বামুনের কাঁধ | বিপুল খাটনিয়ার | অনুবাদক- নন্দিতা ভট্টাচার্য
১৯৫৩ সালে তিনসুকিয়া জেলায় দেওহালী চা বাগানে লেখকের জন্ম। ১৯৭৫ সালে গুয়াহাটী বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্বে স্নাতক ডিগ্রী লাভ। ‘নতুন পৃথিবী’তে প্রকাশিত গল্পগুলোর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে পাঠকের সাক্ষাৎ। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প সংকলনগুলো হল- খোজর শব্দ, দখার, তাই কাপর নিপিন্ধে, ভিন্ন জীবন ভিন্ন কথকতা ইত্যাদি। তাঁর সদ্য প্রকাশিত গল্প সংকলন’ ঘঁরিয়ালডঙ্গার কথা’।
আমাদের বাড়ির কাছেই একটি বিল ছিল ; আকারে বড় নয় কিন্তু নাম বড়বিল। খরার পর পলি পড়লে কাকডোঙ্গা দিয়ে জল ঢুকে চারদিক ভাসিয়ে বর্ষা ঢুকত। উপচে পড়া জলে বড়বিল ফুলে ফেঁপে ভীষণ আকার ধারণ করত। বড়বিলের বাড়তি জলে আশেপাশের গাঁয়ের বাড়ীঘর টলমল করে উঠত। মনে পড়ে এরকম ভরা বর্ষায় একবার আমাদের ভিটে ছুঁয়ে সরে গিয়েছিল বর্ষার জল।
ঠাকুমা তখনও বেঁচে ছিল। বড়বিলে অনেক ইতিহাস জানত। সেই যেবার ভিটে ছুঁয়ে সরে গিয়েছিল জল সেবার মনের ভেতরের অগাধ বিশ্বাস থেকে বলল, ‘দেখলি বাবা! ভিটে ছুঁয়েই বড়বিলের ঘোলাজল কেমন সড়াৎ করে সরে গেল। বুঝলি, তোদের ঠাকুরদা ছিলেন একজন সাত্ত্বিক পুরুষ। তাঁর নামছিল জগতজোড়া, পতিতপাবন। সাত গাঁয়ের লোক ওর আশীর্বাদ নিয়ে জাল-পলো হাতে নিত।
ঠাকুমা ইচ্ছে করেই স্বামীর নাম মুখে নিচ্ছিল না। অবশ্য সমাজের নিয়মই ছিল এমন। কেউই স্বামীর নাম মুখে নিত না , শত অসুবিধেতে ‘উনি’ বা ‘ছেলের বাবা’, এভাবেই কাজ সারা হত। যাই হোক, পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের ভিটে ছুঁয়ে ‘প্রণাম’ জানিয়ে সরে যাওয়া বড়বিলের জল বাড়ির অন্দরের পুকুর, মাছে টইটম্বুর করে চলে যাওয়া ছাড়াও বাড়িকে উর্বরা করে যেত। সেই মাটি কুপিয়ে নিজের বাড়ীর সার জাবর দিয়ে আমাদের সীমানায় লেগে থাকা তুলারাম খুড়া, যাকে আমরা সংক্ষেপে বলতাম ‘তুলা খুড়া‘ ,সেই তুলা খুড়াই বছরের বিভিন্ন সময়ে দেখে শুনে যত্ন করে কাঠ কাঠি দিয়ে, পাহারা দিয়ে শাক সবজির ক্ষেত করত। সেই ফসল তুলাখুড়াও নিত। কিন্তু বাবার অনুমতি নিয়ে, নেয়ার সময় ‘এতুকুই নিচ্ছি’ বলে নেয়ার পরিমাণটুকু সবাইকে দেখিয়ে নিত।
