হাতি হত্যার একটি দূরবর্তী প্রতিতুলনা
সম্প্রতি ভারতের কেরালায় একটি হাতি মৃত্যুর ঘটনা ইতোমধ্যে সকলের নজরে এসেছে। গর্ভবতী হাতিটি একটি আতসবাজিভরে রাখা আনারস খাবার পর সেটা এক্সপ্লোশনের কারণে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো। তীব্র যন্ত্রণায় হাতিটি কয়েক দিন ধরে এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়িয়েছে। যন্ত্রণাকমানোর জন্য শেষমেশ হাতিটি একসময় নদীতে নেমে পানির ভেতরে মুখ ও শুঁড় ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে পানিতে থাকে পুরো তিনটা দিন। পরে নদীতেই কাৎরাতে কাৎরাতে একসময় তার মৃত্যু ঘটে। তারপর দু’দিন যেতে না যেতেই দেখলাম বাংলাদেশের কক্সবাজারে কে বা কারা গুলি করে একটি বয়স্ক মা হাতিকে হত্যা করেছে। মৃত্যুর পর থেকেই মায়ের মরদেহ পাহারা দিচ্ছিল হাতির শাবকটি। শাবকটির চোখে মুখে অসহায়ত্বের ছাপ, চোখ বেয়ে অঝরে ঝরছে কান্নার ফোঁটা।
মৃত্যুর যন্ত্রণা তীব্র হলে মানুষের বহিঃপ্রকাশও তীব্র হয়। কেরালার বন কর্মকর্তার বরাদে হাতিটির মৃত্যুর পুরো ঘটনাটা জানবার পর মানুষ সমব্যথিত হয়েছে। তার প্রকাশ ঘটেছে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। হাতিটিকে কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মারা হয়েছে তার কারণ এখনো জানা যায়নি। শুনলাম ঐ এলাকাটিতে বুনো শূকরের উপদ্রব খুব বেশি। স্থানীয় কৃষকরা নাকি সেখানে বুনো শুকরেরহাত থেকে ফসল রক্ষা করতে আনারসভর্তি আতসবাজি চারদিকে ছড়িয়ে রাখে।তাই হাতি মৃত্যুর সঠিক কারণটা এখনো জানা সম্ভব হয়নি।হাতির বিচরণকৃত লোকালয়গুলোতে মানুষ ও হাতির ক্লাশ খুব নরমাল ঘটনা। বন্য হাতি যখন মানুষের ফসল, গাছপালা, বাড়ি-ঘর নষ্ট করে, আবার কখনোমানুষের প্রানও কেড়ে নেয়, তখনই মূলত শুরু হয় বন্য হাতির প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা। ‘আমাদের সময়’ বলছে—দ্যা হিন্দুর তথ্যমতে, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অর্থাৎ গত তিন বছরে ১৭১৩ জন মানুষ সরাসরি হাতির হাতে খুন হয়েছে। লোকালয়ের নাগরিকদের নিজেদের নিরাপত্তার কারণে অন্য প্রাণীকে যেন হত্যা করতে না হয় তার দায়িত্ব কি শুধু নাগরিকের নাকি রাষ্ট্রেরও? সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রের প্রশাসন কতোটুকু আন্তরিক সেটাও বোঝা দরকার।
বাংলাদেশের হাতি মৃত্যুর ঘটনাটিও এখনো অজানা। তবে মানুষের নিষ্ঠুরতা থেমে নেই। এর মধ্যেইইথিওপিয়ায় বুলেটের আঘাতে ছয়টা হাতি খুন হয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের মাদারীপুরে খাবারে বিষ মিশিয়ে অনেকগুলো বানরকে হত্যা করা হয়েছে। কাজটি করেছিলো স্থানীয় একজন মহিলা। চট্টগ্রামে দেখলাম কারণ ছাড়া কিছু যুবক ছেলে একটা মেছোবাঘ হত্যা করে সেলফি তুলে ফেসবুকেরীতিমতো তাদের বীরত্ব প্রকাশ করছে। এর আগেও ভারত ও শ্রীলংকায় বিষ মিশিয়ে হাতি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বছর চার পাঁচ আগে ভারতের কেরালা রাজ্যের কুকুর হত্যার বিষয়টিও অনেকের অজানা নয়। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, পাকিস্তান সবগুলো দেশেই মানুষ দ্বারা হাতি, কুকুর, বানর, মেছোবাঘ প্রভৃতি প্রাণী হত্যা ও নির্যাতনের এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যা বলে শেষ করা যাবে না। ফলে মানুষ আজ অমানবিক, বর্বর, নিঃসংশয় হয়ে উঠেছে এমন কথাটাই সচারাচার শুনতে পাই। কিন্তু আমরা কখনো মূলটা ঘেঁটে দেখিনা। প্রথমত, আমরা দেখছি না কেন মানুষ এই বন্যপ্রাণী হত্যায় মেতে উঠেছে। সেটাকি কারণ ছাড়া নিছক খেলার ছলেপৈশাষিক আনন্দ পাবার আশায় নাকি নিজের নিরাপত্তা কিংবা পেট তথা ক্ষেতের ফসল বাঁচানোর দায়ে? খাবারের খোঁজে বন্যহাতি, বন্য শুকর, মেছোবাঘ এরা যখন লোকালয়ে চলে আসে তখনি মানুষের সঙ্গে তাদের সংঘাত সৃষ্টি হয়। আমাদেরকে এমর্মে যে কারণটা খুঁজতে হবে তা হল বন্যপ্রাণীগুলো লোকালয়ে আসছে কেন? নিশ্চয় বনে তাদের খাবারের সংকট পড়েছে সেজন্য।টেকসই বিনাউন্নয়নের নামে, বিভিন্ন দেশি-বিদেশী কোম্পানির প্রজেক্টের নামে, সরকারি একদল লোকের পৃষ্ঠপোষকতায় বন উজাড়ের ফলে বন্যপ্রাণী হারাচ্ছে তাদের অভয়ারণ্য। বিনষ্ট হচ্ছে তাদের খাদ্য-শৃঙ্খল। ফলে তারা খাদ্যের সন্ধানে ছুটছে লোকালয়ে। এই কথাগুলো আমরা কেউ বলছি না, আমরা শুধু লোকালয়ের কিছু মানুষের অমানবিকতা নিয়ে নিত্য শ্লোক আওড়াচ্ছি।দূর্গম অঞ্চলে যারা চাষাবাদ করে তাদের অধিকাংশই গরীব এবং অশিক্ষিত মানুষ। তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। নেহাত কোন কারণে কিংবা হয়তো অকারণেই তাদের এই অমানবিকতা। তাদের সচেতনতা নিয়ে কথা না বলে, তাদের জীবন ও ফসলের নিরাপত্তার কথা মাথায় না এনে এই মানুষগুলোর বিচারের দাবিতে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চেঁচিয়ে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে ফেলি, অথচ ক্ষমতায় থাকা যে গোষ্ঠী দিনের পর দিন বন উজাড় করছে, গোটা রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লুট করছে তাদের চিনেও আমরা চুপ করে থাকি। আমাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তখন লুপ্ত হয়ে যায়। কি হিপোক্রেসি মাইরি!
প্রতিবাদ করলে সকল অসৎ ও অপকর্মের বিরুদ্ধেই করা উচিত। নিজের পিঠ বাঁচিয়ে যে প্রতিবাদ তার আসন্ন ফলাফল ভালো কিছু বয়ে আনবে না। আমার এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য কোনোভাবেই হাতি হত্যাকে জায়েস করা নয়। এই জঘন্যতম কাজটিকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। তবে শুধু হাতি হত্যা নয়, যেকোনো ধরণের হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় পারে সবরকম অন্যায়ের অবসান ঘটাতে—আমাদের প্রকৃত মুক্তির উপায় বাতলে দিতে।
দ্বিতীয়ত, এটা অস্বীকার করার কোন উপায়ও নেই যে সত্যিই মানুষ অমানবিক, বর্বর, নিঃসংশয় হয়ে উঠেছে। কারণ নিছক খেলার ছলে কিংবা পাশবিক আনন্দ নিতে বন্যপ্রাণীর হত্যার নজিরও রয়েছে অসংখ্য। কিন্তু এটাও বলা জরুরি কেন মানুষ এমন পাশবিক, বর্বর, নিঃসংশয় হয়ে উঠলো? রাষ্ট্রের নাগরিকের সুস্থমনের প্রজ্ঞাবান একজন মানুষ হয়ে গড়ে তুলবার শিক্ষা দেবার কথাতো রাষ্ট্রের। আমাদের রাষ্ট্রগুলো কি মানুষকে সুস্থ ও সুন্দর মনের অধিকারী হবার সেই শিক্ষাটা দিতে পেরেছে? সেতো মহাব্যস্ত নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকবার বন্দোবস্ত নিয়ে। এতো কিছু দেখবার তার আর সময় কোথায়? শুধু তাই না, শিক্ষার পিছনে কম টাকা ঢালতেও বিশ্বপরিসরে সে মহাওস্তাদ।
একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না যে সব মানুষের ভিতরে রয়েছে একধরণের সহিংস প্রবণতা। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিরাষ্ট্রের নাগরিকের রয়েছেরাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ও ধিক্কার। কখনো সে সুপ্ত, কখনো সে জাগ্রত। বখে যাওয়া রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভাঙতে তার হৃদয়ে প্রতিধ্বনি জাগে। কিন্তু সে পারেনা তার সে সত্তার ডাকে সাড়া দিতে। পিছনে পুলিশ, প্রশাসন, মামলা, নির্যাতনের ভয়। শুনতে অবাক লাগতে পারে; এমতাবস্থায় কখনো কখনো সে তার রাগটাকে পুষিয়ে নেয় নিরীহ প্রাণীর হত্যা ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। ঘটনাটা হৃদয়বিদারক হলেও সত্য।
সম্প্রতি ভারতের কেরালার হাতিহত্যা ও বছর কয়েক আগে কুকুর হত্যার ঘটনাটিকে তুলে সেখানকার কম্যুনিস্ট সরকারকে অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন।কেরালায় সকল মানুষের হাতি খুব আদরের একটা প্রাণী। মানুষের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কারণে হাতিটি মরলে সত্যিই তা হবে খুব মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক একটি ঘটনা।কেরালা ভারতের এমন একটি রাজ্য যেখানকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক উন্নত। গোটা ভারত যেখানে করোনায় হিমশিম খাচ্ছে সেখানে কেরালার সরকার ও জনগণ অনেকটা সফলতার সাথে সে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছে। কেরালায় কম্যুনিস্ট সরকার ক্ষমতায় আছে বটে; তবে ভারত নামক গোটা দেশটা বুর্জোয়াতন্ত্রের ধারক ও বাহক, কেরালা নামের ছোট দ্বীপটাও তার বাইরে নয়। পশ্চিমবঙ্গেও দীর্ঘদিন কম্যুনিস্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল, তার মানে এই নয় যে পশ্চিমবঙ্গেসমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে গিয়েছিল। অনতিদূরের বিষাক্ত বাতাসের কারণে কেরালার নাগরিকদের গাঁয়েও রয়েছে পুঁজিবাদের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ঘা।রাশিয়া (১৯১৭-১৯৯১) ও চীনে (১৯৪৯-১৯৭৬) সমাজতন্ত্র অনেক আগেই শেষ হয়েছে।তবে দীর্ঘদিনের সমাজতন্ত্রের অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে। চীন প্রথম দিকে অবহেলা করলেও, পরে ঠিকই করোনা পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিউবা, আমেরিকা যাকে একঘরে করে রেখেছে; সেদেশে করোনা বিপর্যয়তো নেই-ই; বরং তারা নিজেদের ডাক্তার পাঠিয়ে ইতালি, এঙ্গোলাসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে সাহায্যকরে চলেছেন। সেখানকার চিকিৎসাব্যবস্থা পৃথিবীসেরা। সেখানে প্রতিটি মানুষের চিকিৎসা রাষ্ট্র নিশ্চিত করে থাকে। দেশটিতে কয়েক মাস অন্তর প্রতিটি মানুষেরস্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়।ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকারও পরিস্থিতি দারুণভাবে সামাল দিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক অবয়বে গড়ে উঠা সমাজ ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নরওয়ে ও ডেনমার্ক; সেখানেও করোনা প্রাদুর্ভাব অনেক কম। অন্যদিকে, এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র আমেরিকা চরম ব্যর্থ একটি দেশ।
পুঁজিবাদ গোটা বিশ্বকে তার থাবায় বন্দী করে রেখেছে। হাতে গোনা কয়েকটা লোকের কাছে আজ পৃথিবীর প্রায় সবটা সম্পদ। অসহায় গরিব মানুষগুলো আরো অসহায় হয়ে পড়ছে। তখন মানুষ তার বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। সম্প্রতি আমেরিকায়জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনাটিও এর বাইরে কিছু নয়।কৃষ্ণাঙ্গরা যেমন সেখানে নিষ্পেষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত; তেমনি গোটা পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষ আজ পুঁজিবাদের জালে একইভাবে নির্যাতিত ও নিপীড়িত।
হাতি হত্যা হোক, অন্য যেকোনো বন্যপ্রাণী হত্যা হোক কিংবা শোষিত সমাজের যেকোনো মানুষের হত্যাই হোক; আমাদের প্রতিবাদ হোক সবখানেই। শোষিত—বঞ্চিত—লাঞ্চিত সকল মানুষের কণ্ঠস্বর যখন এক বেদীতে মিলিত হয়ে শোষকশক্তি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে তখনি একমাত্র মুক্তির রাস্তাটা দেখা সম্ভবপর হবে।
লেখক