সুখ খুঁজছিল গাধার ছানা
ছোট্ট গাধার বাচ্চাটা সুখ খুঁজছিল। কিন্তু সুখ খোঁজার আগে তো জানতে হবে, কাকে বলে সুখ। তাই সুখ কাকে বলে জানতে ও চলে গেল ভেড়ার বাচ্চার কাছে।
‘সুপ্রভাত, ভেড়ার বাচ্চা, তোর কাছে কি সুখ আছে?’
‘দেখছি খুঁজে। ভিতরে আয়।’ বলল ভেড়ার বাচ্চা।
গাধার ছানা ঢুকল ভেড়ার ছানার ঘরে। এদিকে খুঁজল, ওদিকে খুঁজল। বিছানার নিচে তাকাল, ফ্রিজ খুলে দেখল, তারপর অসহায়ভাবে ঘাড়দুটো উঁচু করে বলল:
‘সুখ তো খুঁজে পাচ্ছি না!’
‘তার মানে, নেই! তোকে সাহায্য করতে পারলাম না!’
গাধার ছানা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তখন ভেড়ার বাচ্চা বলল, ‘শোন, গাধার ছানা। মনে হচ্ছে, এই জিনিসটার নাম সুখ হতে পারে।’—বলে গাধার ছানার দিকে একটা সিল্কের রুমাল এগিয়ে দিল ভেড়ার বাচ্চা।
‘মনে হয়, এটা সুখ না।’ বলে দরজার দিকে পা বাড়াল গাধার ছানা। ‘দেখি, ছাগলের বাচ্চার কাছে যাই, সেখানে হয়তো সুখ খুঁজে পাব।’
‘ছাগল ছানা, তোর কাছে কি সুখ আছে?’ বুক ভরা আশা নিয়ে ছাগল ছানাকে জিজ্ঞেস করল গাধার ছানা।
‘সুখ?’ হাতের গামলাটা টেবিলে রেখে ছাগল ছানা ভাবতে লাগল!
‘মনে হয় আছে। কিন্তু আমার মনে নেই, কোথায় রেখেছি!…’
‘হুম, বুঝতে পারছি।’ বলল গাধার ছানা। ‘ভেড়ার ছানার কাছে সুখ নেই। তোর কাছও সুখ নেই…’
‘কী যে বলিস! আমার কাছে দুধ আছে। দুধ খেতে দারুণ ভালো। উপকারীও বটে। সবমিলে…’
‘সুখ এটা “সবমিলে” কিছু নয়।’ জ্ঞানীর মতো বলল গাধার ছানা। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেল হাঁসের বাচ্চার কাছে।
হাঁসের ছানা বসে ছিল বিশাল এক পদ্মপাতার নিচে। নাশতা করছিল সে। সবচেয়ে প্রিয় খাবার শ্যাঁওলার সালাদ খাচ্ছিল। খেতে খেতে আনন্দে প্যাঁক প্যাঁক করছিল।
‘কেমন আছিস, হাঁসের ছানা! আমি সুখ খুঁজছি। তোর কাছে কি কোনো কারণে সুখ আছে?’ জিজ্ঞেস করল গাধার ছানা।
‘কেন থাকবে না?’ প্যাঁক প্যাঁক করে বলল হাঁস ছানা।
‘আমি কি একটু খুঁজে দেখব?’
হাঁস ছানা শ্যাঁওলা ভরা বালতির ঢাকনাটা সরিয়ে দিল, তারপর বুক ফুলিয়ে বলল, ‘এই দ্যাখ!’
গাধার বাচ্চা বালতিতে মাথা ডুবিয়ে দেখল, তারপর অবাক হয়ে বলল, ‘তুই কি আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিস?’
‘কী বলছিস তুই? এক বালতি শ্যাঁওলা। এর চেয়ে সুখের আর কী আছে?’ বলল হাঁস ছানা।
এ রকম সুখ আমার দরকার নেই।’ বলল গাধার ছেলে।
গাধার ছেলে হেঁটে হেঁটে ঢুকে গেল বনের আরো ভিতরে।
‘এই গাধার ছানা!’ কে যেন চুপিচুপি ডাকল ওকে।
গাধার ছানা একটা গাছের পিছনে লুকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল, কে ওকে ডাকে। এ সময় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল ছাগল ছানা আর ভেড়ার ছানা।
ওরা এসেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী হলো, সুখ খুঁজে পেয়েছিস?’
মন খারাপ করে এদিক–ওদিক মাথা নাড়ল গাধার ছানা…
গাছের ওপর থেকে একটা কাক হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমার কথা শোন মন দিয়ে।’
ক্রিসমাস ট্রির নিচে যেথায় নীল রঙা এক বন
ডালপালাকে পাঠিয়ে দিল দূর আকাশের গায়
যেথায় নদী আপন মনে বইছে সারাক্ষণ
ভালুক যেথায় চিৎকারে তার জঙ্গল মাতায়
সেইখানেতেই পাবি তোরা নিত্য সুখের খোঁজ
পা চালিয়ে যা সেখানে, সুখ পাবি হররোজ!
এ কথা শুনে অনেক দূর দৌড়ে গেল গাধার ছানা, ছাগল ছানা আর ভেড়ার ছানা। যখন ক্লান্তিতে আর দৌড়াতে পারছিল না, তখনই কেবল থামল তারা। আর থামার পর ওদের সামনে দেখল একটা ক্রিসমাস ট্রি। গাছটা এত উঁচু যে মনে হয় আকাশে গিয়ে ঠেকেছে।
তাহলে সুখ কোথায়? বুড়ো কাকটা কি তাদের মিথ্যে বলেছে?
গাধার ছানা পুরো গাছটা ঘুরেফিরে দেখল আর তখনই আবিস্কার করল, একটা ছোট্ট মেয়ে বসে আছে গাছের নিচে। মেয়েটার হাতে ছিল একটা বালতি আর ও কাঁপছিল শীতে।
‘ভয় পেয়ো না।’ মেয়েটাকে আদর করে বলল ছাগল ছানা।
‘আমরা তোমাকে কষ্ট দেব না।’ বলল ভেড়ার ছানা।
গাধার ছানা ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি সুখ?’
‘আমি মাশা।’ বলল খুকি। ‘আমার খিদে পেয়েছে। আমার ঠাণ্ডা লাগছে। আমি বাড়ি যাব।’
‘একটু অপেক্ষা কর। আমি আসছি।’ বলে খুকির নীল বালতিটা নিয়ে ঝোপের আড়ালে চলে গেল ছাগল ছানা। একটু পরই সে ফিরল এক বালতি গরমাগরম দুধ নিয়ে। রাখল খুকির সামনে।
‘দুধ খা।’ বলল ছাগল ছানা। ‘গরম দুধ।’
কোনো কথা না বলেই মাশা ঢকঢক করে পুরো দুধটা খেয়ে নিল।
‘এখন তোর আর ঠাণ্ডা লাগবে না।’ এই কথা বলে ভেড়ার ছানা ওর সিল্কের রুমালটা নিয়ে জড়িয়ে দিলো মাশার গায়ে। আর তক্ষুণি মাশার ঠকঠক করে কাঁপতে থাকা বন্ধ হলো। ওর শরীর গরম হয়ে উঠল।
‘এবার তবে ফিরতে হবে বাড়ি।’ বলল গাধার ছানা।
মাশা গাধার ছানার পিঠে চড়ে বসল। সবাই চলল পথে। বাড়ির পথ সব সময়ই ছোট আর আনন্দময়।
‘দেখ দেখ, এই তো আমার বাড়ি!’ বলেই মাশা লাফ দিয়ে গাধার ছানার পিঠ থেকে নেমে গেল আর হাততালি দিতে লাগল।
সত্যি সত্যিই গাধার ছানা, ছাগল ছানা আর ভেড়ার ছানা দেখতে পেল দুটি লম্বা ছিপছিপে বার্চ গাছের নিচে ঢালু ছাদের একটা ছোট্ট বাড়ি।
‘মাশা তার নতুন বন্ধুদের চুমু খেল, গাধার ছানা চুমু পেল তার কালো নাকে, ছাগল ছানা পেল তার গোলাপী নাকে আর ভেড়ার খানা পেল তার খয়েরি নাকে।
‘তোমাদের খুব খুব ধন্যবাদ। তোমরা সাহায্য না করলে আমার আর বাড়ি ফেরা হতো না। এরই নাম সুখ!’
এভাবেই গাধার ছানা আর তার বন্ধুরা সুখ খুঁজে পেল।
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অনুবাদক