ঠাকুমার মুখে শোনা তুলাখুড়ার মা রসকী বাই ছিল জাত জেলেনী। ছেলে-বৌমা বা নিজেও টাঙ্গি জাল মেরে বা টোপ পেতে যে মাছ ধরত সেটা মাথায় করে গায়ের ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করত। বড় মাছ জালে পড়লে অবশ্য ছেলে হাট বা সেন্টারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করত। কিন্তু ছোট-ছুটা মাছের বেশিরভাগটাই বিক্রি করত রসকী বৌ।
মাছগুলো কলাপাতায় ও ভোগপ্রসাদের মত থরে থরে ভাগ করে নিত। বেশিরভাগটাই ছিল পুঁটি-দাড়কিনা , কখনও খলিসা-মৌরলা-কৈ বা জ্যান্ত গড়ইয়ের পোনা। কিন্তু শিঙ্গি, কাঁকিয়া, কাঁদাজলের ছোটমাছ ছোট ছোট ভাগে রাখা; মাছের ভাগ তো নয় যেন ছেলের জন্য বেড়ে রাখা ভাতের পাত।
যাই হোক,মাছের বদলে পয়সা নেয়া রেওয়াজ ছিল না। গড়ই মাছ নিত ধানের বদলে। তুলা খুড়াদের ধানের জমি ছিল না। কিন্তু গা-খাঁটা মানুষের অভাবে গাঁয়ের অনেকের মাটি খালি পড়ে থাকলেও ক্ষেত করার প্রতি কারও মন ছিল না। দিনের দিন উদোম পিঠে রোদের প্রখর তাপ নিয়ে বড়বিল, কাকডোঙ্গা অথবা ধনশিরিতে মাছ ধরে যা আনন্দ পেত সে আনন্দ ধানক্ষেত করায় কোথায়?
বাবাদের যুবা বয়েসে রসকী বাইর করুণভাবে মৃত্যু হল। চালনী মারতে সমবেত ভাবে বড়বিলে নেমেছিল। পৌষের হাড় কাঁপান শীত। বড় বড় কৈ মাছ কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে থাকে। মাছের ‘বাঁক’-দুই খলুই ভর্তি হতে আর কতক্ষণ? কিন্তু হঠাৎ কি হল কে জানে , ওর দুটো পা বড়বিলের কাদায় আটকে গেল । যতই টেনে তুলতে চায় ততই আরও চেপে বসে। এদিকে নীচ থেকে হাড় কাঁপান ঠাণ্ডা উঠে আসছে, ক্রমে যেন জমে গেল। টেনে–হিঁচড়ে তাকে যখন তুলে আনা হল তখন বাইরের অবয়বটাই রয়েছে, মানুষটা আর নেই। ঠাকুমার প্রায় সমবয়েসী রসকী বাই অনেকদিন আগে নাকি একবার ঠাকুমাকে বলেছিল,‘ দেখ বামনী! দেখবে এই বড়বিলই একদিন আমার কাল হবে!’
‘মুখে আগুন তোর! মুখে চুন পড়ুক তোর।‘
‘বললাম না বামনী, বিধাতা নয় , আমি স্বয়ং এই দশার জন্য দায়ী। … একবার কি হল জান? ‘
বলে কি রসকী! ঠাকুমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।
সেবার বড়বিলে সবে চর পড়তে শুরু করেছে । নিয়ম মত প্রতিবছর না পারলেও তিন-চার বছর অন্তর অন্তর বড়বিলের পারে ‘কেতেকি-পুখুরী’র থানে ছয়–সাতটি গ্রামের জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ জমা হয়! সেবার ও জমা হল। কয়েকবছর ধরে সম্ভব হয়নি ‘গঙ্গাপূজা’ করা। গঙ্গাপূজা মানে মাছ ধরার আগের পূজা। মাছের জীবন আছে। মাছ ধরা মানে তো জীব নিধন করাই? তাই এই কাজের আগে গঙ্গাপূজা! তাছাড়াও তো রয়েছে অনেক রকমের মঙ্গল–অমঙ্গল।
গঙ্গাপূজার কথা শুনেই রসকী শরীর আনচান করে উঠল। ছয়-সাতটা গ্রামের মানুষ ঢোলে-ডগরে, খোলে–করতালে বড়বিলের পারের পূজায় ভাগ নেবে আর বিলের পারের জালুয়া রসকীর গায়ে ছারপোকা কামড়াবে না তা কি হয়? কিন্তু কি হল? ভোরে ঘুম থেকে উঠে রসকী বাই পরনের মেখলার সামনা পিছন দেখল, দুদিকই লাল; তারমানে ওর মাসিক হয়েছে। কিন্তু জলের পোকা রসকীর গায়ে যেন বাঁদরলাঠির চুলকানি, ও কি করে সহ্য করবে? গঙ্গাপূজার পবিত্রতার কথা ও ভুলে গেল। কিন্তু বয়েস যত বাড়তে লাগল ততই সেই দিনের ‘পাপে ছোঁয়া’র কথাই ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। আর হলও তাই।
বলার সময় ঠাকুমার ঘোলা চোখ জুড়ে কান্না, বর্ষার বড়বিলের মত জল উপচে পড়ত জল।‘ এক ঠেরে নির্বুদ্ধির দণ্ড‘, রসকী বাইয়ের কথা উঠলে বার বার এই কথাই বলে কথা শেষ করত ঠাকুমা।
মায়ের মৃত্যুর পর বাড়িটাকে কি যে ভূতে ধরল, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই হল। পুরানো ভিটেতে রয়ে গেল কেবল তুলাখুড়া। সে তো ভিটেটা আমাদের দিয়ে ধনশিরির ওপারে উঠে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবা টেনে ধরল বলল, ‘শোন তুলা! কথা শোন! এটা তোদের বাপ দাদার ভিটে। আমাদের ঠাকুরদার ঠাকুরদা আর তোদের ঠাকুরদার ঠাকুরদা একসঙ্গে এই একই বাড়িতেই থাকতেন। আরও কয়েকঘর ছিল, ভাগে ভাগে এসেছিল। গাছের বীজ, চারা বাড়লে গাছও সরে যায়,বাতাস সেই গাছের গুটি দূরে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সেইজন্য বেজার হয়ে কেউ মূল গাছকে উপড়ে ফেলে নাকি?
দশ-কুড়ি শপথ, তুই এই ভিটে ছেড়ে নড়বি না।
বামুনের শপথের মূল্য থাকুক বা না থাকুক, তুলা খুড়ার পরিবার ভিটেতে রয়ে গেল। বাবার যজমানির মত তুলাখুড়াও সেই প্রাচীন জীবিকাকে খামচে ধরে রইল। অবসর সময়ে দুজনে একসঙ্গে বসে , এক হুঁকো থেকেই ধুমপান করে; কখনও তুলাখুড়া কলকে নতুন করে সাজিয়ে জুত করে বসে। ধোঁয়া খাওয়ার হুড়ুক হুড়ুক শব্দ শুনলে উঠোনের মধ্যে দিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যাওয়া ব্যাঙেরাও থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু কেবল খুড়াই নয়, কখন ক্বচিৎ খুড়িও আসে, কাঠের পিড়ির বদলে ধান-খড়ের তৈরি আসনটাই টেনে বসে, যে পেতলের গেলাসে চা দেয়া হয় সেটা ধুয়ে উপুড় করে রেখে যায়।
‘দাদা, কাকডোঙ্গার বরালি ধরেছি, ধর তিন সের সাড়ে তিন সের ওজনের। রাখলাম পাকঘরের এক পাশে। … না না; দাম আর কি দেবে। বাড়ীর মানুষ বলে কথা।
আমার মা কিন্তু বাবার পুরো উল্টো, তিনি ইতিহাসের মায়েদের মতই ‘জাত বামনী’। হয়ত এমন ভাবভঙ্গি শাশুড়ির কাছ থেকেই পেয়েছিলেন বোধহয় । বুকের ওপরে একমাত্র হলুদ মেখলা ফেলেই পাকঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে বলল,
‘এই যে অমুকের বাবা! পুরো পুরোটা হলে আলাদা কথা। সেইজন্য ডোমে কাটা মাছ!’
‘ চুপ! চুপ থাক!’ বাবা গজ গজ করতে লাগল- জলের জীব মাছ , তার আবার গোটা কি কাটা কি! মাছ মাছই। আর তুই তোলারামকে কি ডোম ডোম করিস? ‘
‘কেন? ডোম নয় নাকি? গোঁসাই – ব্রাহ্মণ বুঝি?’
‘ডোম আলাদা, জেলে জালুয়া আলাদা।‘ বাবার টিকি ছিল, কিন্তু রাগ উঠলে বেনিয়ানের ওপর দিয়ে লগুণ বের করে আঙ্গুলে পাকিয়ে পাকিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তেন।‘ ওরা জেলে, আমরা যজমানি করি, কেউ ক্ষেত ওরে, ওরা মাছ ধরে, মাছ ধরাই ওদের জীবিকা। আর ডোম? সমাজে সবচেয়ে পূন্যের কাজ ওরাই করে। আমাদের গ্রামীণ মানুষ এই কাজের ভাগ অন্য আর কারোকে করতে দেবে না।‘
বেদের শ্লোক অনায়াসে উচ্চারণ করা, স্নান না করে অন্ন-জল গ্রহণ না করা আমার বাবার মুখের কথায় মা আর কিভাবে ভুল ধরে! এরকম রুদ্র মূর্তি ধরার পর যেদিনই রুটি–রোজগারের সন্ধানে বাবা বাইরে বেরোয় আমার কানে অন্য এক গায়েত্রি মন্ত্র গুনগুন করেন। ‘শুনেছিস? ওরা আলাদা, আমরা আলাদা। আগুন আর জল যেরকম , আমরা ওরাও সেরকম তোর বাবা যা করে করুক, তোরা কিন্তু সেদিকে কান দিবি না । ‘
কিন্তু মায়ের এই ব্রহ্ম বাণে কার বক্ষ বিদারে?
আমাদের ছোটবেলায় তুলাখুড়াদের দুটো দুধেল গাইছিল। একজনকে দুইয়ে আর একজনকে দোয়াত। আমার কাজ ছিল খুড়ার বাড়ী গিয়ে আধ সের দুধ আনা। সেই সুযোগ আমি প্রায়ই নিতাম, খুড়ির সদ্য ওথলান গরম একবাটি দুধ খেয়ে।
কিন্তু পরে একদিন ধরা পড়ে গেলাম।
ঠাকুমা একবারে তুলকালাম করল। ‘এই যে সবাই শুনছ? এই অধম ডোম-বরাহীদের(আদিবাসী) বাড়ীতে দুধ খেয়ে আমাদের সাতপুরুষকে নরকে পাঠাল। হে প্রভু! গোঁসাই আমার। হে ভগবান রক্ষা কর। কোনও নিদান নেই?
নিদান নেই কে বলল?
এমনিতেই বামুন! খাওয়ার জিনিস চোখের সামনে থাকলে লোভ সামলান যায় নাকি?
বাবা ঠাকুমাকে বোঝালেন, দধি, দুগ্ধ, ঘৃত , মধু , এবং নদীর জলদৈব ভোগ্য দ্রব্য। এখনে পাপ পূণ্যের কথা কোথা থেকে আসে?
‘কাঁচা হলে এক কথা, কিন্তু ও তো তপ্ত দুধ গিলে এসেছে?’
