আমি কবি ফাউজুল কবিরকে এখনো বুঝিনি, এখনো চিনে উঠতে পারিনি পুরোপুরি। অথচ এই যে আধচেনা রহস্যময়তায় মগ্ন এই কবিকে আমি খুব ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। এই ‘কবির বাড়ি মেঘের নীলে’। বিশ্বাস করেন, তিনি নিজেই তা বলেছেন ২০০৯ সালে। তাঁর কিশোর-উপযোগী কবিতার সংকলনে। এর আগে আমরা দেখেছি কবি ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’ হয়ে ঘুরে ফিরেছেন শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে সেই ১৯৯৭ সালে।
যেদিন দূর থেকে প্রথম এই সুন্দরকান্তি সুউজ্জ্বল কবিকে দেখি, এক অমোঘ আকর্ষণ আমি বোধ করেছিলাম। যেন কবিতার রাজপুত্তুর, এক গভীর মগ্নতায় যিনি নিজের সৌন্দর্যকে ১৯৯৬ সালে ব্যাখ্যা করেন ‘আমার সুন্দর আমার টেন্টেলাস’ বলে। অথচ ১৯৮৭ সাল থেকে আমি তাঁকে দেখেছি কবিতার সাথে, কবিদের সভা সমাবেশে। কিন্তু কিতাবের সাথে প্রথম দেখা মিললো ১৯৯৬ সালে। কবি ফাউজুল কবিরের জন্ম ৭ আগস্ট ১৯৫৫ চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার উত্তর ইছাখালী গ্রামে। সত্তুর দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি প্রথম গ্রন্থাকারে আত্মপ্রকাশ করেন নব্বইয়ের দশকে এসে। ভাবা যায়! একি অধ্যবসায়? নাকি অবহেলা—হেলাফেলা?
এই মুক্তিযোদ্ধা কবির জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কেটেছে অধ্যয়ন এবং নিরন্তর অধ্যয়নে। বাংলা হোটেলে একটা কক্ষে কতো বিনিদ্র রজনী তিনি পার করেছেন বই আর ধূম্রশলাকার প্রণোদনায়। সাথে কিছুদিনের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতেও নিবিষ্টতা ছিলো তাঁর। তবে দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের বছরগুলো তিনি অপচয় করেছেন তথাকথিত শিক্ষকসমিতি-ধরনের গোষ্ঠীস্বার্থের অর্থহীন গোলমেলে বিষয়-আশয় সামলানোর কাজ নিয়ে। তাই যেভাবে আমরা কবি ফাউজুল কবিরকে ক্রমাগত প্রকাশিত হতে দেখার কথা ছিলো, যে পথে আমরা অবলোকন করার কথা ছিলো, তাঁর কবিতায় নতুন নতুন ব্যঞ্জনের যোগ হতে——তা ঘটে অনেক অনেক পরে; বিশেষত যখন তাঁর সমবয়সী কবিরা স্তিমিত নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন, তখন ফাউজুল কবির যেন নব রূপে নব উদ্যমে নতুন কাব্যভাষার ঝলকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন।
কবিকে খুব কাছে কাছে পাই আমাদের চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনের বহুবর্ণিল আড্ডায়। আমার চোখে যিনি কবিতার রাজপুত্তুর ছিলেন, তিনিই যেন নিজে থেকে আমাকে একান্ত বড় ভাইটির মতো আপন করে নিলেন। এমন দিনগুলোতে আমার কবিতা লেখা তাঁরই প্রবল অনুরাগে তরান্বিত হয়েছিলো। তাঁর কাছ থেকে শিখলাম ‘প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র’ (২০০৯)। মানে জন্মগ্রহণ এক আশ্চর্য জাদুমন্ত্রের মতো কিছু। ২০১০ সালে আমার শাদা অন্ধকার কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পেছনে কবি ফাউজুল কবিরের প্রণোদনা অনস্বীকার্য। গভীর জীবনবোধের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে দেখেছি কবিকে খুব কাছ থেকে। কবির অন্তর্গত রোমান্টিকতা কবিকে ক্রমাগত শিহরিত করে। তিনি বলেন “শিহরণ বড় ভাল লাগে”। তিনি নিজেকে কখনো বলেন মুসাফির মানুষ কিংবা ভ্রমণপিপাসু। কিন্তু এরপরও কবি নিজেকে মনে করেন “নি:সঙ্গ এক কাকতাড়ুয়া”। তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ অনিবার্য। তাঁর কবিতার সরল শব্দাবলী এবং অনবদ্য দৃশ্যকল্পের পাশাপাশি মিথলজির ব্যবহার মনকে ভরিয়ে দেয়।
২.
‘প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র’ বইটির সূচনা কাব্য “ভ্রমণ পথের দৃশ্যাবলী”। যে কবিতায় কবি এক পরিব্রাজক, আর চলার পথে মানুষ দেখেন, মানুষের নানা রূপ তাঁর চোখে নানান মুরতি ধারণ করে আবির্ভূত হয়েছে——
“মানুষের ভেতরে রোপিত, মানুষের
নাগরিক ত্রিশুল
ক্রমশ ছড়াচ্ছে তীক্ষ্ন সুচতুর
ভয়ানক অন্ধ
ইস্পাত নখর আর লালা, বিষের :
শ্বাসে ও প্রশ্বাস মানুষ কিনিতেছে কার্বন ও সিসা
হৃদয়ের অসুখ
বুক পোড়া ধোঁয়া ও ভ্যানিটি ক্যান্সার
গিলিতেছে তরল
দেশি আর বিদেশি ম্যাগালোমেনিয়ার
পাষব উল্লাস, মিথ্যা ও ভেজাল তিক্ত বিবমিষা :
মানুষ লিখিতেছে রাজনীতি বিকার…..”
(ভ্রমণ পথের দৃশ্যাবলী, পর্ব-১ / পৃষ্ঠা-৭ / প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র / ২০০৯)
এই যে বিকারগ্রস্ত রাজনীতি, নাগরিক মানুষের চতুর ত্রিশুলে মানুষ কিনছে কার্বন আর সিসা——শ্বাসে ও প্রশ্বাসে; এই অনির্বচনীয় বাস্তবতায় কবি কেবল নির্লিপ্ত দর্শকের মতো বর্ণনা করেছেন কেমন ‘ভ্যানিটি ক্যান্সার’ নিয়ে আমাদের বিবমিষাময় জীবন যাপন। পুরো কবিতাটি দীর্ঘ, সাতটি পর্বে বিভক্ত। কিন্তু এই উল্লেখিত প্রথম পর্বের অংশ আমাদের যে টান-টান সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্তে কবিতাটির ভেতরে সেঁধিয়ে দিচ্ছে, সেখানে কেমন যেন এক গদ্যময় বিন্যাস। এটা তাঁর মুন্সিয়ানা, সকলে পারে না। আর এই কবিতার চতুর্থ পর্বে গিয়ে কবির ভাষ্য হঠাৎ ঝলসে ওঠে। নাগরিক জীবনে ছুটে চলা মানুষকে দেখে তাঁর সপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা——
“মানুষেরা কখনো ভাবনার পাবে কি অবসর?
পাবে কি স্থিরতার নির্মোহ মানুষী অন্তর?”
(ভ্রমণ পথের দৃশ্যাবলী, পর্ব-৪ / পৃষ্ঠা-৮ / প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র / ২০০৯)
আর এই কবিতার শেষে এসে আমরা দেখি, এই দুর্বহ মনুষ্যের বিষাক্ত আচরণ কবিকে বিক্ষত করে, বিকারগ্রস্তও করে কখনো কখনো। কবি ঢুকে পড়েন ইল্যুশন বা বিভ্রমের জগতে। দেখতে পান বহুদূর পাহাড়ের, সমুদ্রের, নরকের, দিগন্তের অতীতের অমাবস্যা গর্ভ থেকে কালো আলোকরশ্মি জেগে উঠছে। আর কবির আর্ত উচ্চারণ——
“মানুষের মৃত্যু হবে মৃত্যু হবে মৃত্যু হবে
মানুষেরা মরিতেছে, মারিতেছে-মরিতেছে
এরকম স্বপ্ন দেখি শুনি সুক্ষ্ম প্রত্যাদেশ
সাংকেতিক চিহ্নাবলী ক্রমে ক্রমে আঁকিতেছে
জীবনের অন্য ছবি, লিখিতেছে দণ্ডাদেশ
মৃত্যু হবে মৃত্যু হবে।”
(ভ্রমণ পথের দৃশ্যাবলী, পর্ব-৭ / পৃষ্ঠা-১০ / প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র / ২০০৯)
এই কবি যেন এক নিয়ত পরিব্রাজক। পরিভ্রমণের এক পর্যায়ে মানুষের হাঁটাচলার সাথে, স্বভাব বা মতিগতির সাথে তাল মেলাতে চেষ্টা করেন। তবু কবি যেন ঠিক মানুষের মিছিলে আলাদা কেউ একজন হয়ে থাকেন সবসময়। লোকেদের কাছে শুনতে পান “লোকটি ঠিক ‘তাহাদের’ মতো নয়। এবং তিনি বলতে নির্দ্বিধ যে, এই ‘লোকটি’ মানে তিনি বস্তুত ‘অবাক দর্শক’। নিজেকেই হয়তো তিনি প্রশ্ন করেন “কবিদের চেহারা কি তবে মানুষ সদৃশ নয়?” তখন তাঁর মনের ভেতরে কবির চরিত্র বা কবির সংজ্ঞা খোঁজার এক সাবলীল উচ্চারণ আমরা পাই ———
“কবি কি যাপন করে জীবনের ভেতরের গৃহলোকে
গুপ্তসিদ্ধ আরেক বৃক্ষজীবন? কবি সৃজন করে
প্রাণের ভেতরে প্রাণ সত্তার বিশিষ্ট কন্ঠ আউলিয়া
স্বরূপেও বাউলিয়া? ………
……… কবি কি নির্বাণ কন্যা নিয়ত বদলায় স্বর
বাক্য বোধের ফিনিক, কখনওবা অচেনা জামা পরে
হয়ে ওঠে অগম্য অবাধ্য ব্যক্তি প্রাকৃতজনের চোখে!
…..
কবির পঞ্চম চক্ষু অনায়াসে জেনে যায়, মানুষেরা
কবি নয়, নয় প্রমার সন্তান, কিন্তু কবিরা মানব।
(উদ্বাস্তু কোলাজ, পর্ব-৩ / পৃষ্ঠা-১৩ / প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র / ২০০৯)
এটিও তাঁর আরেকটি চার পর্বে লেখা দীর্ঘ কবিতা থেকে চয়ন করা। যেখানে কবি এই দুর্মতি মানুষের কাছ থেকে পৃথক হতে হতে শেষ-মেষ আশ্রয় নেন ইঁদুরের আত্মার বিনিদ্র কোষে। অর্থাৎ মানুষ থেকে কবির পলায়ন ঘটে।
“আমি এখন লুকিয়ে আছি বসবাস করছি
ছোট্ট এক ইঁদুরের আত্মার বিনিদ্র কোষে
লিখছি বিচিত্র সাঁটলিপি মৃত্যুর, স্বপ্নের আর
মানুষের ইঁদুরের প্রাণীগের বৃক্ষদের”
(উদ্বাস্তু কোলাজ, পর্ব-৪ / পৃষ্ঠা-১৪ / প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র / ২০০৯)
অর্থাৎ কবির লেখা যেমন থামে না, তেমনি মানুষের কথাও কবি বলবেই। এই পরিভ্রমণ কবির এক নিরন্তর সাধনার মতো। কখনও ইঁদুরের ভেতরে যেমন তার বাস, কখনোবা কবি বেরিয়ে আসেন বৃক্ষের শরীর থেকে, বৃক্ষের হৃদয় থেকে, ত্বকের গভীর থেকে বৃক্ষশিশু যেন। মানুষের জীবন দেখার জন্যে অনুধাবনের জন্যে বৃক্ষ থেকে বের হয়ে এসে অবশেষে কবির যে বোধ জন্ম লয়, তা নীচের পংক্তিগুলোতে ধরা যায়—-
“বৃক্ষরা মানুষ নয়, মানুষের চেয়ে বেশি কিছু অনন্য গভীর প্রজ্ঞাবান
মানুষেরা কথা বোঝে, ভাষা বোঝে, বোঝে না প্রাণের ভাষান্তর
দিবারাত্রি বৃক্ষের ভেতরে বাইরে চলে সবুজ অনুবাদ জীবনের গান
যার অন্য নাম নীরব জিকির বন্দনায় প্রকৃতির ঋতু-রূপান্তর”
(বেরিয়ে এলাম বৃক্ষশিশু / পৃষ্ঠা-১৫-১৬ / প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র / ২০০৯)
এই কবিতার সমাপ্তি টানতে গিয়ে কবি তাঁর যে উপলব্ধি উচ্চারণ করেছেন, তা হলো মানুষেরা ক্রুশ, কিরিচ, হত্যা এসব ভালোবাসে। মানুষের রক্তে জেগে আছে খুনী—— যার রয়েছে প্রাচীন বৃক্ষ নিধনের নেশা।
কবি তাই স্থির নিশ্চিত হয়ে যান, যে মানুষ ভালোবাসে বিজ্ঞাপন, ভালোবাসে বেচাকেনা, যারা আমদানী রপ্তানী করে পাথর আর অন্ধকার——এই অন্যরকম পৃথিবীতে মানুষ আর প্রাচীন কালের মতো বোধের মগ্ন এস্রাজ ছুঁয়েও দেখবে না।
“যতই প্রার্থনা করো মানুষ কখনো আর
ফিরবে না ভোরের দিকে”
(মাছরাঙা মাগুর স্বপ্ন / পৃষ্ঠা-৪২ / প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র / ২০০৯)
তাই এই পর্বে এসে দেখি আমাদের কবি মানুষে শ্রদ্ধা হারিয়ে কেবল তাদের দুর্বৃত্তপনা অবলোকন করেন, কোনো এক বৃক্ষ কিংবা ইতিহাসের পৃষ্ঠার মতোন।
“আমি শুধু
চেয়ে চেয়ে দেখি
মানুষ কীভাবে চায়
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি
মানুষ কীভাবে পায়
কীভাবে করে ছিনতাই”
(জন্মচক্র / পৃষ্ঠা-৪৩ / প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র / ২০০৯)
এই যে কবির ব্যর্থতা, বস্তুত কবির চোখে মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ব্যর্থতা——যা অবলোকন করতে করতে কবি ফাউজুল কবির শেষ করেন এই গ্রন্থের, সেটা একটি সনেট। আর আমরা তো জানি সনেট হচ্ছে ভাবনার সুসংবদ্ধ প্রকাশ। এখানে তিনি এক জীবনের ব্যর্থ ভোলানাথ, সক্রেতিসের মতোন গিলে যাচ্ছেন মানুষের সমূহ গরল—-
“আমি শুধু জীবনের ব্যর্থ ভোলানাথ, মন্থনের
পরে, পৃথিবীর ফাণ্ডের যতটুকু জমেছে গরল
মানুষের দান ভেবে গিলিতেছি সমস্ত তরল
নিয়েছি দায়িত্বভার সক্রেতিস আত্মগ্রন্থনের।”
(গিলিতেছি সমস্ত তরল / পৃষ্ঠা-৪৮ / প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র / ২০০৯)
৩.
‘রহস্যের চাবিকাঠি’ গ্রন্থটি কবি প্রকাশ করেন ২০১৫ সালে। এই পর্বে এসে কবির সেই পরিব্রাজক সত্তার ভেতর যেন ঢুকে পড়ে মায়া——রহস্যময়তা। কবিতা মোড় নেয় যেন কোনো ভিন্ন রোমান্টিক পথের নিশানায়। কবিও খুঁজতে চান জীবনের রহস্যময়তার সূত্রগুলোকে। আরও লক্ষ্যণীয় যে, এই গ্রন্থের অনেকগুলো কবিতাই সনেটে সংহত।
“তামাদি স্বপ্নের দেশে ব্রাজকের দায়িত্ব আমাকে
দিয়েছেন যিনি, মৃত আজ তিনি, মাটির সংসারে
লীন। শুধু স্মৃতি তার ছবি হয়ে হাঁটে অন্ধকারে
হেসে ওঠে কথামালা, আয় কাছে——ঈশারায় ডাকে।”
(নিঃসঙ্গ বেহালা / পৃষ্ঠা-১৫ / রহস্যের চাবিকাঠি / ২০১৫)
এই পর্যন্ত পাঠে আমরা কবিকে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দেখি যে, এই দেশে আর স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, এখানে স্বপ্নেরা তামাদি হয়ে যায়। আর যে পরম সত্তা তাঁকে এই ভ্রমণে লিপ্ত করেছেন, সেই পরম সত্তাটিকে মৃত বলেই কবির ধারণা জন্মেছে। কবি তাই নিজের মতো করে পৃথিবীর পথে চলা শুরু করেন——
“ …. আমি তাই পথ চলি সুর তুলি
এলোমেলো পৃথিবীতে অচেনা পথের দরোজা খুলি”
(নিঃসঙ্গ বেহালা / পৃষ্ঠা-১৫ / রহস্যের চাবিকাঠি / ২০১৫)
এই বইটির কবিতাগুলো মনোজগতের আলো আঁধারি নিয়ে খেলা করে। আর মানুষকে এখানেও উদ্ঘাটনের চেষ্টা চলেছে। কখনো কখনো আবার তাঁর এমনও মনে হয়েছে যে, এই মানুষের অস্তিত্বের ভেতরে এই হেঁটে যাওয়া ঘোড়ার ঘাস কাটার মতোই।
“চল্লিশটি বছর আমি
মানুষের অনুবাদ
করেছি
চল্লিশটি বছর আমি
মানুষের অস্তিত্বের
ভেতরে হেঁটেছি
যারা অনূদিত আর
উদঘাটিত উন্মোচিত
তাদের কেউ চেনে না
আমাকে
ফলত
চল্লিশটি বছর আমি
কেটেছি
ঘাস, ঘোড়া ও গাধার।
(চল্লিশটি বছর / পৃষ্ঠা-১৫ / রহস্যের চাবিকাঠি / ২০১৫)
আসলে যা প্রকাশ্যও অনুক্ত, যা মানুষের অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত, সেই নৈশব্দের স্বরটিকে উচ্চারণ করাই বুঝি কবির কাজ। সাধক কবি রজ্জবজীর বাণী “যা মৌন তাকে ভাষা দাও, ভাষান্তরিত করো। যা অপ্রকাশ্য-গায়েব তাকে উপলব্ধির বাণীতে পরিণত করো, দৃশ্যমান করে তোলো, হৃদয়ের স্লেটে প্রকাশিত করে তোলো”—— এই কথাটিই যেন মাথায় রেখে অসামান্য ‘সময়ের মায়াবী রাখাল’ এই কবি ফাউজুল কবির রচনা করেন ‘রহস্যের চাবিকাঠি’।
“তোমার হাতেই ছিলো রহস্যের যাবতীয় চাবি
ইচ্ছা আর অনিচ্ছার গুপ্তমন্ত্র যাদুকরী কাঠি
আমি তো ছিলাম শুধু মুগ্ধ যাযাবর সহপাঠী
ছোঁয়ালেই ছুঁয়ে গেছে প্রাণ হৃদয়ের সব দাবী :
কখনো করিনি প্রশ্ন ভোলা মন! কী দিয়ে কী পাবি
অথবা ভাবিনি মনে ভ্রমণের নেশা কতকাল
আমাকে ঘোরাবে পথ, অনির্দিষ্ট পথের রাখাল
নিয়ে যাবে কত দূর —— কত পূর, এখনো কি ভাবি?
কী এমন জানো সুর রক্ত মাংসে লাগাও নাচন
কী মোহন ক্যারিশমায় মাখো বুকে ফানার আগুন
চোখে মুখে জেগে ওঠে সুন্দরের বিপুল ফাগুন
নাচে স্বপ্ন নাচে সুখ অন্তরের বিভূতি সাধন :
কী গোপন মায়া জানো অদৃশ্যের খেলা চুম্বকীয়
নিয়ত শেখাও তুমি আনন্দের সূত্র পরকীয়।
(রহস্যের চাবিকাঠি / পৃষ্ঠা-১৯ / রহস্যের চাবিকাঠি / ২০১৫)
তারপরও প্রস্থানের কাল চলে আসে প্রতি ভ্রমণের শেষে। প্রতিটি ভ্রমণ যেন সময়ের কোথাও অঙ্কিত থাকে। একজন কবি সেই সূচনা-লগ্ন থেকে জীবনের শেষ-মুহূর্ত পর্যন্ত যে পরিভ্রমণে নিমগ্ন থাকেন, জীবনরহস্য ও মানব রহস্যের গোপন অলিন্দে; অথবা ঘুরছে নপথ কোনো এক অচেনা মনের গলিতে, মস্তিষ্কের বিপুল জটিল ঘুলঘুলির ভেতরে—— সে পথ ফুরিয়ে এলে কতোটা প্রতীতি নিয়ে বলা যাবে ‘জেনে গেছি প্রকৃতির রেখা-রং কিংবা মানব জীবনী কথা’। কখন এক কবির হৃদয় থেকে উৎসারিত হতে পারে ‘পেয়েছি কবিতা’, যার জন্যে আজীবন নিত্য আরাধনা? অথচ অমোঘ সেই সময়ের হাত। সময়ের হাতের পুতুল আজ পৃথিবীর সকল কবির মতো ফাউজুল কবিরও বলেন ——
“সময় আমাকে ডাকে : বলে আয়! আয়! আয়!
আর কতদূর পথ যাত্রা হলে বলা যাবে
লিখেছি পথের ছবি
এঁকেছি মাঠের চিত্র
প্রকৃতির রেখা-রং মানব জীবনী কথা
আর কতদূর পথ যাত্রা হলে বলা যাবে
আমি জেনেছি শিখেছি
নদীর কাহিনী গল্প
পাখির ডানার সুর আকাশের লীলাখেলা
আর কতদূর পথ যাত্রা হলে বলা যাবে
বুকের ভেতরে ছিল
অসীম ভ্রমণ নেশা
বিশালাক্ষী পৃথিবীর আশ্চর্য চরিত্র দেখা
আর কতদূর পথ যাত্রা হলে বলা যাবে
এখানে পথের শেষ
আমি হেঁটেছি অনেক
পেয়েছি কবিতা এক সুবর্ণ হরফে লেখা
আর কতদূর পথ যাত্রা হলে বলা যাবে
নিঃসঙ্গ পথিক একা
এবার বিদায় বেলা
সঞ্চয়ের থলিতে শুধু অক্ষত প্রাণের মতো
একটি হৃদয় কবিতা
সময় আমাকে ডাকে : বলে আয়! আয়! আয়!
(সময় আমাকে ডাকে / পৃষ্ঠা-৪৮ / রহস্যের চাবিকাঠি / ২০১৫)
৪.
২০১৫ সালে কবি ফাউজুল কবিরের আরও একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘মেডুসার খেলা’। এই গ্রন্থের নাম কবিতা একটি এপিকধর্মী দীর্ঘ কবিতা। এখানে ১৫ পৃষ্ঠাব্যাপী বর্ণিত হয়েছে একটি মানুষের বুকের ভেতরে জমতে থাকা ধুলোবালি আর স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে কোনো এক অনির্দেশ্য পথে এগিয়ে যাবার অজস্র ঘটনাসংকুল গল্পের পরতে পরতে মনস্তত্ত্বের খেলা। লোকটি হাসপাতালের দিকেই হয়তো যাত্রা শুরু করেছিলো। কিন্তু সেই যাত্রাপথের বিবরণে আমরা দেখি——
“সেবা আর শুশ্রুষার আলোকিত শোভন স্মারকে
গুচ্ছ গুচ্ছ অপেক্ষার ফুলে সাজিয়েছে ক্লিনিক-তোরণ”
আর তার পেছনে পেছনে আসে আলোছায়া, বহুরূপী মায়াখেলা, যেখানে বৃক্ষরা পায়ে হেঁটে যায়। এই যে বিভ্রম “মাথার ভেতরে স্বপ্ন নয় কোনো এক বোধ” কাজ করছে বলেই কবির প্রশ্ন উচ্চারিত হয়——
“লোকটি কি চিহ্নিত করতে পারে আকস্মিক জেগে ওঠা কন্ঠ
নিউরন ম্যুরালে খচিত
সেই সব রেখা রং স্কেচ
ছবিদের পেছনের ছবি
দৃশ্যের অতীত দৃশ্যাবলী?
সে কি চিত্রায়িত করতে পারে
কেঁচোদের জীবন বৃত্তান্ত
অর্থভূক ভূমিভূক প্রাণী আর বেঙ্গাচির রূপান্তর?”
(মেডুসার খেলা / পৃষ্ঠা-৩৫ / মেডুসার খেলা / ২০১৫)
লোকটির এই যাত্রা যেন অনন্তকাল ধরে চলেছে। যেমন ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগরে ১০ বছর ঘুরেছিলো হোমারের ওডিসিউস, অথবা একই বিভ্রান্তি এসে যেমন জেঁকে বসেছিল মাত্র একটি অনন্ত দিবসে জয়েসের ইউলিসিসের জীবনে ডাবলিন শহরে। ঠিক তেমন করেই ধাপে ধাপে উন্মোচিত হতে থাকে আলোচ্য লোকটির জীবনের নানান বিস্ময়। না কি এই লোক আমাদের সেই পার্সিউস, যে এগিয়ে চলেছে মেডুসার দিকে —— পাথরে পরিণত হবার ভয় ও উৎকন্ঠা, আর পথিমধ্যে নানা বিপদের হাতছানি এড়িয়ে পৌঁছাতে হবে সর্পচুলের অভিশপ্ত কন্যাটির নিয়তি নির্ধারণকল্পে। চলতে চলতে কতো বিচিত্র ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকতে হয় ——
“মানুষ কি ভালোবাসে পথ
পথ কি মাতাল করে
মাতাল কি পথ চেনে
পথের কি টান আছে, আছে প্রেম মানুষের প্রতি?
……
জীবন কি পথের কাঙাল
জীবন কি শুধুই ভ্রমণ! ইচ্ছা আর অনিচ্ছার ডাকে
সমূহ বস্তুর মতো
কোনো এক চুম্বকীয়
অদৃশ্য যাদুর কাছে
নিরন্তর আত্মসমর্পন?”
(মেডুসার খেলা / পৃষ্ঠা-৪১ / মেডুসার খেলা / ২০১৫)
এভাবে উদ্ধৃতি দিয়ে তো শেষ করা যাবে না। কবিতাটির প্রতিটি পংক্তিই উদ্ধৃতিযোগ্য। সবচেয়ে ভালো হতো এই কবিতাটির পুরোটাই তুলে দেওয়া, অথবা শুধু এই একটি কবিতা নিয়ে কোনো সুযোগ্য সমালোচক একটি দীর্ঘ আলোচনা লেখা। জীবনের নানা ঘটনা আর নানান বাঁক ঘুরে ঘুরে লোকটি খুঁজতে থাকে স্মৃতি। “সেও কি কখনও ছিলো শিশুদের মতো শিশু / তুলেছিলো ফুল / গেঁথেছিলো মালা / গিয়েছিলো মামাদের বাড়ি?” তবু লোকটি হাঁটতে থাকে সম্মুখের বিরাজ প্রান্তরে। পৃথিবীর সব ক্লান্তি ধীরে এসে জমে চোখে-হাতে-পায়ে। এই ক্লান্তির বর্ণনাও কতো চনমনে, কী উজ্জ্বলতা ধরে রাখে——
“পৃথিবীর সব ক্লান্তি এসে ধীরে ধীরে
জমে চোখে হাতে-পায়ে
ঘুম আসে অফুরন্ত ঘুম
আকাশের তারাদের মতো অজস্র সহস্র ঘুম
বৃক্ষদের পাতাদের মতো সবুজ নরোম ঘুম
শাসিত নদীর মতো শৃঙ্খলিত
জমাট তরল ঘুম
পাথরের হৃদয়ের মতো নীরব কঠিন ঘুম”
(মেডুসার খেলা / পৃষ্ঠা-৪৬ / মেডুসার খেলা / ২০১৫)
কিন্তু এই নিদ্রা এই স্বপ্ন সব ক্ষণস্থায়ী। লোকটিকে এগিয়ে যেতেই হয়। কারণ লোকটির সমস্ত বিভ্রম দূর করতে হবে। সে হাঁটতে শুরু করে পুনরায়——
“লোকটি হাঁটতে থাকে
হাঁটতে থাকে নিরন্তর
লোকটি হাঁটতে থাকে
পথ তাকে টানতে থাকে
পথের অন্তিমে”
(মেডুসার খেলা / পৃষ্ঠা-৪৮ / মেডুসার খেলা / ২০১৫)
আর এই অন্তিমে এসেই আমাদের সচকিত করে ঘোর কাটিয়ে দেন কবি। আমরা আবিষ্কার করি লোকটা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে অথবা ভেতরে। হয়তো আন্তন চেখভ তাঁর এই মনোরোগের শুশ্রুষায় নিবেদিত। আমাদের ভাবনার ভেতরে খেলা করে এক অনন্য রহস্যময়ী মেডুসা। আমরা কী সকলেই পাথরে পরিণত হবার কোনো ভয়ঙ্কর পথের যাত্রী হয়ে উঠি না? আবার কখনো হয়তো মেডুসার মতোই অভিশপ্ত হয়ে পড়ে কিছু লোক, যাদের চোখের সামনে গেলে আমরা পাথর হয়ে যাবো ভেবে দূরে পালিয়ে বেড়াই।
৫.
‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল’ (১৯৯৭) নামে ফাউজুল কবিরের আরেকটি অনন্য কাব্য যেন তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর নিয়ে চির-উজ্জ্বল চির-ভাস্বর। এই এক-ফর্মা দীর্ঘ-কবিতার মধ্যেও আমরা সেই পরিব্রাজক ফাউজুল কবিরের দেখা পাই।
“আমি আগে আগে যাই। আর :
পেছনে শামুক ভালোবাসা
লাজুক চুপচাপ।
আমি হাঁটি সূর্যাস্তের দিকে
আর :
সবুজ বৃক্ষের মৃদু পায়ে
ভালোবাসা হাঁটতে :
ভালোবাসারও কি পা আছে
মানুষের মতো বৃক্ষদের মতো।”
এই কবিতাটির মজা হলো পরিভ্রমণের ভেতর দিয়ে কবি অনেকগুলো থোকা থোকা মেঘপুঞ্জের মতো দৃশ্যকল্প এখানে সেখানে ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন অবলীলায়। আর সেই দৃশ্য কেবল দৃশ্য নয়, সাথে আছে স্মৃতি, স্বপ্ন, বোধ ও বেদনার সাথে অজস্র প্রশ্নের উত্থাপন। এই প্রশ্ন কি কেবলই প্রশ্ন? এর উত্তর তবে কোথায় মিলবে?
“পশ্চিমের লাল বিকেল আমাকে ডাকে
দিগন্তের অসীম ছায়া আমাকে ডাকে
বলে, আয়, কাছে আয়, দ্যাখ
চোখের ভেতরে রোপন করেছি
বিস্ময়ের মুগ্ধ-মেলা, অন্যতম চোখ :
আমি থেমে দাঁড়াই, দেখি আশ্চর্য
আর :
ভালোবাসাও চমকে থেকে দাঁড়ায়।
ও ভালোবাসা, ভয় পেয়েছো?
ভয় পেয়ো না নদীর কাছে যাবো।”
আগের উদ্ধৃতিতে আমরা দেখেছিলাম, সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যাওয়া কবির সাথে সাথে শামুকের মতো চুপচাপ ভালোবাসাও হাঁটছিলো। তখনই প্রশ্নটি এসেছে ভালোবাসার পা আছে কি না। এখানে কবির কল্পনায় ‘মানুষের মতো বৃক্ষদের মতো’ পা। অর্থাৎ কবি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, বৃক্ষদের পা আছে। এবার পরের উদ্ধৃতিতে যখন সূর্যাস্তের দিকে যাত্রার পথের বিবরণ আমরা পাই, তখন দেখি পশ্চিমের লাল বিকেল কবিকে ডাকছে, দিগন্তের অসীম ছায়াও ডাকছে। কবি তাঁর চোখে বিস্ময়ের মুগ্ধ-মেলা রোপন করেছেন বলেই এমন করে তিনি দেখছেন। বিস্ময়ের সাথে কবি দেখেন, তিনি থামলে ভালোবাসাও থেমে দাঁড়ায়। আমরা এখানে অনুভব করি, ভালোবাসা আমাদের সাথে সাথেই হাঁটে, সাথে সাথেই থামে। তবু কেন কবির মনে হয়, ভালোবাসা ভয় পেয়েছে তার থেমে পড়া দেখে।
মানুষের পথ একদিন হয়তো শেষ হয়। মানুষ নশ্বর, মানুষকে তো থামতেই হয়। কিন্তু ভালোবাসা থামতে পারে না। ভালোবাসা হতে হবে প্রবহমান নদীর মতোন। মানুষের থেমে গেলেও ভালোবাসা হেঁটে যাবে ভবিষ্যতের দিকে। তাই হয়তো কবি ভালোবাসাকে বলেছেন, তাকে নদীর কাছে নিয়ে যাবেন। কারণ——
“নদী মানে জলের সাথে প্রেমের মতো
জলাঞ্জলী চলা
নদী মানে জলের সাথে মাছের মতো
এক্কাদোক্কা খেলা”
এই বক্তব্যের পরপরই আমাদের সামনে যে নদীটির চিত্র ভেসে ওঠে সেই নদীর নাম ‘বারোমাসি’ নদী। ‘বারোমাসি নামে পৃথিবীতে আর কোনো নদী নেই, থাকবেও না কখনও’। এই যে বরোমাসি নদীর নাম কেন বারোমাসি, তার কি বারোজন মাসী ছিলো কিনা ভুলোমন কবি ভুলে গেছেন। সেখান থেকে কবি চলে যান শৈশব স্মৃতির স্কুল মাঠের দিকে। আবার সন্ধ্যায় ভালোবাসাকে বাড়ি ফেরার তাড়াও দিচ্ছেন। এর পরপরই আমরা আরেকটি দৃশ্যপটের সামনে উপনীত হই——
“একবার এক বিকেলে নিঃসঙ্গ পুকুর একা পেয়ে
আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিলো। বলেছিলো,
জলে নেমে জল হয়ে যাও
বড় হলে তুমি মাপবে জলের ঘনত্ব
জলের সুন্দর
তোমার ভেতরে জন্ম নেবে
অদ্ভুত আকাশ
শব্দেরা হাডুডু খেলবে তোমার গোপনে
তুমি কবি হবে, ভূবনখ্যাত।”
এই যে নিঃসঙ্গ পুকুর একজন মানুষকে কবি করে তোলে। আর কবি জলে নেমে জল হয়ে যায়, মাপে জলের সুন্দর। তখন কবির ভেতরে অদ্ভুত আকাশ জন্ম নিলে শব্দেরা কবির ইচ্ছার অধীন হয়ে পড়ে। কিন্তু এখানেই কবি পুকুরের কথা একবাক্যে মেনে নেননি। নানান প্রশ্নে আবার চারপাশের প্রকৃতি এসে ধরা দেয় কবিতার হাতে। এক পর্যায়ে বাঁশখালীর গঙ্গাধর নামে একজন চরিত্রও আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়, যিনি বলেছিলেন কবির মধ্যে লক্ষণ আছে, তাঁর হবে। কী যে লক্ষণ আর কী যে হবে, কবি বোঝেননি। তবে, এটুকু জানতেন গঙ্গাধর চিরকাল গানের মানুষ, যিনি সহজে প্রাণের কথা বোঝেন, জানেন——কেমন করে কেমন হয়।
“গঙ্গাধর সব জানে।
জানে আকাশ কী চায়
জানে মেঘের রহস্য
জানে হাতিয়া-সন্দ্বীপ
জানে বহুদূর বঙ্গোপসাগর।
গঙ্গাধর সব জানে
জলের এতটা গভীরে যার প্রবীণ অভিজ্ঞতা
লোকালয়ে যার মশহুর কালো জিরাফের সুনাম
মাছেরাও যাকে চেনে বিখ্যাত এক ধীবর নামে
সে কী আর এই পৃথিবীর
একটি গ্রামের ছোট্ট ছেলের ভাগ্যলিপি-ভবিষ্যৎ
কপাল-বরাত চেনে না বোঝে না?
নদীদের চরিত্র যে চেনে
মাছেদের স্বভাব যে জানে
তার আছে নিশ্চিত তুখোড় জ্ঞান
জলে-স্থলে মানব সংসার।”
কে সেই গঙ্গাধর? কোথা হতে কবির শৈশবে এসে বলেছেন ‘হবে’। এখনও কবি দুপুরে একা হলে প্রাণের উঠোনে গঙ্গাধরের দিলদরাজ হাসির দমক শুনতে পান। শুনতে পান মরমী রোদের প্রহর কাঁপিয়ে মাতাল নদীর হঠাৎ হেসে ওঠা। গঙ্গাধরের কন্ঠে ভাটিয়ালী গানে খেলতো উজান ভাটির কারুকাজ। এই গঙ্গাধরের কাছে লোককথা শুনতেন কবি। নানারকম জীবনের গল্প তাঁর কাছে শুনতে শুনতে কোনো একদিন তিনি কবি হয়ে যান, কবির হৃদয়ে মস্তিষ্কজুড়ে সেই শৈশব—নদী—জল একাকার হয়ে থাকে——বুঝতেই পারেন না কবি।
“বলতো, জীবন জলের মতো
বলতো, জীবন মাছের মতো
বলতো, দয়া করে ঠাঁই দিও, দাদা
প্রজন্মের জেলে নয়
তোমার ছেলে হয়ে জন্মাবো
চোখ ভরে দেখবো তোমার হওয়ার ছবি
তুমি কেমন হয়েছ”
এরপরের ঘটনা বড়ো মর্মান্তিক। এর মধ্যে বহু কাহিনী সঞ্চিত হয়েছে, কিছু পাখি উড়ে গেছে, কিছু ডানা ভেঙে পড়ে আছে, কিছু কিছু জীবিত ও মৃত এবং কিছু অশোক বনে। আবার সোনার সিন্দুকেও জমা আছে কিছু নিশ্চয়। কবিরও অনেক কিছু করার কথা ছিলো। একা যাবেন ইলিশ উজানে, ছেঁকে নেবেন বৃষ্টি-জল, কবিতা পুরাণ। কথা ছিলো যেতে যেতে সঙ্গ হবে, সঙ্গী হবে, ভালোবাসা-প্রেম, সব-সব হবে কথার ভেতরে। কিন্তু আজ সব কথা যেন ‘কথার কুয়াশা’। আমরা জানতে পাই, সত্তরের এর ঝড়ের রাতে যে সাহস হাতে একা দক্ষিণ সমুদ্রে গিয়েছিলো গঙ্গাধর, আর কখনও সে উত্তরে ফেরেনি, এমনকি নদী হয়েও না। অনেক দিবস পরে আজ কবির গঙ্গাধরের সেই হয়ে ওঠার বাণীর কথা মনে পড়লে নিজেকে পুনর্বার যাচাই করতে বসেন। আর তাঁর ধারণা পাকাপোক্ত হতে থাকে যে, ‘এখনও হয়ে ওঠা হলো না’।
“লোকে বলে, বয়স বাড়ছে
আমি বলি, হলো না যে আমার হলো না।
আমার এখন বুকের ভেতর
হলো না হলো না
আমার এখন চোখের ভেতর
হলো না হলো না
আমার এখন প্রাণের ভেতর
হলো না হলো না”
কবির উপলব্ধি আমাদের এমন এক হতবিহ্বল অবস্থায় এনে স্থবির স্থানুর মতো করে দেয়। আমরা জেনে বুঝেও জোর শোর তুলতে পারি না——যা হবার তা হয়ে গেছে অনেক অনেক আগে, সূর্যোদয়ের আগেই ফাউজুল কবিরের কবিতা কিরণ আমাদের নিদ্রাভঙ্গ করে।
এই যে“হলো না হলো না”বলে নিদারুণ আর্তি আর হাহাকারে ভারী হয়ে আসে কবিরকন্ঠ, কী তাঁর তবে,কী হবার কথা ছিলো?কীইবা হওয়ার দরকার?যে কবি সুন্দরেরআরাধনা করেন তিনিই বিভ্রান্ত হয়ে ভাবনায়বুঁদ হয়ে থাকেন,কী সেই সুন্দর?সুন্দরের ধরনকেমন!
“আমাকে কি হতে হবে সম্পূর্ণ সুন্দর?
রূপেগুণে কান্তিমান জমজ অর্জুন?
আমাকে কি হতে হবে সুন্দরের মাঝি?
সুন্দর কোথায় থাকে? জীবনের বুকে?
কে কাঁদে আমার বুকে না হওয়ার শোকে?
যে কাঁদে সে মোর প্রিয় সুন্দরের বোন
জানে সে আমার তত্ত্ব সমস্ত গোপন”
এই যে সুন্দর হবার বা সুন্দরকে পাওয়ার আকুতি,এ কেমন সুন্দর? টানা টানা চোখ,সুন্দর ভুরু, ঢেউ খেলানো চুল,মাংসপেশির চঞ্চল আড়ম্বর,ভালো কর্মে রত, ‘সত্য বই মিথ্যা বলিব না’——ইত্যাকার রূপেগুণে মহাভারতের ঈর্ষণীয় চরিত্র অর্জুনের মতো হয়ে ওঠাই কি তবে প্রকৃত সুন্দর?জীবনের বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকে যে সুন্দর, আহা, কে আজ কাঁদছে কবিরবুকে না হওয়ার শোকে?এ কি কেবলই ফাউজুল কবিরের সুন্দর হওয়ার বা সুন্দর চাওয়ার গল্প?আমার বা আমাদেরও নয়?আমার সমস্ত গোপনতত্ত্ব এই বুকের ভেতরেজানা আছে,এ হৃদয় সুন্দরের বোন। হৃদয় সুন্দর হলে জগৎ সুন্দর হতে বেশিক্ষণ লাগে নানিশ্চয়। তবু কেন এত হাহাকার কবির বুকের ভেতর!
যেদিকে বাড়াই হাত আগুনের চুমু
যেদিকে হাঁটাই দৃষ্টি ব্যর্থতার ধু-ধু
আগুনে আগুন জ্বালে অগ্নির ঘুঙুর
বাতাসে যন্ত্রণা জ্বালে জলের দুপুর
যেদিকে তাকাই শুধু হলো না হলো না
আমার কখন হবে বলা কি যাবে না?
এই যে আগুনের চুমু, ব্যর্থতার ধু-ধু, অগ্নির ঘুঙুর,জলের দুপুর সব—সবকিছু আজ বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে জ্বালিয়ে দিচ্ছে বুকভাঙা যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা।“ কবে আর হবে থাকিতে জীবন”—যেন সুর তোলে কবির হৃদয়ে।এদিকে গঙ্গাধর সাগরে নিখোঁজ, কে তাকে বলে দেবে কখন কবে তার ‘হবে’? কবি তাই পরজন্মে গঙ্গাধরের ছেলে হয়ে জন্মাতে চান।গঙ্গাধরকে ডেকে তার ছেলে হওয়ার গহীন ইচ্ছা প্রকাশ করছেন।কবির জীবন ভরা শুধু জল, কবির হৃদয় জুড়ে শুধু জল, জলের দুপুর, জলের নূপুর—কবির ভেতরে শুধু জল নড়ে, জলতরঙ্গ ছলকায়,পাতা ঝরে বুকের ভেতরকবি যেন একবিষের সমুদ্র মন্থন করে শিবের মতোন নীলকন্ঠ হয়ে আছেন—এক অনির্দেশ্য নীলকন্ঠ বাউল।
“আর জন্মে সত্যি যদি হই
আর জন্মে সত্যি যদি হয়
গঙ্গাধরকে ডেকে বলবো, আয় গঙ্গা আয়,
আমার গহীন ইচ্ছা তোর ছেলে হই।
ও গঙ্গা, আমার কথা তোর মনে আছে?
ও গঙ্গা, আমার কথা তোর মনে পড়ে?
আমার তো শুধু জল নড়ে জলতরঙ্গ
পাতা ঝরে নীলকন্ঠ বাউল।“
৬.
‘আমার সুন্দর আমার টেন্টালাস’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯৬ সালে। এই বইয়ের কবিতাগুলোতে মূলত কবি নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়েছে।’আমার আবার বসন্ত’ কবিতায় তিনি লিখছেন——
“আমার আবার বসন্ত! চোখ মেলতে কষ্ট হয় এতটুকুন ঘর
বহু খুঁজি খোঁজা করে নিজেকে জানাতে হয় নিজের খবর
অষ্টপ্রহর ঝুলে আছে কসাই সুন্দর, কে নেবে তত্ত্বতালাশ
কে সরাবে ঝরাপাতা মরাঘাস কে সারাবে জামার ফাঙাস
কে দেবে সন্ন্যাস সময় সহবাস কার এত ধৌম্য অবকাশ;
ভাগ্যিস আধখানা হৃদয় এখনো জীবন্ত”
(আমার আবার বসন্ত / আমার সুন্দর আমার টেন্টালাস / ১৯৯৬)
মন চলে যায় চর্যাপদের সেই বৌদ্ধ দোহার দিকে যেখানে উচ্চারিত হয়েছিল— “পাবত তাহী ঘর, নিতি উপবাসী”। এখানে কবি জানাচ্ছেন তাঁর জীবনটা কাটলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে-মাড়িয়ে, অর্ধেক খরায় আর অর্ধেক শীতে। এখানেও কবির দার্শনিকতার প্রবণতা বিদ্যমান; যেমন—
‘ছিন্নমূল না হলে কেউ বোঝে না মূলের মর্ম’,‘উদ্বাস্তু না হলে কেউ বোঝে না বাস্তুর ধর্ম,‘উৎসমুখ রুদ্ধ হলে চলে উৎসের সন্ধান, হনন খনন আয়োজন দেশ দেশান্তর’ ইত্যাদি। কবি কবিতার শেষে ঘোষণা দেন——
“আমার বসন্তও নেই, বাসন্তীও নেই, শুধু ভেতরে দহন
আমার এখন কালান্তর
বুক জুড়ে গোত্রান্তরের খেলা, স্বপ্নেও নেই উপমা উৎপ্রেক্ষা।”
(আমার আবার বসন্ত / আমার সুন্দর আমার টেন্টালাস / ১৯৯৬)
নিশ্চয় এক নির্মম সময় অতিক্রমের চিত্র আমরা এখানে পাই, সাথে পাই বাংলার কবিদের শাশ্বত জীবনচিত্র এবং সহজিয়া জীবনদর্শন। ‘একজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিনি’ কবিতাটি তাঁর নিজের প্রতিকৃতি নিজের চিন্তার স্বরূপকে ফুটিয়ে তোলে। ‘আজ একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতাটি যেমন মনে করিয়ে দেয় বাঙালির ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি, সেই সাথে এ জাতির জাত্যাভিমানেরও সূচনা এই দিনে। এই দিবস আমাদের জাগরণের দিন। তাই হয়তো কবিও উচ্চারণ করেন——
“অগস্ত্য দিন নয়, সাথী আজ একুশে ফেব্রুয়ারি
আজ জতুগৃহে আগুন লাগানো দিন
আজ জীবনের অনবদ্য প্রভাতফেরি
আজ শুধু জাগরণ প্রমা অন্বেষণ
আজ ঘুম মানেই আমৃত্যু মরণ
সাথী, আজ ঘুমের চেয়ে শহীদ মিনারে যাওয়াই উত্তম”।
(আজ একুশে ফেব্রুয়ারি / আমার সুন্দর আমার টেন্টালাস / ১৯৯৬)
‘আমার সুন্দর আমার টেন্টালাস’ নামটি হয়তো কবির এক দীর্ঘ সংগ্রামমুখর অথচ হতাশায় পর্যবসিত জীবনকে রূপায়িত করার প্রয়াস। আমরা জানি, টেন্টালাসকে এক ভয়ঙ্কর শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে জিউসের অভিশাপে। মিথের কাহিনী মতে শাস্তি হিসেবে টেন্টালাসকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে টার্টারাস নামের এক জলাশয়ে যেখানে জলে দাঁড়িয়েও সে তৃষ্ণার্ত হয়ে আঁজলা ভরে জল তুলতে গেলে জলের স্তর নেমে যায়। মাথার উপরে আপেলের গাছের ডাল ঝুলে আছে অনেক আপেল নিয়ে একেবারেই হাতের নাগালের কাছে।
অথচ হাত বাড়ালেই আপেল সরে যায় নাগালের বাইরে। এমন জীবনের সাথে কবি হয়তো তাঁর অপ্রাপ্তির বেদনার জীবনকে মিলিয়ে দেখেছেন “জিউসের প্রতি টেন্টালাস” কবিতায়।
“জলের তলায় থাকি জল পাই না খেতে
পথের উপর আছি পথ পাই না যেতে
বুকের ভেতর যদি
থাকতো একটা নদী
জীবন কেমন রাগী সেই জ্ঞানটি পেতে”
আর আমরা তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোতেও এই বুকের নদী বা কোনো নদীতে জীবনের কাছে খুঁজতে চেয়েছেন। আর, আমরাও কী আজীবন যা ধরতে চাই সোনার হরিণ হয়ে সে হাত ফসকে যাচ্ছে না প্রতিনিয়ত? আমরা কে আজ টেন্টালাস নই? কে নই নিয়ত তৃষ্ণার্ত!
৭.
‘সময়ের মায়াবী রাখাল’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালে। কবির প্রকৃতিপ্রেম আগে থেকেই আমরা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। তবে এ সময়ে তিনি যেন আরও সুক্ষ্ম অনুভূতি নিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছেন। ভোরবেলায় কয়েকটি চড়ুই যখন কবির জানালার পাশের উঠোনে কিছু খাবার খুঁটে খেয়ে চড়ে বেড়াচ্ছিলো, তাদের খয়েরি ডানার ঝিলিক যখন দেখছিলেন চোখ ভরে, তখন হয়তো কবি তাঁদের কিছু খাবার দিতে চেয়েছিলেন। ছিটিয়ে দিলেন মুগের দানা কিছু। কিন্তু চড়ুইপাখিরা ভয় পেয়ে উড়ে যায়। পাখিদের বুক থেকে এখনও মানুষের ভয় যায়নি, এই উপলব্ধি নিয়ে কবি ক্ষান্ত হন বটে। কিন্তু কথা শেষ হলেই কি ভাবনার শেষ হয়? না। সেই কত যুগ ধরে মানুষ গুলতি দিয়ে, ফাঁদ পেতে, বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে কতো পাখির রক্তে ঝরিয়েছে, কখনও খাবারের প্রয়োজনে, কখনও নেহাৎ খেয়ালের বশে। তাই আজও মানুষ পাখির বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। মানুষ কি মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেছে আজো?
“পাখিদের বুক থেকে কখনো যাবে না মানুষের ভয়ে
এ বিশ্বাস নিয়ে আমি দ্রুত ফিরে আসি
চুপিসারে আমার টেবিলে।”
(কয়েকটি চড়ুই / সময়ের মায়াবী রাখাল / ২০১৭)
এই চুপিসারে কবির প্রত্যাবর্তন জন্ম দিয়েছে এক অনিন্দ্যসুন্দর কবিতা। এমন প্রাণীচেতনা কবির আরও অনেক কবিতায় আমরা পাই। বিশেষ করে ‘একটি মৃত মাছের কাহিনী’ কবিতাটির। নাম উল্লেখ না করলেই নয়। আমরা প্রতিদিন বাজার থেকে মাছ কিনি, কেনার আগে
“জানায় চুপচাপ শুয়ে থাকা মৃত মাছটিকে
সকলেই প্রশ্ন করে :
যে কিনবে সেও
যে দেখবে সেও
বলে : দাম কত হে?
অনেকেই টিপেটুপে দেখে স্বাস্থ্য
কানকাটা নাড়েচাড়ে
তলপেটে হাত রাখে
গোপনে শরীর মাপে
বলে : ভালো আছ তো?
মাছটি শুধু তাকিয়েই থাকে, কিছুই বলে না।
মাছওয়ালা জানে না, ক্রেতারাও না
মাছটি নীরবে পুঁতে দিয়েছে তার দুটি
ঘোলা চোখ প্রতিটি ক্রেতার চোখে :
ক্রেতারাও ঘরে ফেরে আনন্দের মুচকি হেসে
তারপর চলে খাওয়া দাওয়া
তারপর একপশলা সুখী সুখী ঘুম :
তারপর হঠাৎ ঘুম ভাঙলে অন্যরকম ঘটনা
স্বামী চেনে না স্ত্রীটিকে
স্ত্রী চেনে না স্বামীটিকে
দুজনেই শুয়ে থাকে দুটি পৃথক ডালায়
ঘোলা চোখ মৃত মাছটি এখন নিজেই ক্রেতা
দেখে বরফের দৃষ্টিতে পাথরের চোখে
বলে : দাম কত হে?
বলে : ভালো আছ তো?
(একটি মৃত মাছের কাহিনী / সময়ের মায়াবী রাখাল / ২০১৭)
ফাউজুল কবিরের অনেক কবিতাই একটু বর্ণনাধর্মী হয়ে থাকে। অনেক সময় একটি শব্দবন্ধের পুনরাবৃত্তি পাঠকের মনে হতে পারে যে, এসব কমানো যেতো, কিন্তু তাঁর কবিতা সবসময়ই তা নয়। তিনি কবিতার প্রয়োজনে আঁটসাঁট কবিতা যেমন লেখেন, দীর্ঘ বয়ানের কবিতাও তেমনি লিখে চলেছেন নিত্য।
“আমার ভেতরে
বাস করেন
একজন মানুষ
বিশাল সম্ভ্রান্ত
আমার ভেতরে
চাষ করেন
একজন কৃষক
বেদনা আক্রান্ত
আমার ভেতরে আছেন একজন ভালোবাসা
আমার ভেতরে আছেন একজন সর্বনাশা”
(আমার ভেতরে / সময়ের মায়াবী রাখাল / ২০১৭)
এইভাবেই যদি কবিকে দেখি, তবে সহজেই অনুমেয় যে, সৃজন-প্রেম-কর্ষণ-ধ্বংস —— এইসব কিছু মিলিয়েই আমাদের এই কবিচরিত্র আমাদের সামনে ফাউজুল কবির হয়ে প্রতিনিয়ত মায়া ছড়িয়ে যান। ছড়িয়ে যান ভালোবাসা, শুনিয়ে যান নিজের নিত্য ধ্যানের সঙ্গীত।
৮.
