| 16 মার্চ 2025
Categories
ইতিহাস

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় করপোরেট ক্যু ও সহিংসতা

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

ইবনে মোতালেব

 

ইংরেজি ভাষায় প্রথম যে কয়েকটি ভারতীয় শব্দ প্রবেশ করেছিল তার মধ্যে একটি ছিল ‘লুট’। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানের দেয়া তথ্যমতে, ১৮ শতকের আগ পর্যন্ত উত্তর ভারতের বাইরে এ শব্দটি খুব একটা ব্যবহূত হতো না। ঠিক এর পর পরই শব্দটি ব্রিটেনজুড়ে একটি বহুল ব্যবহূত শব্দে পরিণত হয়। শব্দটি কেন এবং কীভাবে সেই দূরবর্তী ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হলো তা জানতে আপনাকে পোয়েস দুর্গে যেতে হবে।

ত্রয়োদশ শতকে ওয়েলসের শেষ যুবরাজ Owain Gruffydd ap Gwenwynwyn এই প্রস্তর দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। আর যে জমির ওপর দুর্গটি নির্মিত হয়েছে, সেটা তিনি উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন ওয়েলসকে ব্রিটিশ রাজার হাতে হস্তান্তর করার বিনিময়ে। দুর্গের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সম্পদগুলো কিন্তু অনেককাল পরে সংগৃহীত হয়েছে, ইংরেজদের বিজয় আর দখলের কালপর্বে। পোয়েসের একের পর এক কক্ষ ভারত থেকে লুট করে আনা সম্পদে পূর্ণ হয়ে আছে। ১৮ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এসব সম্পদ ভারত থেকে লুট করেছিল।

ওয়েলসের এই দুর্গে যত মোগল আর্টিফ্যাক্ট প্রদর্শিত হচ্ছে, সেই পরিমাণ সংগ্রহ ভারতের কোনো একটি সংগ্রহশালায় একসঙ্গে নেই— এমনকি দিল্লিতে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরেও নেই। দুর্গের সম্পদের মধ্যে আছে আবলুস কাঠের ওপর সোনাখচিত হুক্কা, রত্নখচিত ড্যাগার, লাল নীলকান্তমণি ও সবুজ চুনি। আছে হলুদ পোখরাজ বসানো তলোয়ার সেট, হাতির দাঁতে তৈরি মেয়েদের গহনা।

এসব ধনরত্ন এতটাই জেল্লাদার ছিল যে, বিরাট ফ্রেমে বাঁধানো একটা চিত্রকর্ম আরেকটু হলেই আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছিল। সম্পদগুলো কীভাবে ওয়েলসের এই দুর্গে এল, তার ব্যাখ্যা রয়েছে সেই ছবিতে। ওক কাঠের তৈরি সিঁড়ির মাথায় একটু ছায়ার মধ্যে দেয়ালে ছবিটি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ছবিটা কোনো মাস্টারপিস নয়, কিন্তু গভীর মনোযোগের দাবি রাখে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে স্বর্ণখচিত পোশাকে একজন দুর্বল ভারতীয় যুবরাজ বসে আছেন। তার ডান পাশে উইগ পরা কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ নাগরিক। যুবরাজ বেশ আগ্রহভারে লাল কোট পরিহিত ইংরেজদের হাতে এক টুকরো কাগজ হস্তান্তর করছেন। ছবির দৃশ্যটি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের। তরুণ মোগল সম্রাট শাহ আলম তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে দিল্লি থেকে নির্বাসিত। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, শাহ আলম স্বেচ্ছায় কাগজটি ইংরেজদের হাত সমর্পণ করছেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি এটা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই কাগজ ছিল একটি নির্দেশনামা, যার মাধ্যমে সম্রাট শাহ আলম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা থেকে মোগল রাজস্ব কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নেন এবং তাদের পরিবর্তে বাংলার নতুন গভর্নর রবার্ট ক্লাইভ কর্তৃক মনোনীত কয়েকজন ইংরেজ বণিককে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ক্লাইভ তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক। নির্দেশনামায় রবার্ট ক্লাইভকে একজন অভিজাত, বিশ্বস্ত কর্মচারী এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে মোগলদের রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্বের ঠিকা দেয়া হলো একটি শক্তিশালী বহুজাতিক কোম্পানিকে। এবং কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের কর্মকাণ্ড নিজস্ব সেনা দ্বারা সুরক্ষিত ছিল।

