| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২০

পাটনী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comশেষ ফাল্গুনের বেলা ঈষৎ কাত হতে শুরু করলেই ফের একবার নৌকোয় উঠে এলো ফুল্লরা। বাপ বিভু মন্ডল মারা যাওয়ার পর থেকে এই নৌকোই তার ঘর। নৌকোই তার সংসার। অবশ্য রাতকালে শোওয়ার জন্য একখানা ঘর, আর দু’বেলা খাওয়ার জন্য সত্যিকার একখানা সংসার তার আছে।আর আছে তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা কতগুলো মানুষ। ওই মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ফুল্লরারও বেঁচে থাকা।
মারা যাওয়ার সময় বাপ বলে গিয়েছিল, “তুই এগের দেহিস মা।”

তা দেখে শুনেই রাখছে সে। সংসারে সে ছাড়া আরও পাঁচজন মানুষ। ভাই, ভাই বৌ, আর তাদের তিন তিনটে মেয়ে। মেয়েরা সব স্কুলে যায়। তার একটা খরচ। আবার এতগুলো পেট চালানো। ভাইটা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে কতগুলো বছর হয়ে গেল। না আছে খেটে খাওয়ার উপায়, আর না আছে খানিক চাষের জমি। অগত্যা এই খেয়াই অবলম্বন।
দিনটা বলতে গেলে এই খেয়া পারাপারেই কেটে যায় ফুল্লরার। আর রাতেরও অনেকখানি সময়। সেই যখন শেষ রাতের প্রথম মোরগের ডাক শোনা যায়, তখনই উঠে পড়ে ফুল্লরা। হাত মুখ ধুয়ে আগের রাতের রেখে দেওয়া আধবাটি চুনো মাছের ছালুন আর চাট্টি পান্তা কোনও মতে নাকে মুখে খেয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। ছোট নৌকো। নৌকো জোড়া বাঁশের মাচাল দেওয়া পাটাতন। একপাশে আরও ছোট একখানি ছই।ছইয়ের নিচে সারাক্ষনের সঙ্গী রেডিও, পানবাটা, একটা চটের বস্তা,আর গোটা দুই জলের বোতল। যখন একলাটি থাকে…ওই ছইয়ের নিচে বসে রেডিও টা চালিয়ে দেয়। ভাটিয়ালি, পল্লীগীতির সুর নোনা হাওয়ার পিঠে চড়ে ছড়িয়ে পড়ে দূরান্তে। দিগন্তে তখন হয়তো ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক সাদা বক, কিংবা অন্য কোনও পাখি। সেদিকে তাকিয়ে ফুল্লরার মনে হয়– ‘ইস, ওগের মতন আমিও যদি উড়্যে যাতি পারতাম।’
সে না পারলেও তার মনটা ঠিক পারে। নোনা হাওয়ার পিঠে চড়ে মনটাও উড়ে যায় সেই বক কিংবা পাখিদের পিছু পিছু। এমনই এক ভাটির দেশ।তবে অন্য গাঁ। অন্য এক নদী। যে নদীতে স্বামীর সাথে ছোট একখানি ডিঙি নৌকো আর টানা জাল নিয়ে মাছ ধরতে যেত সে। দিনভর কোমর জলে দাঁড়িয়ে মাছ ধরতো। রাতের বেলায় স্বামীর বুকে মাথা গুঁজে স্বপ্ন দেখতো। আরও একটু ভালো ভাবে দিনযাপনের স্বপ্ন।আরও একটু সুখে বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
স্বামী অভয় মিদ্দে ছিল মদ্দ জোয়ান। মাত্রই মাস কয়েকের সংসার। তবু বড়ো ভালোবেসে ফেলেছিল মানুষটাকে। নদীবাঁধে ছোট্ট একখানি সংসার ছিল তাদের। নদীর ঢেউয়ের কুলু কুলু শব্দ আর নোনাজলের ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে ঘুমোতো রাতে।তার আগে অনেকটা সময় আগামীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতো দুজন।
অভয় বলতো,” আর কডা দিন যাক। তারপর ঘরের চালায় তেরপল নামায়ে টিন দেবো। সামনে–পিছে বারান্দা।বারান্দার পাশে …”
ফুল্লরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতো,” তার আগে আমাগের এট্টা সন্তানের বড়ো দরকার গো “।
অভয় সান্তনা দিত,” হবে গো,হবে।এই তো সবে বে হল।আর কডা দিন যাক।”
আসলে অভয়ের তখন দু’চোখ জোড়া সমুদ্দুরের স্বপ্ন। রাশি রাশি জল। বড়ো বড়ো ঢেউ।বড়ো একখানি নৌকোয় অনেকগুলো মানুষ একসাথে মাছ ধরা।বৌকে বলতো অভয়,” একদিন ঠিক সমুদ্দুরি মাছ ধরতি যাবো আমি।আর অনেক অনেক মাছ নে ফেরবো। যত মাছ তত ট্যাকা।নদীবাঁদ থে সরে গে গাঁয়ের ভেতর নতুন এট্টা বাড়ি বানাবো। নতুন একখান ঘর। ঘরের সামনে ফালি উঠোন। উঠোনের পাশে তুলসি গাছ।আর…”
স্বপ্ন দেখতে গিয়ে কোথায় যেন ভেসে যেত ফুল্লরা।তার চোখ জুড়েও তখন সমুদ্রের নোনা ঢেউ।নাকে ইলিশের গায়ের আঁশটে গন্ধ।বুকের ভেতর কিসের একটা উথাল পাথাল।
না,সে স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি ফুল্লরার। একদিন খাঁড়িতে মাছ ধরার সময় আচমকাই বাঘে টেনে নিয়ে গেল অভয়কে।অনেকখানি পথ ছুটেও আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি তাকে। যে নোনাজল তাকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল সেই নোনাজলই একদিন ভাসিয়ে নিয়ে গেল তার সব স্বপ্ন। সেই সাথে বোধ করি জীবনের সুখটুকুও।
তারপরই ফের একবার বাপের সংসারে এসে ওঠা।
বাপ বিভু মন্ডল বলেছিল, “কেন্দে কোনও লাভ নাইরে মা। এ হল ভাটির দ্যাশ। যহন ভাটির টান শুরু হয়, সব কিছু টেন্যে নে যায়।”
তবু কেঁদেছিল ফুল্লরা।মাটির দাওয়ায় আছাড়ি পাছাড়ি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “আমি ইবার কারে নে থাকপো বাবা?”
বাপ বলেছিল, “এইযে আমরা আছি।আমাগের নে থাকপি।”
বাপ বিভু মন্ডল ছিল খেয়াঘাটের মাঝি। ছোট্ট নৌকোটা নিয়ে লোক পারাপার করতো দিনভর। ওই ছিল তার উপার্জনের রাস্তা। দশ বিশটা গাঁয়ের মানুষের নদী পারাপারের তখন এই একটাই পথ। দুইপারে দুই বাঁশের খুঁটি পুঁতে তাতে বেঁধে রাখা মস্ত কাছি।কাছি টেনেই এপার-ওপার হওয়া। ততদিনে বাপের বয়সটাও বেড়েছে। শরীরে জোয়ান বয়সের সে বাঁধুনিও আর নেই। দিন-রাত্তির এপার-ওপার করায় একটা স্থায়ী ক্লান্তি এসে ততদিনে বাসা বেঁধে ফেলেছে শরীরে।একমাত্র ছেলে,সেও হার্টের রুগি।অগত্যা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,” তুই পারবিনে মা?”
সম্মতি জানিয়ে মাথা নেড়েছিল ফুল্লরা।
বাপ বলেছিল,” একার হাতে কাছি টানতি বড়ো কষ্ট হয়রে মা। তুই সাথে থাকলি আমার বড়ো সুবিধে হয়। “
বাপের সাথে সাথে সেই যে নৌকোয় এসে ওঠা ফুল্লরার, আজ এতখানি বয়স হয়ে গেল সেই নৌকোকে আর ছাড়তে পারলো না সে। দু’দন্ড ছেড়ে থাকলেই মনটা কেমন করে।ভেতরটা উদাস হয়ে যায়। দুইচোখে কেবলই ঝাঁপটা মারে নোনাজলের ঢেউ।এজন্যে নৌকো ছাড়া হয়ইনা বলতে গেলে।কেবল যখন ভরদুপুরের রোদে পারাপার হওয়ার যাত্রী সংখ্যা থাকেইনা বলতে গেলে,তখন স্নান-খাওয়ার জন্য ঘন্টা দেড়েক সময় নিয়ে বাড়ি আসা হয় তার। আর সেই রাতের শেষ যাত্রী পার হওয়ার পর ঘুমোনোর সময়। তাও এক একদিন ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে আসে শরীরটা। সেদিন খেয়াঘাটের খুঁটির সাথে নৌকোটাকে শক্ত করে বেঁধে একাই বসে থাকে চুপচাপ। নোনা হাওয়ার ঝাঁপটা আছড়ে পড়ে চোখে মুখে।আকাশের দিকে তাকিয়ে তারাদের জ্বলা-নেভা দ্যাখে কখনওবা। কখনও আবার অন্ধকারে বয়ে চলা নদীর দিকে চেয়ে কেবল দেখেই চলে আঁধার গোলা জল। নদীর ঢেউয়ে মৃদু দোল খায় নৌকো।সেই সাথে দুলে ওঠে ফুল্লরার ভেতরটা।কি যেন একটা ভাবতে ইচ্ছে হয় তার। জীবনের হিসেবটা তখন বড়ো জটিল মনে হয়। কত সব অঙ্ক।কিন্তু একটাও মেলাতে পারে না সে। অগত্যা রাত্রি বাড়ে।ক্লান্ত চোখ জুড়ে ঘুম নামে কখন। ঘুমিয়েই পড়ে ফুল্লরা। নোনাজলের গা ছুঁয়ে বয়ে আসা বাতাস শান্তির পরশ বোলায়।বেশি রাত হয়ে গেলে কেরোসিনের আলো হাতে ঘাটে এসে দাঁড়ায় ভাই বৌ বেলা।ডাক ছাড়ে,” দিদি ঘুমায়ে পড়লা নেকি?”
পাটাতনে এলিয়ে দেওয়া শরীরটা সোজা করে উঠে বসে ফুল্লরা,” আজ বড়ো খাটনি হইয়ে গেল কিনা।দুই চোখ কহন যে ঘুমে জড়ায়ে আইছে টের পাই নাই। দ্যাহো দেহি কান্ড।তোমারে আবার খালি খালি কষ্ট দিলাম।”
নদীতীরের ঘন অন্ধকারের মাঝেও কেরোসিনের কেঁপে ওঠা আলোয় আবছা দেখা যায় বেলার মুখখানা।সে বলে,” তুমি এটুক না করলি আমাগের সোংসারডা যে ভেস্যে যাতো দিদি।তুমিই তো আমাগের…”
কথা শেষ করতে না দিয়ে মাঝপথেই বেলাকে থামিয়ে দেয় ফুল্লরা।বলে,” ওকথা থাক।আগে বলো আজ কি রান্না হইছে? বড়ো খিদে পাইছে।”
সেদিন বেলা যা রেঁধেছে বলতে না বলতেই পেটের ভেতরে সত্যি সত্যিই চাগাড় দিয়ে ওঠে খিদেটা।মাথাটা ঘুরতে থাকে। নোনা হাওয়ার ঝাঁপটায় বুঝি জ্বলে ওঠে চোখ দুটো।কোমরে জড়ানো গামছাটা খুলে নিয়ে ভালো করে একবার মুছে নেয় মুখ-হাত।তারপর ছইয়ের নিচ থেকে রেডিওটা আর জলের বোতল হাতে নিয়ে নৌকো থেকে নেমে আসে ফুল্লরা।বেলার হাতে ধরা আলোয় পথ দেখে হাঁটে।
সেদিন রাতে আর তাড়াতাড়ি ঘুম আসতে চায় না ফুল্লরার। হাজারো টুকরো অতীত মাথার ভেতরে ঘুরপাক খায়।চোখের সামনে ভেসে ওঠে হারিয়ে যাওয়া সব দৃশ্য।নতুন করে ফের একবার ভেবে দেখার বড়ো ইচ্ছে হয়। নতুন বর। নতুন ঘর। আর নতুন একটা সংসার। কিন্তু বেশিক্ষন ভাবতে পারে না। তার ওপর নির্ভর করে থাকা এই মানুষগুলোর করুন মুখগুলো ভেসে ওঠে। তার নিজের জীবনে সুখ আনতে গিয়ে এতগুলো জীবনকে ভাটির টানে ভাসিয়ে দেওয়ার মত স্বার্থপর সে হতে পারে না।
ভাই বৌ বেলার মুখটাই বড়ো বেশি করে ভেসে ওঠে তখন।তাকে নিজে দেখে এ সংসারে এনেছিল ফুল্লরা।বলেছিল,” আমার তো সারাদিন নৌকোতেই কাটে, ঘর-সোংসার তুমিই কিন্তুক দেখ্যে রাখপা।”
আর পাঁচটা মেয়েও যেমন দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর ঘরে আসে,তেমনি এসেছিল বেলা। কিন্তু সেই স্বপ্ন এতটুকুও হয়তো পূরণ হয়নি তার। অসুস্থ স্বামী কাজ তো বলতে গেলে করতেই পারে না। দিন-রাত একপ্রকার শুয়ে বসেই কাটে তার। অগত্যা সংসারের হাল ধরতে বেলাকেও এগিয়ে আসতে হয়।আর তাই একদিন নিজে থেকেই বলেছিল,” কাছি টানতি তোমার বড়ো কষ্ট হয় দিদি।আমিও যদি তোমার সাথে যাই…”
বারণ করেছিল ফুল্লরা,” যদ্দিন পারছি একাই করি।লাগলি তোমারে ডেক্যেই নেবো। তুমি বরং সোংসারডা দেখ্যে রাখো।”
তবু বেলা কাজ করে।বাড়ির সামনের ফালি জায়গাটুকুতে নানারকমের সব্জি ফলায় বছরভর।খাওয়ারটা বাদ দিয়ে বিক্রিও করতে পারে কিছু।আবার নদীতে জাল টেনে মাছ ধরে আনে। উঠোন ঝাঁটায়।ঘর-দোর পরিস্কার রাখে।মাটির দাওয়ায় গোবরজলের লেপা দেয়। তুলসিতলায় প্রদীপ জ্বালে।হাঁস মুরগি পোষে।আবার রান্নাবান্না। এত কিছু একার হাতে করেও কোনও ক্ষোভ নেই তার।নিজের ভাগ্যটাকে মেনে নিয়েছে কেমন।ওকে দেখেও মনে অনেক জোর পায় ফুল্লরা। কিংবা ফুল্লরাকে দেখেও হয়তো বেলা।
নিজের জন্যে খুব বেশি কিছু তাই ভাবতে পারে না ফুল্লরা। তবু যখন একলাটি থাকে, হাজারো ভাবনার ভীড় এসে ঘিরে ধরতে চায়।ভেতরে এক মস্ত সাগর ঢেউ ভাঙে।রাতেরবেলায় হলে দোর খুলে এসে বাইরে দাঁড়ায়। আকাশ দ্যাখে। তারাদের জ্বলা-নেভা দ্যাখে।আঁধার মাখা ঝোপ ঝাড় দ্যাখে। আর দিন হলে নদী দ্যাখে। নদীর জলে ঢেউ দ্যাখে।ঢেউয়ের মাথায় আকাশের ছবি দ্যাখে।
এখনও তেমনই নদী দেখছে ফুল্লরা। শেষ ফাল্গুনের দুপুর গড়িয়ে সবে বিকেল নামার আয়োজন করছে।ফাঁকা খেয়াঘাট। খুঁটোয় বাঁধা ছোট নৌকো। নৌকোয় তারও চেয়ে ছোট ছই। ছইয়ের নিচে একা বসা ফুল্লরা। বাড়ি থেকে চান খাওয়া সেরে সবে ফিরলো।পানবাটা থেকে সাজিয়ে নিয়ে একটা পান মুখে পুরে দিয়ে রেডিওটা চালিয়ে দিল। মন কেমন করা এক গানের সুর নদীর ঢেউয়ের মাথায় জড়াজড়ি করে ছড়িয়ে পড়লো বহুদূর। তাকে আরও দূরে নিয়ে চললো নোনাবাতাস। একবার আকাশের দিকে তাকালো ফুল্লরা।কোথাও একফালি মেঘ নেই।দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ। বাপকেও মাঝেমধ্যে এভাবেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখতো। একমনে কি সব যেন ভেবে চলতো মানুষটা। বড়ো জানতে ইচ্ছে করতো ফুল্লরার।কিন্তু জানতে চায়নি কোনওদিন। কী খুঁজতো বাপ? মায়ের মুখখানাই কী?
প্রশ্নটা আজও জাগে।কিন্তু বাপ নেই। অনেকগুলো বছর হয়ে গেল মারা গেছে মানুষটা।যাওয়ার সময় সংসারের হাল টা দিয়ে গেছে ফুল্লরার ওপর।আর সেই হাল টানতে টানতে তার জীবনের দুপুরটা কবেই গড়িয়ে গিয়ে বিকেল নেমেছে। সর্বাঙ্গে এখন তার দিন শেষের ইশারা। পঞ্চান্ন পেরিয়ে গেল গত বৈশাখে। শরীরের বাঁধুনি এখন অনেকটাই আলগা।সেই সঙ্গে মনের বাঁধনও।
আকাশ দেখতে দেখতে হঠাৎই একজনার কথা মনে পড়ে গেল ফুল্লরার। একবারই মাত্র উঠেছিল তার নৌকোয়।তখনও এমনই দুপুর গড়িয়ে সবে বিকেল নামতে শুরু করেছে। নোনা হাওয়ার গায়ে কিসব বাসন্তী ফুলের ঘ্রাণ। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় রোদের নাচানাচি। রেডিওয় মন কেমন করা ভাটিয়ালী গান।একমনে গান শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল ফুল্লরা।চমক ভেঙেছিল লোকটার কথায়।
“এমন মন কেমন করা গান কেন শোনো?”
এভাবে কেউ কোনওদিন প্রশ্ন করেনি ফুল্লরাকে।কেউ জানতে চায়নি তার কষ্টের কথা।
সে বলেছিল,” কি আর করবো দাদা, এই গানই আমার একমাত্তর সঙ্গী। তাই শুনি।”
“তা বলে এমন গান? এ গান যে কেবল কষ্টকেই বাড়ায়।”
“এক এক সমায় বেড়্যে যাওয়া কষ্টের মধ্যিও এট্টা সুখ পাওয়া যায়। সেই সুখডার জন্যিই… “
সারা খেয়াঘাট জুড়ে একরাশ দুপুরের নির্জনতা।কোথাও এতটুকু কোলাহল নেই। মানুষের আসা-যাওয়া নেই। কেবল নৌকোর গায়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের কুলুকুলু শব্দ।কথায় কথায় জীবনের অনেক কথাই বলে ফেলেছিল মানুষটাকে।সব শুনে লোকটা বলেছিল,” তুমি যাবা আমার সাথে?”
“আমি?কোথা?”
“আমি তোমার চেয়েও বড়ো একলা মানুষ গো।ঘর আছে,ঘরণী নাই। মন আছে,মনের মানুষ নাই। বাড়িটা বড্ড অগোছালো পড়ে থাকে।তুমি গেলে…”
লোকটা নতুন করে বাঁচার কথা বলেছিল।নতুন স্বপ্ন দেখার কথা বলেছিল। বলেছিল নতুন করে ভাবতে।সঙ্গে করে নিয়েই যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যায়নি ফুল্লরা। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল নিজেদের বাড়ি, উঠোন, তুলসিগাছ,গোয়াল,আর অসহায় মুখগুলো।যে মুখে দু বেলা দু মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য তার এই অমানুষিক পরিশ্রম।
লোকটার কথা মনে পড়তেই হাঁজা ধরা নিজের হাত দুটোর দিকে একবার তাকালো ফুল্লরা।দুইপাড় সংযোগকারী কাছি টেনে টেনে নিত্য জল-কাদায় হাঁজা ধরে গেছে কবেই।ভাই বৌ বেলা বলেছিল মলম লাগানোর কথা।ফুল্লরা বলেছিল,” মলম যে লাগাবো তার সমায় কোথা?জল লাগার তো বিরাম নাই।”
বেলা বলেছিল,” রাতকালে শোবার সমায়…”
সেই থেকে রাতের বেলা খানিক মলম লাগায় বটে,কিন্তু সারাদিন কাছি টেনে টেনে দিনান্তে যে কে সেই।
কেউ কেউ বলে,” কেন করো এত কষ্ট?”
ফুল্লরা বলে,” না করে উপায় কি?আমার ওপর যে অনেক দায়িত্ব গো।”
” কিন্তু…”
” আমি যদি কষ্ট না করি অতগুলো মানষের মুখি ভাত ওঠপে না। ভাইডার চিকিচ্ছে হবে না।ভাইঝিগের পড়া হবে না।সোংসারডা এক্কেবারে ভেস্যে যাবে।”
“তা বলে নিজের কথা ভাববে না?”
“এ জম্মে তা আর হলনা গো। পরে যদি আবার জম্ম নিই…”
ভাবনাটা শেষ করতে পারে না। নৌকোর মাথায় এসে বসলো দুটো পানকৌড়ি। নিত্যদিন পাশাপাশি থাকতে থাকতে ওদের বড়ো সখ্য হয়ে গেছে ফুল্লরার সঙ্গে। ভয় তো পায়ইনা, বরং সাহস করেই বসে ওরা।অবশ্য ফুল্লরা যখন একাই থাকে নৌকোয়।অলস দুপুরের নির্জনতা যখন ছড়িয়ে পড়ে নদীর বুকে।ফাঁকা হয়ে আসে খেয়াঘাট। আরও কয়েকটা পাখিও তখন আসে। ওদের সাথে দু’চাট্টি কথাও হয় ফুল্লরার। নিজেদের ভাষায় উত্তরও ওরা দেয় হয়তো বা।
ওদের দিকে তাকিয়ে ফুল্লরা বলল,” আমারে দুইখান ডানা দিবি?”
কি বুঝলো ওরা কে জানে। একজনা ঝাপটে উঠলো তার ডানা দু খান।
ফুল্লরা হাসলো। বলল,” তোরাই আমার বন্ধু রে।আর এই নৌকো, নদী, নদীর জল, নোনা হাওয়া। তোগের বড্ড ভালোবাসি। জানি তোরাও…”
একজন দুজন করে আসতে শুরু করেছে ফের।দুপুরের রোদ নিঃস্তেজ হতে শুরু করেছে ক্রমশ।দক্ষিনের হাওয়ায় বেশ একটা মিষ্টি গন্ধ। একটু একটু করে পাল্টাতে শুরু করেছে আকাশের রং। নিত্যদিন পারাপার করতে করতে বেশিরভাগ মুখগুলোই বড়ো বেশি করে চেনা তার। ওইতো কাঁধে জামা, হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে আসছে সনাতন দাস। পেছনে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে সেবাদাসী হালদার। আসবে গোবিন্দ যাদব।ভারতী মন্ডল। ধনঞ্জয় সরখেল।নিমাই রায়।কুতুব আলী। মিনতী হাজরা।তারপরে আরও কতজন। সকলেই বড়ো ভালোবাসে ফুল্লরাকে।এই ভালোবাসার টানেইতো…

ঘাটে ভীড় জমতে শুরু করতেই পাশের গামছাখানা বেশ করে কোমরে জড়িয়ে নিয়ে ফের উঠে দাঁড়ালো ফুল্লরা। লোক উঠছে নৌকোয়। ওপারের ঘাটেও ছোটখাটো ভীড়।সকলেরই তাড়া। ওদের তাড়ায় ফুল্লরার তাড়া। সেই তাড়ায় শক্ত হাতে কাছি টেনে এগোয় ফুল্লরা। নৌকো এগোয়।সময় এগোয়।কেবল একা ফুল্লরার জীবনটাই থেমে থাকে সেই বহু বছর আগেকার দিনগুলোয়। ইচ্ছে হলেও এতটুকু এগোনো হয় না তার।কেবল নিত্যদিন কাজের শেষে সন্ধেবেলার অন্ধকারটা গাঢ় হয়ে যখন রাত্রি নামে,আকাশের চাঁদ নিজেকে ঢেলে দেয় নদীর জলে, নোনাহাওয়ার পিঠে সাঁতরে বেড়ায় অতীতেরা, নির্জন খেয়াঘাটে একা একা নৌকোর পাটাতনে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশটাকে দেখতে দেখতে কেবল তার মনে হয় খুঁটো থেকে দড়িটাকে খুলে দিয়ে স্রোতের টানে নৌকোটাকে নিয়ে ভেসে যায় সেই কোন দূরে এক অজানার উদ্দেশ্যে যাতে কেউ খুঁজেও পায় না আর।।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত