একগুচ্ছ কবিতা । কল্যাণী রমা
জানালা
মেয়েটির জানালার ওপাশে বুলবুলি পাখি ছিল। ছিল খালি পায়ে হাঁটবার শিশিরভেজা ঘাস; সমুদ্রের রঙ ঝিলমিল ঝিনুক; আকাশ কালো ক’রে নেমে পড়া বর্ষা; বেগুনি রঙের সূর্যাস্ত; ছোট ছেলেমেয়েদের খেলাধূলা, হৈ চৈ; পূজার ঢাকের শব্দ; মসজিদের আজান; কোন এক প্রেমিকের পথ চেয়ে থাকা। মেয়েটি কোনদিন জানালাটা খোলেনি।
জানালাটার এপাশেও মেয়েটিকে কেউ কোনদিন বলেনি, ‘গয়নাগুলো খুলে রাখ। আজ শুধু তোমাকে দেখি।’
সোনার চুড়ির ঝমঝম শব্দে, জানালা বন্ধ ক’রে মেয়েটির জীবন কেটে গেছে। একটা আস্ত জীবন।
নৌকা
মানুষের জীবনটা নৌকার মত ভেসে ভেসে চলে। কখনো নৌকা বাইচ, কখনো শুধুই ভেসে চলা। তীরে তার কাশবন থাকে, থাকে দূর্গাপূজার ঢাকের শব্দ, আকাশে থাকে ঘুড়ি ওড়ানো, আর মাটির নিচে থাকে বুনো, মিঠে আলু জন্মানোর আনন্দ।
তবু সেসব ছেড়ে মানুষ জলের উপর ভেসে যায়। ছলাৎছলাৎশব্দহৃৎপিন্ডের কোথাও একটা ঘা দেয়। মনে হয় অজানা তীরে কোনদিন না পৌঁছালেও, মাঝনদীতেও হয়ত জীবনটা কেটে যেতে পারে। নৌকার উপর খুব ঝাল দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল রান্না ক’রে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যেন মাছের লাল রক্ত নৌকার খোলে না পড়ে। রক্ত ছুঁয়ে দিলে নৌকা ডুবে যাবে।
তবে জীবনের সব নৌকাই ডিঙি নৌকা হয় না – নিচে ফুটো, টিনের থালায় জল সেঁচতে সেঁচতেই জীবন শেষ।
কিছু নৌকা হয় বজরা – আগের দিনে বাংলাদেশের জমিদার আর বিত্তশালীদের নৌ-ভ্রমণের শখে যেসব নৌকা ছিল ঠিক তেমন। হয় ময়ূরপঙ্খী নৌকাও। প্রাচীন কালের রাজা-বাদশাহদের শৌখিন নৌকা ময়ূরপঙ্খী। সামনের দিকটা দেখতে ময়ূরের মতো। চারজন মাঝি সে নৌকা চালায়।
তবুও সব নৌকার আকাশেই একই মেঘ থাকে। সিঁদুরে রঙ ঝড় ডেকে আনে। বৃষ্টিতে পাল ভিজে যায়। রঙধনু ওঠে। সূর্যোদয় হয়। এবং সূর্যাস্ত।
জলে ভেসে যেতে হ’লে ঘর ছাড়তে হয়।
ঘর
মেঘের ওপাড়ে মেয়েটির একটি ঘর ছিল।
নদীর উপরে মেয়েটির একটি ঘর ছিল।
ঘাসফুলের উপর মেয়েটির ঘর ছিল।
ঝড়ের মেঘে মেয়েটির ঘর ছিল।
বাজপাখির ডানায় ওর ঘর ছিল।
মেয়েটির আসল ঘরটি ছিল ওর মনের ভিতর। মেয়েটি তা বুঝতে পারেনি।
বৃষ্টি
সেদিন আকাশে বৃষ্টি ছিল। আমি কোনদিনই বুঝতে পারিনি বৃষ্টি আকাশের কান্না না আনন্দ! আমি বুঝতে পারিনি তীব্র বেদনায় জুঁইফুল ফুটে ওঠে নাকি আলো ছড়াতে।
মানুষের যেসব যন্ত্রণা তার হৃৎপিন্ডকেস্তব্ধকরেদেয়, তার ভিতর কোন সৃষ্টি আছে?
