কাঠের প্যাঁচা
২১
ভাষার কাছে চলে যেতে চেয়েছে সে
যেতে চেয়েছে উপভাষাসমূহে
মূক ও মৌনতার ভাষা তবে কার?
ওই যে স্থির চোখ, ওই যে কঠিন ডানা
ওদেরও কি ভাষার কাছে নত হতে হবে?
কঠিন সেই ঘাড় নুয়ে পড়েছে—এমন দৃশ্যের কাছে
নত হয়ে থাকি আমি ভাষাহীন।
ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে স্রোত মাটির দিকে-
এও এক দৃশ্যের উপস্থাপনা
কোনদিকে যাব আমি? মাটিতে মিশে যেতে চেয়ে মাটি হব?
পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে সমাধিস্থ হবে বুঝি কাঠের প্যাঁচাটি?
প্রশ্নের স্থানান্তর হতে দেখি বারবার
উত্তরের কাছে গিয়ে অবিচল আমি আর কাঠপ্যাঁচা
চোখের কোণে কি বিদ্যুৎ ঝলকালো কারও?
আকাশ নির্বিকার। আকাশ নিঃস্পৃহ। নীলের সীমানায় ছড়িয়ে দিয়েছে তার ডানা।
একঝাঁক তোতা উড়ে গেল ওই……
ওড়ার বাসনায় মানুষ ও কাঠপ্যাঁচা উভয়ই হয়েছে সামিল।
২২
মাটির কাছাকাছি উষ্ণ হাওয়ায় কাঠের প্যাঁচাটি স্বচ্ছন্দ খুব
বোধের জগত তার স্বাভাবিক থাকে
এ জগতের সামান্যই ওপরে যদিও তখন হিমকণা ভাসছে আকাশে
একে অপরের মুখোমুখি হলেই নেমে আসবে বরফ-পাথর।
সম্ভাবনা এক অপার রহস্য-
শীতলতায় মোড়া।
মেঘ জানে ঈশারা পেলে ঝরে পড়তে হয়
শিল ও শিলার সংস্পর্শে জলের জন্ম দেয় সেই মাটিই।
অন্ধপ্যাঁচা সে, আমিও রঙকানা
ধূসরের ভেতর থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি সমস্ত সম্ভাবনাই।
তার ওই স্থির মণি, আমার এই বেরঙিন চোখ
আকাশের স্বপ্ন দেখতে দেখতে বারবার ভুলে যাই-
আমাদের ওড়ার অক্ষমতা থেকে কিছু ধুলোকণা উড়ে গেছে কবেই।
২৩
রঙের দুনিয়ায় এসে পড়েছি সেই আমরাই
চারিদিক হলুদ বরণ, লালের আভায় দিগন্ত স্থির
সবুজ ঘাসেদের কাছে একটু কি ঝুঁকে এসেছে নীলাকাশ?
রঙের মহিমা কিছু আমরা শিখতে এসেছি
ধূসর এই পৃথিবীতে রঙ বুনে দেব বলে
চলে গেছি বাদলা পোকার কাছে।
রাজনীতি থেকে রঙ চুরি নেব ভেবে
মায়ার দরজা খুলে আবারও এসেছি বারান্দায়
সেও তো বাস্তু জানে, ফেংশ্যুই মানে
ঈশান কোণে নৈঋত এসে বসে বেখেয়ালে।
ত্রস্ত হয়ে ওঠে কাঠপ্যাঁচা!
সম্বিত ফিরে এলে আমিও দুহাতের আলগা রঙ ঝেরে নিই
মায়াদরজা খেলে যেতে দেখি সম্মুখে
মোহক সে আহ্বান—আমরা নিশি পাওয়া জীব
অন্তর্লীন হই অন্তর্জগতে।
২৪
জাদুভ্রমর এক এসে বসেছে কাঠের ডানায়
তিরতির কম্পন অনুভূত হয়েছে……
উড়ে যেতে পারে এমনও নয়,
স্থিরতার কাছে নতি স্বীকারও করেনি।
কাঠপ্যাঁচা সে!
স্থবিরতার ধর্ম ভুলতে চেয়েছে
আমিও মানুষের সত্ত্ব ত্যাগ করে
স্থবির হতে চেয়েছি…
‘ধর্ম কী? মোক্ষ, মায়া কী জান?’
আকাশবাণী হল মেঘ ছিঁড়ে।
নিশ্চুপে ঘুম এসে কণ্ঠরোধ ক’রে
আমাদের বলে গেল-
‘ওই মায়াদরজা খুলে দেওয়ার সময় হয়েছে
জানলার গরাদ ভেঙে সশব্দে উঠে আসছে চীল!
তোমরা বোঝ না?’
কবি ও কথাসাহিত্যিক