আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিটভেজা হাত জামায় মুছে নিলে আকাশের পশ্চিমে কনে দেখা আলো ঝলকায়, তোমার তখন সূর্য ওঠার ঢের ঢের দেরি, লাইব্রেরি ঘরে আলো জ্বলছে; স্ক্রিনের আয়নায় দেখছি তোমার এ্যান্ড্রুজ এর চেক্ শার্ট-পরা মুখটা। ইস্কুল ফিরেই নাকি সো-জা বারান্দা দিয়ে ছুট্টে এসে তুমি বোনের বিছানায় ঝুঁকে দেখতে আমাকে, আর দুপুরে তো সদ্য ঘুম, বাড়িতে সব্বাই সেই চুপ মেনে আছে। কিন্তু তুমি যেভাবে হোক আমাকে জাগাতে চাও, একান্ত চেষ্টায় সফল না হলে শান্ত একটা রামচিমটি অবশ্য প্রাপ্য। মা চাইছেন তোমার খাওয়া হলে হেঁশেল সাফ সুতরো করে নিকিয়ে নিলে এ পর্ব মিটবে, তুমি একদৃষ্টে চেয়ে থাকো, আবার চাইতে চাইতে কখন বোনের দুধের মামরি লাগা বালিশের কোণে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছো , যতক্ষণ ঘুম আসেনি তোমার একটাই কাজ— বোনের কাঁথা চেক্ করা, ভেজেনি তো!
মা যে তাকে বিশেষ দায়িত্বে বহাল করে কাজ সারছিলেন, তুমি ফিরলে মা যে স্নান সেরে রান্না চড়াতেন। আমি চোখ না খুলেও বেশ টের পাই, পাকা এক জিভে উচ্ছের মতো রোদ উঠছে চারিদিকে, আর স্কুলের পায়ে কালির গন্ধের আঙুল, পকেটে টক আচারের কুচি তুমি, আমার মুখচোরা দাদাটি আমার চিবুকে, বা আঁশের মতো চুলের তলায় জলঝাঁঝির ওপর কচি নখ দিয়ে ডাকছো— ওঠ্ বোন, ওঠ্। তোমার গালে ধেবড়ানো কালির দাগ কেমন চন্দনের মতো শোভা পাচ্ছে। চিবোনো কলারে চড়ুইয়ের ছটফটে দু চারিটা সুতো সরে আছে, কব্জির লাল সুতো আধখাওয়া, ওতে কেমন বিটনুনের ঝাল লেগে আছে; কপালের একগুছি চুল যখন ঢলে নামতো আমার চোখের ওপরে, এই সব ঘ্রাণের পরেও একটা দারুচিনির বাস পেতাম , বুঝেছি সে তোমার গায়ের। মায়ের সঙ্গে তার অমিলের ভেতর থেকে চিনতে লাগলাম কোন্ কোন্ টা তোমার। ঘুমিয়েও মনে হোত, এক ঝাঁকায় খেলনাওয়ালা ফেরি করছে রকমারি গন্ধ, কোনোটা ঠাকুমার পানের ডিবের, জর্দার; কিন্তু আমার কানে কেবল উত্তুঙ্গ হয়ে থামে ব্যাগ বকলসের ধুন্ , মাথা ঠেকিয়ে ভ্রূ ছুঁয়ে-থাকা তোমার পেনসিলের ঘ্রাণ।
এর কিছুকাল পরে আমি উপুড় হয়েই কবুল করি তুমি ফিরেছো। তোমার ঈষৎ রাগ আর মায়া পাশে পাশে চলে, মা যখন ছুটির দিনে রান্না চাপান দেরি করে (কারণ মা ও আমায় নিয়ে খেলেন), তোমার খিদে পেলে মাথার ঠিক থাকে না, তুমি তখন বোনের ভাগ নেবেই নেবে, মা তাল না পেয়ে সেদিন আর মাথা ঘষতে পেলেন না এমন হল। তাই গোটা দুপুর জাগিয়ে রাখার বায়নায় তুমি আমাকে এদিকে ওদিকে তুলোর বলের মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখো, ফুটবল একা বারান্দায় থেমে থাকে পুরো শনিবার। কেবল সি. এল্. টি যাবার সময়ে তোমার আগ্রহ দেখে অবাক লাগতো, মেঘ করেছে বৃষ্টি আসছে কিন্তু তোমাকে আটকানো যেত না। বাবার হাত ধরে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যাওয়ার সে কী টান। আমি তখন নিজেই উঠে বসতে পারি, কিন্তু উচ্চাসন থেকে নামতে শিখিনি। তাই তোমাদের দেহের নীচের অংশের রহস্য আমার অজানা, অনেক ভাবার চেষ্টা করলাম কী এমন জিনিস থাকতে পারে, যা দিয়ে তুমি , বাবা নড়ে বেড়াতে পারছো, কিন্তু আমাকে পাল্কির মতো তুলে এধার থেকে ওধার করানো হচ্ছে। বিরক্ত মা কোনও কোনওদিন আমাকে তাঁর পরা কাপড় পাশে দিয়ে বেমালুম গেরস্থালির কাজে চলে যেতেন, মাটিতে শুয়ে আমি সিলিং থেকে কত রকমের নীরবতা টুকে রাখতাম খাতায়।
মুখভার গ্রীষ্মবেলায় গুমোট চারদিক, ডি.সি. ফ্যানের ঘর্ঘর আওয়াজে ঢেকে যেত মা যখন মিহি সুরে স্বর দিতেন। রান্নাঘরের ঐ টঙ্কারে আমার অজ্ঞ কানের তল অব্দি শব্দ পৌঁছলেই জেগে যাই, মনে হয় কোন্ দূর অরণ্যপুর থেকে স্নান সমাপনের পর বৈকুন্ঠের মেয়েরা চুল ঝাড়ছেন। সেই জলের ফুলকি আমার খাটে আমার মুখে চোখে কপালে, গলায়, তানপুরার মতো তারে তারে সা রে গা মা ধরিয়ে দিল বা মায়ের মুখে তখন পরীর দেশের আলো, নীরবতার আলো। খিদে পেলেও সে সময়ে একান্তে মুখ ডুবিয়ে থাকতাম আমার সুবাস সিন্দুকে। দাদাও জানতো না , জানলে সেও নিশ্চয় ডালা খুলে পরীক্ষা করতে বসবে, কোন্ কোন্ শিরোনামে কত কত যুগের ওপারে শিলাবর্তী পাহাড়িটোলায় পিসিদের গ্রাম, কোথায় কত নম্বর তাকে আমি লুকিয়েছি বুড়ির চুল, গোলাপি লজেন্চুস , অশোক ফুলের বীজ। এতে আমার সায় ছিল না।
দাদা,
মনে আছে ঝুলনের ফুলের দোলনায় তুমি কেমন ইচ্ছে করে ভারি একটা নুড়ি চাপিয়ে দিলে!
আমি তো জানি না, তারপর যখন বেশ অনেকে আমার আর নেলিদির ঝুলনের সাজানো দেখতে এসেছে, হঠাৎ দেখি রাধাকৃষ্ণ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। আর তোমাকে যখন বাবাও হাঁক দিচ্ছেন, তুমি বেপাত্তা , নেলিদি অবশ্যি আবার শাড়ীর পাড় জড়িয়ে বাঁধন দিল ঠিকই কিন্তু ফুলের গহনা আর হল না। মাধবীলতার মাকড়ি কি আর বার বার পরানো যায়। নেলিদি আমায় ঠাণ্ডা করলে ঠিকই, কিন্তু দুপুরে যখন চটি খুলে ঘরে এলে, বেজায় রেগে আছি এদিকে, পাড়ার ডলির বোন দৌড়ে খবর দিল ‘দীপুদা নাকি অপরাজিতার ঝোপে সেপাই বুলবুলের বাসা দেখে এসেছে!’ ভেঙচি কেটেছি কি দেখি তুমি বীরদর্পে আমার স্কিপিং দড়ি নিয়ে হাজির, চুল এলোমেলো আর সঙ্গে তোমার ঐ শাকরেদ। তোমাকে ও রকম দেখে হুলুস্থুলু পড়ে গেল পুঁচকে মেয়ে মহলে আর হিংসেয় রাগে আমায় দেখে কে! নিজের দাদা অথচ তার এমন পদমর্যাদা যে, আমার হাতে করা কাঠচাঁপার মালার দোলনা ভেঙেও কোনও আক্ষেপ নেই; উল্টে ফ্যাসাদ হল আমার। ডলির কাছে মুখ থাকল না। শেষে জ্যাঠামশায়ের হস্তক্ষেপে বিষয়ের গতি হল, রফা হল যে ঐ বুলবুলির নীল ডিম আমায় দেখিয়ে আনতে হবে। ব্যস্, শান্তি। সেবার প্রথম দাদার হাত ধরে অতটা পথ যাবার অনুমতি মিললো, পরে জেনেছি তুমি আর সব্যদাদা আমাকে সঙ্গে
নিতে চাওনি, বাবা জোর করেছিলেন, অগত্যা। তোমার নতুন স্কুলের কাছের সুহৃদ বলতে সব্যদাদার আনাগোনা রোজ ছিল বাড়িতে। আর সে-ই হল আমার রঙিন দেশলাই বাক্সের মধ্যে
পাখির পালক লুকিয়ে রাখা, টানা বৃষ্টির ভেজা সুড়কির রাস্তায় লাল টুকটুকে ভেলভেট পোকাদের বাক্সে জমিয়ে রাখার চোরা গল্পের শুরু। পুকুরের আশপাশ ঘেরা একটা বাগানের তুলোর গাছময় সাদা তুলোফুলে যখন চতুর্দিকে দুপুরের বাতাসে বীজের পেখম উড়ছে, মিত্র স্কুলের সামনের নাগকেশর গাছে তখন গাছের গুঁড়ি থেকে সটান ফুলের ডাঁটি জেগে উঠতে লাগল, আমি তো হাঁ করে তোমার বর্ণনা শুনি আর দেখার লোভে টাটিয়ে উঠি । আবদার করি, ফুল ফুটলে যেন নিয়ে আসো। আসলে আমার হামাগুঁড়ির পথ বেঁকে গেল দূরান্তের ফটক ধরে এক্কা দোক্কার গুটি ভেঙে গাছ- ফুল-পাখির চলাচলের আদমসুমারি ধরে,
তুমি ছিলে তার খিলানওয়ালা দুয়ারের পাহারাদার। যে গানের স্বরলিপি শিখিয়েছো, তা আমার সাত রাজার এক মানিক। ডাকঘরের অমল যেমন রাজার চিঠির জন্য বসে আছে, আমিও তোমার যক্ষপুরীর প্রাচীর একদিন ডিঙোবোই দেখো…।
পারিজাত ক্লাবের বঙ্গলিপি রুলটানা খাতায় গানের স্বরলিপি টুকে রাখতাম যে আমরা, মনে আছে? মিত্র স্কুলে ছুটি হোত যখন, আমার তখন মায়ের কাছে চুল বাঁধার সময়, দুপুরে ফিরে এক ঘুম কাবার। আর বাড়ি ফিরেই এক টানে বিনুনি ধরে দাদাগিরি শুরু হোত; সাদা শার্টের পকেটে ইস্কুলের নাম খোদাইয়ের পেটের ভেতর থেকে যে আজও উঁকি দিচ্ছে কেমিস্ট্রি ল্যাব্ এর গন্ধ, ফ্যাসফেসে গলায় ‘আজ প্রথম ফুলের পাবো প্রসাদখানি’র পরের লাইনের টান দিতেই আমার খিলখিলানো হাসির শব্দে দাদাও বুঝি হাসবে এখন ভেবে? কালো শু এর আওয়াজ একটা হারানো সুর ফেলে রাখে, আজও ভুল হয় না।
নয়ানজলির পথে কুমোরদের চাকায় এখন ঢেউ উঠছে গঙ্গামাটির, রেললাইনের শব্দ ছুঁয়ে।
ইতি,
পারিজাত ক্লাবের চিরায়ু
সভ্য রিমি
( সেই গজদাঁতের দিব্বি)
Related