| 5 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২১

প্রবন্ধ: বাঙলা উচ্চারণের বিষফোঁড়া । বেগম জাহান আরা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

সাধারণ জ্ঞানের পাঠতো আজকাল ফেইসবুকের খোলা পাতায় থই থই করে। বারোয়ারি জ্ঞানের ঠেলায় নিজের জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার অবস্থা। তবে বাঙলা বানান উচ্চারণ নিয়ে এগোন না বেশি কেউ। আসলে সমস্যা থাকলে সেখানেই তেড়ে যেতে হয়। আমরা করি উল্টো। সমস্যা ঢেকে রাখি। নিজে তো বলিই না, অন্যকেও বলতে দিই না। যেনো চাপা দিয়ে রাখলে সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে একসময়। তা যে হয় না, সেটা জানার পরেও। তবু কিছু কিছু বিষয় ঢাকনা ভেদ করে বেরিয়ে পড়ে। মানে, মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায়। ফেইস বুকের আকাশে চলেও আসে। সেগুলো  টুকে রাখি। তারই দুচারটে  কথাকে ভিত্তি করে প্রমিত বাঙলা উচ্চারণ সম্বন্ধে কিছু  বলতে চাই। সমস্যা বেশি নয়, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। যেমন;

১) ড়/র-এর উচ্চারণ,

২) ঢ় -এর  উচ্চারণ,

৩) চন্দ্রবিন্দু আরোপের সমস্যা,

৪) যাই/যায়-এর ব্যবহার,

৫) চ-বর্গীয় বর্ণগুলোর উচ্চারণ, এবং।

৬) ও এবং উ-এর উচ্চারণ।

১) প্রধানত  আঞ্চলিকতার  কারণেই  ‘ড়/র’ -এর সমস্যা  সৃষ্টি হয়। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় তাই দেখেছি। মানে বলতে চাই, বাঙলাদেশের  পুর্বাঞ্চলেই  এই সমস্যা  প্রবল। অন্য অঞ্চলেও আছে, তবে কিছু  কম। ভুলও  হতে পারে আমার। কিন্তু প্রমিত বাঙলাভাষীকে এই ব্যাপারে ‘কান-সচেতন, পাঠ-সচেতন, বাক-সচেতন, এবং চর্চা প্রবণ’  হতে হবে। এই যেমন, অফিসে যাওয়ার সময় আমরা পোশাক সচেতন থাকি। মহিলারা কুচিমুচি  করে রাখা পাড়ওয়ালা শাড়ি পরে অফিসে যাবেন না। পুরুষেরা কুচিমুচি করে রাখা কোট পরে অফিসে যাবেন না। কিছুতেই না। ইস্ত্রি করা পোশাক চাই। এটাই স্বাভাবিক। এটুকু সচেতনতা অনিবার্য আনুষ্ঠানিক পরিবেশের জন্য। সেখানে আনুষ্ঠানিক পোশাক না পরে, ঘরের পোশাকে গেলে মান থাকে না। ঠিক তেমনি করে যদি আমরা ভাবি, আনুষ্ঠানিক পরিবেশে ঘরের ভাষা নাই বললাম। শুধু এইটুকু সচেতনতাই  যথেষ্ট।

তার মানে, ব্যক্তি বুঝতে পারেন, ঘরের এবং মঞ্চের ভাষা এক রকম নয়। ঘরে যিনি  আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে গেলে সেই তিনিই  বাক-সচেতন হয়ে পড়েন। ঘরে যিনি সাবান কাঁচা পাজামা বা লুঙ্গি অথবা শাড়ি পরে আন-প্রসাধনে থাকেন, সেই ব্যক্তিই অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য পোশাক সচেতন,  সাজ সচেতন হয়ে ওঠেন। কারণ, প্রত্যেক মানুষ নিজের চোখে নিজে সুন্দর। এই সৌন্দর্য তিনি ফুটিয়ে তুলতে চান এবং অন্যকেও দেখাতে চান। এটাই মানুষের সহজাত প্রবনতা।

তাহলে কি করে ভাবি, মুখের বচনের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবতে হবে না? এক রকম করে কথা বললেই  হলো? আসলে কিন্তু তা নয়। সেটা জেনে শুনেই আমরা জ্ঞানপাপী হয়ে থাকি। এই আমরাই সুবচনের বক্তা পেলে আল্লাদে আটখানা হয়ে বলি, কি চমতকার উচ্চারণে কথা বলেন; কিন্তু নিজেরা সামান্য প্রশিক্ষনের ধারে পাশে যাই না। কেনো অনীহা, কেনো অশ্রদ্ধা, কেনো চর্চায় অনাসক্তি, বুঝতে পারি না। সারাজীবনে কতো কিছু শিখতে হয়। শিখতেই হয় বাধ্যতামূলকভাবে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে এখন কতো কিছু শিখতেই হচ্ছে, করতে হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে।

প্রশ্ন হলো, কেনো একটা বর্ণের উচ্চারণ আমরা পারবো না? পারতে গেলে কি করতে হবে? টিপসটা হলো, ‘ড়’ উচ্চারণের কৌশলটা জানা। ‘র’-তো সবাই উচ্চারণ করতে পারে। তবে কোনও  কোনও ভাষায় ‘ র ,ড়’ নেই, তারা পারে না সহজে। যাক সে  কথা।

 ‘ড়’-এর উচ্চারণের সময় যা করতে হয়ঃ

ক) জিবের আগা বাঁকিয়ে জিব উলটে তালুর পেছনে নিতে হবে, এবং

খ) পেছন তালুতে একটা ধাক্কা লাগিয়ে জিব সামনে আনতে হবে।

এই  প্রক্রিয়ায়  ‘তাড়নজাত ধ্বনি’  ‘ড়’  উচ্চারিত  হয়। কম্পনজাত  ‘র’ উচ্চারণ হতেই পারে না।

এবার বলি, ‘ড়’ উচ্চারণের স্থান এবং রীতি  বুঝে তা পালন করলে কিছুতেই  ‘র’ -এর উচ্চারণ  হবে না। আয়নায় দেখে উচ্চারণ করেন। বুঝতে পারবেন নিজেই। একবার আয়ত্বে এসে গেলে আর ভাবতে হবে না। প্রশিক্ষনের এই সামান্য কষ্ট ব্যক্তির নিজের জন্যই আবশ্যিক।

এরপরে একগুচ্ছ শব্দ বেছে তালিকা করতে পারেন চর্চা করার জন্য। শব্দ তালিকার মধ্যে  দুই  ‘ড়/র’ পাশাপাশি রাখতে হবে। যেমনঃ

বড়ো  বরো, বাড়ি  বারি, শাড়ি  সারি,  কড়া  করা,  কড়ি   করি,  পড়া  পরা, ইত্যাদি। এই শব্দগুলোকে জোড়াভাবেও লেখা যায়। যেমনঃ

বড়ো বড়ো বরো বরো,  বাড়ি বাড়ি  বারি বারি, ছাড়াছাড়ি  মারামারি, গড়াগড়ি 

ঘোরাঘুরি, ইত্যাদি। এমন কি শুধু ‘ড়ড়ড়  ররর, ড়াড়াড়া  রারারা, এমনও হতে পারে। এতে নির্ঘাত ফল পাওয়া যাবে। অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।

২) ‘ড়’-এর উচ্চারণ করতে পারেন, এমন অনেকের মুখেও  ‘ঢ়’-এর উচ্চারণ আসে না। আবার অনেকের মতে ‘ঢ়’-এর উচ্চারণই নেই বাঙলায়। আমার ধারনায় এখানেও আঞ্চলিকতা দায়ী। তবে ‘ঢ়’-কে এমন ভাবে অস্বীকার না করে বলা যায়, এই বর্ণ দিয়ে বেশি শব্দ নেই বাঙলায়। কোনো কোনো অঞ্চলের বাঙলায় এখনও এই বর্ণের উচ্চারণ  শোনা যায়। প্রমিত  বাঙলায় আমরা বলি ‘বুড়ো লোক’, আঞ্চলিক বাঙলায় বলে, ‘বুঢ়া’ লোক। এই দিক থেকে বিচার করলে বলা যেতে পারে, প্রমিত বাঙলায়  ‘ঢ়’ ধ্বনি অনাদৃত। এই ধ্বনি দিয়ে নির্মিত  শব্দ প্রমিত বাঙলায় খুব  কম। তাই তেমন প্রয়োজন পড়ে না। এই বর্ণের উচ্চারণ সত্যিই বেশ কঠিন। বাঙলায় ‘আষাঢ়’ মাসের নাম আছে। কিন্তু ‘ঢ়’ বদ্ধধ্বনি হওয়ায় উচ্চারণে শোনা যায় ‘আষাড়’। আবার  ‘দৃঢ়’ শব্দে শোনা যায় বর্ণটির যথার্থ উচ্চারণ, যদি কেউ ঠিক মতো পারে। শব্দের শেষ অক্ষর যদি বদ্ধধ্বনি  হয় এবং সেই বদ্ধধ্বনিতে যদি মহাপ্রাণতা থাকে, তাহলে সেই  মহাপ্রানতা তথা  ‘হ’ শোনা যায় না। যেমন; শোধ, বোধ, বিরোধ, প্রতিশোধ, ইত্যাদিতেও একই অবস্থা। কিন্তু আবার ‘শোধের, বোধের’ উচ্চারণে ‘ধ’-এর উচ্চারণ স্পষ্ট। বাঙলা উচ্চারণের ধরনই এই রকম।

তবে একটা কথা ঠিক, আবৃত্তিতে এবং গানে ‘আষাঢ়’ শব্দের যেমন উচ্চারণ শোনা যায়, সাধারন কথাবার্তায় তা যায় না। আমাদের শেষ আশ্রয় প্রমিত বাঙলাভাষী আমজনতা। গ্রহণযোগ্যতার কষ্টিপাথর তাদের হাতে। তাই অপেক্ষা করতে হবে ‘ঢ়’  বর্ণ/ধ্বনির থাকা না থাকার ব্যাপারে। তবে এটা ঠিক যে, ‘আষাঢ়’-এর ‘ষ,ষ ঢ়’ ধ্বনি দুটো আমাদের জন্য কঠিন।

৩) চন্দ্রবিন্দু নিয়ে সমস্যাটাও কম নয়। যাঁরা একেবারেই এই ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারেন না, তাঁদের জন্য সত্যিই  সমস্যা। আমি নিজে প্রশিক্ষন দিতে গিয়ে বিষয়টা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু নিবিড়  প্রশিক্ষনে কেউ কেউ আয়ত্বে এনেছেন। মানেটা হলো, পারা যায়। খাটতে হয় একটু বেশি। এই আর কি! সে তো নির্ভুলভাবে গানের সুর, মুড়কি, মীড় তুলতেও খাটনি  হয়। একবারে হয় না। তখন তো গানের শিল্পী বান্দা কষ্ট করেন। নইলে ‘চাঁদ হেরিছে চাঁদ মুখ তার’ গানটা গাইবার লোক পাওয়া যাচ্ছে কি ভাবে?

অপারগতা এবং চর্চা বিমুখতা থেকেই  অনেকে বলতে শুরু করেছেন, চন্দ্রবিন্দু  আরোপ না করলে কি হয়? হয় তো অনেক কিছুই।  সে ব্যাখ্যায়  না গিয়েও বলা যায়, সমধ্বনিজ শব্দের তালিকায়  শব্দ কমবে। ‘কাঁদা’-কে  ‘কাদা’ বলা যাবে। ‘তাঁর-কে ‘তার’ বলা যাবে। ‘চাঁদাবাজি’-কে ‘চাদাবাজি’ বলা যাবে। ‘বাঁশ, শাঁস, কাঁসা, হাঁস’-কে ‘বাশ, শাস, কাসা, হাস’ বলা যাবে। চিরাচরিত  উচ্চারণ এবং বানান রীতিকে  কিছু মানুষের অপারঙ্গমতার দোষে একটা হুলুস্থুল বেধে যেতে পারে। আর প্রমিত বাঙলার শাস্ত্রীয় উচ্চারণের কথা তো আছেই। এখানেও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে গ্রহনযোগ্যতা কোন দিকে যায়, তা দেখার জন্যে। তবে সমস্যা হলেই তাকে বর্জন করার প্রস্তাব গ্রহনযোগ্য নয়। একটা নিশ্বাস নিতেও অনেক সমস্যা। বোঝা যায় না তাই। আসলে, সমস্যা জয় করেই চলতে হয়।

আমাদের উচ্চারণে সম্মানিত ব্যক্তির জন্য ক্রিয়াপদের অন্তে ‘ন’ ব্যাবহারের ক্ষেত্রে ব্যাপক অসঙ্গতি দেখা যায়। যেমন;

(ক) তিনি বললো, উঁনি আসলো, স্যার বলেছিলো, বাবা/মা আসবে না, ওকে খবর দাও, ইত্যাদি শুনি অহরহো।

এইসব ক্ষেত্রে প্রমিত বাঙলায় বলতে হবে,

(খ) তিনি বললেন, উঁনি আসলেন, স্যার বলেছিলেন, বাবা/মা আসবেন না, ওঁকে খবর দাও, ইত্যাদি।

অনেক শিক্ষিত মানুষের মুখে (ক)-এর বাক্যরীতি শোনা যায়। কি করে এমন উচ্চারণ রীতির চল হলো, তার একটা মৌখিক গবেষনা করেছিলাম। মানে  বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম কারনটা। সেখানে দেখেছি, বাবা মায়ের সাথে যে সব ছেলে মেয়েরা  ‘তুমি’ সম্বোধন করে,  তারা স্বচ্ছন্দে এমন ভাষা ব্যবহার করে। ওরা বোঝেই না বিষয়টা। কেউ শেখায়নি যে, সম্বোধনে তথা মুখোমুখি ‘তুমি’ করে বললেও  উল্লেখকরনের সময় বাবা মা এবং সম্মানিত ব্যক্তির জন্য ক্রিয়াপদে ‘ন’ যোগ করতে হবে। এটাই বাঙলা ভাষার প্যাটার্ণ বা ছক বা বৈশিষ্ট।  পারিবারিক  ভাষাচার থেকেই ‘আপনি’ সর্বনামের সাথে ক্রিয়াপদে ‘ন’ ব্যবহার না করার প্রবণতা এসেছে মনে হয়েছে। এটাও জয় করা সম্ভব। শুধু একটু সচেতনতা প্রয়োজন।

আমি মনে করি, বাঙলা ব্যাকরণে এই সবের ব্যাখ্যা থাকা জরুরি। কিন্তু নেই। প্রচলিত বাঙলা ব্যাকরণের, যতোগুলো দেখার সুযোগ হয়েছে, কোনোটাতেই পাই নি।

৪) ‘আমি যায়’ আর ‘আমি যাই’ নিয়েও সমস্যা। এটা আমি দেখেছি উত্তরাঞ্চলের বিশেষ এক জেলায়। তাঁরা মুখের ভাষাতেও এই রকম ব্যবহার করেন, লেখার ভাষাতেও করেন। হয়তো ক্রিয়ারুপ শেখার সময় প্রশিক্ষণটা ভালো হয়নি। ফলে আঞ্চলিক ভাষার দুর্বলতা থেকেই  গেছে। এইক্ষেত্রে কিছুদিন  প্রমিত বাঙলার ক্রিয়ারুপ ছক কেটে পড়তে হবে। দেখতে হবে। বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রথম ব্যক্তি আর তৃতীয় ব্যক্তির ক্রিয়া প্রত্যয় এক হতে পারে না। প্রথম ব্যক্তির ক্রিয়া প্রত্যয় ‘+ই+’ ; আর তৃতীয় ব্যক্তির জন্য ক্রিয়া প্রত্যয় ‘+ য় / এ’ , যেমন;

প্রথম ব্যক্তিঃ   আমি/আমরা          যাই, খাই, চাই, বসি, করি, ধরি

তৃতীয় ব্যক্তিঃ  সে/তারা                  যায়, খায়, চায়, বসে, করে, ধরে

বাক্যে প্রয়োগঃ

ক)  আমরা ভাত খেতে চাই,  আমি স্কুলে যাই না,

খ)  সে ভাত খেতে চায়,  তারা স্কুলে যায় না।

স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ক্রিয়ারুপগুলো। বোঝাই ।যাচ্ছে, আমি ‘যায়, খায়, চায়’ বললে হবে না। আমি বললে ‘ই/ই-কার’  প্রত্যয়  লাগবেই। এটুকু শেখা কঠিন নয়।

‘আমি’-র সাথে “খায়, চায়, করে, ধরে” বলেই দেখেন, নিজের কানেই লাগবে।

বি.এ. পর্বের পরীক্ষার খাতায়ও এই সমস্যা পাওয়া যায় ভুরি ভুরি। আমার জীবনে একজনকে প্রশিক্ষন দিয়েছিলাম। তারও চেষ্টা ছিলো। সফল হয়েছিলাম। ফলে বলতে পারি, এটা শেখা যায়, শেখানোও যায়।

৫) চ-বর্গীয় বর্ণগুলোর উচ্চারণে আমাদের  সমস্যা খুবই  প্রকট। সারা বাঙলাদেশের সবগুলো আঞ্চলিক ভাষাতেই এই সমস্যা আছে। ফলে খুব ভালো প্রমিত বাঙলা বলা মানুষেরও স্খলন হয় “ডায়ালেকটাল ইনটারফিয়ারেন্স”-এর জন্য। মাতৃভাষা এই রকমই। রক্তের ভেতর থেকে হঠাত জানান দেয় বেয়াক্কেলেল মতো। সহজাত স্বভাবে এবং পারঙ্গমতায় আমরা মাতৃভাষা তথা নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় কথাও বলি। দোষ নেই কোনো। তবে সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে সব রকম আবেগের সময়। তা রাগই হোক আর প্রেমই হোক, সচেতন সতর্কতা শিথিল হয়ে যায় তখন।

এইবার সামান্য প্রশিক্ষনের কথা বলা যাক। মানে, চ-বর্গীয় বর্নের উচ্চারণের স্থান আর রীতি, দুটি শিখতে হবে প্রমিত ভাষীকে। এই বর্ণের উচ্চারনে ঘর্ষন আছে। জিবের আগার ঠিক একটু পেছন আর সামনের পাটি  দাঁতের গোড়ার একটু পেছনে সম্মুখ তালু হলো এই বর্ণগুলোর উচ্চারণ স্থান। ফুসফুসের বাতাস ঐখানে এসে বাধা পায় এবং সামান্য ঘর্ষণ দিয়ে ধ্বনি উতপাদন করে বাতাস বের হয়ে যায়। এজন্য এই  বর্নগুলোর নাম ঘর্ষনজাত ধ্বনিও। মনে রাখতে হবেঃ

ক) জিবের আগার সামান্য পেছনের অংশের সাথে অগ্রতালুর ( উপরপাটি দাঁতের গোড়ার একটু পেছনে ) ঘর্ষণে এই ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হয়,

খ) জিবের আগার সাথে দন্তমূলের ঘর্ষনে এই ধ্বনি উচ্চারিত হবে না,

গ) এই ধ্বনির দন্তজ উচ্চারণে/ঘর্ষনে আঞ্চলিকতা , অসচেতনতা এবং অর্বাচীনতা  প্রকাশ পায়।

ঘর্ষণজাত ধ্বনির মধ্যে যে কোনো একটার স্খলন প্রমিত বাঙলা ভাষীর বাকপটুতাকে দারুন ভাবে খর্ব করে দেয়। তাই শুধু সচেতনতা নয়, চর্চারও প্রয়োজন। উত্তম খেলোয়াড়কে যেমন নিজের দক্ষতা বাড়ানো এবং ধরে রাখার জন্য প্রতিদিন অনুশীলন করতেই হয়, ব্যাপারটা প্রায় তেমন। লক্ষ করলেই দেখা যায়, খুব আন্তরিক চারুবাক বাচিক শিল্পীদের  উচ্চারনে কোনো স্খলন নেই। এইই দক্ষতা আরোপিত নয়, স্বভাবজও নয়, সম্পুর্ণ অর্জিত এবং চর্চিত।

মাঝে মাঝে চ-বর্গীয় ধ্বনিগুলোর দন্তজ উচ্চারণ  করেন প্রমিত ভাষীরাও। অনেক ভালো গানের শিল্পীদের মধ্যেও  চ-বর্গীয় বর্নের দন্তজ  উচ্চারণের প্রবনতা আছে। হয়তো তাদের ধারণা, এটা একটা স্টাইল। কিন্তু এমন ধারণা ভ্রান্ত, শাস্ত্রবিরুদ্ধ  এবং শ্রুতিকটু। ‘ক’ বলতে গিয়ে ‘গ’ বললে যেমন কানে  লাগবে, তেমনি ‘চ’ বলতে গয়ে ‘দন্ত-চ’ বললেও কানে লাগবে। কণ্ঠ যতোই সুরেলা  হোক, উচ্চারণের বিষকাঁটা  খোঁচা দেবেই কানে। পন্ডিত গবেষকেরা প্রতি ধ্বনির উচ্চারণ স্থান এবং রীতি নির্ণয় করে দিয়েছেন বিজ্ঞানলগ্ন ব্যাখ্যায়। প্রামান্য বিশ্লেষণে। সেইটা জানতে, শিখতে এবং মানতে হবে প্রমিত  ভাষীকে। এরজন্য কারো গবেষক হওয়ার দরকার নেই। বাঙলা ভাষার ধ্বনিগুলোর  বিজ্ঞানমন্ত  উচ্চারণের নির্দিষ্ট  কিছু পাঠ এবং চর্চাই যথেষ্ট।

৬) প্রমিত বাঙলার গঠন প্রক্রিয়া এখনও চলমান। অনেক  শব্দের উচ্চারণ নিয়ে এখনো মতান্তর দেখা দেয়। যেমন; রোগি/রুগি,  শোয়া/শুয়া, তুলা/তোলা, ওপর/উপর, ইত্যাদি শব্দে ও-কারান্ত উচ্চারণই আদৃত। আবার দেওয়া/দেয়া, নেওয়া/নেয়া, দেওয়াল/দেয়াল, ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ও’ থাকে না। থাকার কথা নয়। মুখেও না, বানানেও না।

বাঙলা আমাদের জীবিনের সর্বস্তরের ভাষা। তার চর্চাতো করতেই হবে।উচ্চারণের এইসব ছোটো খাটো সমস্যাকে বলেছি ‘বিষফোঁড়া’। স্থানিক ভাবে একটু ব্যথা দেয়। তবে  চিকিতসা তথা যত্ন নিলে অল্প দিনেই সেরেও যায়। সেইভাবে নিতে হবে সমস্যাগুলোকে। আমাকে সুন্দরভাবে সাজাতে হলে , আমার বচনকেও সাজাতে হবে। ললিত  করতে হবে বাচনকে। সাজুগুজুর জন্যে সময় লাগে। যত্ন লাগে।  আপনা থেকে হয় না। তাই না? প্রমিত বাঙলা উচ্চারণ  আয়ত্ব করতেও সময় লাগে। যত্ন লাগে। কথা আছে, ‘সুন্দর মুখ আর সুন্দর বচন’, দুটোই সমান প্রিয়। সুকুমার বৃত্তিগুলো বিকাশে  যাঁরা সচেতন, আমার কথাগুলো তাঁরা সহজ মনেই নেবেন বলে আশা করি।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত