শতবর্ষে হেমন্ত
আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে, ১৯২০ সালের ১৬ জুন, বেনারসের এক প্রখ্যাত চিকিৎসকের বাড়িতে তাঁর কন্যার গর্ভে জন্ম নেয় এক পুত্রসন্তান, নাম হেমন্ত। সেই শিশু যে কালক্রমে তার স্বর্ণকণ্ঠ দিয়ে ভুবন ভোলাবে, এমন কোনও ইঙ্গিত কিন্তু কেউই পান নি। কলকাতায় বেড়ে ওঠা, প্রথমে নাসিরুদ্দিন স্কুল ও পরে ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশনে শিক্ষালাভ। সেসময় তাঁর দুই ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর নাম জানেন? কিংবদন্তী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, এবং প্রখ্যাত লেখক সন্তোষকুমার ঘোষ। শোনা যায়, অদৃষ্টের অদ্ভুত খেয়ালে এই তিন কিশোরের মধ্যে তখন গায়ক হিসেবে পরিচিত ছিল সুভাষ! ওদিকে সন্তোষ কবিতা লিখত, আর হেমন্ত? সে ছিল ছোটগল্প লেখক!
এই জড়িয়ে যাওয়া তারের জট কবে খুলেছিল জানা নেই, তবে দ্বাদশ শ্রেণীর পর তৎকালীন বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)-এ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন হেমন্ত। সেকথা অনেকেরই হয়তো জানা। তিনি যে তাঁর পিতার প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ না করেই সঙ্গীতের প্রবলতর আকর্ষণে উচ্চশিক্ষায় ইতি টানেন, তাও হয়তো জানেন কেউ কেউ। তবে মজাটা হলো, তখনও লেখক হওয়ার বাসনাও একেবারে জলাঞ্জলি দেন নি হেমন্ত। জনপ্রিয় ‘দেশ’ পত্রিকায় একটি গল্প ছাপিয়েও ফেলেছিলেন, তবে এরপর আর কোনোরকম ‘বিচ্যুতির’ খবর পাওয়া যায় না। মোটামুটি ত্রিশের দশকের শেষ থেকে ১৯৮৯ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অবিচল থাকে তাঁর সঙ্গীতের সাধনা।
প্রথম রেডিওতে গান
লেখা না থাক, সুভাষ রয়ে যান তাঁর জীবনে। সুভাষের উৎসাহেই ১৯৩৫ সালে প্রথম অল ইন্ডিয়া রেডিওর জন্য গান রেকর্ড করেন হেমন্ত। গানের প্রথম লাইন ছিল, ‘আমার গানেতে এলে নবরূপী চিরন্তনী’। এ সময় হেমন্তের শিক্ষাগুরুর ভূমিকা নিয়েছিলেন শৈলেশ দত্তগুপ্ত, তবে হেমন্ত নিজের গানের ধাঁচ তৈরি করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম গায়ক পঙ্কজ মল্লিকের অনুকরণে। এতটাই, যে তাঁকে ‘ছোট পঙ্কজ’ বলে ডাকা হতো! আশির দশকে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে হেমন্ত জানিয়েছিলেন যে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ’র কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিমও শুরু করেন তিনি, তবে ফৈয়াজ খাঁ’র অকাল প্রয়াণ সেই শিক্ষায় ইতি টেনে দেয়।
প্রথম বাংলা রেকর্ড
১৯৩৭ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়ার মালিকানাধীন কলাম্বিয়া লেবেল তাঁকে দিয়ে রেকর্ড করায় শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে দুটি নন-ফিল্ম গান, ‘জানিতে যদি গো তুমি’ এবং ‘বলো গো বলো মোরে’। তারপর থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত প্রতি বছর গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়ার জন্য তিনি নন-ফিল্ম গান রেকর্ড করে গেছেন।
প্রথম হিন্দি রেকর্ড
হেমন্তের প্রথম হিন্দি গান ছিল ‘কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে’ এবং ‘ও প্রীত নিভানেওয়ালি’, সৌজন্যে ফের কলাম্বিয়া, সন ১৯৪০। এই গান দুটির সুর করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত, কথা লিখেছিলেন ফৈয়াজ হাশমি।
প্রথম ছায়াছবির গান, প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত
১৯৪১ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘নিমাই সন্যাস’-এ হরিপ্রসন্ন দাসের সুরে প্রথমবার বাংলা ছবিতে গান করেন হেমন্ত। হিন্দিতে প্রথম ছবির গান ১৯৪৪ সালে, ‘ইরাদা’ ছবির জন্য, পণ্ডিত অমরনাথের সুরে। সেই একই বছরে তিনি প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেন, তাও ছায়াছবির জন্যই। ছবি ‘প্রিয় বান্ধবী’, গান ‘পথের শেষ কোথায়’।
ফের একবার ১৯৪৪-এই কলাম্বিয়ার সঙ্গে তিনি রেকর্ড করেন তাঁর প্রথম ফিল্ম-বহির্ভূত দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘আমার আর হবে না দেরি’ এবং ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’। এর আগে অল ইন্ডিয়া রেডিওর জন্য তিনি রেকর্ড করেছিলেন ‘আমার মল্লিকাবনে’। দুর্ভাগ্যবশত, সেই রেকর্ডিংটি চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে।
প্রথম গানের সুর
১৯৪৪ হেমন্তের জীবনে অনেকগুলি মাইলফলক গড়ে দেয়, কারণ সে বছরই বাংলায় প্রথম তিনি নিজের জন্য সুর করেন দুটি আধুনিক গানের, ‘কথা কয়ো নাকো শুধু শোনো’ এবং ‘আমার বিরহ আকাশে প্রিয়া’। এরপর স্বাধীনতার বছর, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে প্রথম বাংলা ছবিতে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে। তখন পর্যন্ত সমালোচকরা তাঁর গানের প্রশংসা করলেও, সেভাবে জনপ্রিয় হন নি এই কিংবদন্তী। কিন্তু ছবিটা এবার পাল্টাতে চলেছিল।
গাঁয়ের বধূ
চল্লিশের দশকেই ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন বা আইপিটিএ-র সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠেছিলেন যুবক হেমন্ত। আইপিটিএ গড়ে ওঠার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে ১৯৪৩ সালের বাংলার ভয়াবহ মন্বন্তর তথা দুর্ভিক্ষ, যা প্রতিরোধ করার কোনও চেষ্টা করে নি ব্রিটিশ প্রশাসন এবং অর্থবান ভারতীয় সমাজ। আইপিটিএ-তেই হেমন্তের আলাপ হয় আরেক গানপাগল যুবকের সঙ্গে, নাম সলিল চৌধুরী।
সলিলের কথায় ও সুরে ১৯৪৭ সালে হেমন্ত রেকর্ড করেন ‘গাঁয়ের বধূ’। ছ’মিনিটের এই গান ভেঙে দেয় প্রথাগত সঙ্গীতের প্রায় সব নিয়ম। প্রথমত, গানে বিভিন্ন ছন্দ ব্যবহারের রীতি কোনোদিন ছিল না, বাংলা গানে তো নয়ই। দ্বিতীয়ত, তখন পর্যন্ত বাংলা গান ছিল কাব্যিক, রোম্যান্টিক। সেখানে এক বর্ধিষ্ণু ঘরের পল্লীবধূর দিনলিপি, যা ছারখার করে দেয় দুর্ভিক্ষের দানব, তা নিয়ে যে আদৌ গান হতে পারে, এমনটা কেউ ভাবতেই পারেন নি।
কিন্তু গানটির অভাবনীয় জনপ্রিয়তা প্রায় রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেয় সলিল এবং হেমন্তকে, শুধু বাংলায় নয়, গোটা পূর্ব ভারতেই। এবং হেমন্তকে বসিয়ে দেয় তাঁর সমসাময়িক গায়কদের অনেক ওপরের আসনে। পরবর্তীকালে একের পর এক গানে জুটি বাঁধেন দুজনে, এবং তাঁদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে নি একটি দিনের জন্যও।
মুম্বই যাত্রা, প্রথম ফিল্মফেয়ার
তখন বাংলা গানে নিয়মিত সুর করছেন হেমন্ত, সেসময় পরিচালক হেমেন গুপ্ত তাঁকে ডেকে নিলেন মুম্বইতে, তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি, ফিল্মিস্তান স্টুডিও প্রযোজিত ‘আনন্দমঠ’-এ সুর করতে। সেইমত ১৯৫১ সালে মুম্বই পাড়ি দিলেন হেমন্ত, যোগ দিলেন ফিল্মিস্তানে, পরের বছর মুক্তি পেল ‘আনন্দমঠ’। ‘আনন্দমঠ’-এর গান খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও একটি গান সকলের মনে রয়ে গেল – লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘বন্দে মাতরম’।
ফিল্মিস্তানের আরও কিছু ছবিতে সুর দিচ্ছিলেন হেমন্ত, যদিও সেরকম সফল হচ্ছিল না সেসব ছবি। তবে পাশাপাশি যেটা হচ্ছিল, তা হলো হিন্দি ছবিতে প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে ‘হেমন্ত কুমারের’ বাড়তে থাকা চাহিদা, যা জন্ম দেয় কিছু কালজয়ী গানের। শচীন দেববর্মণের সুরে দেব আনন্দের লিপ-এ তিনি গাইলেন ‘জাল’ ছবিতে ‘ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদনী ফির কাহাঁ’, ‘হাউজ নং ৪৪’-এ ‘চুপ হ্যায় ধরতি’, ‘সোলভা সাল’ ছবিতে ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা’, ‘ফান্টুশ’ ছবিতে ‘তেরি দুনিয়া মে জিনে সে’, এবং ‘বাত এক রাত কি’ ছবিতে ‘না তুম হামে জানো’-র মতো চিরসবুজ গান।
এছাড়াও পঞ্চাশের দশকে প্রদীপ কুমার (‘নাগিন’, ‘ডিটেকটিভ’), সুনীল দত্ত (‘দুনিয়া ঝুকতি হ্যায়’), এবং ষাটের দশকে বিশ্বজিৎ (‘বিস সাল বাদ’, ‘বিন বাদল বরসাত’, ‘কোহরা’) এবং ধর্মেন্দ্রর (‘অনুপমা’) জন্যও প্লেব্যাক করেন তিনি। পাশাপাশি এই সব ছবিতেই সুরও করেন।
তাঁর সুরে ‘নাগিন’ ছবির গান এমনই জনপ্রিয় হয় যে শুধুমাত্র গানের জোরেই বক্স-অফিসে ঝড় তুলে দেয় ছবিটি। এবং এর ফলেই জীবনের প্রথম ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর সম্মানে ভূষিত হন ১৯৫৫ সালে।
উত্তম সংবাদ
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবনের মাইলফলক নিয়ে লেখা, অথচ উত্তমকুমারের নামগন্ধ নেই তাতে। ঘোর অনাচার। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি প্রতিষ্ঠিত গায়ক-সুরকারদের দলে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন হেমন্ত। কী ফিল্মের গান, কী রবীন্দ্রসঙ্গীত, তাঁর চাহিদা অব্যাহত। আর কেউ ‘ছোট পঙ্কজ’ বলে ডাকে না তখন, বরং সসম্মানে পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে একাসনে বসানো হয় তাঁকে।
ওদিকে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, এদিকে সেবছরই একটি বাংলা ছবির কাজ শুরু হলো। ছবির নাম ‘শাপমোচন’। ছবিতে অভিনয় করছেন উত্তমকুমার, যিনি তখন ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের পায়ের তলার মাটি মজবুত করার চেষ্টায় রয়েছেন। ঠিক হলো, তাঁর প্লেব্যাকে মোট চারটি গান গাইবেন হেমন্ত। এবং শুরু হলো আরেক জুটির স্বর্ণযুগ। পরবর্তী দশক বাংলা ছবির জগতে দাপিয়ে বেড়ান হেমন্ত-উত্তম, যে আখ্যান লিখতে শুরু করলে বই হয়ে যাবে। এটুকু বললেই যথেষ্ট, আক্ষরিক অর্থেই একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা দুজন। গায়ক এবং অভিনেতার এই আশ্চর্য পরস্পর-নির্ভরতা কদাচিতই দেখা গিয়েছে এদেশে।
পঞ্চাশের দশকের শেষদিক থেকে শুরু হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কেরিয়ারে ক্রমাগত উত্থান। ছবির গান, আধুনিক, রবীন্দ্রসঙ্গীত, সর্বত্রই তাঁর জয়জয়কার, তা গায়ক হিসেবেই হোক বা সুরকার। এতরকম গায়কীর মধ্যে এই অনায়াস বিচরণ অত্যন্ত বিরল। এই আবহ বজায় থাকে আগামী এক দশক, তবে সেই কাহিনী আরেকদিনের জন্য থাক। আমাদের আজকের ‘প্রথম সবকিছুর’ উপাখ্যানে স্থান সংকুলান।
পরিশেষে, প্রথম প্রযোজনা
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে হেমন্ত-বেলা প্রোডাকশনস-এর নামে ছবি প্রযোজনার কাজে হাত দেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এবং প্রথম ছবিতেই বাজিমাত, মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৯)। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এক চিনে ফেরিওয়ালার কাহিনী মন জয় করে সাধারণ দর্শক এবং সমালোচকেরও। যার জেরে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক জিতে নেয় এই ছবি।
পরবর্তী দশকে নিজের সংস্থার নাম বদলে গীতাঞ্জলী প্রোডাকশনস করেন হেমন্ত, এবং ‘বিস সাল বাদ’, ‘কোহরা’, ‘বিবি আউর মাকান’, ‘ফারার’, ‘রাহগির’, এবং ‘খামোশি’-র মতো ছবি প্রযোজনা করেন। প্রতিটি ছবির গানের সুরও করেন তিনি, তবে ‘বিস সাল বাদ’ এবং ‘খামোশি’ বাদে বক্স-অফিসে তেমন সাফল্যের মুখ দেখে নি তাঁর প্রযোজিত কোনও ছবি।
![ইরাবতী নিউজ ডেস্ক](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2021/12/irabotee-cover-e1640636602578-150x150.jpg)
বিশ্বের সর্বশেষ খবর, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, ভিডিও, অডিও এবং ফিচারের জন্যে ইরাবতী নিউজ ডেস্ক। খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য সহ নানা বিষয়ে ফিচার ও বিশ্লেষণ।