তা কিন্তু নয়। যেমন স্বভাব তেমন নাম। খুব রাগী রাগী যে তার নাম ক্ষিপ্রদাস , খুব শান্ত স্বভাবের যে তার নাম শান্তদাস। আর বেশ ন্যাকা ন্যাকা যে সে কান্তদাস। কিন্তু সবাই একেবারে আমার মতো দেখতে।”
-” ওসব আপনার মনের ভুল বুঝলেন ? নামগুলোও আপনার নিজেরই তৈরী করা।”
বিপ্রদাস বাবু বিমর্ষ চিত্তে বাড়ি ফিরে এলেন। প্রতিদিনের মতো খবর দেখে চা খেতে বসেছেন, চোখ চলে গেলো লুডোটার দিকে। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিছুতেই যেন অগ্রাহ্য করতে পারছেন না এই হাতছানি। আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলেন। ঘড়িতে ঢং করে রাত আটটা বাজলো। বিপ্রদাস বাবু হাতে তুলে নিলেন বোর্ডটা। এবার খুলে বিছানায় রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলেন ওরা এসে গেছে। শান্তদাস শান্ত ভাবে বললো -” কেন ভাই আমরা খেলতে আসি , তোমার কি ভালো লাগে না ?”
কান্তদাস কেঁদে কেঁদে বললো -” ভালো না লাগলে বলে দিলেই হয় আমরা চলে যাই “
ক্ষিপ্রদাস তিরিক্ষে গলায় বললো,” এতো সহজে আমরা চলে যাবো , তা কিন্তু ভেবোনা “
ঢোঁক গিললেন বিপ্রদাস বাবু -“মানে ?”
-” মানে আমাদের খেলায় হারিয়ে যদি জিততে পারো। তবে তোমার মুক্তি। আর যদি জিততে না পারো” ক্ষিপ্রদাস আড়চোখে অন্যদের দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হাসলো “
পরদিন ডাক্তার অশোক দাশগুপ্ত বিপ্রদাস বাবুর কাছে এই গল্পটাই শুনছিলেন।
বললেন ভারী ইন্টারেষ্টিং-” তার পরে কী হলো ? কে জিতলো ? আপনি না ওরা ?”
বিপ্রদাস বাবু আড়চোখে চারদিকে তাকিয়ে বললেন-” আমি জিতলে তো কোনো কথাই ছিল না
আমি তো ওদের হারিয়ে প্রায় জিতেই যাচ্ছিলাম।
ঠিক ঘরে ঢোকার আগের মুহূর্তে ক্ষিপ্রদাস খপ করে আমার গুটিটার টুঁটি চেপে ধরলো।কান্তদাস কাতর গলায় বললো -“ইসসসসসস “
শান্তদাস শান্ত গলায় বললো -” তুমি হেরে গেছো ভাই। এবার চলো “
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম ” কোথায় ?”
-” লুডোর স্বৰ্গে ” বলে ওরা হা হা হা করে সবাই মিলে হাসতে লাগলো। “
ডাক্তার বাবু হেসে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন,
হঠাৎ চমকে তাকিয়ে দেখলেন চারদিক থেকে ওরা কারা ছায়ার মতো এগিয়ে আসছে, আর সমস্বরে বলছে -” লুডো খেলবেন ? ডাক্তারবাবু ‘

গবেষণা করছেন বৈদিক সাহিত্য নিয়ে। ভালোবাসেন কবিতা ও ছোটগল্প লিখতে , ছবি আঁকতে, যে কোনো সৃষ্টিশীল কাজে ডুবে থাকতে, আর ছোটদের সঙ্গে সময় কাটাতে।