সবসময় আনন্দের গান চোখের জলেই আঁকা।
চাঁদ
কাল দেখেছিলাম আকাশে খুব সরু একটা চাঁদ উঠেছে। কারো সরু ঠোঁটের কথা মনে হ’ল। যার কাছে আমি কোনদিন যেতে পারব না। মাঝখানে অনেক সমুদ্র আছে, নদী আছে, অজানা পাহাড় আছে। অজানা কিছু পার হ’য়ে যাওয়ার মত ঠিক অতটা বোহেমিয়ান প্রাণ নয় আমার। যাযাবর নই আমি। দিনের শেষে আমার ছাপোষা ঘরে অল্প ভাত রান্না করি। তা সরষের তেল আর কাঁচা মরিচ ডলে খাই।
মানুষের জীবনের সব স্বপ্ন সফল হয় না। পূর্ণিমায় ভেসে যায় না তার চারপাশের সব শাপলা ফুল। মানুষ তার আঙিনায় দাঁড়িয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে উড়ে যাওয়া পাখির দিকে, ড্যান্ডিলিয়ানের সাদা তুলোর দিকে, বহুদূরের ঝরণার জলের দিকে।
মানুষের হৃৎপিন্ডদূরেরআকাঙ্ক্ষায়ভিজেথাকে, শেওলার মাঝ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ে।
একা
আকাশ ফুঁড়ে যে গাছ উঠেছে, বনের রাজা, সে একা নয়। তার শিকড়ে জড়িয়ে আছে অন্য গাছের ভালোবাসা।
পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছে যে বাজপাখি, সেও একা নয়। উঁচু থেকে সে নিচের পৃথিবীকে দেখছে।
বনের মাঝে যে হলুদ রঙের একলা বাড়ি, সে একা নয়। তার ইঁটের গায়ে শ্যাওলার সবুজ।
ঘাসের উপর ঝলমলে ফুলগুলো একা নয়, মেঘ একা নয়, সূর্যাস্ত একা নয়, মেঠো পথ একা নয়।
শুধু যে মানুষটি সময়ের সাক্ষী, এঁকেবেঁকে যাওয়া জানালাটার সামনে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে, সে একা।
স্বপ্ন
(ফারজানা সুরভি-কে)
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আমি কিছুতেই ভোরের স্বপ্নটার কথা মনে করতে পারি না। ভোরের স্বপ্ন খুব নরম আর তুলতুলে হয়। সেখানে একটা নদী থাকে। নদীর জলে পা ডোবানো থাকে। জলের ধার ঘেঁষে কলমির কচি সবুজ রঙ থাকে। সে নদীতে হলুদ পালতোলা নৌকা ভেসে যায়।
আমার মাঝরাতের স্বপ্নগুলো কালো দু:স্বপ্নে এসে শেষ হয়। সেখানে কোন সবুজ ডাঙা ভ’রে নেই মধুকূপী ঘাসে অবিরল। আমি দেখেছি ইঁটের নিচে গংঙ্গা-ফড়িঙের শবদেহ পড়ে আছে।
স্বপ্ন আর দু:স্বপ্ন খোঁজাটুকুই মানুষের জীবন। টলটলে জ্যোৎস্নায় খোলা মাঠের মাঝে ঘাসের শিশিরের উপর শুয়ে।যে মাঠের কোন শেষ নেই।আর যে জ্যোৎস্নার।

কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে। প্রকাশিত বইঃ আমার ঘরোয়া গল্প; হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা; রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা; মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক; রেশমগুটি; জলরঙ; দমবন্ধ।