| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২১

ইরাবতী ঈদ সংখ্যার ভ্রমণ: কুইকুই । শুভময় পাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

চেনা জানা বহুদিনের …

প্রথম দেখা শীতের কাক ভোরে। ভোরবেলা খবর এলো দিল্লি থেকে একটা গাড়ি আসছে, দশ-চাকার, প্রচুর রেডিমেড গার্মেন্টস নিয়ে, যাবে আসাম। মালের কাগজপত্র কিছু নেই। দুটো কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমোচ্ছিলাম, আলিপুরদুয়ারে, অফিস লাগোয়া কোয়ার্টারে। ফোনের রিং শুনতে পেয়ে কোনো রকমে ধরেই এই খবর, চেনা ইনফর্মার, খবর পাকা। জবুথবু, তাও উঠলাম, ডাকলাম আরো দুজন অফিসারকে। বাইরে কনকন করছে জানুয়ারির ঠান্ডা। বেরোলাম। আলিপুরদুয়ার একদম কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। রাস্তার আলোগুলো ফ্যাকাসে সাদা, মিটমিট করছে। অঝোরে ঝরছে কুয়াশা, ভিজে চুপচুপে আশেপাশের গাছপালা। রাস্তাও ভিজে। আমাদের আম্বাসাডার গাড়ির ওয়াইপারের ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। সামনে একজন অফিসার ড্রাইভারের পাশে, আর আমরা দুজন পেছনে। রেললাইন পেরিয়ে, রেল-পুকুর, জংশন স্টেশন, ডিআরএম চৌপথী পেরিয়ে ভোলারডাবরী চা-বাগান। রেনট্রিগুলো কুয়াশায় আবছা, চা গাছগুলোর একটু ওপরে কুয়াশার পাতলা সর পড়েছে। নিঝুম নিথর সবুজ , কুয়াশা ভিজিয়ে দিয়েছে আপাদমস্তক। গোটা চা-বাগান ঘুমিয়ে আছে মনে হচ্ছে। ফরেস্টের চেকপোস্ট চলে এলো, কেউ কোত্থাও নেই। রাস্তা সোজা দমনপুর ব্রিজের তলা দিয়ে জয়ন্তীর দিকে চলে গেছে, ব্রিজের তলাটা গুহার মতো লাগছে।

ওপরে উঠে এলাম হাইওয়েতে। ডানদিকে আসামের রাস্তা, খানিকদূর দেখা যাচ্ছে, বাকিটা হোয়াইট আউট। বাঁদিকে হাসিমারার দিকে এগোলাম। খবর আছে যেরকম, তাতে গাড়িটা এখন মোটামুটি হাসিমারা পেরোনোর কথা। দুদিকে নিচে ঘন জঙ্গল, আবছা হয়ে মিলিয়ে গেছে। ভোরের হালকা আলো পড়েছে গাছগুলোর ওপর। কুয়াশা কাটছে আস্তে আস্তে। সামনে এক বড় বাঁক। বাঁক ঘুরতে না ঘুরতেই গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো। আমি জঙ্গলের দিকে দেখছিলাম, গাড়ি দাঁড়াতেই সামনে তাকিয়ে দেখি বিশাল এক মূর্তি, আবছা। রাস্তা জুড়ে পায়চারি করছে; একা। বিশাল ছাই ছাই কালচে চেহারা, একটা দাঁত আছে, অন্যটা ভাঙা, লেজের জায়গায় প্রায় কিছুই নেই। গোকুল, ড্রাইভার, বললো কুইকুই! মানে?

শুনলাম এই হাতিটার নাম নাকি কুইকুই। বুনো হাতি, রোগ (rogue )।জয়ন্তীর জঙ্গল-বস্তিতে একবার দলবল নিয়ে চলে এসেছিলো। ছোঁড়া মশালের আগুনে লেজ পুড়ে যায়। তারপর থেকে একাই থাকে, আর সামনে কাউকে পেলে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সেই ঘটনার পর নাকি জয়ন্তীর বস্তিতে হানা দিয়ে একটা ছেলেকে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে দিয়েছিলো। লোকালয়ের আশেপাশেই থাকে বেশিরভাগ সময়। এ অঞ্চলের ত্রাস। শুনেটুনে ওই গাড়ির মধ্যে বসে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। উনি বেশ খানিকক্ষণ পায়চারি করে বোর হয়ে নেমে গেলেন জঙ্গলের গভীরে।

এরপর মাঝেমধ্যেই দেখা হতো।

বিয়ের পর ফিরলাম আলিপুরদুয়ারে, সস্ত্রীক। জুনের প্রথমদিক, ডুয়ার্সে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। একদিন  ভোরবেলা দুজনে হাঁটতে বেরিয়েছি; বৃষ্টি নেই, কিন্তু আকাশ এক্কেবারে টইটম্বুর, মেঘ ঝুলে আছে অলিপুরদুয়ারের ওপরে। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সব পেরিয়ে চা-বাগানের কাছে। পুকুর, ডোবা সব জলে ভরে আছে। লতা পাতা জড়িয়ে পেঁচিয়ে উঠেছে বহু পুরোনো শিরিষ, মেহগনি গাছ বেড় দিয়ে। চা গাছগুলো একদম চকচকে সবুজ হয়ে আছে। আমরা যাচ্ছিলাম বাগানের পাশের রাস্তা দিয়ে, হঠাৎ দেখি একটা বিশাল ছাই-কালো পিঠ একটু দূরে চাগাছের ওপর দিয়ে উঁকি মারছে !!  প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি, তারপরেই দেখি বাগানের একদিক থেকে হৈ হৈ করে লোকজন ছুটে আসছে। আমার স্ত্রীর ওই প্রথম অত কাছ থেকে দেখা; ঘাবড়ে গেছে একদম। হাতি তেড়েফুঁড়ে লোকগুলোর দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই ওই লেজহীন বিশাল চেহারা দেখে কুইকুইকে চিনতে একটুও অসুবিধা হলো না। খানিক হম্বিতম্বি করে দৌড়ে বাগান পেরিয়ে মিলিয়ে গেলো অতবড় চেহারাটা।

সেদিনই বিকেলে আমরা গেছি নিমতি ধাবায়, দমনপুর পেরিয়ে হাইওয়েতে হ্যামিল্টনগঞ্জের রাস্তা যেখানে বেরিয়ে গেছে, তার আগেই এই ধাবা।  বৃষ্টি নেই, আকাশও পরিষ্কার, পূর্ণিমার আগে-পরে কোন এক সময়। রাতের খাওয়া সেরে বেশ ফুরফুরে। ফিরছি।  জঙ্গল লাগোয়া বস্তি, অনেকটা ধূ ধূ মাঠ, চাঁদের আলোয় থৈ থৈ। হঠাৎ বস্তির দিকে থেকে হৈ হট্টগোল। আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেলো। দেখছি মাঠ, জঙ্গল পেরিয়ে ছুটছে এক বিশাল চেহারা। পূর্ণিমার আলোয় ভেসে যাচ্ছে সবকিছু, তার মধ্যে ওই দৌড়। কুইকুই।

শেষ দেখা এক অন্য মহল্লায়, অন্য চেহারায়। আজও মনে পড়লে শিউরে উঠি। শীতকাল, ডুয়ার্সে জাঁকিয়ে ঠান্ডা। ফসলে ভরে আছে মাঠ, আর শুরু হয়েছে হাতির উপদ্রব। ডুয়ার্সের মানুষ অবশ্য ভয়ে, ভক্তিতে হাতি না বলে ‘গনেশ বাবা’ বলে। আমার এক পরিচিত থাকেন গ্রামে। উনি একদিন এসে গল্প করছেন কিভাবে সারা রাত জেগে পাহারা দেন ওনারা। আমি ঠিক করলাম দেখতে যাবো। সেই মতো পৌঁছে গেলাম সন্ধে সন্ধে ওই গ্রামে। বড় অপূর্ব সে গ্রাম। শামুকতলার মোড় থেকে হাইরোড ছেড়ে বাঁদিকে নেমে এগোলাম। রায়ডাক ফরেস্ট একপাশে, রাস্তার অন্য পাশে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে তিরতির করে বয়ে চলেছে তুরতুরি নদী। আকাশ লালে লাল, ফরেস্ট পেরিয়ে রায়ডাক চা-বাগান। আস্তে আস্তে সন্ধে নামছে কুয়াশার চাদর মুড়ে। ম্লান আলো ছড়িয়ে আছে বাগানের বড় গাছগুলোতে। ওনাদের গ্রামে পৌঁছলাম যখন তখন সন্ধে বেশ ঘন। চললাম কুয়াশা মাখা আল ধরে ক্ষেতের একদম মাঝখানে। ক্ষেত ভরা ধান। একদম মাঝখানে টং ঘর। টং হলো মাটির উঁচু ঢিবি, ওপরে খড়ের ছাউনি। দেখলাম তার চারপাশে দু ফুটের মতো গর্ত করে পরিখা কাটা। শুনলাম হাতি নাকি কিছু টপকায় না, তাই এই ব্যবস্থা! বিস্মিত হলাম, আমরাই টপকে চলে এলাম, গনেশ বাবা টপকাবে না?

বসে আছি টঙের ওপর, আমরা সব মিলিয়ে আট-দশ জন। সামনে অন্ধকার ক্ষেত, কুয়াশা আজ বেশি নেই, আবছায়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে হালকা কুয়াশা। ক্ষেতের শেষেই জঙ্গল, বক্সা টাইগার রিজার্ভ। আয়োজন অতি সামান্য। আমার জন্যই ওনারা একটু ছাং (এক ধরণের মিলেট থেকে তৈরী রক্সি) আর মুড়ি-ডিমের ঝুড়ির ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়া মশাল, কেরোসিন এগুলো প্রস্তুত।

সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ছাং খানিক গরম করছে বটে, তবে তা খুবই সামান্য। এটা ওটা গল্প চলছে। মোটামুটি রাত আটটা- সাড়ে আটটা বাজে, নিস্তব্ধ, নিথর চারপাশ, শুধু হাওয়ার আওয়াজ ক্ষেতের ফসলে ধাক্কা খাচ্ছে।  হঠাৎ বহু দূরে একটা যেন হৈহৈ, দূরে যেন আলোর চলাচল, আর টিন পেটানোর মৃদু কিন্তু তীক্ষ্ণ আওয়াজ। ওরা বললো এসে গেছে। অতক্ষণ বসে থেকে দ্রব্যগুণে একটু ঝিমুনি আসছিলো, মুহূর্তে স্নায়ু টানটান।  অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু দূরের কোনো মাঠে লোকজনের আওয়াজ টের পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ টং এর ওপরে কেমন একটা কাঁপুনি। মাটি কাঁপছে? বাঁদিকে সবাই তাকিয়ে ওরা। তাকিয়ে দেখি অন্ধকারের মধ্যে আরো অন্ধকার কিছু একটা তীব্র বেগে ছুটে আসছে। আমি ভয়ে পিছিয়ে বাঁশে হেলান দিয়ে। ওরা মশাল জ্বালিয়ে ফেলেছে।  সেই আলোয় দেখলাম ওই একটা দাঁত; তীব্র মাথা নাড়াতে নাড়াতে সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে; কুইকুই! দৌড়ের তীব্রতায় এই টং রীতিমত কাঁপছে। সোজা চার্জ করলো আমাদের এই ঢিবি। একদম সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। ওনারা তো মশাল ছুঁড়ছেন ওপর থেকে। আর ওই অন্য মাঠের যারা তাড়া করছিলো, তারাও হৈহৈ করে প্রায় কাছাকাছি। জানি না কতক্ষণ, কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ সোজা তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর ঘুরে একদম বুলডোজারের মতো সব ফসল তছনছ করে জঙ্গলের দিকে দৌড়ে গেলো। অন্ধকারে ওই বিশাল শরীর ডালপালা ভাঙতে ভাঙতে জঙ্গলে মিলিয়ে গেলো।

প্রায় মাস ছয়েক পরে খবর পেলাম কুইকুইকে বালা নদীর ধারে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। একা, ক্লান্ত, রিক্ত এক গণেশ বাবা চলে গেছে চুপিচুপি, কাউকে জানান না দিয়ে।

 

প্রচ্ছদ শিল্পী: লেখক

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত