আজ ২১ মে কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক ফারুক আহমেদের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
তুমি একটি ম্যাজিক
তুমি একটি ম্যাজিক;
দূর নক্ষত্রমালা তার ম্যাজিকে আমাদের
অনন্তকাল ধরে বিস্মরণে ডুবিয়ে রাখে
সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দের তুমি
পলিমাটির মতো তুলতুলে সড়কে নামিয়ে দাও;
ইশারা বলে- হাঁটো, হাঁটো, হাঁটতে থাকো।
আমার পা অচল, এ পথ ধরে যাব কোথায় আমি?
তবু অচেনা গল্প দিয়ে হাঁটি, হাঁটতে থাকি
অচেনা গল্প হলো দীর্ঘশ্বাসের মতো
শান্তি ও হতাশার দ্বৈরথে তৈরি হয়।
তুমি একটি ম্যাজিক;
বাষ্পরুদ্ধ বিকালকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলে
বিকাল ফেরত আসে না বহু বহু দিন ও রাত্রি।
অপরিচয় গল্প ধরে হাঁটি, হাঁটতেই থাকি
হাঁটতে হাঁটতে ভাবি তুমি একটি ম্যাজিক
তা জানার আগে আমি কোথায় ছিলাম, বলো।
শহর সেদ্ধ হচ্ছে গরম কড়াইয়ে, উত্তাপ বেড়ে বেড়ে
পুরো সেদ্ধ হবার পর শহরটাকে
খেয়ে সোজাসুজি বাড়ি চলে যাব।
জোছনার তোড়া বা উপমাফুল
বালক, জ্যোৎস্না কেটে কার জন্য তোড়া বানাচ্ছো
কার জন্য বারান্দায় চাষ করছো উপমাফুল।
বালক, ভাবছো তুমি নদীগুলোকে শুশ্রƒষা করে
তার ভেতর ঢেউ ফলাবে, ধরবে প্রাণবন্ত স্রোত।
বালক, যে শহর এখন ফুলেল উপত্যকার মতো সুধাময়
যে শহর ধরা দিচ্ছে একটি নীরব কচ্ছপের মতো;
তুমি ভাবছো, তাকে নিয়ে যাবে হোমারের কাছে
ভাবছো তাকে নিয়ে বসবে এরিস্টটলের সামনে।
তারপর চাষ করবে কবিতা, দর্শন, চিত্রকলা, সুর;
আর বরশি ফেলে ধরবে ছোটবড় হাসি-ঐশ্বর্য।
বালক, কত কত দিন খুন হয়েছে ধুলোর ভেতর;
তুমি কি জানো, লক্ষ লক্ষ সংসার মেশিনে ঢুকে
বেরিয়েছে ডলার হয়ে, বেরিয়েছে কান্না হয়ে;
বালক, তুমি উপমাফুল চাষ করো, ক্লান্ত হও
আর ভাব, জোৎস্নার তোড়া বানিয়ে বলবে
তোমাকে দিলাম, তোমার কোন অসুখ নাই।
শীতকাল এলেই আমি পুরুষ
শীতকাল এলেই আমি নগ্ন হয়ে যাই
যেন প্রকৃতি, মানুষ নই-
পাতা ঝরার মতো আমার পোশাক একে একে ঝরে পড়ে।
শীত এলেই খুব করে গণিকাদের কথা মনে পড়ে যায়,
যাদের হাসির সঙ্গে আমি আস্ত সবুজ সবজির মাঠ মিলিয়ে ফেলি।
আর নিকটাপন্ন হওয়ামাত্র ছুটির ঘন্টা বাজলে শিশুরা যেমন
উৎফুল্লতায় ভেসে যায়, তেমনি পড়ে যাই করাতকলের নীচে।
সূর্য ডোবার মতো আমার ভণিতা সব ডুবে গিয়ে একে একে
উঠে আসে ক্ষুধিত কথার প্রজাকূল, পথে ঘুরে বেড়ানো অনুভূতিদল।
মনে হয় ফোন করি, বলি, কেমন আছো, কার সঙ্গে আছো।
শীত এলে খুব করে গণিকাদের কথা মনে পড়ে, যাদের মুখ
ছিল অবিকল প্রেমিকার মতো।
শীত এলে শর্ষে ফুলের বড়া খেতে ইচ্ছা করে,
কিছুদিনের জন্য কুয়াশায় গা ঢাকা দিতে ইচ্ছা করে
সব সময় ভাবি সঙ্গে একটা প্রেমিকা থাকুক, তার ঠোঁট ভরে চুমু দিই।
শীত এলে এসব বেলেল্লাপনা আমাকে নিয়ে নিয়ে,
নিয়ে একটা মধু ভরা জাহাজে উঠিয়ে ঘাটের দিকে যেতে চায়।
কিন্তু আমি তো শর্ষেফুলের বড়ার জন্য ছটফট করি, একটা প্রেমিকার
মুখের জন্য ছটফট করি, ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়া ঠোঁটের জন্য।
শীতকালে আমি এসবের জন্য পাগল হয়ে ওঠি। শীতকাল আমার এসব
ইচ্ছা পূরণ করে দেয়। শীতকাল আমার কোন ইচ্ছাই পূরণ করতে পারে না।
শুধু অবিকল…
শীতকাল এলেই আমি প্রেমিক হয়ে যাই, দেশ প্রেমিকের মতো-
আমার খুব করে দেশের মুখ দেখতে ইচ্ছা করে, ফোন করে জেনে
নিতে ইচ্ছা করে, কোথায় আছে, কেমন আছে, কার কাছে আছে?
ফোন করতে ইচ্ছা করে, খুঁজ জানতে ইচ্ছা করে খুব-
শীত এলে আমি নগ্ন হয়ে যাই, আমার কোন আবরণ থাকে না,
ভণিতা কোনমতেই আমার কোলে এসে বসতে পারে না-
আর শুধু গণিকাদের কথা মনে পড়ে,
যাদের মুখ ছিল অবিকল প্রেমিকার মতো।
মটকানো খেলা
একটা দুপুর এসে সকালের ঘাড় মটকে দেয়
রয়েল বেঙ্গল টাইগার মটকে দেয় চিত্রাহরিণকেÑ
বিরোধীদল মটকে দেয় সরকারি দলের ঘাড়।
বয়স এসে মটকে যায় কৈশোরকে
একখণ্ড মেঘ মটকায় অনেকটা রোদের ঘাড়
একটা কান্না এসে হাসির ঘাড় মটকে ফেলে
একটা পিএইচডি মটকে দেয় কবিতার ঘাড়
একজন কথা এসে আরেকজন কথার ঘাড় মটকায়।
আবার একটা নদী সমুদ্রে যায় নিজের ঘাড় মটকাতে
একজন মাতাল পানপাত্রে নিজের ঘাড়টাকে মটকায়,
দিন সন্ধ্যায় যায় নিজের ঘাড়টাকে অন্ধকারের হাতে তুলে দিতেÑ
এভাবে অনেক মটকানোর খেলা চলতে থাকে।
কিন্তু দেখুন একখণ্ড মেঘ কতক্ষণ রোদের ঘাড় মটকাতে সক্ষম?
ঘুরে যায়, কান্না হাসির দিকে ঘুরে উল্টো মটকে দেয়। ফলে
ভাবি বিরান হওয়া ভূমিকে, অনেকটা সবুজ এসে ঘাড় মটকাবে।
একদঙ্গল আনন্দ বেদনার ঘাড়ে এমন চাপ দিবে যে,
সে তিরোহিত হবে অনন্ত আনন্দের দিকে।
এভাবে মটকানোর খেলা একটা দারুন তলোয়ার পেয়ে যাবে
যার দুদিক ধারালো, দু’দিক গড়া জীবন দিয়ে।
আশ্চর্য নদী
আমার বালিশের নীচে চাপা পড়ে আছে একটা নদী
বিভূর ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠলে সে নদীর আর্তনাদ
শোনা যায়, শোনা যায় পরম্পরার আকুতি। তবে কখনও বালিশে
হাত ঢুকিয়ে নদীকে বের করে নিয়ে আসতে চাইলে
সে আর দৃশ্যমান থাকে না- অদৃশ্যে লোপাট হয়।
আমি বার বার বলি দৃশ্যতে আসো; হোক মেলবন্ধনের
নিপাট যোজন। এভিন্যুতে বৃষ্টি শেষে গাছের পাতাগুলো
যেমন চকচক করে, তেমনি তোমার উজ্জ্বল মুখ রচিত হোক,
বাদাম ভাঙার মতো আমাদের যোজন মুহূর্তগুলো ভেঙে ভেঙে
বের করে আনি সারাৎসার। অথচ নদী কোন দিক থেকে
কোন দিকে চলে গেল, শশাঙ্ক আর তাকে শাসন করতে পারলো
না, বিপাশা নামে যে নদী, সেও মুখ থুবড়ে পড়লো এর সামনে।
জৈষ্ঠ্যের খরতাপে মাঠ ফেটে কৃষকের কপালে ছোট ছোট
অগণিত দেয়াল। অথচ তখনও বহমান ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ
তোলে বালিশের নীচে খেলছে আমার আশ্চর্য নদী। অন্যদিকে
দেখো তোমার বালিশের নীচে আত্মার দীর্ঘ আকুতি। তার চেয়ে
বরং চলো নদীতে ছেড়ে দিই আকুতি, গোসল করুক, ভিজুক।
বর্ষাতো ঘড়ির কাটার মতো কৃতদাস হয়ে আসছে না।
রাগী কবিতা
শব্দেরা আমার কাছে আসে, আর কেউ আসে না। শব্দেরা আসে বলে ওরাই আমার কবিতায় ঢুকে যায়। শব্দ না এসে যদি আসে ঘ্রাণ, তাহলে তাই আমার কবিতায় ঢুকে যাবে। অথবা একটি মায়াবী দ্বীপের গৃহসুখবিস্তারী মুখ এসে যদি বলে এলাম, তাহলে আমার কবিতায় তার জায়গা অবধারিত। কিন্তু এসব নয়, আমার কবিতায় আসে শব্দ, অগণন শব্দ। ফলে আমি ওদের ঢুকিয়ে দিই আমার কবিতায়।
মনে হয় গণধর্ষণের পর বালিকার যোনিপথ থেকে চুইয়ে পড়া রক্তের মতো লাল আমাদের যে প্রাত্যাহিকতা তা এলে আমার কবিতায় ঢুকে যাবে। এমনকী সেই রাষ্ট্র যার মস্তক কাটা পড়েছে তা এলেও আমার কবিতায় ঢুকে যেতে পারবে অনায়াসে। অথবা ধরো একটা ঋতু এলো- বর্ষাঋতু। কুৎসা রটানোর মতো অতিদ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়া বৃষ্টি একের পর এক চেপে ধরছে সবুজ ঘাসের ঘাড়। যেই ঘাস মাথা তুলছে অমনি আবার। সে ঋতু এলে তাও আমার কবিতায় ঢুকে যাবে (ঋতুসংহার নামে)। দূরাগত, যা আর স্মৃতিতে নেই, সে পলাতকা-প্রতারক পাপিয়া পিউকাহা বলে ডেকে উঠলে, কৈশোরের স্মৃতি হয়ে ঢুকে যাবে আমার কবিতায়। ঢুকে যাবে টুনটুনির নাচের মুগ্ধতা।
ঘন্টা বাজিয়ে দাও। আর না হয় প্রেম, যার প্রতিশব্দ অভিনয়। সংসার, যার প্রতিশব্দ খুন। নগর, যার প্রতিশব্দ প্রতারক। নিরাপত্তা, যার প্রতিশব্দ ধর্ষণ। সরকার, যার প্রতিশব্দ গোল্লাছুট- এরকম অনেক শব্দ আমার কবিতায় ঢুকে যাবে। ফলে তার আগেই ঘন্টা বাজিয়ে দাও।
আমার কাছে শব্দেরাই আসে আর কিছু আসে না। এলে পেরেকের মতো আমি ওদের গেথে দেব আমার কবিতায়।
এসো
শান্তি তো এখানে পড়ে আছে, কুড়িয়ে নিলেই হয়।
ওই যে হোগলাবনের ভেতর একটা হাঁস সাঁতরাচ্ছে
তার পেছন পেছন শান্তির রেখা পথ করে নিচ্ছে।
সেখানে এসে দাঁড়াতে হবে।
শূন্য মাঠের ভেতর কুয়াশা জড়ানো বিকালে
একটু একটু করে শান্তির শিশির জড়ো হচ্ছে-
ইঁদুরেরা বিকালকে সন্ধ্যার গর্তে টেনে নেওয়ার আগেই
সেখানে এসে দাঁড়াতে হবে।
হেমন্তবনে বাতাস এসে পাতা আর পাতা
ঝরিয়ে বলল, এতো তনুভূত শান্তির ঝরে পড়া।
সেখানে এসে দাঁড়াতে হবে।
যে দিগন্তে সাতরঙের প্রদর্শনী চলে, তার পাশে
নদীবায়ুঘেরা অধরউপকূলে শান্তি জড়িয়ে পড়ে
সেখানে এসে দাঁড়াতে হবে, আবার।
সুতরাং এসো।
কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।