| 27 জানুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: ই…র…র! । ফারুক আহমেদ

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

আমার কথা কেউ বুঝতে পারছে না! আমার কথা ইরর শোনাচ্ছে। চিত্রকলার বিমূর্তের মতো- রেখা থেকে, রঙ থেকে, টান থেকে কিছু বুঝে নেওয়া, কিন্তু দৃশ্যমান কোন অর্থ নাই। আমার অবস্থা দাঁড়িয়েছে সে রকম। আমি একটি বিমূর্ত মানে অ্যাবস্ট্রাক্ট মালে পরিণত হয়েছি!

গত রাতে প্রথমবারের মতো ব্যাপারটা টের পাওয়া গেল। মনে হলো, রঞ্জনা আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে। ফোনে যখন তাকে বললাম, চল সকালে আমরা বিয়ে করে ফেলি।

উত্তরে সে বলে, কী বলো বুঝতে পারি না।

আমি রঞ্জনার কথায় হেসে উঠি। বলি, তোমাকে বিয়ের কথা বললে কানে শুনতে পাও না, এই অসুখটা তোমার ছাড়ানো দরকার।

সে বলে, তোমার ফোন বোধহয় সমস্যা করছে, কথা বুঝতে পারছি না কেন?

তার গলা খুব সিরিয়াস, সে আমার সঙ্গে এভাবে ঠাট্টা করতে পারে ভেবে আমার অবাক লাগে। বলি, আমার কথা বুঝতে পারছো না? আমি আজ রাতে ফ্যানে ঝুলে যাব বলে ঠিক করেছি। সেটা জানাতেই তোমাকে ফোন করা।

-আচ্ছা রাখো এখন। সকালে ফোন ঠিক করে কল দিও। বলে রঞ্জনা লাইনটা কেটে দেয়। আমি ফ্রিজ থেকে বরফ বের করি। গ্লাসে রাখা পানিতে বরফের কয়েক টুকরো ফেলে নিজের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি।

-আমি গ্রাম থেকে এসেছি। বলে কান পেতে থাকি। কানে ‘গ্রাম থেকে এসেছি’ শব্দ তিনটা ঠিক ঠিক ঢুকে পড়ে। আমি খুশিতে ঢক ঢক করে বরফের কুচি দেওয়া প্লাসের পানিটা একটানা গিলে ফেলি। খেয়ে মনে হয়, আরেকবার ঝালাই করে নিই নিজেকে। তাতে বান্ধবী যে আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে, তার প্রমাণ আরো পোক্ত হবে। বলি, আমি একটা চোরের শহরে থাকি। ছোটকালে শেখা এরকম গরুর রচনা টাইপের একটা বাক্য ঠিকঠাক অর্থ তৈরি করছে না। আমি আরো কয়েকবার বাক্যটাকে নানাভাবে বলে যাই। কিন্তু ঠিক হয় না। বরং অর্থ সরে যাচ্ছে, অন্য কোন অর্থ দাঁড়াচ্ছে। আমি যা বলছি, হুবহু তা থাকছে না। আমি হতভম্ব হয়ে ভাবলে লাগলাম, আমার স্বর, আমার কথা কে নিয়ন্ত্রণ করছে!

শব্দ ঠিকঠাক না হওয়ার কারণে বিরাট একটা উদ্বিগ্নতা কোল বালিশের মতো পাশে নিয়ে আমাকে শুয়ে পড়তে হলো। এই উদ্বিগ্নতা সকালে কী রূপ নিবে, তা ভাবতে পারছিলাম না। পরক্ষণে মনে হলো, কোথাও কোন গড়বড় হয়েছে। আমি সুস্থ-স্বাভাবিক একটা মানুষ, আমার এরকম হওয়ার কথা নয়। মনে হয়, আমার বান্ধবীর কথায় বিদ্ধ হয়ে ভাবছি, আমার কথা হচ্ছে না। এটা আসলে একটা মজা। সকালে নিশ্চয় ঠিক হয়ে যাবে।

 

দুই.

সকাল মানে আগামীকাল প্রেমিকা আমার বাসায় আসবে। সকালে উঠে এইচআর-কে ফোন করে বলতে হবে, আমার পেটের সমস্যা হয়েছে। অফিসে আসা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের ডেট যদি আগে শেষ হয়ে যায় বা কোন কারণে পণ্ড হয়, তাহলে পেটের সমস্যা ভালো হয়ে যাবে। অফিসে গিয়ে হাজির হব। তবে ভালো না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর জন্য খুব করে দোয়া করছি। এটা এক সপ্তাহ আগের প্ল্যান, আমরা দু’জন একসঙ্গে রান্নাবান্না করব। রান্না হলে পাশাপাশি বসে খাওয়া সারব, একজন আরেকজনের মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলব, সোনা খাও। আমাদের ভালোবাসার একটা মাখামাখি রূপ তাতে তৈরি হবে। এরপর আমরা বিছানায় চলে যাব। বিছানা থেকে উঠে একসঙ্গে কফি পান করব, হাত ধরে বারান্দায় বসে থাকব। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা হবে, একবার বিছানায় চলে যাওয়ার পর, কফি পান বা বারান্দায় বসা, সেসব হয় না। দু’জন দু’জনকে নিয়ে এমন মগ্ন হয়ে যাব যে, কফি পান বা বারান্দায় বসা- এরকম কমজোর বিষয়ের কথা আর মনে থাকবে না।

 

তিন.

আমার পেটে গণ্ডগোল হয়েছে, এই কথাটা জানাতে এইচআর-কে ফোন করি। কিন্তু এইচআরের রহমান ভাই বললেন, আপনার কথা কিছু বুঝা যাচ্ছে না। আমি ফোন কেটে দিয়ে আবার কল করি। এবারও তিনি আমাকে বলেন হুবহু আগের কথাগুলো, আপনার কথা কিছু বুঝা যাচ্ছে না।

ঘড়িতে সকাল নয়টা। রঞ্জনার আসার কথা সাড়ে দশটায়। আমার মনে হলো, একটা সিএনজি নিয়ে অফিসে চলে যাই। আড়াইটায় জরুরি মিটিং। এ কারণে সমস্যাটা জটিল হলো। বিনা নোটিশে না গেলে যেকোন দিক থেকে ঝামেলা এসে ঘাড়ের ওপর পড়তে পারে। সিএনজি আপ-ডাউন করে ফিরে আসব। তাহলে হয়তো দেড় ঘন্টায় ফিরে আসা সম্ভব হবে। কিন্তু যে কারণটা দেখিয়ে আজ ছুটি নেওয়ার কথা, সেটা মাঠে মারা গেল। এখন অন্য কোন কারণ অনুসন্ধান করতে হবে এবং সেটা হতে হবে এর থেকে অনেক বেশি মোক্ষম। অন্যথা যদি বলে, না মিস্টার রনি, আপনার আজ ছুটি হবে না। আপনাকে মিটিংয়ে থাকতেই হবে। তাহলে চাকুরি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। এই যে একটা সাতাশ বছরের তরুণ। এই শহরে যে মাসের পর মাস অবদমন চেপে রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই অবদমন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চাইতে জরুরি আর কী কাজ হতে পারে? কিন্তু এই কথাটা বলা যাবে না, এই কথাটা বৈধ বলেই বিবেচিত হবে না। ছুটি তো অনেক দূরের বিষয়। তিন মাসের চেষ্টায় রঞ্জনাকে বাসায় আসার ব্যাপারে রাজি করানো গেল। এর মধ্যে গত সপ্তাহে একবার রাজি হয়ে বাতিল করলো। কিন্তু এবারেরটা হলে, এই বেদনা, এই অবদমন কোনকিছু দিয়েই মাটিচাপা দেওয়া যাবে না।

হুট করে তৈরি হয়ে নীচে নেমে এলাম । সিএনজি পেতেও দেরি হলো না। কিন্তু যা ঘটলো, তাতে আমার আত্মবিশ্বাস বেঘোরে মারা পড়লো। আমি এমন অবাক হলাম যে, বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতে গেলেও মানুষ এতো অবাক হবে না। সিএনজি ড্রাইভার আমার কথা বুঝতে পারছে না। তবে আমি অবাক হলেও মুচড়ে পড়লাম না। ক্রিকেটের কথা মনে হওয়ায় আমার বোর্ড সভাপতির কথা মনে পড়লো। তিনি কোন অবস্থাতেই মুচড়ে পড়েন না। একটা সমাধান তিনি আমাদের সামনে এনে হাজির করেন। দ্রুততার সঙ্গে আমি ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক এবং কলম বের করে আনি। নোটবুকের একটা পাতায় লিখি, তেজগাঁও যাবেন?

লোকটা কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, যামু, ৪০০ টাকা লাগব।

আমি হাসিমুখে বললাম, শুয়োরের বাচ্চা।

এই প্রথম আমার কথা বুঝতে পারছে না জেনে ভালো লাগলো। লোকটা বুঝে গেছে সে যা চাইবে তাই দিয়ে যাব। এ শহরের এসব সিএনজি ড্রাইভার অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে একেকজন বড় মাপের দার্শনিকের জ্ঞান অর্জন করে ফেলে। এই দার্শনিকের আবার দুই ভাগ- ভালো এবং মন্দ। আমি পেলাম মন্দটাকে।

হাত দিয়ে বারি দিলে সঙ্গে সঙ্গে লোকটা দরজা খোলে দেয়। আমি উঠে চিন্তা করতে থাকি মোক্ষম কী কারণ দেখানো যায়, যার জন্য আমাকে আজকে ছুটি মঞ্জুর করতে কোন বেগ পেতে হবে না।

আচ্ছা, ঠিক আছে। আমার মন ভালো হয়ে যায়। অনেকগুলো কারণ একসঙ্গে মাথায় ঠিক করে রাখি। এর যেকোন একটা বললেই হয়ে যাবে। মামা, ফুফু, খালা- যে কেউ একজন আইসিইউতে। আমাকে থাকতেই হবে। যেকোন সময় যেকোন কিছু ঘটে যেতে পারে।

সিএনজি অফিসের নীচে দাঁড়ালে ভাড়া পরিশোধ করে এক লাফে লিফটে উঠে পড়ি। লিফট নয় তলায় এসে পৌঁছালে নেমে সরাসরি চলে যাই এইচআর ডিপার্টমেন্টে। গিয়ে দেখি রহমান ভাই সিটে নাই। পাশের সিটে এইচআরের ডেপুটি সিরাজ বসে আছে। আমাকে দেখে বলে, ভাই, কেমন আছেন? রহমান ভাই ওয়াশরুমে গেছে।

আমি উত্তরে মুচকি হাসি। কোন উত্তর দিই না।  রহমান ভাইয়ের টেবিলের সামনে চেয়ারে বসতে বসতে রহমান ভাই চলেেআসে। আমি একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যাই, ভাই আমার আজ ছুটি দরকার, বড় খালা ল্যাব এইডে ভর্তি, আইসিইউতে আছে। আমার এগারোটার মধ্যে হাসপাতালে খাকতে হবে। আত্মীয়-স্বজন সবাই হাসপাতালে, ক্রিটিক্যাল অবস্থা।

আমার কথা শেষ করে রহমান ভাইয়ের উত্তরের আশায় তার দিকে মনোযোগ দিই। দেখি তার মুখ হা হয়ে আছে, কপালজুড়ে ভাঁজ। আমার বুকটা কেঁপে ওঠে।

-ভাই, কী বলছেন আপনি, কিছুই বুঝতে পারছি না তো।’ রহমান ভাইকে মনে হলো আমার থেকেও বেশি বিচলিত হয়ে পড়েছেন।

আমার রাগে শরীর কাঁপতে থাকে। রাগ বা হতাশা কোন একটা আমার ভেতর কাজ করছে। নির্দিষ্ট করে ধরতে পারছি না। আমি বলি, শুয়োরের বাচ্চা, এইচআর চালাস, কথা বুঝিস না। কথা না বুঝেই তুই সবার সঙ্গে মাতাব্বরি করিস!

আমার এই রাগের ভঙ্গিটাও বুঝতে পারলো না রহমান ভাই। উনি মনে হলো এবার বিপন্ন বোধ করছেন। ডেপুটি সিরাজকেও মনে হলো হতবিহ্বল হয়ে এদিকে ঝুঁকে পড়েছে।

এর মধ্যে দু’জন চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারপর একসঙ্গে সিট থেকে উঠে রহমান এবং সিরাজ অফিসের দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করে। আমি তাঁদের হাঁটার গতিপথ দেখেই বুঝতে পারি বসের রুমের দিকে যাচ্ছে। শরীর ঘেমে উঠেছে। মনে হলো, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক মতো কাজ করছে না।

এক ঝটকায় লিফটের সামনে চলে আসি। লিফট বারো তলা থেকে নামছে। মনে হলো, দ্রুত এলে বেঁচে যাই। লিফটে উঠতে উঠতে চোখে পড়লো, বসসহ রহমান এবং সিরাজ বিপুল উত্তেজনায় এইচআর ডিপার্টমেন্টের দিকে যাচ্ছে। আমি নেমে নোটবুকটা বের করে লিখলাম, কলাবাগান যাবে? লিখে সামনে যে সিএনজিটা পেলাম, তার ড্রাইভারের সামনে পৃষ্ঠাটা ধরলে সে সঙ্গে সঙ্গে জানাল- যাবে, ভাড়া দুইশত টাকা।

আমি কাল-বিলম্ব না করে সিএনজিতে উঠে পড়ি। আমার মনে হলো, এই লোকটা তো ভারি অভিজ্ঞ। এও মনে হলো, এই লোকের চেহারায় কোন বিস্ময় দেখা গেল না। তার মানে, এরকম মুখবন্ধ লোক সে পায়। সকালে যাকে পেয়েছিলাম, তার থেকে এ আরেকরকম দার্শনিক।

 

চার.

বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ১০.৪০ বেজে গেল। পৌঁছে দেখি রঞ্জনা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তার চেহারা কিছুটা ম্লান। আমাকে দেখে রাগত স্বরে বলল, ফোন বন্ধ কেন! কোথায় গিয়েছিলে?

একসঙ্গে দুটা প্রশ্ন ছুটে এলে উত্তরে আমি একটা হাসি বরাদ্দ করি। আমি আনন্দ-উত্তেজনায় আমার সংকটের কথা ভুলে যাই। চুপচাপ তালা খোলে ভেতরে ঢুকে পড়ি, পেছন পেছন রঞ্জনা। ব্যাগ থেকে দুটা খাবারের প্যাকেট বের করে টেবিলের ওপর রাখে সে। বলে, আজ রান্না করে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না, তাই নিয়ে এলাম। তোমার দেখি তালা খুলতেও হাত কাঁপছিল। রঞ্জনা মুচকি হাসে।

তার এই কথায় আমার ভেতর শিহরণ খেলে যায়। পুরুষ এবং নারীর যে গোপন জগৎ তা আসলে অভাবনীয়। তাদের সে অনুভূতির সঙ্গে আর কিছুর তুলনা হয় না। তার কোন ভাষা নাই। রঞ্জনা আবারও বলল, কী ব্যাপার তোমার ফোনের কী হয়েছে, রাতে কথা বুঝি নাই, এখন একদম বন্ধ!

এবার মনে হলো আমি কিছু বলি। আমার ইরর ব্যাপারটা নিশ্চয় এতোক্ষণে কেটে গেছে। ভালোবাসার কাছে ইরর তো নতজানু হয়ে মিশে যাওয়ার কথা। বললাম, তুমি এলে আমার বুকের ভেতর খৈ ফুটার মতো গোলাপ ফুটতে থাকে। দেখো বুকে নাক এনে, শুধু গোলাপের ঘ্রাণ।

রঞ্জনা এবার রহমানের মতো হয়ে গেল। রহমানের চেহারা যেমন হয়েছিল রঞ্জনারও তেমন হলো। বলল, রনি তুমি কী বলছ, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

আমি এবার চুপ করে রইলাম। মনে মনে বললাম, আমরা এখন যা করব, তার জন্য শব্দ কোন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। আমরা শব্দ থেকে বেরিয়ে শব্দহীন ভাষায় প্রবাহিত হয়ে যাব। কিন্তু এই ব্যাপারটা রঞ্জনাকে বুঝাতে পারলাম না। সে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলো। আমিও যথাসাধ্য উত্তর দিয়ে গেলাম। কিন্তু উত্তর সব ইরর হয়ে গেল। রঞ্জনা এভাবে কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে বাতচিৎ চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে বলল, আমি তাহলে যাই। আমার তো বলার কিছু নাই। ফলে এমন ঘটনায়, আমি হতবিহ্বল হয়ে নিজের ভেতর নতজানু হয়ে রইলাম। সঙ্গে টেবিলের ওপর রাখা দুইটা প্যাকেট আমাকে দেখে হাসতে লাগলো।