‘জেগে ওঠো পাখির প্রমায়’ যখন ২০১৯-এ প্রকাশ পায় তখন যেন কবি ফাউজুল কবির তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা ও জীবনদর্শনের সাক্ষাৎ পেয়ে গিয়েছেন। তাই, এই গ্রন্থের প্রতিটি ছত্রই যেন বাণী হয়ে ওঠে। ১০টি ছোট ছোট পর্বে বিভক্ত দীর্ঘ কবিতা ‘সঞ্চয়ের ধুলোবালি’ কবিতায় যখন প্রশংসাকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস পান, তখন আমাদের হৃদয়ে অনুরণিত হয় প্রশংসার নতুন অভিজ্ঞান।
“প্রশংসা শুধু শব্দে গাঁথা বাক্য নয়, বাক্যের অধিক কিছু।
প্রশংসা মানে প্রার্থনা
যেন এমন হয়, অভিজ্ঞানে চারি ও কারুর সুন্দর।
প্রার্থনা করি যেন প্রতিদিন ভোরে হেসে ওঠে রোদ
মানবের প্রাণের প্রতিটি পাতায়। প্রার্থনা করি পৃথিবীর
কোনো চতুর শেয়াল যেন তোমাকে গল্পে গল্পে প্রলুব্ধ না করে।”
(সঞ্চয়ের ধুলোবালি / পৃষ্ঠা-৩৭ / জেগে ওঠো পাখির প্রমায় / ২০১৯)
একইভাবে প্রার্থনা বিষয়েও তাঁর বয়ান পাই——“সমস্ত প্রার্থনাই তো একান্ত নিজস্ব / এবং নিজের মতো করে নিজের কাছে চাওয়া রচনা”। কবি এই প্রসঙ্গে বলতে থাকেন যে, তিনি কোনোদিন কোনো গোলাপকে কারও কাছে প্রার্থনা জানাতে দেখেননি। “গোলাপ শুধু পাপড়ির ডানা মেলে হাওয়াকে ডাকে / ছড়ায় আত্মার লোবান, আর কথা বলে আকাশের সাথে। // আকাশ এমন এক পটভূমি / যেখানে তুমি সারাটি জীবন প্রার্থনার ছবি আঁকতে পারো।” (সঞ্চয়ের ধুলোবালি / পৃষ্ঠা-৩৭ / জেগে ওঠো পাখির প্রমায় / ২০১৯)। এই কবিতার প্রতিটি শব্দই তুলে দেবার বা তুলে ধরার মতো। যেমন আমরা আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র কবিতায় পেয়েছিলাম— “জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা”—— এই বাণী যেন অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ করেছে এই ‘জেগে ওঠো পাখির প্রমায়’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো।
‘মোড়ক’ কবিতায় কী অকপটে কবি বলে যান, দুপুরবেলা রোদেরা এসে তাঁর বাম পকেটে একটু বিশ্রাম নেয়, একথা সকলে জানে। তিনি বলেন, মোড়ক খুললে কেবল ছায়াবাজি ছাড়া কিছুই মেলে না। তবে, এখানে মানব চরিত্রের বড় দুর্বলতাটি ঘোষণা করে বলেন, “আসলে প্যাকেট পেলেই খোলার আকাঙ্ক্ষা জাগে।
‘একটি ছবির সন্ধানে’ কবিতার শুরু করেন একটি ব্যর্থতার সংবাদ দিয়ে যে, শুধু একটি ছবি আঁকবার চেষ্টায় তাঁর দুটি বছর পার হয়ে গেছে। অনেক রং, রঙের মিশ্রণ, বিমুগ্ধ রেখার ঢেউ, নিপুন স্কেচ ইত্যাদি অনেক ইশারা ইঙ্গিত করে যায়, কিন্তু ‘প্রার্থনার জীবন্ত মুখশ্রী’ কিছুতেই আঁকা গেলো না। আমার মনে হয় এই কবিতায় আমাদের কাছে কবি সশব্দে প্রকাশ করলেন প্রতি মুহূর্তে পথে প্রান্তরে অথবা তাঁর কবিতার শব্দবন্ধে
ঠিক কোন্ জিনিসটির সন্ধান করে ফিরছেন। তবে, তার সাথে টেনে এনেছেন গ্রিসের দার্শনিক ডিয়োজিনাসকে, যিনি পথে প্রান্তরে বাজারে দিনে দুপুরে হারিকেন জ্বেলে খুঁজে বেড়াতেন একজন সৎ মানুষ, যাকে হয়তো তিনি তাঁর জীবদ্দশায় খুঁজে বের করতে পারেননি। তাই আমাদের কবি সৎ মানুষ খোঁজেন না, তিনি যা খোঁজেন, তা হলো ‘একান্ত ব্যক্তিগত সুন্দর’।
কবিরা কল্পনার আধার। কতোভাবেই না কবি ভাবতে পারে! মানুষের ক্ষোভ এবং ব্যর্থতার ক্লেদ অনেক সময় এতোটা গভীর হয় যে, মনে মনে সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। এমন ব্যাপার কেবল কি মানুষেরই ঘটে? এমনকি হতে পারে, এই যে আমরা যে শহরটাকে আমাদের মতো সাজাই, সেই শহরটিরও ইচ্ছে জাগলো একটু ভেঙেচুরে নিজের মনের মতো হতে? হতেও তো পারে, যদি থাকেন সে শহরে নিয়ত পরিব্রাজক কবি ফাউজুল কবির।
“চট্টগ্রাম শহরটা তো আজ ভোর রাতে ঘুমের ভেতর
তিন টুকরো হয়ে
ভেঙে গেলো অকস্মাৎ নক্ষত্রদের চোখের সামনে
কেউ পায়নি টের আমি একাকী দর্শক
কাউকে বলিনি আমি——চুপচাপ দেখলাম
দেখলাম এক টুকরো নেমে গেলো
বঙ্গোপসাগর——খেলতে খেলতে জলের ভেতর
আরেক টুকরো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে
হেসে হেসে উঠে গেলো আনন্দের বাটালি পাহাড়
আরেক টুকরো দারুণ দ্বিধায়
সংকোচে আচমকা ঢুকে পড়লো আমার পকেটে
বুকে হাত দিয়ে বললো কাউকে বলিস না বলিস না।
………
আসলে কখনো কখনো
শহরেরও হঠাৎ নিজের জীবনকে ভাঙচুর করতে ইচ্ছে করে
ইচ্ছে করে ভেঙেভুঙে
দারুণ তচনচ করে বুকের ভেতর কোথায় কী আছে দেখতে।”
(ইচ্ছে করে ভেঙ্গেভুঙ্গে / পৃষ্ঠা-৬০ / জেগে ওঠো পাখির প্রমায় / ২০১৯)
এটি যেন এক স্বপ্নদৃশ্য। আবার এটাই হয়তো কবির ভেতরের ক্ষোভের সুচারু প্রকাশ। তবে, কেন যেন মনে হলো, এ শহরের সমস্ত শিল্পকলা ও সাহিত্যের জমিদারী এই ইমেজারির মধ্যে দিয়ে কবি তাঁর পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন, আমাদের বুঝতেই দিলেন না একটুও।
আবার স্যাটায়ারও পাকাপোক্ত করেই বাস করে কবির ভেতরে। একটি বিড়াল ছানার বেড়ে ওঠার গল্প বলতে বলতে তার শিকার শেখা ও লেজ নাড়ার খেলা দেখতে দেখতে অবলীলায় কবি বলে ওঠেন——
“বিড়াল ছানার শিকার শেখার চেয়ে
লেজনাড়াটাই আমার জীবনে বিজ্ঞতম সুখের মানুষী কাজ।”
(লেজ নাড়ছি সকাল বিকাল / পৃষ্ঠা-৮৩ / জেগে ওঠো পাখির প্রমায় / ২০১৯)
কবির দীর্ঘ পরিভ্রমণের ইতিকথা বহুবার কবিতায় এসেছে। কবিও মনে করেন “প্রস্তুতির জন্য দরকার ছিলো সুদীর্ঘ ভ্রমণ”। এই দীর্ঘ পথ তিনি পাড়ি দিয়েছেন যে পরম দায়িত্ব নিয়ে তা হলো ‘ভাঙামন পাথর জোড়ানো’ এবং মানুষে মানুষ ঘষে আগুনের আয়োজন করা——যেমন, আগুনের মুদ্রণ ছাড়া কবির সংসার চলে না; তেমনি আবার কবির সম্মতি ব্যতীত বুকের পাথরও নামে না। আজ তাই পরিণত বোধে ও প্রজ্ঞায় যে কবিকে আমরা পাই, তিনি এই পথচলার অভিজ্ঞতায় যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি মানুষে মানুষ ঘষে আগুন জ্বালাতেও ভীষণরকমের দক্ষতা অর্জন করেছেন, আর পাথর সরিয়ে ভাঙামন জোড়া লাগিয়ে পার করছেন সম্মুখের পথ। তাই পরবর্তী জীবনে যে কবিতাগুলো আমরা পাই তা বারবার বোধের জগতে টঙ্কার তুলে আলোক ছড়িয়ে যায়।
“অগ্নির মুদ্রণ ব্যতীত কবির সংসার চলে না
কবির সম্মতি না পেলে বুকের পাথর সরে না”
(গল্পের সন্ধান / পৃষ্ঠা-৮৮ / জেগে ওঠো পাখির প্রমায় / ২০১৯)
৯.
কবি ফাউজুল কবিরের ইদানীংকার কবিতাগুলো পাঠকের কাছে বেশ নিয়মিতভাবে পৌঁছে যায় ফেসবুকের কল্যাণে। তাঁর কবিতা সরল সহজ ভাষায় জীবনবোধের এক মহত্তর জগতে পাঠককে উপনীত করে। কবির কিছু অতি সাম্প্রতিক কবিতা থেকে উদ্ধৃত করছি——
ক.
“কবিতার চেয়ে সহজ মেধাবী
সর্বগ্রাসী কোনো আগুনের পথ নেই”
(কবি / ফাউজুল কবির / ১৭ ০৮ ২০১৯ / ফেসবুক)
খ.
“যার ঘর নাই
সে ঘরের দিকে যেতে চায় ।
আর
যার ঘর আছে
সে ঘরের দিক থেকে উল্টো পথে হাঁটতে চায় ।”
(ইচ্ছা / ফাউজুল কবির / ১৬ ০৮ ২০১৯/ ফেসবুক)
গ.
“অহংকার থাকা ভালো। নম্র মুগ্ধ সাহসী বকুল
যেভাবে ছড়ায় প্রাণ, ভালোবাসা কিরিচের ধার
যেমন মূর্ছনা তোলে টান দেয় আনন্দের মূল
বিশুদ্ধ আগুন জ্বালে সংগীতের অলোকের সুর
আকাশে হাওয়ায় কাঁপে জাগে ধ্বনি মধুর ! মধুর !
অহংকার থাকা ভালো– বলে ওঠে সমস্ত সংসার”
(অহংকার থাকা ভালো / ফাউজুল কবির / ১১ ০৮ ২০১৯; স– ১৫ / ফেসবুক)
ঘ.
“চমৎকার রোদ ফুটে আছে বৃক্ষের হাসির মতো।
বনে উপবনে যারা গায় বিতরণ করে সুর
রবীন্দ্র সংগীত তারা আমাদের বোন”
(সুন্দর তোমার নাম / ফাউজুল কবির / ০৯ ০৮ ২০১৯ /স –১৩ / ফেসবুক)
ঙ.
“যে খাদ্যকণাটি হঠাৎ তোমার হাত থেকে
খসে পড়ে গেলো মৃত্তিকায় ধুলায় অথবা ঘাসে
তার জন্য দুশ্চিন্তা করো না
করো না বেদনা নিয়ো না কষ্টের শোক
…
এ সংসার অকৃতজ্ঞ নয়
কোনো কিছু ফেলনা নয় পৃথিবীতে নয় মুল্যহীন
ব্যর্থ নয় নিঃস্ব নয় অর্থহীন নয় এই জন্মদিন —
এই যে গরীব কবি– ফাউজুল কবির
খ্যাতির মানচিত্রে নাই যার অনন্য সুনাম সমাজ ভূগোল
…
বন্ধুগণ! আমি জানি পিপীলিকারাই চেনে পৃথিবীর মহৎ কবিতা”
(ফাউজুল কবির ।। ১৯ ০৮ ২০১৯ / এ সংসার অকৃতজ্ঞ নয় / কবিতা– ৬৫তম জন্মদিনে /ফেসবুক ওয়াল)
চ.
“জুতোজোড়া ছিঁড়ে গেছে জুতোদের প্রাচীন নিয়মে
কিছুদিন আগে বেশ কিছুদিন আগে
পেরেক গেঁথেছে পায়ে
তাই রক্ত ঝরে তাই কষ্ট পাই বেদনাও পাই
অনেকে শুনেছে এখবর তবু কেউ জানে নাই জানে নাই
বোধ হয় কেউ বাসে নাই ভালো তাই জ্বালে নাই আলো
সময় সেলাই করে করে আপাতত একান্ত নিজের কবরে কাটাই”
(ছবি আঁকা শেষ হলে / ফাউজুল কবির / কাব্যগ্রন্থ –“জেগে ওঠো পাখির প্রমায় ” / ০৬-০৮-২০১৯)
ছ.
দুঃখের দিকে যেও না
কষ্টের দিকে যেও না
সস্তায় বাজারে মেলে ওসব মালপত্র
সুখের দিকেই যাও
আনন্দের হাত ধরো
সমুদ্রকে বলো ঢেউ দাও ঢেউ দাও
আকাশকে বলো শুধু নীল দাও নীল
বনে গিয়ে বলো বিশুদ্ধ ভিখারি
সহস্র বছর আমি
শূন্য থালা ভর্তি করে দাও ধন
সব অকৃতজ্ঞে দিয়ে আসি কিছু
মুঠি মুঠি দান — শস্যের সমান
এমন ফসল তোমারই প্রাণ—
আমাকে চাষের সাজ-সজ্জা দিও
বুদ্ধি ও বিশ্বাস সোনা ফলানোর
ও বন বন্যতা গোপনেই বলি
আমার ভেতরে সোনা আছে সোনা
তাই ভিক্ষা করি তামা আর রুপা ।
(ভিক্ষা করি / ফাউজুল কবির / ০২ ০৭ ২০২০ / বিশেষ–৭৪ )
জ.
কিছু বৃষ্টি পেলে জীবন্ত মুখর
ধুয়ে নেয়া যেতো সমস্ত কালিমা
হৃদয় ধোয়ার মতো বড় কাজ নেই
পবিত্রতা শব্দ তোমাকে মহৎ করে
যদি মহতের স্নিগ্ধতার অর্থ বোঝ ।
জীবনেরে একা ফেলে যেতে ভয় লাগে
কার কাছে রেখে যাবো অভয়ের সাথে
পাতা ঝরলে ত্রস্ত হই — বুক কাঁপে
মনে হয় কেউ মৃত্যুর সংবাদ দিলো
ফোন বাজলে মনে জাগে কালো প্যাঁচা ডাকে
দিন নয় রাত্রি ভালো মনে হয় বুকে
যদিও নির্ঘুম চোখ স্নায়ূ ছিঁড়ে যায়
জীবনের কথা মনে পড়ে একা একা ——
স্বগতোক্তি বলে জীবন সাঁতার শেখা
চতুর্দিকে কেউ টেনে যাচ্ছে গুপ্ত রেখা
কোথাও গোপনে বিষণ্ণ তাম্বুরা বাজে
জীবনের শিল্পী মরণের ফ্রেস্কো আঁকে ।
(কিছু বৃষ্টি পেলে / ফাউজুল কবির / ২৯ ০৬ ২০২০ / বিশেষ –৭৩ / দিনলিপি — ০১ / ফেসবুক)
অতি সম্প্রতি কবির কবিতায় হয়তো মৃত্যুচিন্তাও চেতন-অবচেতনে ঢুকে পড়ছে——হয়তো কোভিড সংক্রমণের কারণে অথবা জীবনের পরিপক্কতার কারণে। তবে, এই মৃত্যুচিন্তাও যেন জীবনচেতনায় ঝলসে ঝলকে ওঠে বারবার।
আবারও বলতে হয় কবি ফাউজুল কবির আমার পাঠ ও বোধের জগতে নিত্য প্রেরণা হয়ে থাকেন, ব্যক্তিগত জীবনেও বটে। আমার যে মহাকাল পরিভ্রমণ সংক্রান্ত সিরিজ কবিতাবলী গতবছর আর্টস বিডিনিউজ.কম-এ প্রকাশিত হয়েছিলো তার পেছনেও কবি ফাউজুল কবির-এর প্রায় প্রাত্যহিক প্রণোদনার কথা আমি স্মরণ না করে পারি না। তাঁর অগাধ পাঠ অভিজ্ঞতা, অপরিসীম বিনয় এবং বন্ধু বাৎসল্যের তল আমি আজও খুঁজে পাইনি। তাই প্রতিনিয়ত পরিবর্তমান ভাষা ও আঙ্গিকের এই কবি চিরচেনা হয়েও নিয়ত অচেনা থেকে যান আমার কাছে, আমাদের কাছে।
নিবাস: চট্টগ্রাম।
কবিতাই প্রধান বিচরণ।তবে নন্দনতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণগদ্য এবং অনুবাদকর্মেলিপ্ত।
কবিতার বই:
অন্যমন্ত্র(লিরিক১৯৯৫),
শাদা অন্ধকার(লিরিক২০১০),
ডায়োজিনিসের হারিকেন(ভিন্নচোখ২০১৮)
দীর্ঘ কবিতার পুস্তিকা:
শতখণ্ড(বাঙময়২০১৭)
আত্মজার প্রতি(বাঙময়২০১৭)
প্রবন্ধ/নিবন্ধ:
উত্তর আধুনিকতা: এ সবুজ করুণ ডাঙায়(লিরিক২০০১, পরিবর্ধিত২য়সংস্করণ: খড়িমাটি২০১৯)
অমৃত কথা(লিরিক২০১০)
অনুবাদ:
আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব: কয়েকটি অনুবাদ(লিরিক২০১০)
নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ(বাতিঘর২০১৮)
এমিলি ডিকিনসনের কবিতা(চৈতন্য২০১৮)