বাবা লগুণের গিঁট খামচে ধরলেন।
‘হে মাত গোঁসাইনি!’ বাবা কোনও মতে বললেন, ‘শাস্ত্রে নিদান আছে। গো-মূত্র ও গো-বিষ্ঠা গোবরের জল।‘
যথা নিদান!
তুলাখুড়ার গোয়াল ঘর থেকেই সংগ্রহ করা হল দু রকমের অমৃত তারপর স্নান করিয়ে শুদ্ধ করে তাই দিয়ে দূর করা হল এই অধমের পেটের হলাহল।
এর পরও বুঝি ‘বামনাইপনা‘ রাখতে পেরেছি? দুধ দোয়ানর সময় গরুগুলোর দিকে বেজারমুখে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে তুলাখুড়ি একফাঁকে খুড়ার দুধের পাত্র থেকে এক বাটি দুধ আমার হাতে দিয়ে বলতেন –‘ খা বাবা! কাঁচা দুধে কোন দোষ নেই।‘
শুধু দুধই নয়, তুলা খুড়ার ভিটের লাগোয়া ছোট্ট বাড়িটার প্রতি আমাদের বয়েসি ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সব ছেলে-মেয়েদের যে কি আকর্ষণ ছিল সে বোঝাবার নয়। দুটো আমগাছের আম এক সময়েই পাকে, গাছের নিচ ছেয়ে যায় পাকা আমে। নড়তে পারিনা ওখান থেকে । খুড়া নিজে ফর্মুটি দেয় গাছে, কাঁচা আম পেকে থলথলে হয়, ধুপধাপ করে নীচে পড়ে। এই সবটাই আমরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখি। গাঁয়ের কলিতা, কেওট, কোচ, অহোম–কুহুম সবগুলোর সঙ্গে একঘর বামুনের সাত-আটবছরের ছেলেটাও একাকার হয়ে যায়। তখন আর সঙ্গের কোন ছেলে আমাকে ‘কটা, খকুয়া বামুনের জাত‘ বলে উপহাস করে না।
একবার হল কি, বাবা বাড়ী নেই দুইদিন দুইরাত; দূরের এক যজমানের বাড়ীতে বিয়ের অনুষ্ঠান। বাবার পাঁজিপুঁথিতে ওদের চৌদ্দ পুরুষের নাম ঠিকানা , জন্ম মৃত্যুর ক্ষণ । তাই বাবাকে ছাড়া ওদের চলে কি করে ?
যাবার সময় বাবা বলে গেলেন, ‘বাপু! তিনদিনের দিন ফিরে আসব। আবহাওয়ার তো এই হাল, রাস্তা ঘাটের অবস্থা তো তুমি দেখেছই। ফিরে আসতে দু একদিন দেরী হতে পারে।‘
আর পায় কে? বাড়ীর দেবী দুর্গা হলেন মা। কিন্তু তিনি পুরুষ ‘দেবতা’ তো নন , রক্ত-মাংসের দেবীকে আর কে ভয় করে?
সেই তিনটে দিন যে কি আনন্দ ফুর্তিতে কেটেছিল !
কিন্তু বাবা বাড়ী ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই চৌতাল লাগল। কোনও এক যজমানের বাড়ীতে রাত কাটিয়ে সকালেই বাড়ী ঢুকেছেন।
‘দরজায় পা দিয়েই গন্ধ পেয়েছি। … চাতালে ওটা কি?’
একেবারে ঊষা সকালে পুকুরে এক ডুব দিয়ে আসার অভ্যেস মায়ের , গাঁয়ের লোক ওখান থেকে খাওয়ার জল নেয়। অন্যেরা যদি কেউ এই কাজ করে তবে পাড়ার লোক রে রে করে ওঠে ; কিন্তু ‘ আদত’ বামনির এরকম কর্মে সকলে চোখ বুঁজে থাকে, নয়ত সৌভাগ্যের কারণ বলে মান্য করে। যাই হোক, ভেজা কাপড়েই মা দৌড়ে আসেন।
‘কিসের গন্ধ রে, কিসের গন্ধ!’
‘পাকা কাঁঠালের গন্ধ।‘
ছোটবেলায় নাকি বাবার প্রিয় ছিল কাঁঠাল। গাছের তলায় বসেই একটা গোটা কাঁঠাল মেরে দিত। একবার হল কি একটা কাঁঠালের কোয়া গলায় আটকে গেল, না এদিক যায়, না ওদিক, এদিকে পেট ফুলে ঢোল। তখন দাদু আয়ুর্বেদিক টোটকা হিসেবে এক খাবলা পুরান নুন খাইয়ে বাবার প্রাণ রক্ষা করল। বাবাও ভয়ে শপথ নিল, জীবনে আর কখনও কাঁঠাল মুখে দেবে না। নিজেও খায় না, ভবিষ্যৎ পিড়িকেও সাবধান করে।
সিম গাছের সমাধি হতে আর কতদিন লাগবে?
‘ব্রাহ্মনের ঘরে চণ্ডাল জন্মালি। কাঁঠাল চুরি করে এনেছিস? তাও আবার তুলারামের ভিটে থেকে! লজ্জা লাগল না বাঁদর কোথাকার! ধর। তুলে …
আনার সময় ভারি ছিল না, এখন আর তুলতে পারি না!’
চোর, চোর, চোর, মাথা ভাংগব তোর! এবার বাবার হাত লগুণের গিঁটে গেল না। সেই লগুনহীন হাতের বজ্রাঘাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে অচেতন হয়ে গেলাম। জ্ঞান যখন ফিরল, দেখলাম, বাবা দুঃশাসন রক্তের শুশ্রূষা করছে আর ‘গান্ধারী’ মা কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে পড়েছে।
‘আপনি মানুষ না জমদগ্নি ঋষি। এই একফোঁটা ছেলেটাকে এভাবে আঘাত করছেন !’
মেয়েমানুষকে সম্মান করে এই জন্যে! তিনি গরজে উঠলেন, লকাইর ছেলে মাতালকে দেখনি? ও কি ওর সম বয়েসি নয়? হাল চষা চাষার মাতাল ছেলে হালের মুঠি ধরতে না পারলেও কাদার
মধ্যে দিয়ে ক্ষেতে চা–জলখাবার নিয়ে যেতে পারে আর আমার ছেলে বামুনের ঘরে জন্মে আম কাঁঠাল চুরি করে বাউন্ডুলেপনা করে সময় কাটায়! বাবা, আমার টকটকে লাল কান দুটো টেনে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করাল এবং দুটো হাত ও বুকের মাঝে ‘ব্রহ্ম-ভারি’ আমায় খা আমায় খা কাঁঠালটা তুলে দিয়ে গর্জে উঠল, ‘নে, নে। এগো, এগো।‘
গরুর ল্যাজে মোঁচড় দিয়ে, মাঠে হাল জুড়তে নেয়া বলদের মত হ্যাঁচর প্যাঁচর করতে করতে তুলা খুড়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম এবং উঠোনে পা দিয়েই কাঁঠালটা রেখেই কানে ধরে হাঁটুমুড়ে বসার ‘ব্রহ্মবানী’ পালন করলাম। তুলাখুড়া গরুর দুধ দোয়ান ছেড়ে দৌড়ে এগিয়ে এল আর বাজে পোড়া মানুষের মত স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। ‘তুলা, এই কুকুরটা তোর গাছের এই কাঁঠালটা চুরি করেছে। পারিস যদি এই নরাধমের সঙ্গে আমাকেও ক্ষমা করে দে।
মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে তুলাখুড়া বারান্দার ধারেই বসে পড়ল।
‘হে প্রভু!’ যখন হুঁশ এল, তুলাখুড়া অনুনয় বিনয় করে বলল, বল কি দাদা। এত কাঁঠাল গাছে কার জন্য? আমাদের তো নিঃসন্তান। ওরাই যদি না খায় তো খাবে কে? আর চুরি করা যে বলছ , আমার বাড়ীর ফল তোমার ছেলে নিলে চুরি করা বলে?… বামুনের ছেলে তুই ,আমাকে আর নরকের দিকে ঠেলে দিস না । দাঁড়া, তোকে আমি একটা পুরুষ্টু কাঁঠাল পেড়ে দিচ্ছি। কাঁকালে কটারি গুঁজে লপ লপ করে গাছের ওপরে উঠে গেল।
কতদিন আগের যে কথা! বাবা পরপারে গেল, পেছন পেছন মাও। কাকডোঙ্গারও যা অবস্থা! বড়বিলের কথাই আর কি বলি! শুকিয়ে এক পানা পুকুরে পরিণত হয়েছে। চারদিক থেকে ভূমিহীন মানুষ ধান লাগিয়ে দখল করে ফেলেছে।
এখন আর কোথায় মাছ মারানিরা! জেলে মৎস্যজীবীর সংখ্যাও হাতে গোনা। বরফের কোলে শুয়ে মাছ আসে অন্ধ্র ও কানপুর থেকে। তাতেই সকলে মহা উৎসাহে ঢেঁকুর তোলে-‘খেলাম বটে, আহা।‘
পূর্বপুরুষের পুরান বৃত্তি ছেড়ে নিষ্কর্মা ঘরে বসে বসে অন্ন ধ্বংস করা সহোদরের খবর নেয়ার জন্যও মাঝে মাঝে ফেলে আসা গ্রামে যাই । তুলাখুড়াদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় বর্তমানে আমাদের বিভাগীয় প্রধান।
‘পিসেমশাই ভাল আছেন?’ যাওয়া আসা নেই, খবরা খবর রাখে না, এমনিই জিজ্ঞেস করে।
যাই হোক, এবার বাড়ী পৌঁছেই দেখি তুলাখুড়াদের উঠানে গাঁয়ের লোকের ভিড়। তার এখন তখন অবস্থা। এই যায়, এই যায়। কিন্তু কাছে গিয়ে কথা বলারও সুযোগ দিল না তুলাখুড়া। কান্না কাটি করার ও কেউ নেই। খবর পেয়ে এসেছে খুড়তুত তিন ভাই, মনে শোক থেকেও স্বস্তির ভাব বেশী।
কিন্তু সময় কি এগিয়েছে?
জেলেদের লাশ।
সময়মত দেখা গেল, দাদা–ভাই মিলে সাকুল্যে তিনজন, চতুর্থ কেউ এগিয়ে আসে না। এটা তো আর বর্তমানে আমাদের মত শহুরে লোকে বাস করা মহানগর নয় যে উপায় না থাকলে‘ ছুইপার’ বা ‘দিন হাজিরা মিঞা‘ ডেকে দুটো পয়সা হাতে গুঁজে দিলেই হল! হাঁটুর ওপরে ভেজা কাপড় পরে যে রয়েছে সেই-ই বোধহয় তুলাখুড়ার ছোট ভাই , নামটা এখন আর মনে পড়ছে না।
‘বাপু তুমি কখন এলে?’
এসেছি তো অনেকক্ষণ।
সেইদিন কাঁঠালটা মুখের সামনে নিয়ে হাঁটু মুড়ে কানে ধরে বসে থাকার সময় মাথাটা নুয়ে পড়েছিল ঠিক, কিন্তু একফোঁটাও চোখের জল ফেলিনি। আজ কিন্তু বর্ষার কাকডোঙ্গা বাঁধা মানল না।
‘ধর ! একধারে আমি ধরব , জানিনা পারব কি পারব না। কোনদিন ভার না বওয়া বামুনের কাঁধ!’
হাঁটু মুড়ে বসেছিলাম, উঠলাম। উঠে শবদেহের দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম ।
