Categories
স্বপ্ন কথন
আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট
অফিসে ফেইসবুক ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে, তবুও একটু পর পরই ফেইসবুক খুলছে সে কি এক নেশায়৷ অথচ এমনটা হবার নয়৷জীবনে বহু রকমের বহু নারী সে দেখেছে। এই বয়েস পর্যন্ত মেয়ে তো আর কম দেখা হলোনা! অথচ ক’দিন থেকেই এমন চলছে। এই নতুন ফেবু এ্যাকাউন্টটা খোলার পর থেকেই। আগের প্রফাইল ডিজেবল হয়ে গেলো হঠাৎই, এর পরেপরে নতুন করে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্তথাকার জন্য ফের আরেকটা আইডি দরকার পড়লো প্রিয়মের৷ পিপল ইউ মে নো ‘ ফেইসবুক সাজেশনে আসা একটা আইডি দেখে দেখে যেনো আশ মেটেনা প্রিয়মের৷
মাত্রই আটজন কমন ফ্রেন্ড তার সাথে সেই নারীর। এমন কিছু আহামরি সুন্দরীও সে নয়, তবুও কী যেনো কি একটা আছে। ডিপিতে একটা বিষন্ন মুখ! কপাল থেকে মুখের একটা পাশ বেয়ে নেমে আসা চুলের ঢাল! কেন যেন চেনা লাগে, মেয়েটা যেন বড় আপন! যদিও বারবার প্রফাইল দেখেও কিছুই জানা গেলনা, প্রাইভেসি সেটিং দেয়া তার প্রফাইলে। কেবল কয়েকটা ছবি আছে প্রফাইলে মেয়েটার৷ সে কে কী করে কোথায় থাকে কিচ্ছু নেই প্রফাইলে, স্রেফ নামটা জ্বলজ্বল করছে সেঁজুতি শাহানা। নাম দেখে নারীর জাত, সম্প্রদায়, ধর্ম, সমাজ, পরিবার কিছুরই খোঁজ মেলেনা ”
ব্যাপক চিন্তিত আমাদের প্রিয়ম, প্রিয়ম হাসান৷ বছর আটত্রিশের ঝকঝকে যুবক। প্রচন্ড রকম ব্যস্ত কর্পোরেট পারসন৷ একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। সকাল আটটা শার্প, অফিসে একবার ঢুকলে আর বেরুতে বেরুতে সেই রাত দশটা। প্রচন্ড রকম ধকল সইতে হয়, যতোটা শরীরে নয় তার চাইতে বেশি করে মগজে। এই প্রতিযোগিতার বাজারে কেউ কাউকে এক বিন্দুও ছাড় দেয় না, সেটা খুব ভালো করে জানে প্রিয়ম।
একটা হেকটিক শিডিউল মানতে হয় প্রিয়মকে, অনেকটাই যন্ত্রের মতো কাজ করে চলে। সামনে পার্সোনাল ম্যাকবুক খোলা, খোলা আছে ডেস্কটপও। চোখের চাপ কমাতে আর সব কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর মতো সবুজায়ন হয়েছে এই অফিসেও। সারা অফিস জুড়ে ছড়ানো সবুজ, নানান রকম ইনডোর প্লান্টস, ক্যাকটাস, সাকুলেন্ট।
প্রিয়মের কেবিনের দক্ষিণ খোলা জানালা, যদিও ব্লাইন্ড দিয়ে ঢাকা। পাশেই ঝুলছে তিব্বতি থাঙ্কা। উত্তরের দেয়ালে প্রায় পুরোটা জুড়ে অমিতাভ বুদ্ধের ছবি। এক পেইন্টার বন্ধুর আঁকা এ্যাক্রেলিক বুদ্ধ। ঘরের প্রায় সব খানেই শোপিস হিসেবে বুদ্ধ মূর্তিও আছে।
মেইল আসছে-যাচ্ছে৷ সঙ্গে একটার পর একটা সিগারেট ধরানো ও যেন একটা কাজ৷ সিগারেট পুড়ছে, পুড়ছেই কেবল অস্থিরতা তবু কমছেনা তার৷
কাজ চলছে তার যন্ত্রের সাথে যন্ত্রবৎ, কিন্তু মন বড় উচাটন। মনের গভীরে কেনো কে জানে, গুনগুনিয়ে উঠে শাহানা রাগিণী।
সবে মাত্র স্নান সেরে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল সেঁজুতি। ঠাকুরদার আমলের আসল বর্মা সেগুনের আলমিরা, তাতেই বড় কাঁচ বসানো৷ পাঁচ সাতের একহারা গড়নের সেঁজুতি, শরীরটা বাঁকিয়ে পিছনে হাত দিয়ে যেন বা নাচের মুদ্রাবিভঙ্গে সামনে টেনে আনলো চুলের রাশি। চারপাশের এত এত চুলেরকাটের ভীরে তার এখনো হাঁটু ছাপানো চুলের ঢাল।
নার্সিসিসম..! হতেও বা পারে। নিজের প্রতি প্রচন্ড অখন্ড ভালোবাসা৷হবে নাইবা কেন?অফিস আর বাড়ির হাজারটা ঝক্কি সামলেও সে নিজের প্রতি মনযোগী৷যত্ন নিতে কার্পন্য নেই। যথেষ্ট রকম একটা ভালো চাকরি করে সে, হাই সোসাইটিতে বেড়ে উঠেছে। চট্টগ্রামের পশ এলাকায় নিজেদের বাড়ি। কিন্তু নিজের সৌন্দর্য আর দশজনের ছাঁদে ঢেলে ফেলতে সায় নেই তার। সে তাই বরাবরই তার নিজের মতো, শতভাগ।
দ্রুত তৈরী হতে হবে সেঁজুতিকে। যথাসময়ে যেন পৌছঁতে পারে সে ব্যপারেও তার খেয়াল রাখতে হয়৷ আর নিজেকে তার নিজেরই মতো যেনো সম্ভ্রান্ত দেখায়, তাতেও দিতে হয় সমান মনযোগ৷ আকর্ষনীয়া তো সে বটেই, কিন্তু উগ্রতা তার একদমই নাপছন্দ৷
তড়িঘড়ি অফিস পৌঁছেই পড়ে গেল বা বলা চলে, ডুবে গেল কাজে৷ প্রচন্ড ব্যস্ততায় উড়ে যায় সময়। দুপুর নাগাদ একটু সময় পেল, ফাঁকতালে একটু ঢুঁ মারলো ফেবুতে। এই এক নতুন আপদ জুটেছে বলা চলে। যবে থেকে অফিস ফরমান জারী করেছে, চব্বিশ ঘণ্টা অনলাইনে হাজির থাকতে হবে। সঙ্গে আরো আরো বহু রকমের এ্যাপসের মতো, ফেইসবুকও একটিভ থাকে সর্বক্ষণ। কী এক নেশায় রোজ হাজির হয় এখানে৷যাঁদের লেখার সে মুগ্ধ পাঠিকা ছিল এযাবৎ তাদের অনেকেই যুক্ত হয়েছেন এখানে তার বন্ধু হিসেবে৷ আরো অনেকেই অনুরোধ পাঠিয়েছেন বন্ধুত্ব চেয়ে৷ রোজই নতুন নতুন সব বন্ধু যুক্ত হচ্ছেন। অফিসের কাজের ফাঁকেও নতুন করে কারা কারা বন্ধুতা চাইছেন এই তালিকা দেখতে গিয়েই সে স্থানু!
যে নামটা অর্হনিশি জপছে সে, রোজ এফবিতে এসে যার আইডি খোঁজা একটা নেশা সেই মানুষটাই তার বন্ধুত্ব চাইছেন! ছবি অল্প, তবু তাই দেখছে সেঁজুতি। দেখছেই… চোখ আটকে যায় নতুন আপলোড করা কভার ফটোতে। তন্ময় হয়ে দেখতে থাকে, ডুবে যায় ভাবনায়৷ শেষে নিতে হলোই তাকে বন্ধু করে…।
প্রিয়মের দিন কাটে ব্যস্ততায়৷ অহর্নিশি একটা আচ্ছন্নতা৷ অনেক রাতে ফিরে ও এফবিতেই নিমগ্ন হয়। নতুন বন্ধুর সাথে কথা বলতে উন্মুখ। ফেবুতে ঢুকেই নক করে তাকে মেসেঞ্জারে। সেঁজুতি’র মেসেঞ্জার সেটিংস এমনই, সে নেটে অন না অফ বোঝা গেলো না। মেসেজও সীন দেখায় না কিন্তু প্রিয়ম জবাবের আশায় অপেক্ষায় থাকে। একটার পরে একটা মেসেজ দিতে থাকে সেঁজুতি’কে। প্রিয়মের অনেক অনেক জিজ্ঞাসা, অনেক কৌতুহল। নিজের আচরণে নিজেই অপ্রতিভ হয়, ফের লিখতে থাকে। নিজের মনের গহীনে বরফ চাপা পড়ে থাকা কথারা যেনো ভীর করে আসে। কিন্তু প্রিয়মের কথার ঢেউ থামাতে কেউ এলো না। রাত আর নেই, প্রায় ভোর। কিন্তু এতবার ডেকেও সাড়া মেলেনা৷ ওপাশের মানবী যেন পণ করেছে, কথা না বলবার৷ জেদ চেপে যায়…কথা বলাবেই৷
প্রিয়ম, জানে না কেন তাকে রোজ রোজ নক করতে হয় সেঁজুতি নামের এক মৌনীকে। জানে না কেন নিজের জীবনের সব কথা বাঁধভাঙ্গা জলের মতো কুলকুল করে বয়ে চলে এক অদেখা অধরা নারীর ইনবক্সে! জানে না কেন তার কোন সাড়া সে পায় না। কিন্তু কথারা এতো প্রাণবন্ত হয়ে কেবলই কেন সেঁজুতি শাহানাকেই খোঁজে। কেন সে কথা বলে না! কেন সে কথার জবাব দেয় না?
অপেক্ষার প্রহর শেষে একদিন ওপাশের বরফ গলে, সেঁজুতি’র ভিতরঘরে আলো জ্বলে উঠে। নৈঃশব্দের কঠিন বর্ম ভেদ করে বেড়িয়ে আসে মানবিক আর আন্তরিক এক নারী। তবু সে থেকে যায় যেন অধরা মাধুরী৷ প্রিয়ম আর সেঁজুতি ভেসে যায় দুজনই, রাত্রিদিন কথার খেলায়৷ এতো এতো এতো কথা কোথায় কী করে কোন অতলে জমা হয়েছিল যেনো দু’জনে দু’জনকে জানাবে বলে! দুই শহরের বাসিন্দা দুই অদেখা নারীপুরুষ কোন মন্ত্রবলে দু’জনার এতো কাছে চলে আসে! স্রেফ কথা কথা আর কথা বলে! মানুষ কেন এতো হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল!
কথা চলে দুই প্রান্তে, দুই শহরে, দুই নারী পুরুষের। মাঝে হঠাৎই একদম লাপাত্তা প্রিয়ম৷ ফেইসবুকে একটিভ না সে। কোন স্ট্যাটাস বা ছবিও নাই, ইনবক্সে টিং করে আসেনা কোন টেক্সট। কেউ জানতে চায় না, কী হাল আজ? লাঞ্চ টাইমে কেউ প্রশ্ন করেনা, লাঞ্চিত হলেন নাকি?
সেঁজুতি’র মেসেজ আনসীন থাকে, কেমন আছো ‘র জবাবে প্রিয়ম হাসির ইমোটিকন দিয়ে বলে না, ‘ খাটিয়া খাড়া! ‘
অস্থির সময় আরো বেশি অস্থির সেঁজুতি। নিজেই নিজের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়৷ নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করে করে জেরবার হয়। প্রিয়মের কথা এতো কেন মনে হয়! কেন রোজ রোজ হররোজ প্রিয়মের সব মেসেজগুলো সে পড়ে খুঁটিয়ে। কেন সে শতো কাজের ভীরে খুঁজে ফেরে একটু অবসর প্রিয়মকে ভাবার। তবে কী সে ভালোবাসতে শুরু করলো এক অচেনা অদেখ স্ট্রেঞ্জারকে! না দেখেও কেনো তার মন বলে, প্রিয়মকে সে সবটা জানে।
একেই কি বলে প্রেম? রোজ প্রিয়মের খোঁজ নিতে ফেবু খোলে, তার ইনবক্সে পাঠায় কতোনা মেসেজ, নানান রকম ছবি। শুভ কামনা। কিন্ত কোন রিপ্লাই আসেনা। একের পরে এক সব রকমের সব শুভ কামনা, উদ্বেগ উৎকন্ঠার জবাবে, কেবলই শূন্যতা। প্রিয়মের খোঁজ জানতে কোথায় কাকে কী জিজ্ঞেস করবে সেঁজুতি। সেই ভেবে অস্থিরতা কাটেনা সেঁজুতি’র।
সময় কাটতে চায়না যেনো, তবুও সময়ের নিয়মে কালচক্র ঘোরে। হপ্তা দুয়েক লাপাত্তা থেকে ফের হাজির প্রিয়ম হঠাৎই। সে কেন ছিল না, কেন সে জবাব দিতে এলো না তা জানায় না কিচ্ছুটি। ফের দুজনার আউলা বাউলা কথার খেলায় সময় চূড় হতে থাকে। মাঝের অনুপস্থিত সময় নিয়ে কথা উঠে না আর। এক অলস ছুটির দুপুরে কথার খেলায় ভাসতে ভাসতে সেঁজুতি ঢুঁ মারে প্রিয়মের প্রফাইলে। দেখে একটা সেলফোন নম্বর দেখা যাচ্ছে।
দুষ্টহাসি খেলে তার অধরে, তুলে নেয় ফোন৷ মেসেঞ্জারে চ্যাটিং চালু রেখেই প্রোফাইলে দেয়া সেলফোন নম্বরে ফোন করে। কন্ঠ না শূনে আর থাকা যায় না প্রিয় মানুষটার৷ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে সেঁজুতি সেই নম্বরে। রিং হয় বেজেই যায় কিন্তু ফোন কেউ ধরেনা, ফোন ধরে কথা কেউ বলে না। ওপারে মেয়েটার চোখে মেঘ করে, জমে জল৷ অনেকবার চেষ্টার পরে সাড়া মেলে, কেউ বলে ওঠে হ্যালো-বলুন৷
যদিও ফোন কানে প্রিয়মের তবু সে এফবিতেই নিমগ্ন..কথার খেলায়৷ ভাবতেই পারে না…ফোনের ওপারে আছে তার স্বপ্ন৷ কথা বলছে বটে তবে কড়া ভাষায়।
আহা মেয়েটা কাপঁছে অপমানে। ছেলেটা বিরক্ত, বারবার কেটে দিচ্ছে ফোন৷ প্রিয়মের সব কথা সব মনোযোগ কেবল সেঁজুতি’র সাথে। ফোনে সে কথা বলতে আগ্রহ পায় না। অচেনা এক নারী কন্ঠের অযাচিত ফোনে বিরক্তি চাপা রাখতে পারে না।
মেয়েটা মরিয়া হয়েই বলে উঠে আপনি আমার সাথেই চ্যাটিং করছিলেন। আমি সেঁজুতি বলছি৷
ভাবেনা প্রিয়ম, সে আর যেন ভাবতে পারে না …দ্বিধার স্বরে হড়বড়িয়ে বলে ওঠে ..তুমি! কি মুশকিল৷ কি করে? আমার নম্বর পেলে?ওপারে কাঁচভাঙ্গা হাসিতে উচ্ছ্বল হয় সেঁজুতিও৷ কেটে যায় সব দ্বিধা৷
প্রিয়মের রাত দিনের ফারাক ঘুচে যায়। সারা পৃথিবী একদিকে, আর তার প্রেম আরেক দিকে। সেঁজুতি ছাড়া, প্রিয়মের আর দিন রাতের বোধ থাকেনা। দুইজনের দুই দেহে একটাই যেনো প্রাণ৷ দুই শহরের দুই বাসিন্দা, ভেঙে ফেলে শহরের সীমানাও। কোন একটা শহর নয়, দুইজনার দু’টো শহরেই হতে থাকে দু’জনার অবাধ যাতায়াত।
দুইজনার দুই মন এক হতে হতে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলে পুরানো সব সামাজিকতার শৃঙ্খল। দুইজনার এক হতে বাঁধা হয় না, দুই ধর্মের কট্টর চোখ রাঙানিও। ভালোবাসলে বুঝি এমনই হয়। সব বাঁধা পরাজয় স্বীকার করে নেয়, প্রেমের কাছে। ফের কালচক্র ঘোরে, সময় আবর্তিত হয় নিজের নিয়মেই।
সমগ্র চরাচর ঘুমে মগ্ন,জেগে থাকে কেবল দু’টি স্বর৷ শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়..প্রেম আর প্রেমে মাতাল হবার৷ যেনবা নূতন জন্ম…দোহের৷ একই স্বপ্ন, একই প্রত্যাশা…এক সাথে জীবনের পথ চলা. ..
সেই ছেলেটার বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে মেয়েটা এখনও জানতে চায়… এত কেন রাগ করছিলে সেদিন? আমার ছবি দেখে কি ভেবেছিলে ফের বলো, সোনা? কেন তুমি এতো এতো সুন্দরী ছেড়ে কেবল আমাকেই ভালোবাসলে! কেন কেন কেন আর কেন’র জবাবে মেয়েটাকে বুকের সাথে মিশিয়ে পিষে ফেলতে থাকে ছেলেটা৷ আর পদ্মিণী মেয়েটার পদ্ম গন্ধী চুলের গভীরে নাক ডুবিয়ে প্রগাঢ় প্রেমে বলে উঠে সোনা রে!
লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী। জন্ম ও নিবাস বাংলাদেশের ঢাকায়।