Categories
গল্প: শকুন্তলা দেবী কিংবা রোজিনা । কিযী তাহনিন
আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট
শকুন্তলা নামটা শুনলেই বাকি সবটুকু সাধু ভাষায় লেখা মনে হয়। শকুন্তলার জীবন কাহিনী, সাধনার বেদীখানা, মাছের পাকস্থলিতে খুঁজে পাওয়া বিয়ের আংটিটি, সবটুকুতে বড্ড সাধু সাধু বোধ হয়। শকুন্তলা নামটি শুনলেই মনে হয়, বিশ্বামিত্র, মেনকা আর দুষ্মন্তরাই শকুন্তলাকে ঘিরে থাকতে পারে। আর কেউ নয়। আর আমার মতন যার নাম রোজিনা, তার তো শকুন্তলার চল্লিশ গজের মধ্যেই থাকা উচিত না। আমি তাও আছি। কারণ আমার সামনে বসে থাকা শকুন্তলা কোনো বেদিতে নয় বরং পুরনো কাঠের ঘুনে ধরা, আমসত্ব চেহারার একখানা পিড়ির উপর বসে বটিতে রুই মাছ কাটছেন। সেই মাছ কাটার নিপুণ কৌশলে আমি মুগ্ধ। প্রত্যেকটা পিস সমান হছে, মাছের রক্ত ফিনকি দিয়ে কখনো তার কপালের কোণ, কখনো তার দু’আনা সোনায় গড়া ঝিরি চুড়ি ছুঁয়ে যাচ্ছে . সবটুকু নিয়ে তিনি দেখতে কেমন বাস্তব ছাপিয়ে অন্যরকম, তবু এই মাছ কাটায় আটকে যাওয়া জীবনের শকুন্তলা দেবীকে আমার এ মুহূর্তে সাধু ভাষায় রচিত মনে হচ্ছে না। তিনি আপাদমস্তক চলিত ভাষায় তৈরী। আর সেই ভরসায় আমি তার সামনে উবু হয়ে বসে আছি।
আমার নাম রোজিনা। নাম শুনলেই সবার ধারণা হয় আমি অতোটা স্মার্ট নই । নামের সাথে স্মার্টনেসের কী সম্পর্ক আমি বুঝি না। আমি যথেষ্ট আধুনিক স্মার্ট মানুষ। আর তাই নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে করিনি। আমাদের সাথে কলেজে এক মেয়ে পড়তো! যার নামও ছিল রোজিনা। কলেজের পাট চুকানোর পরপর দেখলাম সে তার নাম পরিবর্তন করে রেখেছে রেজিনা। আমার তেমন প্রয়োজন হয়নি। বরঞ্চ কলেজে বন্ধুরা যখন আমার দু’বেণী ঝাঁকিয়ে গান গেতো –
‘রোজিনা ও রোজিনা
জসিম ছাড়া নাচি না।’
আমার ভারী মজা লাগতো। আমিও ওদের সাথে সেই গানে যোগ দিতাম। ‘জসিম ছাড়া নাচি না, না না না’ – গাইতে গাইতে আমি জসিমকে ছাড়াই বন্ধুদের সাথে বেঞ্চের ওপর উঠে নাচানাচি করতাম। তাতে জীবনে খানিকটা সুর-গান যোগ হতো, আর বন্ধুদের গুরুত্বে বেড়ে যেতো আমার সম্মান।
আমি এই মুহুর্তে শকুন্তলা দেবীর সামনে বসে আছি। কিংবা অপেক্ষা করছি। শ্রাবন্তীদের বাড়ির রান্নাঘরে। শ্রাবন্তী আমার স্কুলবেলার বন্ধু। রোজিনা-জসিম নাচের এ আসরের একজন নিষ্ঠাবান শিল্পী ছিল সে। ক্লাসের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, রোজিনা-জসিম নাচ শুরু হলে বেঞ্চের উপর উঠে, এ বেঞ্চ ও বেঞ্চ লাফিয়ে লাফিয়ে আমার কাছে চলে আসতো। তারপর শুরু হত তার নাচ। হাত দুটোকে মুঠো করে হাওয়ায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একই মুদ্রায় সে নাচতো। আবার কখনো এমন করে হাত নাচাতো ঠিক যেন সেঁকে ফুলে ওঠা গরম রুটি এই হাত থেকে ও হাতে নিয়ে খেলছে।
আমার স্কুল কলেজ সবটুকুতেই শ্রাবন্তী ছিলো। আমিও ছিলাম তারটুকুতে। ছিলাম মানে সবকিছুই ভালো ছিলো তা নয়। তাতো জীবনে হয়ও না, তাই না? তবু আমরা ছিলাম, থেকে গিয়েছিলাম। আমি বুদ্ধি রাখি। আমি ভীষণ শুকনা পাতলা ছিলাম স্কুল জীবনে। সবাই বলতো এই চিকন শরীরে এতো বুদ্ধি কেমনে তোর রোজিনা? ঢলঢলে মাখন মাখন শ্রাবন্তীর বুদ্ধিকেও অবহেলা করবার কিছু নেই। কিন্তু পার্থক্য হলো, আমার বুদ্ধি খুব কাজের। আর শ্রাবন্তীরটা অকাজের নয়, কিন্তু সরল। আমি যেমন যেকোনো বিপদে বুদ্ধি দিয়ে উতৎরে পাড়ি দিয়ে উঠে আসি। ধরা যাক, আমি বিপদের নদীতে পড়লাম, সাঁতার না জানলেও, আমি খড়কুটা, বাঁশ কিছুটা আঁকড়ে ধরে পাড়ে উঠে যাবো। আর শ্রাবন্তী তার বুদ্ধি ব্যয় করবে সাঁতার কেটে ঠিক নিয়মে পার হয়ে আসবার জন্য। সে বিপদের নদীতে হাবুডুবু খেতে খেতে বুঝতে পারবে না, সাঁতারের কোন কৌশল তাকে এখন বাঁচাবে। এর মধ্যে সে এক বালতি বিপদ নামক নদীর পানি গিলে ফেলবে, হাঁসফাঁস করবে, অতঃপর পাড়ে উঠে যাওয়া আমার দিকে হাত বাড়াবে। আমি তাকে টেনে তুলবো। সব সময় যে টেনে তুলতে পেরেছি তা না, কখনো দুইজনে বেঁচেছি, কখনো আমি বেঁচে এসেছি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তার দিকে হাত বাড়াতে পারিনি। নিজেকে ডাঙায় তুলতে ব্যস্ত ছিলাম, হয়তো শ্রাবন্তী বিপদের নদীতে ততক্ষণে পুরো ডুবে গেছে।
এই যেমন, সেবার ক্লাস এইটে শ্রাবন্তী হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় অংকে ফেইল করলো খুব বাজে ভাবে। ফাইনালে ফেইল করলে প্রমোশন পাবে না, আর ক্লাস নাইনে সায়েন্স পাওয়া তো দূরের গল্প। শ্রাবন্তীর বাবা, নিরঞ্জন কাকু খুব কড়া মানুষ। সেই ছোটবেলায় শ্রাবন্তীর মা মরে গেছে। কাকু তাই মেয়ের দেখভালে সতর্ক, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। অংকে ফেইল করেছে জানলে, কাকু মেরেই না ফেলে শ্রাবন্তীকে! শ্রাবন্তীর বড় পিসি যে শ্রাবন্তীদের সঙ্গে থাকে, তিনিই এই শকুন্তলা পিসি। তখন তিনি তাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। আর উনি তো সূর্যের চেয়ে বালি গরম গোত্রের। কাকুর চেয়েও কড়া। শ্রাবন্তী ভীষণ ভয় পায় পিসিকে। অতঃপর, এই আমি বুদ্ধি করে নিরঞ্জন কাকুর সই দেখে, নকল করে শ্রাবন্তীর রিপোর্টকার্ডে বসিয়ে দিলাম। এতো নিখুঁত জালিয়াতি করলাম, যে কেউ ধরতে পারলো না। নিরঞ্জন কাকু নিজেও পারবে না আমি নিশ্চিত। আমি বললাম, “সাইন তো দিলাম, ফাইনালে কী হবে রে? কাকু দেখবেন রিপোর্টকার্ডে হাফইয়ার্লি পরীক্ষার জায়গায় উনার সই বসানো। তোকে তো মেরে ফেলবে।”
শ্রাবন্তী কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলে, “তখন যা হবে, হবে। বাবার মেজাজ খুব খারাপ এখন চাকরি নাই। মেরেই ফেলবে। আর ফাইনালে আমি ঠিক ভালো রেজাল্ট করবো। সায়েন্স পেলে বাবা কিছু বলবে না। থাঙ্কস দোস্ত তোর বুদ্ধির জন্য।” খুব বাজে কাজ হলো, না? তবু করলাম, হ্যাঁচকা টেনে তুললাম শ্রাবন্তীকে, সে বিপদ নদী থেকে। এর পরের কাজটুকু আরো খারাপ ছিলো। ফাইনালে সায়েন্স পেলো ঠিক শ্রাবন্তী। ভালো ঠিকঠাক রেজাল্ট করলো। কিন্তু কাকুর হাতে জালিয়াতি সই ধরা পরে গেলো, এবং তিনি মোটেও শ্রাবন্তীকে ক্ষমা করলেন না। ক্ষমা করলেন না শকুন্তলা পিসিও। কী যে মার খেলো মেয়েটা। আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন শকুন্তলা পিসি। আমি যাইনি। বাসায় ফোনে করে আমাকে জানতে চেয়েছিলো, শাসিয়েছিলো, এই কাজে আমি শ্রাবন্তীকে সাহায্য করেছি কিনা? উনি আমার আব্বাকে বলে দিবে। আর আমি জানি, আব্বা জানলে আমার কী পরিণতি হবে। তাই আমি সেই খুব বাজে কাজ করলাম, আমি অস্বীকার করলাম, নাহ এ কাজের সাথে আমি ছিলাম না। আমি শকুন্তলা পিসির সাথে তাল মিলিয়ে সুর তুলেছিলাম যে শ্রাবন্তী অত্যন্ত বাজে কাজ করেছে। জালিয়াতি একটি নোংরা কাজ। আর তার পরের তিন সপ্তাহ আমি শ্রাবন্তীর সাথে যোগাযোগ করিনি।
তবুও আমরা সব ভুলে আবারও বন্ধু হলাম, হয়ে রইলাম। এসএসসি পরীক্ষার আগে জন্ডিসে পড়লো শ্রাবন্তী। ভূগোল পরীক্ষার দিন তার নাকি প্রশ্নে প্রায় কিছুই কমন পড়েনি। শ্রাবন্তীর সিট আমার পাশের সারিতে, কোণাকুনি। আমি ওর দিকে সম্পূর্ণ খাতা মেলে দিলাম। “লেখ তুই।” শ্রাবন্তী লিখেছিলো। গার্ড স্যার এসে দাঁড়ালেন। শ্রাবন্তীকে কিছু বললেন না। কিন্তু আমার খাতা কেড়ে নিয়ে ঠিক ৪৫ মিনিট আটকে রেখেছিলো। চোখের জলে আমি সারা। পুরো স্কুলে দুজন মাত্র ভূগোলে লেটার পায়নি আমি আর শ্রাবন্তী। আর শ্রাবন্তীর টোটাল মার্ক, এসএসসিতে আমার চেয়ে ৫৩ বেশি। আমি পিছিয়ে গেলাম।
তবুও আমরা বন্ধু রয়ে গেছি। তবুও আমরা বিপদে একজন আরেকজনকে টেনে জাপ্টে তুলতে চাই। কখনো নিজেই ডুবে যাই। কলেজের শেষের দিকে, ইকবালের সাথে আমার দেখা, পরিচয়। তারপর শ্রাবন্তীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। শ্রাবন্তী ডুবে গেলো কেমন ইকবালে। টলটলে জলজ প্রথম প্রেম। আমার তো আর ইকবালকে বলা হলো না আমি ও টলটলে, ভীষণ জলজ, গলে আছি, পুড়ে যাচ্ছি প্রথম প্রেমে, ইকবালে। আমি ছেড়ে দিলাম। তিনমাসের প্রেম হলো শ্রাবন্তী আর ইকবালের। টেকেনি। টিকে যাবার জন্য সে প্রেম হয়নি। কিন্তু শ্রাবন্তী আজও জানে না, সেই তিনমাসের প্রেমটা আমারও হতে পারতো। শ্রাবন্তীকে বলা ও হয়নি যে আমার এখনো হৃদয় পোড়ে, একটা তিনমাসের প্রেমের জন্যে।
আর আমার যখন সেই বাম পা ভাঙলো, প্রতিদিন ক্লাস করে ফিরে, শ্রাবন্তী সোজা আমার বাসায় এসে, সব নোট লিখে দিয়ে যেত আমার খাতায়। একটা ব্ল্যাকবোর্ড কিনে এনেছিলো আমার বাসায়। প্রতিটি ক্লাসের পড়া, এঁকে বুঝিয়ে শিখিয়ে বাসায় ফিরতো ক্লান্ত হয়ে সেই সন্ধ্যায়। আর জ্বর হলে, এখনো বয়ামে ভরা মুরগির সুপ বানিয়ে এনে খাইয়ে যায়, আমার বন্ধু শ্রাবন্তী।
আমরা এমন করেই বন্ধু রয়ে গেলাম। এই যে, এই মুহূর্তে আমি শকুন্তলা দেবীর সামনে বসে আছি, এক বিপদ নদী সাঁতরে পার করবার কৌশল হিসেবেই আছি। শকুন্তলা দেবী কেমন যেন, বাস্তব মনে হয় না। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি। এখনো। খাঁটি ঘিয়ের মতন ঘন তার শরীরের রং। জোড়া ভুরু, আর কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠা ঠোঁট তার। তাকে দেখলে একবার, “হায়! আমি কেনো এমন হলাম না,” হিংসে বোধ জাগবে। এই যেমন উনার পাশে বসে আমার এখন যেমন মনে হচ্ছে। মাছ কুটছে এখনো। আজ বোধহয় সারা মাসের মাছ এনেছে বাজার থেকে। রুই কাটছে এখন। পাশে টুকরিতে কই, পাঙ্গাস, পাবদা, ট্যাংরা। সব কেটে ফেলবে, কী নিবিড় মনোযোগে। কোথাও ভুল নেই। মাছের মাথা থেকে ফিনকি দেয়া রক্ত এই মাত্র উনার সোনার নাকফুলে যেয়ে টুপ্ করে পড়লো। সবুজ পাথরের সোনার নাকফুল লাল রক্তজবা রং, কেমন কবিতার মতন সব। তবে এই নান্দনিকতার বোধ জাগে, যখন উনি চুপ করে ধ্যানরত পাখির মতন থাকেন। কিংবা এই একমনে মাছ কাটেন। ধ্যানভঙ্গ কথার কথায় যে শকুন্তলা দেবীর পরিচয় মেলে, তিনি এক ধ্বসে পড়া পুরোনো বাড়ির মতন খসখসে, রসহীন, এবং জৌলুশহীন।
আমি যে বিশেষ উদ্দেশ্যে বসে আছি, সেটার প্রথম চাল কীভাবে চালবো সেটা ভাবছিলাম আসলে। কিন্তু তার আগেই তিনি প্রশ্ন করলেন, ঠিক ওই নাকফুল রক্ত ছিটে আসবার পর পরই।
“তুমি এখানে বসে আছো যে? শ্রাবন্তী কই?”
শকুন্তলা দেবী, শ্রাবন্তীর পিসি, আমাকে মনে হয় বিশেষ পছন্দ করে না। উনি শ্রাবন্তিকেও পছন্দ করে না তেমন। শ্রাবন্তী বলে, “পিসির পুরো দুনিয়ার উপর রাগ, যেন সবাই তার শত্রু।”
তাই আমার উপর উনার বিরক্তি নিয়ে আলাদা করে ভাবি না। বরং কাজ শেষ করে চলে যাবো কখন তাই ভাবছি।
তবে চাল চালতে হবে খুব সাবধানে। তাই, মিহি করে বললাম, “শ্রাবন্তী গোসলে গেছে। আমি তাই একটু এসে বসলাম পিসি। চলে যাবো?”
ইচ্ছে করে মাপ মতন ঢঙে কথা বললাম। এমন নরম কথা কেউ ফেলতে পারে?
তিনি কিছু বললেন না। রুই মাছ কাটাকুটি সারা। এবার পাবদায় হাত দিলেন। মাছ নয়, যেন একটা করে রুপোর খাড়ু। এমন আলতো করে, আদর দিয়ে মাছগুলো তুলে পেট কেটে পরিষ্কার করছেন। কিছু যখন বললেন না, তখন বুঝলাম অনুমতি আছে আমার এখানে বসবার। আমি এতক্ষণে ঠিক করে ফেলেছি যে আমি এর পর কী বলবো। আমার প্রথম দুতিন লাইন ঠিক করা। পরেরটা পরে দেখছি।
বললাম, “আম্মার পাবদা মাছের ঝোল যা পছন্দ ছিলো এক সময়ে, ওই পাতলা ঝোল, নামানোর আগে জিরা টেলে গুঁড়া আর গোটা কাঁচা মরিচ। এখন তো আর এসব খেতে পারেন না।”
উনি ঠিক তা বললেন, যা ভেবেছিলাম, “তোমার আম্মা কেমন আছেন এখন?”
-“ওই প্যারালাইজড মানুষ যেমন থাকে।”
শকুন্তলা পিসি নীরব। কাজ করছে।
আমি ভেবেছিলাম, উনি এরপর একটা প্রশ্ন করবেন যে, “তোমার মায়ের দেখাশোনা কে করে?” ঠিক আছে, প্রশ্ন না করলেও চলবে। আমার চাল তৈরী।
আমি নিজেই ঘুরিয়ে বলি, “আজকাল তো আসতে পারি না পিসি খুব একটা। যে লোকটা মায়ের দেখাশোনা করতো চলে গেছে। মাকে দেখাশোনা করতে হয়। একদম একা আমি।”
“কেন তোমার ছোট বোন আছে না একটা, সে মায়ের দেখা শোনা করে না?” শকুন্তলা পিসি প্রশ্ন করলেন।
আমি এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তবে প্রশ্নটা খারাপ না। সামনে আলাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক। আমার এখানে বসে থাকার উদ্যেশ্য খুব সহজ। আজ শ্রাবন্তীর বিয়ে। গোপন বিয়ে। আশরাফের সাথে তার প্রেম। টলটলে থেকে এখন গভীর। বড়বেলার প্রেম। আমি সেই প্রেমের আসে পাশে গোপনে গভীরে জড়িয়ে আছি। শ্রাবন্তী আর আশরাফ আজ পালিয়ে বিয়ে করবে। একে ধর্ম মেলে না, তারপর প্রেমের বিয়ে। শকুন্তলা পিসিতো মেনে নেবে না। শ্রাবন্তীর বাবা নিরঞ্জন কাকু বেঁচে নেই তিন বছর হলো। বোনের হাতে সংসারের চাবি দিয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়েছে। তাই নিরঞ্জন কাকুর বাড়ি সম্পত্তি এবং একমাত্র কন্যার দায় এবং দায়িত্ব সম্পূর্ণ ভাবে শকুন্তলা পিসির হাতে। এবং তিনি তা বিনা কার্পণ্য ও মায়াহীন ভাবে পালন করে। সেই হিসেবে শ্রাবন্তীর একমাত্র ভরসা পালিয়ে বিয়ে করা। কারণ শকুন্তলা পিসির সাথে এই খটখটে ঝুরঝুরে পুরোনো বাড়ির মতন জীবনের চেয়ে, টলটলে জলকেলির প্রেম প্রেম জীবন অনেক আদরের, বাসন্তী।
আমাকে তাই দায়িত্ব শ্রাবন্তী দায়িত্ব দিয়েছে যে, সে যতক্ষনে তার সুটকেস এবং প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে, আমি যেন রান্নাঘরে শকুন্তলা দেবীকে আমার গল্পে আটকে রাখতে পারি এবং বিশ্বাস গাঢ় করে দিতে পারি যে, আমি এবং শ্রাবন্তী আজ দুইজন মিলে সাজেক ঘুরতে যাচ্ছি তিনদিনের জন্য। গল্পের প্রপস হিসেবে আমার বাসা থেকে একটি কাপড় ভরে ব্যাগও নিয়ে আসতে হয়েছে। প্রমাণ, আমি আর শ্রাবন্তী ঘুরতে যাচ্ছি।
তো, আমার ছোটবোন মায়ের দেখাশোনা করে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর দিলাম শকুন্তলা দেবী, মানে পিসিকে।
“পিসি, আমার ছোটবোনের তো বিয়ে হয়ে গেছে।”
রুপোর গয়নার মতন যত্ন করে হাতে ধরে থাকা পাবদা মাছ দেখি ফেলে দিলো গামলায়। এই প্রথম উনি আমার দিকে তাকালেন, জোড়া ভুরু আর বাঁকা চোখ দুটো কুঁচকে বললেন, “মানে কী? তোমার আগে ছোটবোনের বিয়ে হলো? তোমার বাবা মা দিলেন?”
“ইয়ে পিসি, আমার ছোটবোনের একজনকে পছন্দ ছিলো। জোর দিচ্ছিলো, বিয়ে করে বউ নিয়ে বিদেশ যাবে তাই…”
“আর তোমার বিয়ে?”
এইসব প্রশ্নের জন্য তো আমি তৈরী ছিলাম না। আমতা আমতা করি। কিন্তু ওই যে আমার খুব বুদ্ধি, ঠিক সব সামলে নেই। তাই সামলে নিয়েই বললাম, “এরপর তো মা অসুস্থ হয়ে গেলো, বাবা ও তো বহুদিন ধরে অসুস্থ। এখনো ওসব ভাবছি না। দেখি…”
শকুন্তলা দেবী চুপ। আমিও। একটু আগে যত্নে তোলা রুপোর মতন মাছগুলোকে, এখন কী নির্মম হাতে তুলে নিচ্ছে। শকুন্তলা দেবীর হাতের অনাদরে পাবদাগুলোকে এখন মাছই মনে হচ্ছে, রুপোর ঝিকমিক পাত মনে হচ্ছে না। যাক কালক্ষেপণ তো হচ্ছে। শ্রাবন্তী কতদূর এগোলো, কে জানে? ব্যাগ গুছিয়ে দরজার বাইরে রেখে এসে আমাকে মোবাইলে মিসকল দিবে। সব প্ল্যান ঠিক। তারপর আমরা বেরিয়ে যাবো। ওকে আশরাফের কাছে পৌঁছে আমার ছুটি। এখনো সে ফোন করেনি আমাকে। অপেক্ষা করছি।
শকুন্তলা দেবী বললেন, “রোজিনা।”
– “জ্বি”
“আমার মতন হয়ে যেও না।”
আমি চমকে উঠি। পাবদা মাছ হলে এতক্ষনে পিছলে মেঝেতে পড়ে যেতাম। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার কী করার আছে? বুদ্ধি তো কাজে দিচ্ছে না, এই প্রথম।
শকুন্তলা দেবী, দ্বিতীয়বার আমার দিকে তাকায়। “জানো তো কেনো বললাম?” আমি আসলেও জানি না। শ্রাবন্তী মোটেও শকুন্তলা পিসিকে পছন্দ করে না। তাই তার গল্পও করে না। এতোবছরে শুধু জানি, তিনি চালচুলা হীন, সংসারহীন এক মানুষ, এ সংসারে থাকে, আর জ্বালিয়ে মারে।
মাথা নাড়লাম তাই, জানি না। আমার দিকে তাকিয়ে হাতের মাছ হাতে রেখেই বললেন, সেই পরিচিত ঝুরঝুরে কণ্ঠেই বললেন, “ওই যে আমার বিয়ের সম্বন্ধ আসলো, কী ভালো ঘর, বর। বিয়ে ঠিক হলো। বিয়ের আগে, ছেলে আমাদের বাড়ির সামনে পৌষের মেলা দেখতে নিয়ে গেলো। আমি আমার ছোট বোন নীলিমা, আর আমার হবু বর।”
আমি শ্রাবন্তীর ছোট পিসি নীলিমাকে দেখেছি এক দুই বার মনে আছে। মনে আছে যে, সে শকুন্তলা পিসির মতন একটু ও নয় দেখতে, রূপকথার মতন নয়। প্রতিদিনের মতন। তবে খুব সহজ স্বাভাবিক। হেসে হেসে ওঠা এক মুখ।
“তো মেলা থেকে ফিরে হবু বর জানালেন, তার আমার ছোটবোনকে পছন্দ, আমাকে নয়। ওই আগেরকার দিনে বাংলা সিনেমাও দেখাতো যে, তেমন। ব্যাস, এক মেয়েকে তো পার করা যায়। আমার ছোটবোনের সাথে ওই লোকের বিয়ে হলো। এর পর আমার বাপ মরলো।” এরপর ক্ষণিক বিরতি। দীর্ঘশ্বাস। যা এই গল্পে প্রয়োজন ছিলো ঠিক এ জায়গাটিতে। তিনি আবার শুরু করেন। “আর আমি এই বাড়ি, ও বাড়ি, কারো পিসি, কারো মাসি হয়ে কাটিয়ে দেই। সবাই বড় ছিঃ ছিঃ ঘেন্না করে, বুঝি তো। কই যাই বলোতো? যা করি সব অন্যের, নিজের নাই কিছু। তাই বলি কি, আমার মতন হয়োনা। সময় কিন্তু চলে যাবে একদিন।”
শকুন্তলা দেবী আবার মনোযোগে পাবদা মাছের শেষটাকে কাটাকুটিতে ব্যস্ত থাকে। যেন এ ছাড়া আর কোন কাজ নেই। যেন এ ছাড়া আর কখনো তিনি কিছু করেনও নি। বলেনও নি।
আমি না এতক্ষন উবু হয়ে বসে মাছ কাটা দেখছিলাম। এবার বসেই পড়লাম মেঝেতে। শকুন্তলা দেবীর নাকফুল ওই যে এক ছোট্ট সিঁদুরের টিপের মতন রক্ত জমে আছে, তার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমারও তো আজ বড় মন খারাপ। খুব খুব। আমার এমন মাছের রক্তের মতন চুঁয়ে পরা, গলগলে কষ্ট হচ্ছে, সেকি শকুন্তলা দেবীর জন্য, নাকি নিজের জন্য? এই যে আমি প্রতিদিন এক স্বপ্ন দেখি যে, আশরাফের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে, শ্রাবন্তীর না। আমি যে মোবাইলে প্রতিদিন আশরাফের ছবি খুলে নিয়ে বসে থাকি, সেই যে শ্রাবন্তীর সাথে আশরাফের প্রেম হব হব সময়ে, আশরাফ আমাকেও বলেছিলো, আমাকে দেখলে এক মায়াচোখের কাঠবেড়ালির কথা মনে হয়, আমার যে সব মনে পড়ছে। আমি যে সব ছেড়ে, বিপদের নদী থেকে তুলে আনবার জন্য যে হাত বাড়িয়েছি শ্রাবন্তীর দিকে। কারণ আমরা তো এমন করেই বন্ধু হয়ে আছি। কিন্তু আমি তো ডাঙায় নেই, আমি নিজেই তো ডুবে যাচ্ছি। সেই কতবছর আগের হারানো গুনগুন তিনমাসের প্রেম, আজকের ঘন গাঢ় বড় বেলার প্রেম, সব হারিয়ে যে আমি কুলহারা হয়ে যাচ্ছি। শ্রাবন্তীকে তুলে দিচ্ছি ডাঙায়। আমরা যে এমন করেই বন্ধু। তবু আমার যে খুব মন খারাপ।
শেষ পাবদা মাছ টুকরিতে ফেললেন, তিনি আমার দিকে তাকালেন না। কিন্তু প্রশ্ন করলেন, “রোজিনা, শ্রাবন্তীতো আজ পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তাই না?”
আমি চুপ। আমার এক উত্তরে শ্রাবন্তী এ বিপদ নদী থেকে এ যাত্রায় বেঁচে যেতে পারে। আবার আমার আরেক উত্তরে শ্রাবন্তী এই বিপদ নদীতে আটকে হাবুডুবু খেয়ে ডুবে যেতে পারে। আমার এক উত্তরে আমি শকুন্তলা দেবী হয়ে সব বিসর্জন করে, সারাজীবন এমন মাছ কাটাকুটির অন্যজীবন বেছে নিতে পারি। আমার আরেক উত্তরে আমি রোজিনা হয়ে উঠতে পারি, শ্রাবন্তীকে শকুন্তলা পিসির কাছে ধরিয়ে দিয়ে, ডুবিয়ে দিয়ে, আমি এবার আবার প্রেমের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে পারি।
“রোজিনা, শ্রাবন্তীতো আজ পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তাই না?” আমার কাছে এ প্রশ্নের দুটো উত্তর আছে, না কিংবা হ্যাঁ। আমার উত্তরে আমি শকুন্তলা দেবী হয়ে উঠতে পারি কিংবা রোজিনা। শকুন্তলা দেবী আমার উত্তরের অপেক্ষা করছে। আমি আমার উত্তরের অপেক্ষা করছি।

জন্ম ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স এবং অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটি থেকে এনভায়রনমেন্ট এন্ড সাস্টেইনেবিলিটি বিষয়ে আরেকটি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এর পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত তার লেখা কলাম, ছোটগল্প এবং কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে।
চমৎকার গল্প
অশেষ কৃতজ্ঞতা
অশেষ কৃতজ্ঞতা
বাহ্, আরো একটি মুগ্ধতা উপহার দিলে…