মনে হলো, কোন চাপ নেওয়া যাবে না। কিন্তু রঞ্জনার চলে যাওয়াটা বড় চাপ হিসেবেই আমাকে বারবার আঘাত করতে লাগলো। ঘুমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিছানায় পড়ে রইলাম। সময় কোনভাবেই কাটছে না। এমন এক অবস্থা, কোথাও যাব, তা চিন্তাই করতে পারছি না। বিকাল তিনটায় দরজায় বেল বেজে উঠলো। আমার মনে হলো রঞ্জনা এসেছে। আমি পড়িমড়ি করে দরজা খোলে দেখি, সত্যি সত্যি রঞ্জনা! ঘরে ঢুকে বলল, রেডি হও। দ্রুত।

 

পাঁচ.

আমার কোন ভাষা নেই, যা দিয়ে আমার ইচ্ছাকে জানাব। আমি তৈরি না হয়ে বসে থাকলে রঞ্জনা চলে যেতে পারে। রঞ্জনাকে হারানোর ব্যাপারটা হবে খুবই বেদনার।  তার থেকে তৈরি হয়ে ওর সঙ্গে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের। ফলে কালবিলম্ব না করে তৈরি হয়ে নিলাম। মেয়েটা আমাকে শর্তহীনভাবে ভালোবাসে। এই ব্যাপারটা তৈরি হতে হতে গুঞ্জরণের মতো আমার ভেতর বাজতে লাগলো।

আমরা দু’জন একটা সিএনজি করে পথ পার হচ্ছি। রঞ্জনা শক্ত করে তার এক হাত দিয়ে আমার একটা হাত ধরে রাখলো। এর মধ্যে সিএনজি মহাখালী ডিওএইচএসের প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছি? উত্তরে রঞ্জনা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তখন মনে হলো আমি একটা ইরর। আমার কথা হাওয়া হয়ে যাবে বা হয়ে যাচ্ছে বুদ্বুদ।

ডাক্তার সানজিদা শাহরিয়া। এরকম একটা নেমপ্লেট রাইরের দেয়ালে সাটা আছে। আমরা রিসিপশনে ঢুকে পড়ি। বুঝতে পারি, ইরর সফটওয়ার সংশোধনের একটি মিশন এটি। আমার তো এটা ঠিক হওয়া দরকার, না হলেও অসুবিধা নাই। যদি রঞ্জনা বলে, মুখবন্ধ তোমাকে কিন্তু দারুণ মনে হচ্ছে। একদম আলাদা, এরকম প্রেমিক আমার চেনা-জানা কারো নেই!

এসব ভাবছিলাম। ভাবনা থেকে বেরিয়ে একটা রুমে ঢুকে পড়লাম। হাসিমুখে একটি মানুষ আমার সামনে বসে আছেন। তিনিই বোধহয় ডা. সানজিদা শাহরিয়া। আমি একাই উনার সামনে, রঞ্জনা রিসিপশনে অপেক্ষা করছে। আসলে ভেতরে রঞ্জনা ছিল। আমি ঢুকেছি যখন, সে বেরিয়ে এলো ওই মুহূর্তে।

ডাক্তার আমার কাছে জানতে চাইলো, কোথায় সমস্যা হচ্ছে। আমি বুকে হাত দিয়ে দেখালাম- এখানে। ডাক্তার মুচকি হাসলেন। বললেন, বলেন, কী কী সমস্যা।

এই কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হলো। ভাবলাম, উনি তো জানেন আমি কথা বলতে পারছি না। তবু এরকমটা কেন করছেন। আবারও একটা মিষ্টি ধমকের স্বরে আমাকে তাগিদ দিল, বলেন।

আমি রেগে বলতে শুরু করলাম, আপনি গর্দভের মতো কথা বলছেন কেন?

আমার কথায় উনি হাসতে লাগলেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমার ইরর ব্যাপারটা নাই। আমার এমন কথায় কোন লজ্জাই হলো না। বরং খুশিতে আমি চেয়ার থেকে উঠে পড়লাম। কিন্তু ডাক্তার উঠতে দিলেন না। বললেন, বসুন।

চেয়ার থেকে উঠে পড়েছিলাম, বসতে হলো। তিনি আবারও জানতে চাইলেন, আপনার কী সমস্যা হচ্ছে।

– আমার কথা কেউ বুঝতে পারছে না।

-এই যে আমি বুঝতে পারছি। তিনি বললেন।

-তাহলে তো আমার সব ঠিক হয়ে গেছে। আমি এখন যেতে পারি?

এর উত্তরে ডাক্তার গেলেন না। বললেন, আপনার কী কী সমস্যা হয় বলেন।

আমি বলি, আমার বুকে একটা পাথর চেপে থাকে। আমি যতোক্ষণ সজাগ থাকি এ পাথরটা সরে না। মনে হয় পাথরটার ওজন কয়েক মণ হবে। শুধু নিরঞ্জনা আমার সঙ্গে থাকলে সে পাথরটা সরে যায়। আমি পালকের মতো হয়ে যাই তখন।

-আপনি এ পাথরটা নামাতে চান?

আমি বিপুলভাবে মাথা নাড়াতে থাকি। বলি, অবশ্যই।

-নামিয়ে কোথায় রাখতে চান?

-যেখান থেকে এটা আর ফেরত আসতে পারবে না।

-আচ্ছা। ডাক্তার বলেন।

আমার মনে হলো আরেকটা কথা বলা দরকার। আমি বলি, মাঝে মাঝে আমি রঞ্জনার প্রতি খুব রাগ দেখাই, নানা কারণেই এটা হয়। এই রাগের পথ না মাড়ালেও হয়। কিন্তু  আমার মনে হয় রাগটা করি। রাগটা তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। সে এসে হাত চেপে ধরে বলবে, রনি তোমার কী হয়েছে। তখন আমি আমার ভালোবাসার কথা আরো বেশি করে বলতে পারব। কিন্তু ঘটে উল্টোটা। আমাদের সম্পর্ক কয়েকদিনের জন্য ভেঙে পড়ে। আমার রাগ তাকে আমার থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নেয়।

ডাক্তার বলে, এরকম পীড়াদায়ক এবং দূরাগত সংকেত থেকে আপনার বেরিয়ে আসতে হবে।

উত্তরে আমি মাথা নাড়াই। বলি, আপনি যেভাবে বলবেন।

কিছুক্ষণ আমাকে দেখেন তিনি। মনে হলো অচেনা একটা গাছকে দেখছেন। তারপর আচমকা বলেন, আপনাদের সঙ্গে আরেকজন যে এসেছে, সে কী হয় আপনার?

ডাক্তারের এ কথায় আমার মনে হলো, ডাক্তারের মাথায়ও গণ্ডগোল আছে। আমার যেমন কথার সমস্যা, উনার মাথার। উনি কোন সমাধান করে দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। বললাম, কোথায়, আমরা দু’জনই তো এলাম।

তিনি বললেন, না, না মাঝে যে ছিল দু’জনের।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ওর নাম রনি।

তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, আচ্ছা দু’জনই রনি!

এরপর তিনি আমাকে যা করালেন, তা একরকম সাধনার মতো ব্যাপার। আমার মনে হতে লাগলো, আস্তে আস্তে জড়তা কেটে যাচ্ছে একদম। আমি যা বলছি, তাই ঠিক ঠিক উচ্চারিত হচ্ছে। আমার একটু আগের সন্দেহটা কেটে যেতে লাগলো। তিনি আমার মুখের ভাষা ঠিক করে দিতে পারছেন। এখনো সন্ধ্যা হয়নি। রঞ্জনাকে বলব, আজকের যে আয়োজনটা আমাদের ছিল, চল এটা শেষ করি, হাহা।

ডাক্তার বের হওয়ার সময় কড়াকড়িভাবে নিষেধ করে দিল, রঞ্জনার সঙ্গে আজ কোন কথা না বলতে। ডাক্তারের এমন বারণ আমাকে অবাক করলো। তার থেকে বেশি হতবিহ্বল হয়ে রইলাম। তাহলে আজ আমাদের কোনকিছু হবে না! ডাক্তার বললেন, আগামীকাল প্রথম অফিসে যাবেন, গিয়ে কথা বলে ছুটি নিবেন, তারপর বিকাল চারটায় আমার কাছে আসবেন। একাই আসবেন। রঞ্জনাকে নিয়ে আসতে হবে না।

আমি ডাক্তারের এসব উপদেশ মাথায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। তারপর চুপচাপ দু’জন সিএনজিতে পাশাপাশি বসে রইলাম। রঞ্জনা আমার হাত ধরে রাখলো। বাসায় পৌঁছে দিয়ে সে চলে গেল।

 

ছয়.

অফিসে পৌঁছামাত্র আমাকে পুরো অফিস ঘিরে ধরে। সবার চোখে কৌতূহল। আমি বললাম, রহমান ভাই গতকাল শরীর খারাপ হয়েছিল, এজন্য অফিস করতে পারি নাই।

আমার এরকম স্পষ্ট কথায় সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো। এর মধ্যে লালন বলল, রহমান ভাই আপনি রনিকে নিয়ে এরকম একটা মিথ্যা ছড়াতে পারলেন?

আমি বললাম, কী হয়েছে। বলে কথা না বাড়িয়ে আমার ডেস্কের দিকে এগোতে থাকি। ডেস্কের কাছে পৌঁছে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিই এ মুহূর্তে জটলার অবস্থা কী। মনে হলো, সবাই কেমন সন্দিহান, কেমন দিকভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যে আনন্দ-উত্তেজনা নিয়ে জড়ো হয়েছিল, তা মাঠে মারা গেল যেন।  

বিকাল চারটায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। আমি অফিস থেকে বেরিয়ে তিনটায় রঞ্জনার অফিসের নীচে চলে আসি। মনে হলো, রঞ্জনাকে শুনাই আমার পুরনো কণ্ঠস্বর। সে আমার সব বুঝতে পারুক। সে নিশ্চয় এতে আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। তার অফিসের নীচে এসে টেক্সস করলাম, রঞ্জনা, আমি তোমার অফিসের নীচে। সে উত্তরে বলে, মানে! আমি তো মিটিংয়ে, আসবে যে জানাবে না আগে? আমি লিখি, তুমি আসো মিটিং শেষ করে, কোন চাপ নাই। আস্তে ধীরে আসো। সে কোন উত্তর দেয় না।

 

সাত.

মিনিট পনেরো পর রঞ্জনা নেমে এলো। বলল, কী ব্যাপার, তোমার না চারটায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা?

আমি হাসতে হাসতে বলি, চল একটু কফি খাই। আমার কথা বুঝতে পারছিলে না। এই যে এখন সব ঠিক হয়ে গেছে ‘ আমি একটানা এই কথাগুলো বলে দেখি, রঞ্জনার কোন প্রতিক্রিয়া নাই। আমার মনে হলো, কথা তো আবারও ইরর হয়ে গেছে। রঞ্জনার কাছে এলেই কী তাহলে এমনটা হচ্ছে।

রঞ্জনা মুচকি হাসে। বলে, তোমার চারটায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। সেখানে গেলেই ভালো করতে।

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। রঞ্জনা মোবাইলে কাউকে টেক্সট লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমার মনে হয়, এখানে এক সেকেন্ডও থাকাটা ঠিক হবে না। রঞ্জনার কাছে বেশি সময় থাকা মানে, একটা ভাষাহীন বস্তু হিসেবে নিজের জীবনকে আরো দীর্ঘায়িত করা।

আমি দ্রুত তার সামনে থেকে সরে পড়ি। অভ্যাসবশত বলি, বাই। কথা হয় না। সে টেক্সট লেখা থেকে মাথা তুলে একবার আমাকে দেখে আবার লেখায় মনোযোগ দেয়। বলে, মিটিংয়ের ফিটব্যাক দিতে হচ্ছে আমাকে।

আমি ফুটপাতে নেমে আসি। ডাক্তারের কাছে আর যেতে ইচ্ছে করে না। কয়েকটা দিন ইরর হয়ে থাকি বরং। রঞ্জনার কাছে  যেহেতু, তাই অন্যদের কাছেও।

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত