ঈদ সংখ্যার গল্প: যে দুপুর মৃত চৈত্র । অপরাহ্ণ সুসমিতো
সূর্য কি বৃষ্টিতে ভেজে এরকম একটা ভাবনা ভাবতে ভালো লাগছিল। ভালো লাগা ভাবনার একটা প্রবল টান থাকে স্রোতের গতির মতো। সেদিকেই টানে। যে রকম ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমার অবদমিত বাসনার ছন্দ দোলে। কত কত অতৃপ্ত ইচ্ছাগুলো যেন হাতের তালুতেই লুকানো থাকে, আর সময় পায় না যেন। এইসময়েই তাকে মনে দোলাতে হবে যেন।
বৃষ্টির তো সূর্যকে ভেজানোর কথা নয়। ঘুমের রেশ আছে শরীরে তবু পাশের সোফায় এসে বসি। সোফার এক কোণে যত্নে পড়ে থাকা ল্যাপটপের ডালা তুলি। গুগল করতে শুরু করি সূর্য ভেজে কিনা বৃষ্টিতে। এই জানার বিষয়টুকু বেশিক্ষণ আগ্রহ ধরে রাখতে পারে না। একটু পরেই ইউটিউবে পা চালাই। ধীরে চলো হে রাজনন্দিনী এই গানটা ইউটিউবে নেই তবু আরেকবার খুঁজি। সবগুলো সার্চ ইঞ্জিন খুব স্মার্ট। তুমি কোনকিছু সার্চ করলে সেটার সংশ্লিষ্ট ওয়েব লিংক দেখাতেই থাকবে।
বিনা কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার একটা বিট গান লাফিয়ে উঠল কানে। সোফা ত্যাগ করে ভাবলাম কী কী করা যায় এই লগনে। ভাবনাটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। এও এক ধরনের রহস্য। কী করে ভাবনা ভাবা যায়? একবার মনে হলো কে যেন আমাকে ডাকছে। সব ডাক কানের নয়। কিছু ডাক আছে মনের। কোথায় যেন দোলে ডাকের ধ্বনিতে।
সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাই, ঘরে একটা জমাট দশা ঘুরপাক খাচ্ছে। বৃষ্টিতে সূর্য ভেজে কিনা পরে আবার পড়ব। ক্যানসারের ৪র্থ স্টেজ কতদিন সারভাইভ করতে পারে, এটাও জানতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বাইবার কালে মনে হলো বাহির মানে মুক্তি। ঘর মানে দমবন্ধ। ঘর মানে ক্যানসার।
সাইকেলসহ সিঁড়ি নামা খানিক সাবধানতা লাগে। উপরের তলার ভদ্রমহিলা বিপুলা স্বাস্থ্যের, সিঁড়ি উঠছেন থেমে থেমে। হাঁপাচ্ছেন। থুতনিতে মাস্ক নামিয়ে দম নিচ্ছেন। আমাকে দেখে আবার দ্রুত মাস্ক পরে নিলেন। চোখাচোখি হতে হাসলেন বলে মনে হলো। সাইকেলসহ আমাকে নামার জায়গা করে দিলেন। খুব আস্তে কপালে হাত তুলে সালাম দিলাম। মুখ থেকে শব্দ বেরুল বলে মনে হলো না।
নিচে নামতে দেখি চৈত্র মাস আমার জন্য অপেক্ষা করছে। রোদের কম্পাস কাঁটা+বাতাসহীন সকাল ১১টা+গুমোট ক্ষণ= আমার চামড়া চিড়চিড় করতে লেগে গেল। বাসায় এসি থাকলে এই হয়। তবু আমি বাসার আবহ থেকে, এই সময়টা থেকে দূরে চলে যেতে চাই। হয়ত পালাতে চাই। দূর থেকে শুনতে চাই কাঙ্খিত সংবাদ, এই ভদ্রলোকের মৃত্যু।
আমার বাবার কথা আমার ঝাপসা পুকুরের মতো মনে থাকে। ছবি দেখেও বড় করে মনে করতে পারি না। আমার চার বছর বয়সেই বাবা মাকে আমাকে রেখে উধাও হয়ে যান। মা আমাকে নিয়ে জনে জনে যান, আইন শোনেন। আত্মীয়স্বজন বলে ৭ বছর নিখোঁজ থাকলে মৃত্যু ধরা হবে।
মা বিয়ে করেন। আমার একটা বোন হয়। কী যে ভালো বোনটা। আমি ডাকি ওকে অমৃতা। ও সাদা ড্রেস পরে কলেজে যায়। সুযোগ পেলে লবণ মেখে আমলকি খায়, তারপর পানি। আমাকে সাধে। আমলকির পর পানির স্বাদ নাকি অপূর্ব মিষ্ট। এই বোনটার বাবা মানে আমার সৎ বাবা অসুস্থ। ক্যানসার। ৪র্থ স্টেজ।
বাচঁবে?
বাড়ি জুড়ে শোকের নেপথ্য কুচকাওয়াজ। চোখে দেখা যায় না হয়ত, টের পাওয়া যায় ঘর ভর্তি ঔষধের বোতলে, কেমো’র ন্যাড়া মাথায়। মা অনেক রাতে, রাত আমাদের বাসার ছাদে এসে জমাট বাঁধলে গুনগুন করে কাঁদেন। আচানক আমার ঘুম টুটে গেলে টের পাই কান্নার ধ্বনিতে তেলাওয়াতের নূর ধ্বনি। আমি উঠে বসি। বুক ওঠা নামা করে দ্রুত। সময় বারান্দার রেলিংয়ে আটকে থাকে। ভোর হয় না।
সাইকেল চালিয়ে কতদূরে যাব, কার কাছে যাব, কোথায় আজ লক ডাউন নেই? মা যেমন দুই হাতে বিষাদ নিনাদ সরিয়ে একেকটা দিন ইচ্ছে মতো স্বপ্ন ঘুমের স্বপ্ন দেখেন; আমিও ইচ্ছে মতো শার্টের বোতামগুলো খুলে, পিচ ঢালা ঢালু রাস্তার মসৃণে ছুটে চলি চুল উড়িয়ে। চলো সাইকেল চলো, দূরে দূরে।
একটা কাঁচা দোকানের সামনে ভিড় দেখে গতি শ্লথ করি। এক বোতল পানি কিনি। প্রথম চুমুকেই অমৃতার ফোন এলো। বুক ধড়াস করে ফোন বাজে। অমৃতা কি কাঁদল? ফোনের ওপাশ থেকে কি মায়ের ফোঁপানো?
বাসায় ফিরে আসার এইটুকু পথ কত দীর্ঘ! সাইকেল নিয়ে বাসায় আসার পথটুকুতে যেন চৈত্রের রোদ নেই, উত্তপ্ত মার্চ নেই। মাস্কবিহীন যেন কেউ নেই, সবাই নি:শব্দে হাঁটছে। রোদের দাপট নেই যেন ফর্মহীন বোলারের মতো। বাসার সামনে আসতে দেখি উপরের সেই ভদ্রমহিলা, আমাকে সাইকেলসহ ওঠার জায়গা করে দিলেন মনোযোগে।
আজ কি বৃষ্টি হবার কথা ছিল? ফোনে আবহাওয়া সংবাদ দেখা হয়নি। ভাবনায় এলো বোধ করি বৃষ্টি হচ্ছে পেখম পেখম জুড়ে।
বাড়িতে কি বৃষ্টি নামল? মা, অমৃতা কি তবে বৃষ্টিদূত?

জন্মের শহরঃ সিলেট। বেড়ে ওঠাঃ সিলেট, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম। কিছুদিন আন্ডারগ্রাউন্ড সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি চলছিল। গদ্য পদ্য দুটোতেই দৌড়-ঝাঁপ। লালমনিরহাটে বছর পাঁচেক ম্যাজিস্ট্রেসি করেছেন। ত্রাণ মন্ত্রণালয়েও কিছুদিন। কানাডার মন্টিয়ল শহরে আছেন দীর্ঘদিন। লেখালেখির বাইরে আবৃত্তি, অভিনয়, টেলি-জার্নাল, বড়দের-ছোটদের নিয়ে নানা রখম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সমান আগ্রহ। একসময় গ্রুপ-থিয়েটার করতেন। একটা শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছেন। কাব্যগ্রন্থঃ তুমি পারো, ঐশ্বর্য (২০১০), রাষ্ট্রপতির মতো একা (২০১৪) গল্পগ্রন্থঃ চিরিয়াখানা বা ফেসবুক ও অন্যান্য গল্প (২০১৬), গল্পগুলো (২০১৯) প্রবচনগুচ্ছঃ মিরর (২০১৬)