ঠিক এ মুহূর্ত থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর মসলা-সিল্কের বাণিজ্য করা গতানুগতিক করপোরেশন রইল না, বরং ভিন্ন কিছু হয়ে উঠল। কয়েক বছরের মধ্যে ২০ হাজার স্থানীয় ভারতীয় সেনার সমর্থনে কোম্পানির ২৫০ জন কর্মচারী বাংলার শাসক হয়ে উঠল। একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি নিজেকে আগ্রাসী ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত করছিল।

ক্রমবর্ধিষ্ণু নিরাপত্তা বাহিনীর সাহায্যে কোম্পানি দ্রুতগতিতে পুরো উপমহাদেশকে দখল করে নেয়। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সেনাবাহিনীর আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ৬০ হাজার। বিস্ময়করভাবে এসব ঘটতে সময় লেগেছিল অর্ধশতকেরও কম সময়। প্রথমবারের মতো কার্যকরভাবে ভূখণ্ড দখলের ঘটনা ঘটেছিল বাংলায়, সেটা হয়েছিল ১৭৫৬ সালে। এর ৪৭ বছর পর কোম্পানির বিস্তার উত্তর ভারতে মোগলদের রাজধানী দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দিল্লির দক্ষিণে প্রায় পুরো ভারতেও কোম্পানির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। লন্ডনের এক বোর্ডরুম থেকে এই পুরো ভারত শাসিত হতে থাকে। ১৭৬৫ সালের অব্যবহিত পর নারায়ণ সিং নামে একজন মোগল কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘কয়েকজন বণিকের কাছ থেকে এখন আমাদের নির্দেশ নিতে হয়, যারা এমনকি নিজেদের পশ্চােদ্দশও ধুতে শেখেনি। এর পর আমাদের আর কী সম্মান অবশিষ্ট রইল?’

আমরা এখনো বলি যে, ব্রিটিশরা ভারত দখল করেছিল কিন্তু এ বাক্যটি একটি সত্যকে আড়াল করে রাখে। ১৮ শতকের শেষভাগে ব্রিটিশ সরকার নয়, বরং একটি বিপজ্জনকভাবে অনিয়ন্ত্রিত কোম্পনির দ্বারা ভারত দখল হয়েছিল। লন্ডনে পাঁচ জানালার ছোট্ট এক অফিসে ছিল সেই কোম্পানির কার্যক্রম আর ভারতে তা দেখাশোনা করতেন অস্থির এক সোশিওপ্যাথ— ক্লাইভ।

অনেক ক্ষেত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল করপোরেট দক্ষতার আদর্শ: কোম্পানির ইতিহাসের ১০০ বছরে লন্ডনের হেড অফিসে তাদের মাত্র ৩৫ জন স্থায়ী কর্মী ছিল। এই অল্প কয়েকজন কর্মচারীই ইতিহাসে এক তুলনাহীন করপোরেট ক্যু সংগঠিত করেছিলেন: দক্ষিণ এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তারা সামরিক বিজয় অর্জন করে লুটপাট চালিয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে করপোরেট পরিচালিত সহিংসতার ক্ষেত্রে এটাই সর্বোচ্চ উদাহরণ। আজকের দিনের সবচেয়ে বড় করপোরেশন যেমন— এক্সনমোবিল, ওয়ালমার্ট কিংবা গুগলের ক্ষমতা সামরিকায়িত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিধ্বংসী সীমানা দখলের ক্ষুধার কাছে নিতান্তই নস্যি। যদি ইতিহাস এখানে কিছু শিখিয়ে থাকে তাহলে সেটা হলো রাষ্ট্র ও করপোরেশনের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পরিণতি এবং করপোরেশনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলে তারা তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে।

যখন প্রয়োজন হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, তখন আইনিভাবে নিজেদের রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে নিয়েছে। তারা জোর খাটিয়ে, বিতর্ক করে প্রতিষ্ঠা করেন যে শাহ আলমের স্বাক্ষরযুক্ত দেওয়ানি কাগজটি কোম্পানির নিজস্ব সম্পত্তি, ব্রিটিশ রাজের নয়। যদিও ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্থাপনা রক্ষায় সরকার নৌ ও স্থলে সামরিক অভিযানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিল। তবে যেসব এমপি দেওয়ানির ওপর কোম্পানির অধিকারের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, তারা সবাই কিন্তু নিরপেক্ষ ছিলেন না। তাদের এক-চতুর্থাংশ ছিল কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার। অন্যদিকে কোম্পানিকে বিদেশীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা থেকে সুরক্ষা দেয়ার প্রয়োজন ছিল এবং এ বিষয়টি ব্রিটিশদের পররাষ্ট্রনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

চিত্রকর্মে ফুটে ওঠা হস্তান্তর ভয়াবহ ফলাফল বয়ে এনেছিল। সেদিনকার কিংবা আজকের করপোরেশনগুলোর মতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুধু তার শেয়ারহোল্ডারদের কাছেই জবাবদিহিতা করত। এ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা কিংবা এর দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন— এসব কোনো কিছুর দিকে মনোযোগ না দিয়ে তারা বাংলার সম্পদ পশ্চিমে পাচার করা শুরু করে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত হওয়ার আগে ১৭৬৯ সালে বাংলা দুর্ভিক্ষ দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল। এর পর আসে উচ্চহারের কর। কোম্পানির কর সংগ্রহকারীরা যা করত তা আজকের দিনে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে পরিচিত। আগের মোগল শাসনামলের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘সম্পদ তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য ভারতীয়দের অত্যাচার করা হতো। নগর, শহর ও গ্রাম তছনছ করা হতো; জায়গিরগুলো চুরি করা হচ্ছিল: আর এসবই ছিল একনায়ক এবং তাদের অনুগতদের আনন্দ ও ধর্ম।’

বাংলার সম্পদ দ্রুতগতিতে ব্রিটেনে পাচার হতে লাগল। অথচ এখানকার দক্ষ তাঁতি ও শিল্পীরা নতুন প্রভুদের কাছ থেকে ‘দাসের মতো’ নিগৃহীত হতে থাকেন। বাংলার বাজার ব্রিটেনের পণ্য দিয়ে সয়লাব হয়ে গেল। বাংলার লুটপাটের একটা অংশ গিয়েছিল ক্লাইভের পকেটে। ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার সময় ক্লাইভের নিজের সম্পদ ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার পাউন্ড, যা তাকে ইউরোপের সবেচেয়ে ধনী আত্মকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৭৫৭ সালে পলাশির জয় ছিল যতটা না সামরিক শৌর্য, তার চেয়ে বরং অনেক বেশি প্রতারণা, ঘুষ আর ভুয়া চুক্তির ফল। পলাশির জয়ের পর পরাজিত বাংলার শাসকদের কাছ থেকে ২৫ লাখ পাউন্ড কোম্পানির কোষাগারে জমা হয়ে যায়। আজকের বাজারের হিসাবে ২ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড জমা হয় ক্লাইভের খাতায় আর বাদবাকি ২৫ কোটি পাউন্ড যায় কোম্পানির ঘরে। বাংলার কোষাগারের সব সম্পদ ১০০টি নৌকায় তোলা হয় এবং গঙ্গা দিয়ে বাংলার নবাবদের প্রাসাদ থেকে কোম্পানির সদর দফতর ফোর্ট উইলিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়। এই লাভের কিছু অংশ পোয়েস দুর্গ পুনর্নির্মাণে ব্যবহূত হয়েছিল।

পোয়েস দুর্গে রাখা দেওয়ানি হস্তান্তরের চিত্রকর্মটি বিভ্রান্তিমূলক। চিত্রকর বেঞ্জামিন ওয়েস্ট কখনো ভারতে যাননি। এমনকি সে সময় একজন সমালোচক বলেছিলেন, ছবিতে যে মসজিদের গম্বুজ দেখা যাচ্ছে, সেগুলো সেন্ট পলসের প্রাচীন গম্বুজের মতো দেখতে। বাস্তবে এই হস্তান্তর মোটেই প্রকাশ্যে হয়নি। এলাহাবাদে মোগলদের দুর্গ দখলের পর সেখানকার প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত ক্লাইভের তাঁবুতে বসে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। শাহ আলম যে সিল্কের সিংহাসনে বসে আছেন প্রকৃতপক্ষে সেটা ছিল ক্লাইভের আর্মচেয়ার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ চেয়ারটি খাবার ঘরের টেবিলের ওপর তোলা হতো।

পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা এটাকে ‘এলাহাবাদ চুক্তি’ নাম দিয়ে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছে। প্রকৃতপক্ষে চুক্তির সব শর্তই ক্লাইভের নির্দেশমতো হয়েছে এবং ভীত শাহ আলম কেবল সেগুলোয় সায় দিয়েছেন। ১৭৯৫ সালে রয়্যাল একাডেমিতে যখন চিত্রকর্মটি প্রদর্শিত হয়, তখন এসব ভুল নির্দেশ করার জন্য সেই ঘটনার সাক্ষী কেউ জীবিত ছিলেন না। চিত্রকর্মটি সম্পূর্ণ হওয়ার কয়েক মাস আগে কাগজ কাটার ছুরি নিজের গলায় চালিয়ে ক্লাইভ ১৭৭৪ সালে আত্মহত্যা করেন। ক্লাইভকে গোপনে চিহ্নহীন একটি কবরে সমাহিত করা হয়। অনেক বছর পর খনন করতে গিয়ে একদল শ্রমিক ক্লাইভের কঙ্কালের সন্ধান পায় এবং সেটা আবার সেখানেই রেখে দেয়া হয়। সেখানে এখন একটি বাক্য খোদাই করা আছে— ‘প্রাইমাস ইন ইনডিজ’ যার অর্থ ‘ভারতে প্রথম’।

আজকের দিনে কোম্পানির সমালোচক নিক রবিনস নির্দেশ করেছেন যে, লিডেনহল স্ট্রিটে কোম্পানির সদর দফতরের স্থানে এখন রিচার্ড রজার্সের গ্লাস ও মেটাল লয়েডের ভবন মাথা উঁচু করে আছে। ক্লাইভের সমাধিস্থলের মতো এখানে কোনো চিহ্ন নেই। ম্যাকলারি কোম্পানিকে ‘দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ করপোরেশন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে মোগলদের সঙ্গে একমাত্র কোম্পানিরই তুলনা করা চলে। কিন্তু কোম্পানির কিংবদন্তি নিয়ে কোনো স্থাপনা খুঁজলে আপনাকে শুধু চারপাশে খুঁজে মরতে হবে। এখনকার কোনো করপোরেশনই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বর্বরতার সমতুল্য হতে পারেনি, তবে কোম্পানির মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিজের হাতে রাখতে অনেকেই চেষ্টা করেন।

ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্কের সূচনা কূটনৈতিক বা দূতিয়ালির মাধ্যমে হয়নি, বরং হয়েছিল বাণিজ্যের মাধ্যমে। ১৫৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ফাউন্ডারস হলে ৮০ জন বণিক ও অভিযাত্রী জমায়েত হন এবং একটি কোম্পানি শুরু করার জন্য রানী প্রথম এলিজাবেথের কাছে আবেদনের বিষয়ে একমত হন। এক বছর পর বণিকদের কোম্পানি ইস্ট ইন্ডিজে বাণিজ্য শুরু করে, ২১৮ জনের একটি দল ১৫ বছর ‘পুবের সঙ্গে বাণিজ্য’ করার একচেটিয়া অধিকার-সংবলিত রাজকীয় সনদ লাভ করে।

সনদটি নতুন এক ধরনের ব্যবসায়িক কাঠামোকে বৈধতা দেয়— পারিবারিক অংশীদারিত্ব নয় (তখনকার দুনিয়ায় এটাই ছিল সাধারণ বৈশিষ্ট্য), এবার দেখা গেল জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। এ কোম্পানি উন্মুক্ত বাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিক্রয়যোগ্য শেয়ার ছাড়ে, এভাবে বড় আকারের পুঁজি সংগ্রহের পথ উন্মোচিত হয়। এ ধরনের প্রথম জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ছিল মাসকোভি কোম্পানি, যা সনদ পেয়েছিল ১৫৫৫ সালে। এর ৪৪ বছর পর গঠিত হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেয়া সনদে কোথাও বৈদেশিক ভূমির ওপর দখলদারিত্বের অধিকারের কথা ছিল না। কিন্তু এটা প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিকে ‘যুদ্ধ করার’ অধিকার প্রদান করেছিল।

থমাস রো-এর অভিযানের ছয় বছর আগে ১৬০৮ সালের ২৮ আগস্ট উইলিয়াম হকিন্স সুরাটে অবতরণ করেন। হকিন্স ছিলেন কোম্পানির কোনো জাহাজের প্রথম কমান্ডার, যিনি ভারতের মাটিতে পা রাখার জন্য যাত্রা শুরু করেছিলেন। হকিন্স ছিলেন পানাসক্ত নাবিক, আগ্রায় তাকে সম্রাটের পক্ষ থেকে একজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে উপহার দেয়া হয়। হকিন্স এই স্ত্রীকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। এ ইতিহাস হাউজ অব কমন্সের ঝুলন্ত কমিটি ভুলে যেতে চায়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্রুতগতিতে উত্থান সম্ভব হয়েছিল ১৮ শতকে মোগলদের বিপর্যয়ের মাধ্যমে। ১৭৩৯ সালে মোগলরা কাবুল থেকে মাদ্রাজ পর্যন্ত বিপুল ভূ-ভাগ শাসন করতেন। ক্লাইভের বয়স তখন মাত্র ১৪। এ বছরই পারস্য থেকে দেড় লাখ অশ্বারোহী সেনা নিয়ে খাইবার গিরিপথ দিয়ে ভারতে হানা দেন নাদির শাহ। ১৫ লাখ সেনাসদস্যের মোগল সেনাদল নাদির শাহের কাছে পরাজিত হয়। ২০০ বছর ধরে মোগলরা যে সম্পদ জড়ো করেছিল, সেগুলো নিয়ে তিন মাস পর নাদির শাহ পারস্যে ফিরে যান। নাদির শাহ ভারত থেকে কাফেলায় করে শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় হীরা কোহ-ই-নূর, তার বোন দরিয়া নূর এবং ৭০০ হাতি, ৪ হাজার উট ও ১২ হাজার ঘোড়া এবং অনেক গাড়িতে সোনা-রুপা-রত্নপাথর বোঝাই করে নিয়ে যান। নাদির শাহ সে সময়ের হিসাবে ভারত থেকে ৮ কোটি ৭৫ লাখ পাউন্ড সমমূল্যের সম্পদ নিয়ে গিয়েছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে বাংলা থেকে ক্লাইভের আহরণ করা সম্পদের বেশ কয়েক গুণ।

নাদির শাহ কর্তৃক মোগল শক্তির ধ্বংসযজ্ঞ এবং সম্পদ সরিয়ে নেয়া দ্রুতই সাম্রাজ্যকে বিভক্ত করে দেয়। একই বছর ফরাসিদের অভিযান ‘দেস ইন্ডেজ’ শুরু হয় এবং তারা নিজেদের মুদ্রা ব্যবহার শুরু করে। কেউ বাধা দিচ্ছিল না, ফরাসি ও ইংরেজরা নিজেরা প্রশিক্ষণ দিয়ে সিপাহি তৈরি শুরু করে এবং সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একাই বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভারসাম্যকে উল্টে দেয়। রোমান যুগ থেকে পশ্চিমের সোনা ভারতে এসে জমা হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীনে আফিম সরবরাহ করত, এর পরিপ্রেক্ষিতে হংকংয়ের উপকূলীয় ঘাঁটি দখল করে এবং মাদকের ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতে আফিম যুদ্ধ লড়ে। এরা চীনের চা ম্যাসাচুসেটসে সরবরাহ করত, বোস্টন বন্দরে তাদের মালামাল খালাস আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে উসকে দিয়েছিল।

১৮০৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগলদের রাজধানী দিল্লি দখলের পর ২ লাখ ৬০ হাজার সদস্যের এক প্রাইভেট নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলে, যা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আকারের দ্বিগুণ। এই নিরাপত্তা বাহিনীর ফায়ারপাওয়ার ছিল এশিয়ার অন্য যেকোনো জাতি-রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। কোম্পানির এক পরিচালকের কথায়, এটা ছিল ‘সাম্রাজ্যের মধ্যে আরেকটি সাম্রাজ্য’। এই পর্যায়ে কোম্পানি বিরাট আকৃতির এবং বাস্তবধর্মী প্রশাসন ও সিভিল সার্ভিস গড়ে তোলে। কোম্পানি লন্ডনের ডকল্যান্ডের বেশির ভাগ নির্মাণ করেছিল এবং ব্রিটেনের বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেক ছিল তাদের হাতে। তাই যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের ‘দুনিয়ায় বণিকদের সর্বশ্রেষ্ঠ গোষ্ঠী’ হিসেবে দাবি করে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

আজকের অনেক মেগা-করপোরেশনের মতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একই সঙ্গে ক্ষমতাবান আবার ঝুঁকির মুখে ছিল। দেওয়ানি পেয়ে বাংলার সম্পদ দখলের পর রাতারাতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ারের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। কিন্তু এর সাত বছরের মাথায় কোম্পানির সাফল্যের বেলুন চুপসে যায়। লুটতরাজ ও দুর্ভিক্ষের কারণে ভূমির রাজস্ব ব্যাপকভাবে কমে যায়। কোম্পানি ১৫ লাখ পাউন্ড দেনায় পড়ে এবং ব্রিটিশ রাজের কাছে তাদের ১০ লাখ পাউন্ড কর বাকি পড়ে যায়। এ খবর ইউরোপজুড়ে প্রচার পেলে ৩০টি ব্যাংক ধসে পড়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে যায়।

আগ্রাসী করপোরেশনগুলো সরকারের কাছে অর্থসহায়তা চাইছে— আজকের দিনে এমন চিত্র কিন্তু হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। ১৭৭২ সালের ১৫ জুলাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকরা ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের কাছে ৪ লাখ পাউন্ড ঋণের জন্য আবেদন করে। দিন পনেরো পর তারা আরো ৩ লাখ পাউন্ডের চাহিদার কথা জানায়। কিন্তু ব্যাংক সর্বসাকূল্যে ২ লাখ পাউন্ডের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল। আগস্ট মাস নাগাদ কোম্পানির পরিচালকরা সরকারকে জানান, তাদের আরো ১০ লাখ পাউন্ড প্রয়োজন। পরের বছর এডমন্ড বার্ক সরকারি প্রতিবেদনে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন যে, কোম্পানির এই আর্থিক সমস্যা হচ্ছে একটি লক্ষণ, এ কোম্পানি সরকারকে রসাতলে নিয়ে যাবে।

কোম্পানি আসলেই এত বড় হয়ে গিয়েছিল যে, তার ভেঙে পড়ার দশা হয়েছিল। ১৭৭৩ সালে ইতিহাসের প্রথম মেগা-বেইলআউটের মাধ্যমে প্রথম আগ্রাসী বহুজাতিক কোম্পানিকে রক্ষা করা হয়।

ইতিহাসবিদরা অনেক কারণের কথা প্রস্তাব করেন: মোগল ভারত বিভক্ত হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন রাজ্যে পরিণত হওয়া, শিল্প বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয়দের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সম্ভবত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি ব্রিটিশ সংসদের সমর্থন। এ সম্পর্ক আঠোরো শতকজুড়ে আরো বেশি মিথোজীবী হয়ে ওঠে। ক্লাইভের মতো ধনীরা এমপিদের না হয় সংসদের আসনে কিনে নেয়। বদলে সংসদ কোম্পানিকে রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে সহায়তা করে। ফরাসিদের বিরুদ্ধে এই সরকারি জাহাজ ও সেনা কাজে লেগেছিল।

দুর্গের দেয়াল বেয়ে অতীতের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে আমি আজকের ভারতে করপোরেশন ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কের কথা ভাবছিলাম। পৃথিবীর বিলিয়নিয়ারদের ৬ দশমিক ৯ শতাংশ এখন ভারতীয় অথচ বৈশ্বিক জিডিপিতে ভারতের অবদান ২ দশমিক ১ শতাংশ। ভারতীয় বিলিয়নিয়ারদের মোট সম্পদ ভারতের জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ। অন্যদিকে চীনা বিলিয়নিয়ারদের ক্ষেত্রে এই পরিমাণটা ৩ শতাংশের কম। গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, এদের অনেকেই সম্পদ তৈরি করেছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে— জমি ও খনিজ সম্পদের ওপর অধিকার স্থাপন করে, আইন শিথিল করে এবং বিদেশী কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সুরক্ষা পেয়ে।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখনো ভারতে খল চরিত্র হিসেবেই পরিচিত। অবশ্য এর উপযুক্ত কারণও আছে। ১৯৮৪ সালে ভোপালের বিস্ফোরণে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু সহজে ভোলার মতো ঘটনা নয়। গ্যাস প্লান্টের মালিক আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিয়ন কার্বাইড শাস্তি ও বড় কোনো জরিমানা এড়িয়ে যেতে পেরেছে। তবে ভারতীয় নীতিনির্ধারক ও গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে ভারতের বড় বড় করপোরেশন যেমন— রিলায়েন্স, টাটা, ডিএলএফ ও আদানি অনেক বেশি দক্ষ। রিলায়েন্স এখন ভারতের সবচেয়ে বড় মিডিয়া কোম্পানি। এই ব্যবসায়িক গ্রুপের মালিক মুকেশ আম্বানির রয়েছে সীমাহীন রাজনৈতিক ক্ষমতা।

বিগত কংগ্রেস সরকারের শেষ পাঁচ বছর বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির ঘটনার মধ্য দিয়ে কেটেছে, যার মধ্যে আছে— জমি, খনিজ সম্পদ থেকে মোবাইল ফোনের স্পেকট্রাম প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি। এসবের ফলে জনগণের চরম বিতৃষ্ণাই ছিল গত নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের মূল কারণ। যদিও কংগ্রেস-ঘনিষ্ঠ সেই পুঁজিপতিরা কিন্তু এজন্য তেমন কোনো দুর্যোগ পোহাবে না।

গণতন্ত্রের ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচন হয় ভারতে। করপোরেট অনুদানের স্রোতে ভেসে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেছেন। প্রকৃত অঙ্কটা জানা কঠিন কিন্তু যতদূর জানা যায় যে, মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি শুধু টেলিভিশনের প্রচারণাতেই খরচ করেছে কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার। এ অর্থের ৯০ শতাংশই এসেছে অজানা করপোরেট উত্স থেকে। কে জানে এই অর্থসহায়তার বিনিময়ে করপোরেটরা কী কী সুবিধার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। মোদিকে সমর্থন দিয়ে করপোরেটরা সবই নিজের ইচ্ছামতো করতে পারবেন, এমনটা নয়। কিন্তু অর্থসহায়তার বিনিময়ে তারা নিশ্চয়ই কিছু পুরস্কার পাবেন।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর রঘুরাম রাজন মুম্বাইয়ে দেয়া এক ভাষণে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছিলেন, করপোরেট মানি সংসদের অখণ্ডতা, ন্যায়পরায়ণতাকে ক্ষয় করছে। রাজন বলেছেন, ‘আমাদের গণতন্ত্র ও অর্থনীতি আগের চেয়ে গতিশীল হয়েছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় একটা বিষয় উঠে এসেছে যে, আমরা কী গোঁড়া সমাজতন্ত্রের স্থলে গোঁড়া পুঁজিবাদ নিয়ে এসেছি; যে ব্যবস্থায় ধনী ও প্রভাবশালীরা অসত্ রাজনীতিবিদদের অর্থ দিয়ে বদলে জমি, খনিজ সম্পদ ও স্পেকট্রাম পাবেন। স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতাকে হত্যাকারী গোঁড়া পুঁজিবাদ স্বাধীন উদ্যোগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর। এবং বিশেষ স্বার্থকে জণগণের স্বার্থের উপরে স্থান দিয়ে এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষতি করছে।’

রঘুরাম রাজনের এই উদ্বেগ ঠিক যেন ২০০ বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিয়ে ব্রিটেনে সৃষ্ট উদ্বেগের সমতুল্য। সে সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল সম্পদ আর রাজনৈতিক দুর্নীতির প্রতিশব্দ। ক্রুদ্ধ হোরাস ওয়ালপোল বলেছিলেন, ‘ইংল্যান্ড এখন কী? ভারতীয় সম্পদের একটি জলাশয়।’ ১৭৬৭ সালে সংসদের বিরোধিতাকে কোম্পানি নিষ্ক্রিয় করে দেয় রাজকে ৪ লাখ পাউন্ড প্রদান করে। পরিবর্তে কোম্পানি বাংলায় শাসন অব্যাহত রাখার অনুমতি পায়। কিন্তু ১৭৮৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষোভে আগুন জ্বলে ওঠে। এদিন ক্লাইভের উত্তরসূরি বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসকে লুটপাট ও দুর্নীতির দায়ে অভিশংসন করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের নেয়া ব্যবস্থার মধ্যে এটাই সবচেয়ে কঠিন। আর এটা করা হয়েছিল বিশিষ্ট বাগ্মী এডমন্ড বার্কের সাহায্যে।

সেদিনের বিচারে বার্ক কঠোর অবস্থান জানিয়েছিলেন ভারত থেকে ফেরা কোম্পানির নবাবদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে, এই নবাবরা তাদের স্বার্থে ভোট দেয়ার জন্য এমপিদের কিনে নেয় আবার অন্যদিকে ভারত থেকে লুট করা সম্পদ ব্যবহার করে সংসদে বসার আয়োজন করছে। বজ কঠিন গলায় সেদিন বার্ক বলেছিলেন, ‘আজ কমন্স অব গ্রেট ব্রিটেন ভারতে যাওয়া অপরাধীদের বিচার করছে। আগামীকাল এই অপরাধীরাই হয়তো কমন্স অব গ্রেট ব্রিটেন বনে যাবে।’

আধুনিক উদারতাবাদী গণতন্ত্রের একটি বড় বিপদকে বার্ক সে সময় সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছিলেন— নিষ্ঠুর কোম্পানি কর্তৃক আইনপ্রণেতাদের কিনে নেয়া। এখনকার করপোরেশনগুলো যেমন অবসর নেয়া রাজনীতিবিদদের নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রভাবকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও সেটা করেছিল। যেমন লর্ড কর্নওয়ালিসকে ভারত দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া।

ওয়ারেন হেস্টিংস অবশ্য শেষমেশ খালাস পেয়েছিলেন, কিন্তু ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সংসদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সেটা ছিল কোম্পানি দেওয়ানি পাওয়ার ৯০ বছর এবং হেস্টিংসের বিচারের ৬০ বছর পরের ঘটনা। ১৮৫৭ সালের ১০ মে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী তাদের মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কোম্পানি সফলভাবে সেই বিদ্রোহ দমন করে। নয় মাসের বিদ্রোহ শেষ হওয়ার পর কোম্পানি শেষবারের মতো তার নিজের অতুলনীয় কর্মকাণ্ডের আরেকটি উদাহরণ সৃষ্টি করে। গঙ্গার তীরে শহরগুলোয় তারা ১০ হাজার সন্দেহভাজন বিদ্রোহীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে— এটা সম্ভবত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাত্ত অধ্যায়।

যথেষ্ট হয়েছে, যে সংসদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়েছিল এবার তারাই তাদের সৃষ্টিকে হত্যা করল। ব্রিটিশ রাষ্ট্র, করপোরেট লোভ এবং অদক্ষতার পরিণতি সম্পর্কে সতর্কতা জারি করে। ১৮৫৯ সালে এলাহাবাদ দুর্গের চার দেয়ারের মধ্যে বসে গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেন যে, ভারতে থাকা কোম্পানির সব সম্পদ সরকারীকরণ করা হয়েছে এবং ব্রিটিশ সিংহাসনের অধীনে নেয়া হয়েছে। কোম্পানির পরিচালকদের পরিবর্তে এখন থেকে ভারতের শাসক হবেন রানী ভিক্টোরিয়া।

পরবর্তী ১৫ বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে এবং ১৮৭৪ সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কোম্পানির ব্র্যান্ড নামটি এখন এক গুজরাটি ব্যবসায়ীর দখলে, লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে কোম্পানিটি একটি শোরুম থেকে মসলা ও খাবার বিক্রি করে। পোয়েস দুর্গের বর্তমান মালিক একজন বাঙালি নারীকে বিয়ে করেছেন এবং সেই ভারতীয় রীতিতে হওয়া বিয়ের একটি ছবি দুর্গে প্রদর্শিত হচ্ছে। এর অর্থ ক্লাইভের উত্তরসূরিরা আধা-ভারতীয়।

করপোরেশনের ক্ষেত্রে— ইউরোপীয়দের একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার তাদের প্রতিযোগিতার কালে সহযোগিতা করেছে। এ উদ্ভাবনটি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক অভিযান শুরুর সমসাময়িক কিন্তু এই ঔপনিবেশিক তত্পরতায় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তা বিকশিত হয়েছে। ইতিহাসবিদরা ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের কিংবদন্তির কথা আলোচনা করতে গেলে সাধারণত গণতন্ত্র, আইনের শাসন, রেলওয়ে, চা ও ক্রিকেটের কথা বলেন। কিন্তু ভারতে আসা ব্রিটেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলোর একটি হচ্ছে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। ভালো বা খারাপ যে রকমই হোক, এ ধারণাটিই দক্ষিণ এশিয়াকে বদলে দেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় ধারণা। এর প্রভাব নিশ্চিতভাবেই কমিউনিজম, খ্রিস্টধর্মের প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ, এমনকি মনে হয় গণতন্ত্রের চেয়েও বেশি।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আজ আর নেই। আমাদের ভাগ্য ভালো যে, সেই কোম্পানির মতো অন্য কেউ এখন নেই। আয়ের বিবেচনায় এখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় করপোরেশন হচ্ছে ওয়ালমার্ট, তবে তাদের সম্পত্তির মধ্যে কোনো পারমাণবিক সাবমেরিন নেই; ফেসবুক কিংবা শেলের পদাতিক সেনা নেই। তার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আজকের অনেক জয়েন্ট স্টক কোম্পানির আদর্শ। সবচেয়ে ক্ষমতাধর কোম্পানিগুলোর এখন আর নিজস্ব সেনাবাহিনী দরকার হয় না। তারা নিজেদের সুরক্ষা ও বেইলআউটের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করে। করপোরেট ক্ষমতার অপব্যবহার ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ কীভাবে রাষ্ট্রের স্বার্থ হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকাণ্ড ইতিহাসে সতর্কবাণী হয়ে থাকবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ৩১৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তার গল্প আজকের দিনের মতো এত প্রাসঙ্গিক কখনো ছিল না।

 

 

 

উইলিয়াম ডলর‌্যাম্পল ও অনুবাদ: শানজিদ অর্ণব

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত