হোমলেস লোকটি তাহলে কোথায় যাবে
‘হোমলেসরা তাহলে এখন কোথায় যাবে?’’
প্রথমেই এই প্রশ্নটাই মাথায় আসে তাঁর। মহামারীর মধ্যে টেলিভিশনের নিউজ আর ফেসবুক দেখা ছাড়া মোহাম্মদ শফিউর রহমানের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কাজ নেই। সকালে নিউইয়র্কের গভর্নরের কোন প্রেস ব্রিফিং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখতে না পারলে মনে হয় পুরো দিনটাই মাটি।
শফিউর রহমানের স্ত্রী দিলরুবা বেগম ওই সময় মেয়ে রিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। । রিয়া ওর স্বামীর সঙ্গে নর্থ ক্যারোলিনা থাকে। শফিউর রহমান এত জোরে টিভির সাউন্ড দিয়ে রাখেন যেন বেশীরভাগ সময় মেয়ের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না! বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে কথা বলতে হয়। মেয়ে বাবার নিউজ প্রীতির কথা ভালো ভাবে জানে। মাকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘মা, তুমি তো জান- নিউজ শোনা বাবার একটা নেশা। এটা নিয়ে রাগ করে সময় নষ্ট করে কি লাভ!’
দিলরুবা বেগম আসলে রাগ করেন না। কপট রাগের ভান করেন কেবল। ওনারা দুজনেই সহজ সরল মানুষ। সাধারণত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন অন্তত জটিল হন, কিন্তু ওনাদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটেনি। দুজনেই একই রকম আন্তরিক, অতিথিবৎসল ও পরোপকারী, এটা আসলেই খুব বিরল। আগে যখন ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা ছিল না, তখন মানুষ বিশ্বস্ত আত্নীয় স্বজনের কাছে টাকা গচ্ছিত রাখতো, যদিও এখন আর সেটা করার দরকার হয় না। এখন মানুষ গচ্ছিত রাখে কথা, বিশেষ করে নিজের সমস্যার কথা, নিজের কষ্টের কথা, বেশীরভাগ মানুষ সেই আমানতের খেয়ানত করে, কিন্তু এই দম্পতির কাছে নিশ্চিন্তে যে কোন কিছু বলা যায়!
দিলরুবা বেগম মেয়ে রিয়ার সঙ্গে কথা বলে এসে দেখেন, শফিউর রহমান চিন্তিত চেহারায় সোফায় পায়ের ওপর পা ফেলে বসে আসেন। কেউ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলে গালে হাত দেন, কেউ দাঁতের নখ কাটেন আর শফিউর রহমান সোফায় হেলান দিয়ে পায়ের ওপর পা ফেলে বসে থাকেন! দিলরুবা বেগম কোন আগ্রহ দেখান না শফিউর রহমানের কি ভাবছেন তাই নিয়ে। রোজ সকালে উচ্চ ভলিউমে টিভি দেখার জন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না, এই জন্য তিনি প্রতিদিন বেশ বিরক্ত হন। মেয়ে তো শুধু তার একার নয় বাবারও, কিন্তু ফোন করা কিংবা খোঁজ খবর নেবার ব্যাপারে পুরো দায়িত্ব শুধু মায়ের। অথচ মেয়ের কোন সাফল্যের খবর পেলে এমন ভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে চারদিকে বলেন যে তখন আর মায়ের কোন ভূমিকা থাকে না।
‘তোমার কাছে মামুনের নম্বর আছে ? আমার এই মোবাইলে অনেকের নম্বর দেখি মুছে গেছে।’ ফজলুর রহমান জানতে চান।
আছে আমার কাছে। এখন দিতে পারব না। কাজ করছি।’ দিলরুবা বেগম একটা বড় বাটিতে শুকনা ছোলা ভিজিয়ে রাখছেন। রাতেই ভিজিয়ে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু মনে ছিল না। এখন এগারোটার দিকে ভিজালে ভালো ভাবে নরম হবে না।
শফিউর রহমান প্রতি বছর রোজার আগে বলেন, এ বছর কোন ভাজা পোড়া খাবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি কথা রাখতে পারেন না। ছোলা, পিয়াজু আর আলুর চপ প্রতিদিন ইফতারে না থাকলে তিনি যেন চোখে অন্ধকার দেখেন।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়েও দিলরুবা বেগম দেখতে পান একই ভঙ্গীতে সোফায় বসে আছে তাঁর স্বামী। আগের মতোই চিন্তিত ভঙ্গী। আগে স্বামীর এই রূপটা দেখে দিশেহারা বোধ করতেন। এখন আর করেন না, কারণ তিনি জানেন, সামান্য ছোট খাটো বিষয় নিয়ে তাঁর স্বামী অকারণেই ব্যাতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
একটা সাদা কাগজে লিখে মামুনের নম্বর এনে দেন দিলরুবা বেগম। মোবাইলের মাধ্যমে টেক্সট করতে পারেন না তিনি। শফিউর রহমান নম্বর পেয়েই নড়েচড়ে বসেন, দ্রুত মোবাইল টিপতে শুরু করেন। ভাগ্যক্রমে মামুনকে পেয়ে যান একবার কল করতেই।
’হ্যালো মামুন, হ্যা আমি সানিসাইড থেকে তোমার শফিউর আঙ্কেল বলছি।’ শফিউর রহমান বেশ উত্তেজিত। জোরে জোরে কথা বলা শুরু করেছেন।
‘জি, আংকেল শুনতে পারছি। স্লামালাইকুম।’ অপরপ্রান্ত থেকে ঘুম জড়িত কণ্ঠে উত্তর দেয় মামুন।
শফিউর রহমান ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে কথা বলছেন। মামুন দিলরুবা বেগমের ভাইয়ের মেয়ের জামাই। নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটি সংক্ষেপে এমটিএ’তে চাকরী করে মামুন। সাবওয়ে স্টেশনের কাঁচঘেরা কাউন্টারে বসে সে।
’নিউইয়র্ক সিটির গভর্নর ও মেয়র সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাবওয়ে স্টেশন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার। জানতো?’ শফিউর রহমান জিজ্ঞাসা করেন।
’জানব না কেন আঙ্কেল? এই সাবওয়ে স্টেশন থেকেই তো নিউইয়র্ক সিটিতে বেশী করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে। এখনও ইসেনশিয়াল ওয়ার্কাররা যাওয়া আসা করে। স্টেশন নোংরা করে রাখলে তাদের অপমান করা হয়।’ মামুন উত্তর দেয়।
‘এই জন্য কি তোমরা সব হোমলেসদের বের করে দেবে? ওরা তাহলে কোথায় যাবে?’ শফিউর রহমান উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন।
‘কি বলেন আংকেল! সবাই কত আনন্দিত হোমলেসগুলিকে স্টেশন থেকে বের করে দেয়ার জন্য। আপনি বলছেন অন্যকথা।! মামুনের কণ্ঠে বিরক্তি।
ভোর সাতটায় কাজ থেকে ফিরে ঘুমিয়েছে তাও চার ঘন্টা হয়নি। কাজের জায়গা থেকে জরুরী ফোন আসতে পেরে ভেবে মোবাইল বন্ধ করেনি।তাছাড়া এখন মহামারীকালে কে কোথায় অসুস্থ হয়ে পড়ে তার কোন ঠিক আছে! দিলরুবা আন্টি আর শফিউর আংকেল বয়স্ক দম্পতি। তারা লকডাউনের আগে থেকে গৃহবন্দী আছেন। কয়েকদিন ধরে স্ত্রী সীমা বলছিল কাজ থেকে ফেরার সময় জ্যাকসন হাইটসের আপনা বাজারে গিয়ে কিছু বাজার করে তাদের দিয়ে আসতে। আজ করি-কাল করি বলে কাজটা করতে না পেরে, মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ ছিল। যে কারণে দ্রুত ফোন ধরেছিল এই ভেবে যে হয়ত তারা কোন সমস্যায় পড়েছে! কিন্তু এখন দেখছে সব অবান্তর কথাবার্তা!
শফিউর রহমানের পাশ থেকে কথা বলে ওঠেন দিলরুবা বেগম। ‘তুমি এসব কি বলছ, হোমলেসদের গায়ের গন্ধে ট্রেনে চড়া যায় না, আর তারা কোথায় যাবে সেটা নিয়ে তুমি ভাবছ! ওরা তো কাপড় চোপড়, হাড়ি পাতিল সব নিয়ে সাবওয়ে স্টেশনকে পুরো ঘরবাড়ি বানিয়ে রাখে!’ প্রতিদিন বিরক্তিটা স্বামীর খবর দেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, আজ আবার শুরু হয়েছে নতুন বাতিক, হোমলেসরা কোথায় যাবে ? আরে মরণ! নিজের বাসার ভাড়া কিভাবে দিবে তার কোন খবর নেই, ওনার চিন্তা হোমলেসদের নিয়ে! ভাইঝি জামাই যে খুব বিরক্ত হচ্ছে বুঝতে পারেন দিলরুবা বেগম।
মামুনও বুঝতে পারে আন্টি কিছুটা বিব্রত স্বামীর হোমলেসদের ব্যাপারে দরদ দেখে। ‘আংকেল আমি ব্রুকলীনে যে ট্রেন স্টেশনে কাজ করি ওখানে একজন হোয়াইট বয়স্ক হোমলেস আছে। ওকে কাল রাতে যখন ট্রেন স্টেশন পরিস্কার করার জন্য খালি করা হচ্ছিল, তখন পুলিশ বের করে দেয়। বের করার সময় লোকটার যে গালাগালি আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। পুলিশদের ধৈর্য্য বলতে হবে, কেউ কোন কথা বলেনি। এদেশের আইনে তো আবার হোমলেসদের গায়ে হাত দেয়া যাবে না। অথচ আমার নিজেরই মারতে ইচ্ছা করছিল।’
শফিউর রহমান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেন খুব কষ্টে। স্ত্রী হাতে হালকা চাপ দেন। দিলরুবা বেগম মনে মনে ভাবেন, হোমলেসদের এই দেশের মানুষ কুকুর-বিড়ালের চেয়েও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। বহুবার তিনি নিজেও ট্রেনের কোন বগিতে হোমলেসদের শুয়ে থাকতে দেখে সেই বগিতে না ঢুকে অন্যটাতে ঢুকেছেন।
শফিউর রহমান ক্ষুব্ধ স্বরে বলেন, ‘তোমরা যে লোকটাকে বের করে দিয়েছ সে কোথায় গেছে জানতে পেরেছ?’
মামুন হাই তুলতে তুলতে বলেন- ‘জানি না কোথায় গেছে! মনে হয় সারা রাত পথে পথে ঘুরেছে। তারপর সকালে তো দেখি আবার বান্দা হাজির!’
শফিউর রহমান হয়ত রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, দিলরুবা বেগম দ্রুত মোবাইল হাতে নিয়ে বলেন, ‘বাবা মামুন, তোমার তো সকালে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কথা! তুমি বরং এখন ঘুমাও। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে পারলে একটা ফোন দিও।’ কথা বলেই কেটে দেন তিনি। স্বামীকে আর কিছু বলার সুযোগ দেন না।
‘তোমার কি হয়েছে বলতো, হঠাৎ করে হোমলেস নিয়ে পড়লে কেন! আর জামাই মানুষের সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে! লকডাউনে বাসায় থাকতে থাকতে তুমি পুরোপুরি মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছ!’ কথা শেষ করে গটগট করে দিলরুবা বেগম বাথরুমে ঢুকে যান। ওখানে এরপর ওজু করে প্রথমে জোহরের নামাজ ও তারপর কোরআন শরীফ নিয়ে বসবেন, ইবাদতের সময় স্বামী কিছু বলার সাহস পাবে না।
রোজার দিনে দুপুর বেলাটা কেমন অস্বস্তিকর, কেননা কিছুই করার থাকে না। দিলরুবা বেগম লম্বা সময় ধরে কোরআন তেলওয়াত করেন এই সময়ে। প্রতি বছর রমজান মাসে এক খতম কোরআন শরীফ দেন তিনি। কিন্তু এবার কেন যেন এগোতে পারছেন না। অন্যান্য বছর রোজার মাসে কত কাজ থাকে, জ্যাকসন হাইটসে যে স্বর্ণের দোকানে কাজ করেন, সেখানে অনেক সময় ওভারটাইম করতে হয়, এবার লকডাউনে বাসায় বসে আছেন, কিন্তু কোন কাজই করা হচ্ছে না।
জ্যাকসন হাইটস স্বর্ণের দোকান থেকে বের হয়ে সেভেন ট্রেন নিয়ে সানিসাইডের বাসায় আসেন দিলরুবা বেগম। ট্রেন স্টেশনের সামনে প্রতিদিন ফর্সা লম্বা একটা লোককে রাস্তায় জিনিষপত্র নিয়ে বসে থাকতে দেখেন। লোকটার বয়স খুব বেশী মনে হয় না। কিন্তু কোন কাজ না করে একটা বিশাল কুকুর নিয়ে সারাদিন রাস্তায় বসে থাকে সাহায্যের আশায়! দিলরুবা বেগম মনে মনে হোমলেসদের ঘৃণা করেন। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে তার ভাবনা মিলে যায়, শুধু এই হোমলেস প্রীতি ছাড়া।
এক সন্ধ্যায় খুব তুষারপাত হচ্ছিল, দিলরুবা বেগম সাবধানে পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন দেখেন- সাবওয়ে স্টেশনের সামনে বসা পুরুষ হোমলেস লোকটির সঙ্গে আরেক নারীও বসে। সঙ্গে তাদের পোষা বিশাল দেহী কুকুরও আছে। ওই নারী আর পুরুষ চুম্বনরত, চারদিকে কোন খেয়াল নেই। দিলরুবা বেগম মনে মনে হাসছিলেন এই ভেবে যে হোমলেস লোকটারও তাহলে গার্লফ্রেন্ড আছে।
আসরের নামাজ শেষ করে রান্নাঘরে কাজ করতে করতে এসব ভাবছিলেন দিলরুবা বেগম। একটু পরে সেখানে দুপদাপ শব্দ করতে করতে হাজির হন শফিউর রহমান। মোবাইলে একটা ছবি দেখাতে উদ্যত হন স্ত্রীকে। দিলরুবা বেগমের কোন ছবি দেখার আগ্রহ নেই। স্বামীকে বেশী উত্তেজিত করে লাভ নেই ভেবে ছবিটা দেখেন। একটা বাড়ির সিড়ি দেখা যাচ্ছে ছবিতে। সিড়ির আশে পাশে বহু মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে।
‘দেখেছ, দেখেছ… এই হল নিউইয়র্কের হোমলেসদের শেল্টারের চিত্র। কোন সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানা হচ্ছে না। কে কিভাবে থাকবে, কোথায় ঘুমাবে কোন ঠিক নেই। সবাই শুধু মেয়রের গুনগান গায়, কিভাবে সে সাবওয়ে স্টেশন পরিচ্ছন্ন করছে, কিভাবে সে ইসেনশিয়াল ওয়ার্কারদের সম্মান দেখাচ্ছে, সেটাই যেন সব। হোমলেসরা কোথায় ঘুমাবে সেদিকে কোন খেয়াল নেই।’
কিছু না বললে স্বামী মনক্ষুন্ন হবে, সে কারণে দিলরুবা বেগম দায়সারা কণ্ঠে বলেন, ‘এটা কোন কথা হল! এভাবে গাদাগাদি করে মানুষকে কেউ রাখে!’
‘ওরা হোমলেস বলে কি মানুষ না!’ শফিউর রহমান মহা উত্তেজিত। ‘আমি মেয়র অফিসে ফোন করব।’
দিলরুবা বেগম বুঝতে পারছেন, লকডাউনের অখন্ডে অবসরে কিছু করার নেই, এজন্য তার স্বামী তিলকে তাল বানিয়ে হৈচৈ করছেন। মেয়র অফিসের লোকদের এখন মহামারীর সময়ে এক সঙ্গে কত বিষয় মোকাবিলা করতে হচেছ। তাদের খেয়ে পড়ে কাজ নেই এখন হোমলেসদের নিয়ে অভিযোগ শোনার।
‘শোন, তার আগে একটা কাজ কর। ভাগ্নে লোকমানের সঙ্গে এই নিয়ে আগে পরামর্শ কর।’ দিলরুবা বেগম পরামর্শ দেন স্বামীকে। এই শহরে তাঁর স্বামীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ এই লোকমান হোসেন। আপন ভাগ্নে নন, শফিউর রহমানের মেজ বোনের স্বামীর আগের ঘরের ছেলে, কোন রক্তের সম্পর্ক নেই দুজনের মধ্যে, তবু ভিনদেশে এই মামা আর ভাগ্নে একে অপরের হরিহর আত্না।
‘ভালো একটা কথা বলেছ। কিন্তু লোকমান এখন ফ্রি আছে কিনা কে জানে!’ শফিউর রহমান জানেন তিনি একটা ফোন করলে লোকমান নিজের জরুরী কাজ ফেলে মামার কাজের জন্য দৌড়াবে। এজন্য অনেক সময় তিনি ফোন করতে চান না।
‘লোকমান, তুই কোথায় ? কাজে ব্যস্ত না তো!’ শফিউর রহমান ফোন করার সঙ্গেই সব সময় লোকমানের লাইন পেয়ে যান। ও যেন সব সময় মামার ফোনের জন্য অপেক্ষায় থাকে।
‘উডসাইডের কয়েকটি দোকানে মাল ডেলিভারি দিতে যাচ্ছি। গাড়ি চালাইতিছি। কথা বলতে সমস্যা নাই। ’ লোকমান পেশায় গ্রোসারি শপের ডিস্ট্রিবিউটর। বিভিন্ন দেশ থেকে পন্য আমদারী করে গ্রোসারি শপগুলিতে ডেলিভারী দেয়া তার কাজ।
‘আচ্ছা, তুই তো করোনা ভাইরাসের সময়েও পুরো শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, এই শহরের হোমলেসদের কি অবস্থা জানিস?’ শফিউর রহমান জানতে চান।
‘হোমলেস তো অনেকে করোনায় মারা গেছে শুনছি। আমার সামনেই তো সেদিন একজন হোমলেস অসুস্থ হয়ে পড়ল, একটু দূরে পুলিশ দাঁড়িয়েছিল, তারা দ্রুত ৯১১ এ ফোন করল, তারপর এম্বুলেন্স এসে লোকটাকে নিয়ে গেল। তারপর কি খবর জানি না! ওদের তো কেউ নাই মামা খোঁজ নেবার।’
শেষের কথাটা শফিউর রহমানের বুকে এসে বেধে। এই মহামারীকালে সবার জন্যেই কেউ না কেউ আছে। তারা এখানে বাসা ভাড়া দিতে না পারলে নর্থ ক্যারোলিনায় মেয়ের কাছে চলে যেতে পারবে। সেখানে ওর সুইমিং পুলওয়ালা বিরাট বাড়ি। নিউইয়র্ক শহরেও তার স্ত্রীর ভাই-বোন অনেকে থাকেন। শ্বশুরবাড়ি সিলেট হওয়াতে, সেখানকার ধনী লোকদের কাছ থেকে অনেক রকম সাহায্য পাওয়ার আশা আছে। বাইরে যেতে পারেন না বলে ভাগ্নে লোকমান প্রতি সপ্তাহে মামার জন্য বাজার দিয়ে যায় বাসার নীচ। কিন্তু হোমলেসদের তো কেউ নেই। তাদের পরিবার পরিজন, আত্নীয়-স্বজন কেউ নেই। এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডে তারা নি:সঙ্গ মানুষ।
মামাকে চুপ থাকতে দেখে লোকমান জানতে চায়, ‘মামা, আমাকে কি করতে হবে বলেন!’
‘শোন, তুই কয়েকজন হোমলেস খুঁজে বের করবি। পারলে তাদের সঙ্গে কথা বলবি। তারা কেমন আছে জানতে চাইবি।’ শফিউর রহমান বলেন। এই করোনা মহামারীর সময়ে স্বামীর এমন আজগুবি আবদার শুনে দিলরুবা বেগমের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু অনুগত ভাগ্নে বলে ওঠে- ‘জি আচ্ছা, মামা।’
ইফতারের ওয়াক্তে ভাগ্নের ফোন আসে, ‘মামা, আমার বাসার সামনেই দুজন হোমলেস পেয়েছি। ওদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা তো বাঙালি মামা।’ রীতিমত লটারিতে পুরস্কার জেতার মতো আনন্দ যেন লোকমানের গলায়।
‘বাঙালি’ শুনে শফিউর রহমান হালকা চুপসে যান। এত বছর নিউইয়র্কে আছেন কখনও বাঙালি হোমলেস চোখে পড়েনি। দিলরুবা বেগমেরও অভিজ্ঞতা তেমনই। বাঙালি কেন এশিয়ান হোমলেসও সচরাচর চোখে পড়ে না। নিউইয়র্কের অন্যান্য বর্ণের মানুষের মধ্যে এশিয়ানরা তুলনামূলক নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে।
‘বাঙালি যেহেতু আমাদের তো দায়িত্ব ওদের সাহায্য করা। তুই ওদের কিছু খাবার দাবার সহায়তা করতে পারস। আমি আর তোর মামী বাসা থেকে মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে দিতে পারি। কি বলিস?’ শফিউর রহমান জানতে চান ভাগ্নের কাছে।
‘আচ্ছা আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে জানাবো মামা।’ লোকমান ফোন কেটে দেয়।
শফিউর রহমান ফ্রিজ থেকে একটা চিকেনের প্যাকেট বের করে ছোট গামলায় ভিজিয়ে রাখেন। স্ত্রীকে বলার সাহস হয় না রান্না করে দেবার জন্য। তবু দিলরুবা বেগম রেগে ওঠেন, ‘ফ্রিজ প্রায় খালি হতে চলেছে, উনি আছেন দান করা নিয়ে।’
বেশ দ্রুততার সঙ্গে আজ তারাবির নামাজ শেষ করেন শফিউর রহমান। কখনও লোকমান ফোন করে বসে, যে কারণে অস্থিরতা প্রকাশ পায় তার আচরণে।
লোকমান ফোন করে রাত দশটায়। সে বলে, ‘মামা, ওরা তো খাবার চায় না। আমি চাল-ডাল দেবার কথা বলেছিলাম। ওরা সেটা নেবে না। বলে এসব নিয়ে কোথায় রান্না করব। ওরা ক্যাশ চায় মামা।’
নগদ ডলার সাহায্যের কথায় শফিউর রহমান দমে যান। তবু হয়ত কিছু বলতেন, তার আগেই লোকমান বলেন, ‘মামা, আপনি চিন্তা করবেন না! আমি আপনার হয়ে ওদের ২০ ডলার দিয়েছি। প্রয়োজনে আবার দেব। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান মামা।’
শফিউর রহমান কিছুটা স্বস্তি পান। লকডাউনের কারণে আজকাল অনেকেরই ঘুমাতে দেরী হয়ে যায়। পরদিন যেহেতু কাজে যাবার তাড়া নেই, সবাই দেরীতে ঘুমায়।
ভাইঝি সীমা যখন ফুফু দিলরুবা বেগমকে ফোন করে তখন রাত প্রায় পৌনে একটা। স্বামী-স্ত্রী তখন বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। ‘ফুফু, আজ সকালে তোমাদের জামাইয়ের সঙ্গে ফুফার কথা হইছিল মনে হয়।’
‘তোর ফুফা, জানিস না, হঠাৎ করে একটা বিষয় নিয়ে এমন মাতামাতি শুরু করেন, আমার নিজেরই বিরক্তি লাগে।’ দিলরুবা বেগম টেনশন বোধ করছেন, মামুন মনে হয় রাগ করে সীমাকে কিছু বলেছে।
‘ না না, ফুফা তো আমাদের খুব ভালো মানুষ। অসহায় মানুষের জন্য সব সময় চিন্তা করেন। আজকাল তো ফুফার মতো মানুষ দেখাই যায় না। তোমাকে এত রাতে যে কারণে ফোন করেছি, সেটা বলি- মামুন একটু আগে সাবওয়ে স্টেশনে ওর কাজের জায়গা থেকে ফোন করেছিল। বলেছে যে, ওর স্টেশনে যে লোকটা ছিল, তাকে সিটি থেকে গাড়ি পাঠিয়ে ওখানকার এক হোটেলে নিয়ে রেখেছে। হোমলেস শেল্টারগুলিতে নাকি গাদাগাদি করে থাকছে মানুষ, এই নিয়ে একটা রিপোর্ট হবার পরে মেয়র এই ব্যবস্থা করেছেন।’
স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ভাইঝির কথোপকথন পাশ থেকে শুনছিলেন শফিউর রহমান। খবরটা শুনে পরম করুনাময়ের কাছে শুকরিয়া আদায় করেন তিনি।
লেখক ও সাংবাদিক।
জন্ম ৯ মার্চ, বরিশালের পিরোজপুরে, নানাবাড়িতে। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের পুরো সময় কেটেছে পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। বিয়ের পরে দীর্ঘদিন থেকেছেন ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডে। দেশান্তরী জীবনে বাস করেছেন শুরুতে নিউইয়র্কর সিটির জ্যাকসন হাইটসে ও বর্তমানে এস্টোরিয়ায়। লেখকের লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে এসব স্থানের স্মৃতি। গেন্ডারিয়া মনিজা রহমান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পরে বেছে নেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার মতো নারীদের জন্য অপ্রচলিত এক পেশা। দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, দৈনিক জনকণ্ঠ ও দৈনিক মানবজমিনে। নিউইয়র্কে আসার পরেও নিজেকে যুক্ত রেখেছেন লেখালেখির সঙ্গে। প্রথম আলো উত্তরের নকশার বিভাগীয় সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন এস্টোরিয়ার একটি স্কুলে। গেন্ডারিয়া কিশলয় কচিকাঁচার আসর, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, কণ্ঠশীলন ও বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০০৮ সালে প্রথম বই প্রকাশিত হবার পরে এই পর্যন্ত তাঁর বইয়ের সংখ্যা তেরটি।