না-লেখা পুলিশ ডায়েরি, বাধ্যতা ও সীমাবদ্ধতার সাতকাহন
আত্মজীবনীর নাম…” না লেখা পুলিশ ডায়েরি”। লেখক সুব্রত বসু। কিন্তু কে এই সুব্রত বসু? একজন খাকি পোশাকের পুলিশ অফিসার মাত্র!অধস্থনের কাছে উচ্চবাক হয়েও অভিভাবকসুলভ! হাতি গন্ডার মারার আস্ফালন লুকিয়ে রাখা নাট্যকর্মী পুলিশ অফিসার! না, সদা বন্ধু-বৎসল রসিক গল্পকার! আবার ‘একের ভিতরে সাত’- এর মত সবকটিই। ২০০৪ এ তিনি সুটুঙ্গা মানসাই বেষ্টিত আমার জন্ম শহর মাথাভাঙ্গার নগরপাল হয়ে আসেন। কোন এক মঞ্চে এসেছিলেন অতিথি হয়ে। খটকা লাগল সত্যি বলতে কোন পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে এত তথ্য ও রসসমৃদ্ধ বক্তৃতা শুনিনি আগে তাও একটি সাংস্কৃতিক মঞ্চে! জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনি কি লেখেন?’ সবিনয়ে বললেন,” থানায় আসবেন, দুই একটা শোনাবো”। দুরুদুরু বুকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে একদিন গেলাম চেম্বারে শোনালেন, “প্রেসার কুকার” নামের একটি গল্প সাদা কাগজে লেখা। তার পরের বছর তিনেক মাথাভাঙা থানা হয়ে উঠেছিল আমাদের আড্ডা ঘর আর সুব্রত বসু আমাদের সাহিত্য স্বজন, আমার সুব্রতদা। এমনকি এই বইতেও এই অধমের উল্লেখ আছে। তাই সুব্রতদার বই এক অর্থে আমারও কিছুটা। জীবন ওর, ঘটনা ওর, ভাষা ওর, বস্তুনিষ্ঠা ওর, ভঙ্গিমা ওর। কিন্তু বন্ধুর সন্তানকে যেমন কিছুটা নিজেরই মনে হয় তেমন আর কি! ধান ভানতে শিবের গীতটা বলতেই হল যাতে ধান ভানাটা আত্মিক ও আন্তরিক হয়। সমালোচনার দায় আমার নেই, দায়িত্ব প্রতিক্রিয়া টুকু জানানোর মাত্র, তাও ওর সমগ্র অনুভূতি ‘ফিনিশড প্রডাক্ট’ হিসাবে আমার চোখে কতটুকু।
সুব্রত বসু সে অর্থে কোন চ্যাপ্টারে বা পর্বে পর্বে ভাগ করেননি। সাবটাইটেল দিয়ে ছোট ছোট অংশ। কখনো কখনো স্মৃতি ওভারল্যাপও করে গেছে। মহাকালের আবর্তন প্রবাহে জীবনের রঙ্গমঞ্চে প্রতিদিন কত ঘটনাই না ঘটে! আবার তাদের তাৎক্ষণিক অস্তিত্ব শেষ হয়ে গেলে, হারিয়েও যায়। সবসময় বিশ্বের বাকি সব মানুষের সামান্য প্রবেশও থাকেনা, আগ্রহও থাকে না। তাই ঘটনা বাছাটাও একটা বিষয় যা পাঠকের মনোগ্রাহী হবে আবার রসময়ও। তবে মানুষের মস্তিষ্কই বুঝি অবচেতনে সেই দায়িত্ব নিয়ে নেয়। না, হলে রবীন্দ্রনাথই বা “জীবনস্মৃতি”তে কেন লিখবেন এরূপ আর সুব্রত বসুইবা কেন উদ্ধৃত করবেন তা…”স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আকিঁয়া যায় জানিনা। কিন্তু যে-ই আকেঁ সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা-কিছু ঘটিতেছে তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সেই আপনার অভিরুচি অনুসারে কত কি বাদ দেয়, কত কি রাখে। কত বড়কে ছোট করে, ছোটকে বড় করে তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজেই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।”
আর প্রত্যেকটি মানুষের ইতিহাসকে সম্মিলিত করতে পারলেই একটা সময়ের ইতিহাস, একটা জাতির ইতিহাস। তাই আত্মজীবনী যদি তা নির্মোহ, নিরপেক্ষ হয় তবে তা অবশ্যই সমাজবিজ্ঞানের অংশ। আরে এ লেখা তা অবশ্যই দাবি করতে পারে। কেননা এ লেখা পুলিশের রাজা-উজির বা হাতি গন্ডার মারা নয় যা অনেকেই করে থাকেন সূচাগ্র সত্যের সাথে অনেকটা মিথ্যের হওয়া ভরে দিয়ে। এ লেখা অনেকটাই অসহায়তার, অনেকটাই ব্যর্থতার, অনেকটাই আশাভঙ্গের। এ লেখা অনেকটাই একজন মানুষের নীতিকথা হারানোর গল্প। এ লেখা একজন সংস্কৃতিবান মানুষের পরিপূর্ণ পুলিশ না হতে পারার স্বভিমানি অক্ষমতার গল্প। জীবনের পরতে পরতে যারা তার কাছে বিচার আশা করেছিলেন নিরব আকুতিতে তাদের বিচার না পাওয়ার গল্প। আইনের হেরে যাওয়ার গল্প। অনেকটা দন্ডিতের সাথে দন্ডদাতার সমান আঘাতে জর্জরিত হবার গল্প। আর সেইসব কেতাবি রহস্য কথা ও পর্দার আড়ালে কিভাবে খসে পড়ে বিচারালয়ে রাখা নারীমূর্তির চোখের বাঁধন, খানা কি করে হয়ে ওঠে ভাগ-বাটোয়ারার নিলাম ঘর এ লেখা সেসবের সাতকাহন। এক অনুমোদিত দর্শকের ভূমিকায় দেখা চিত্রনাট্যগুলি উপস্থাপন করেন পেশায় পুলিশ ও নেশায় নাট্যকর্মী-গল্পকার সুব্রত বসু সম্পূর্ণ নির্মোহ ভঙ্গিতে। ‘প্রাককথন’ এপশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আইজি পল্লব কান্তি ঘোষ যথার্থই বলেছেন, “সুব্রত বসু পুলিশের চাকরিতে আমার সমসাময়িক তো বটেই চাকরি জীবনের অনেকটা সময় আমরা একই মহকুমায় বা একই জেলায় কাজ করেছি। আশি নব্বই সালে বা তারও পরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি সারা জীবনের অভিজ্ঞতার রসে জারিয়ে নিয়ে একজন সংবেদনশীল মানুষ কোন দৃষ্টিকোণ থেকে সেইগুলো পরিবেশন করেছেন সেই বিবরণ সকলের কাছেই অত্যন্ত আকর্ষনীয় হয়ে উঠবে এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু উল্লেখযোগ্য যা, তা হল অভিজ্ঞতা বর্ণনে লেখক তার নিজের ভূমিকা প্রসঙ্গে থেকেছেন অতি বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ। নিজের ব্যর্থতার কথা বলেছেন অকপট স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে। সেই সব ব্যর্থতার দায় সরাসরি নিয়েছেন নিজের কাঁধে কোন অজুহাতের আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেননি। একই ভাবে সাফল্যের কথনেও থেকেছেন নিস্পৃহ। আত্মজীবনী বা কর্ম জীবনের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হল candid থাকা। সুব্রত বাবু সে বিষয়ে সফল।”
দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে সুব্রত বাবুর সাথে আমার সান্নিধ্য, সখ্যতা ও সংস্রব একথাই প্রত্যয়িত করে। পর্বে ভাগ না করলেও এ লেখায় একটা ছন্দবদ্ধতা আছে তার সাব হেডিংগুলো দিয়ে। প্রথমদিকে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে তার কর্মজীবনে প্রবেশ,পুলিশ ট্রেনিং ও সেই সময়কার সমস্ত অভিজ্ঞতা। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের যে একটা ভূমিকা ছিল আছে সেই প্রত্ন ইতিহাস। ফিজিক্যাল টেস্ট, দৌড়, বুকের ছাতি ফোলানো, অবশেষে উত্তীর্ণ হওয়া। আবার ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটার ফিরে যাওয়া ও পরে অফিস থেকে পুনরায় ফিরে পাওয়া এবং শেষে মৌখিক এর প্রশ্নবাণ– এসবই বর্ণিত হয়েছে চান্স এন্ড কোইন্সিডেন্সের বিশ্বাসে ও অবিশ্বাসে। মেডিকেল চেকআপে জীবনের প্রথম ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে ‘Under the table transaction ‘-এর মাধ্যমে লেখকের পুলিশি জীবনে প্রতীকি প্রবেশ। পাঠক বোধহয় এ জায়গাটাই খুঁজছিলেন। কেননা আম আদমির দৃষ্টিতে পুলিশ মানে তাই। তা, ইংরেজ বাম-ডান যে আমলই হোক। কিন্তু তারপরে পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকলে ভিন্নধারার অভিজ্ঞতাও হবে। পুলিশ ও রক্ত-মাংসের সাধারণ মানুষ। সমাজ যেমন পুলিশ ও তেমন। ল, ক্রিমিনোলজি, সাইন্টিফিক এইড ইন ইনভেস্টিগেশন,পুলিশ রেগুলেশন অফ বেঙ্গল, ঘোড়ার তিন চাল- ট্রট, ক্যান্টার, গ্যালপ, সাঁতার না-জেনে ফেল করে যাওয়া আর ঘোড়া চালানোর পরীক্ষায় মাঠ ছেড়ে একেবারে গান্ধীঘাটে চলে যাওয়ার মত অক্ষমতাও অকপটে লিখেছেন, কথক তার “পুলিশ তৈরীর কারখানা” পর্বে। আর তার সন্নিহিত আত্মজীবনী না আত্মপ্রচার অংশে তিনি যখন লেখেন, “জীবন একটা বড় সমুদ্র, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিস্মরণের তাপে শুকতে শুকতে ঘোলা ডোবায় পরিনত হয়। আমাদের মতন লোকের আত্মজীবনী মানেই সেই ঘোলা জলে পাঁক ঘেটে যা সংগৃহিত হয়নি সেই মনি মুক্তার সন্ধান করা।শেষ পর্যন্ত রোমন্থনের আঁচে পাক হতে হতে যা পড়ে থাকবে তা শুধু আত্মপ্রচারের গাদ। “তার এই বক্তব্যের সাথে আমরা সহমত হইনা। এ লেখা মোটেই আত্মপ্রচারের গাদ নয়, বরং ঘটনার আশ্রয়ে এক ধরনের আত্ম-সমালোচনা।
থানা ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের সাধারনের কোন ধারণাই নেই। বরং যা আছে তা এক ধরনের বিরক্তিকর অনীহা। এক ধরনের নির্লিপ্তি। বা খুব অসত্য হবে না যদি বলি যা ধারণা তার সবটাই নেগেটিভ। থানার মধ্যেই যে কত ঘটনা প্রতিদিন তৈরি হয় বা কত বিভাগ রয়েছে পুলিশেরই! পুলিশ, রিজার্ভ ফোর্স, সিআইডি, ডিআইবি কতকিছু! আছে মালখানার মত একটা বিষয় ও। যেখানে মাছিমারা কেরানি রা বছরের-পর-বছর লিখে চলেছে বা কপি করে চলেছে। ‘ছাতি’ কিভাবে ‘হা তি’ হয়ে বিপদ ঘটায় -সেইরকম হাস্যকর ঘটনা প্রমাণ করে থানা সব অফিসের মতোই নিছকই একটা অফিস। আবার অপরাধী কে ধরলেই যে পুলিশের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না সে কথা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের বারবার দেখিয়েছেন তিনি। কেননা শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত অপরাধীকে অপরাধী বলা যাবে না। আর কালো কোটের উকিল,কোর্ট এসব তো রয়েছে সাদাকে কালো আর কালোকে সাদা প্রমাণ করতে। তাই আরক্ষা আধিকারিকের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও ছাড়া পেয়ে যায় অপরাধী বরং কখনো কখনো নিরপরাধও শাস্তি পায়। কেস সাজানো এবং এভিডেন্স জোগাড় করায় যে আসলে একজন পুলিশ অফিসারের সবচেয়ে বড় কাজ সে কথা এই বইটি না পড়লে জানতেই পারতাম না। কেননা আছে রাজনৈতিক চাপ, ওপর ওয়ালার চাপ ও সর্বোপরি ব্যক্তি পুলিশকর্মীটির প্রলোভনে সাড়া না দেওয়ার লৌহ সংকল্প। আধিকারিক সুব্রত বসু এত চেষ্টা করেও হাসুয়া দিয়ে খুন করা খুনিকে সাজার ব্যবস্থা করতে পারেননি কেননা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বলেছিল “এটা দিয়ে ওইভাবে হত্যা করা সম্ভব নয়। “বা কাটোয়ার সেই বাচ্চা মেয়েটি যাকে পাঞ্জাব পুলিশ খুঁজে পেয়ে ফেরতও নিয়ে এসেছিল কিন্তু তার বাবা-মা অন্য কোথাও চলে যাওয়ায় সেই কিশোরীটি চির অনাথ হয়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ইন্সপেক্টর সুব্রত বসু।
ব্যক্তিগত পরিচয় সূত্রে জানি সুব্রত বসুর পাঠ পরিসর। বারবার তবুও বলেন ‘বিপুলা বসুধার কতটুকু জানি’? শুধু জ্ঞেয় পৃথিবীর কথাই নয় তিনি এক অজ্ঞেয়, অজ্ঞাত পৃথিবীর কথাও বলেন।যা হয়তো আছে, হয়তো নেই। হোরাশিও পুরোটা জানে না। তাই তার অন্যান্য অনেক লেখার মতো এখানেও তার জীবনের প্রত্যক্ষ করা কিছু অব্যাখ্যাত সঙ্গ, অনুষঙ্গ এসেছে স্বাভাবিক ভাবেই। হাসিবুল কাজী চাইলেই যে যা খেতে চায় তাই খাওয়াতে পারে। অথচ নির্লোভ হাসিবুল জানে না কিভাবে হয়, বা রহমত চাচা যে তার ছেলের হাতেই খুন হয়েছে তারও সুলুক সন্ধান পান তিনি স্বপ্নে। “মনে হলো কে যেন বলছিল, সবকিছু দেখলেন হাতের মুঠিতে দেখলেন না। “বর্ধমানের কোয়ার্টারে একসময়ের সহপাঠী সমরের অশরীরী আনাগোনাও আলাদা এক ছোট গল্পের উৎস হতে পারে। হয়তো হয়েওছে তার কোন না কোন গল্পের।উল্লেখ্য, লেখক কিন্তু আজ নিরাপদ স্থানগত ও কালগত দুরত্বে দাড়িয়ে ঘটনাগুলো লিখছেন এবং তিনি আদৌ জাজমেন্টাল নন বলেই তা অধিকতর সুখপাঠ্য।
সমগ্র বই জুড়ে লেখক নিজেকেই উন্মোচন করেছেন এবং তা এমনভাবে পাঠকের সামনে যেন ছবির মত পাঠক তা দেখতে পায়। আর এখানেই মঞ্চ সফল নাট্যকর্মী সফল কথাকার হয়ে ওঠেন। আমরা জানতে পারি পুলিশের ক্ষমতা-অক্ষমতা, সততা-অসততা, শক্তি ও দুর্বলতা। এ লেখা তাই এক পুলিশ অফিসারের রাজা-উজির মারা নয় বরং কিছু আক্ষেপ-কথা এবং সিস্টেমের অংশ হয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া সিস্টেমের ত্রুটি।
বইয়ের নাম ও কাহিনি অনুযায়ী চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়। একটি পাঠযোগ্য, আড়ম্বরহীন, রসময় ও সৎকথন হিসাবে এই ছোট্ট টেক্স্টটি বাংলা সাহিত্যে অনেকদিন বেঁচে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।

কবি, সম্পাদক