ছায়াবৃত্ত
রাত কটা বাজে কে জানে। অন্ধকার ঘরে দেয়াল ঘড়ির একঘেয়ে টিকটিক শব্দ আমাকে সময়ের হিসেব জানাতে পারে না এখন। একটা সিগারেটের তৃষ্ণা পায় হঠাৎ। টেবিলেই রাখা আছে বেনসন লাইটের প্যাকেট, উঠে খেলেই হয়। কিন্তু এখন একেবারেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। আর অদিতি ঘরের ভেতর সিগারেট খাওয়া খুব অপছন্দ করে, থাকুক। এ ঘরে অদিতি আর কোনোদিন ফিরবে কি না জানি না- তবু ওর পছন্দকে অস্বীকার করতে পারি না কিছুতেই।
আমি পাশ ফিরে শুই, কিং সাইজের খাটটার এক কোণে পড়ে আছি এখন। ঊর্বী হবার পরে খাটটা কিনেছিলাম আমরা। তিনজন শুলে খাটটায় আর জায়গা থাকত না, ঊর্বী এমন হাত পা ছড়িয়ে ঘুমায়! কতবার মনে হয়েছে ওর জন্য একটা বেডসাইড কট কিনব, অদিতিই কিনতে দেয়নি শেষ পর্যন্ত। মেয়েকে আলাদা রেখে আমার বুকে নাকি ঘুমাতে পারবে না ও। আজ এই পুরো বিছানার একচ্ছত্র মালিকানায় আমার বুকের ভেতরটা শূন্য লাগে।
আজকাল ঘুম আসে না কিছুতেই। প্রায় প্রতি রাতেই ঘুমের ওষুধ সঙ্গী করেও নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের দেখা পাই না কত রাত! অদিতির ইনসোমনিয়া ছিল, রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গিযেছিল শেষের দিকে। আচ্ছা, ওর কি এখন ভালো ঘুম হয়? ঊর্বীকে বুকে করে ও কি এখন আরামে ঘুমাতে পারে?
গুণে গুণে এক মাস তিন দিন হয়ে গেছে অদিতি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার। তারপর থেকে একদিনও কথা হয়নি। এই তেত্রিশটা মাত্র দিন অথচ আমার মনে হয় মাঝখানে যেন কত জন্ম পেরিয়ে গেছে। আচ্ছা, ওর কি আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছেটা একেবারেই মরে গেছে? ওর কি সারা দিন সারা রাতে আমার কথা একবারও মনে হয় না?
ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে না পারার মতো বিশ্রী আর বোধহয় কিছু হয় না। মাথা পুরোদমে ঝিম ঝিম করছে এখন। চাইলেই নেটফ্লিক্সে কোনো একটা সিরিয়াল বা সিনেমা দেখা যায়, সেখানে এত হাজার হাজার সিনেমা সিরিয়ালের কালেকশন জমে আছে। কিন্তু আমার এখন তাও দেখতে ভালো লাগছে না, নিজের ভেতর প্রচণ্ড আলসেমি বোধ করছি।
আসলে আমার ভালো লাগছে না কিছুই। এই মুহূর্তে আমার মাথাজুড়ে কেবল এলোমেলো হাজারটা স্মৃতি- অদিতির, আমার, আমাদের। আমি সেই স্মৃতির ঝুলি হাতড়ে লুকানো মণিমুক্তা খুঁজে বেড়াই। এই সংসারে অদিতির চাওয়াগুলো কী সামান্য ছিল! ওর কাছে আমার প্রত্যাশাগুলোও কত ছোট ছিল! কিন্তু তারপরও কী করে যেন দিনের পর দিন একটু একটু করে সরতে সরতে দুজনে এত দূরে চলে গেছি যে আজকাল সে দূরত্ব পরিমাপ করা যায় না। আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে এখন তারাদের মতো আলোকবর্ষের দূরত্ব।
আচ্ছা, এখন শুক্লপক্ষ না কৃষ্ণপক্ষ? আমাদের গ্রামে শুক্লপক্ষকে ‘জোছনা’ আর কৃষ্ণপক্ষকে ‘আন্ধার’ বলতো লোকে, এখনো বলে নিশ্চয়ই। অদিতি গ্রামে গিয়ে শিখে এসেছিল এই শব্দগুলো। শুক্লপক্ষের রাত ওর প্রিয়তম সময়। অনেক জোৎস্নারাতে এই বাসার ছাদে শরীর ডুবিয়ে স্নান করেছি দুজনে, অদিতির জন্যই। আমার চুল, কপালে হাত বোলাতে বোলাতে ও আমাকে স্টারি নাইটের গল্প বলত। আমি পেইন্টিং বুঝি না একেবারেই, আগ্রহও পাই না তবু অদিতির কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম- কী সুন্দর করে কথা বলত ও! অনলাইনে কোন একটা পেইজ সেবার স্টারি নাইট শাড়ি এনেছে, কেনার সিরিয়াল পায়নি বলে ওর কী মন খারাপ ছিল অনেকদিন!আচ্ছা, অদিতি কি পরে কিনতে পেরেছিল শাড়িটা? আমার মনে পড়ে অদিতির ছোটখাট অনেক কথার পাশাপাশি এ প্রশ্নের উত্তরটাও আমার অজানা।
তমাল, আজকাল তুমি আমার খবর রাখো কোনো? এবারের পূজায় একটা শাড়ি কিনেছি কি না জানতে চেয়েছ কোনোদিন?
অদিতির অভিমানী কণ্ঠ এ ঘরের বাতাসে ভাসে। ওর শাড়ি জামার খবর আমি সত্যিই রাখতে চাইতাম না। বরং আলমারি ভরা শাড়ি থাকার পরও অদিতি যখন বলত- তমাল, দ্যাখো না পহেলা ফাল্গুনের জন্য এই শাড়িটা অর্ডার করেছি; বিরক্তির সীমা থাকত না আমার। অথচ মা কেমন সহজে বলত চাকরি করা মেয়েদের অমন বেশি বেশি শাড়ি লাগেই রে বাবা, রোজ রোজ অফিস করতে হয়, আর তাছাড়া আরও কত রকম প্রোগ্রাম থাকে ওদের!
শুধু শাড়ি জামা জুতাই নয়, মাসের পর মাস আমি অদিতির মনের খবর রেখেছি? শরীরের? রাতের পর রাত যখন ঊর্বী ঘুমিয়ে গেলে ও এসে আমার কপালে চুমু দিয়েছে, আমি কী অবহেলায় ওকে সরিয়ে দিয়ে বলেছি- এখন না, অদিতি, ঠান্ডা লেগেছে আমার, কাল সকালে।
যাবার আগে একদিন তুমুল ফুঁসে উঠে ও আমাকে প্রশ্ন করেছিল- এই জন্যই কি সেই সকালগুলো কোনোদিন আসেনি আমাদের ঘরে?
আমি সেই প্রশ্নে ছিন্নভিন্ন হয়েও নীরব থেকেছি। অদিতিকে আমি কোনোদিনই বোঝাতে পারব না নীরার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই ক’মাস আমি কী অমানুষিক চেষ্টাই না করেছি। প্রথম প্রথম ওর ছাব্বিশ বছরের শরীরটা নিজের করে পাওয়ার আনন্দে বিভোর ছিলাম কিন্তু তারপর সেই আনন্দই আমার সারা শরীরে হাজার বিছার হুল ফুটিয়েছে। যত দিন গেছে আমি এতসব অসম্ভব উপায়ে নীরাকে ছেড়ে আসতে চেয়েছি যে বলার মতো না! আসলে অসম্ভবও নয়, ভেবেছিলাম ওর পরিবারে জানালে নিশ্চয়ই নীরা এই সম্পর্কটা নিজেই ভেঙ্গে দেবে। কিন্তু কীসের কী! আচ্ছা, নীরা কি আমার জন্য পাগল ছিল? তাই বা কেন- প্রথমবার ওর সাথে সম্পর্ক ভাঙ্গার দিন থেকেই তো সে আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল। তবে?
অদিতি আমার এসব কথা শুনে কেমন অবিশ্বাসের হাসি হেসেছিল একদিন- এতই যদি চাইতে তাহলে তো তুমি নিজেই সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিতে পারতে, তমাল। ওর বাড়ির লোকদের বলতে গেলে কেন?
ওকে আমি বোঝাতে পারিনি আমার ভয়ের কথা- অদিতিকেই হারিয়ে ফেলার ভয় ছিল আমার সবচেয়ে বেশি। বিয়ের আগে নীরার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর অপরাধ ক্ষমা করে সে বিয়েতে রাজি হয়েছিল, এবার এই অপরাধ আর ক্ষমা করতে পারত না সে। ওর অভিমান আমি চিনি, নিজের এত বড় অপমান সে মানতে পারত না কিছুতেই।আর তাছাড়া একটা মানুষকে এক কারণে আর কতবার ক্ষমা করা যায়?
নীরার সঙ্গে সেই প্রথম কয়েকবার ছাড়া কোনো শরীরী সম্পর্ক আমি উপভোগ করতে পারিনি। আমাদের মৈথুনের ক্লান্তি আর ক্লেদ মেখে ওকে কতবার বলেছি- আমি আর এই সম্পর্ক মানতে পারছি না, নীরা। তুমি প্লিজ তোমার প্রেমিকের কাছে ফেরো।
নিষ্ঠুর হেসে নীরা প্রতিবার বলেছে-
তোমার বউয়ের নম্বরটা আমার কাছে আছে। আর তোমাদের দুজনের চৌদ্দগুষ্টির ফেসবুক আমি নিয়মিত চেক করি!
তারপর তোয়ালে তুলে নিয়ে আমার দিকে না তাকিয়ে বাথরুমে হেঁটে চলে গেছে নীরা। ও জানত এ পৃথিবীতে আমি কেবল অদিতিকেই হারাবার ভয় পাই। আর অদিতির কাছে আমাদের পরিচয়ের এগারো বছর পরে এসে ওর কাছে এই প্রতারণার খবরটা পৌঁছে দেয়াই যথেষ্ট। নীরার কথায় আমি শামুকের মতো আরো গুটিয়ে গিয়েছি বারেবারে। যে জাল নিজের হাতে বুনেছিলাম কেবল অদিতির সঙ্গে একত্রবাসের বিরক্তি থেকে, দিনে দিনে আমি মাকড়সার মতো তার গভীর থেকে গভীরে পৌঁছে যাচ্ছিলাম। সে সময় প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছি প্রেম আর সংসার এক জিনিস নয়, দিনের পর দিন একত্রবাসে ক্লান্তি আসতেই পারে, রোজকার চাল, তেল, নুনের হিসাব দুজন মানুষের মন বিষিয়ে দিতেই পারে কিন্তু তার কারণে এমন দূরে সরে যাওয়ার অর্থ কেবল পদ্মবিলের পাকের আরও গভীরে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
অদিতিকে আমি বলেছিলাম- যেও না, অদিতি। নীরা ঠিক এটাই চেয়েছিল যে আমরা দুজন আলাদা হয়ে যাই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অদিতি বলেছিল- ভাগ্যিস মেয়েটাই আমাকে কলটা করেছিল, নাহলে তোমাকে কোনোদিন চিনতে পারতাম না আমি।
ওরা চলে যাওয়ার সময় মা ঊর্বীকে বুকে নিয়ে শক্ত হয়ে বসে ছিল। এই বয়সে এসে ঊর্বীর চেয়ে প্রিয় মার কাছে আর ছিল না কিছুই। অদিতি কেমন রুক্ষ গলায় মাকে বলেছিল-
ওকে আমার কাছে দিয়ে দিন মা। আপনার যদি ওকে দেখতে ইচ্ছে করে, আমাকে কল করলেই হবে। আমি ওকে দিয়ে যাবো অথবা আপনাকে নিতে আসব।
মা কিছু বলেনি তখন, শুধু দুই চোখ গড়িয়ে জলের ধারা নেমেছিল। ঊর্বী মার সাথে বেড়াতে যাচ্ছে ভেবে বেশ আনন্দেই চলে গিয়েছিল সেদিন, অবশ্য বাবা সঙ্গে গেল না বলে একটু অবাকও হয়েছিল বোধহয়। এই এক মাস তিন দিনে মা কি ওকে কল করেছিল একবারও? দেখতে গিয়েছিল ওদের? ঊর্বী কি এ বাড়িতে এসেছিল একবারের জন্য? জানি না, মা আজকাল ওদের নিয়ে কোনো কথা বলে না আমার সঙ্গে। ওরা কোথায় আছে আমি তা জানি না পর্যন্ত, অদিতি ওর নতুন বাসার ঠিকানা দিয়ে যায়নি আমাদের।
সিগারেটের তৃষ্ণাটা বাড়ছে একটু একটু করে। এই বিশ্রী নেশাটা গত বছর শুরু হয়েছে, নীরার সঙ্গে সম্পর্কটা নতুন করে শুরু হবার পর। সিগারেট ছাড়লে নাকি টেনশান কমে, রওনক বলেছিল। অদিতি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল- এই বয়সে এসে তোমার কীসব জঘন্য অভ্যাস হচ্ছে, তমাল? গাাঁজা, হেরোইনও চলছে নাকি আজকাল?
ততদিনে বেশ কয়েকবার গাঁজা খেয়েছিলাম রওনকের সঙ্গে। অদিতিকে বলতে পারিনি সেকথা। এইসব গাঁজাটাজা ওর রুচিতে বাঁধে। তবে কয়েকদিন অবাক হবার পরে ও আমার সিগারেট খাওয়া নিয়ে আর বলেওনি কিছু। আসলে আমরা ততদিনে একে অপরের বিষয়ে কথাবার্তা বলা ছেড়েই দিয়েছি প্রায়।
প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট আর লাইটার বের করে আমি স্লাইডিং ডোরটা খুলে বারান্দায় যাই। কী ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ! তাহলে এখন ‘জোছনা’। বিয়ের পর পর এমন জোৎস্না দেখলে অদিতি বলত- এমন জোছনার রাতে তোমাকে বুকের পাঁজরের সাথে মিশিয়ে নিতে ইচ্ছে করে, তমাল! মুখের সামনে ধোঁয়ার রিং ওড়াতে ওড়াতে আমার এখন হঠাৎ অদিতির বুকের পাঁজরের সঙ্গে একেবারে মিশে যেতে ইচ্ছে করে।
দূরের কোনো মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসছে, তার মানে এখন ভোর। একটু পরেই আমাদের পাড়ার মসজিদ থেকেও ভেসে আসবে একই সুর। হালকা হিম বাতাসের ভোরে অপার্থিব জোৎস্না আর আজানের ধ্বনি মিলেমিশে কেমন অদ্ভুত আবহ সৃষ্টি করেছে। আমি আচমকাই এক অসীম শূন্যতা অনুভব করি অদিতির জন্য, এমন সময়ে ও যদি আমার পাশে থাকত! এই ফুটফুটে শুক্লপক্ষের ভোরে আমার জীবন জুড়ে কী নিঃসীম অন্ধকার! যেন এই আদিগন্ত বিস্তৃত আলো আর আমার মাঝখানে এক অনিঃশেষ অন্ধকারের নিরেট দেয়াল, সে দেয়াল পার করে আমি অদিতি নামের আলোকবৃত্তে হাত ছোঁয়াতে পারি না।সিগারেট শেষ করে বারান্দার এক কোণায় রাখা অ্যাশট্রেতে ফিল্টারটা গুঁজে দিই। জোৎস্নায় ভেসে যাওয়া চরাচরের দশ দিকে ওকে খুঁজতে খুঁজতে নিজস্ব অতল অন্ধকারের ভেতর থেকে আমি ফিসফিসিয়ে ডাকি- ফিরে এসো, অদিতি, ফিরে এসো প্লিজ।
গল্পকার