অনুবাদ: আমাকে বানিয়েছে আমার মা । ফ্রান্সেস গ্যাপার
শর্ট ফিকশনের তিনটি সংকলন সহ ছয়টি বইয়ের লেখক ফ্রান্সেস গ্যাপার। তিনি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বাস করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বেশ কয়েকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন, এবং ৫৫ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন। তারপর থেকে তিনি অনেকটা থিতু হয়েছেন পারিবারিক জীবনে। ফ্রান্সেস গ্যাপারের ফ্ল্যাশ ফিকশন Meniscus, Cafe Irreal, Wigleaf, The Ilanot Review, The Citron Review, New Flash Fiction Review, Splonk, Spelk, Spontaneity and Silver Apples এ প্রকাশিত হয়েছে।আমাকে বানিয়েছে আমার মা (My Mother Made Me) ফ্রান্সেস গ্যাপারের মূল লেখাটি অনুবাদ করেছেন লুনা রাহনুমা।
আমার মা আমাকে বানিয়েছে মাটির পাত্র তৈরী করার প্রাথমিক শিক্ষা ক্লাসে। ওটা ছিল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য স্থানীয় একটি সন্ধ্যাকালীন এডুকেশনের ব্যবস্থা। আমার মায়ের শিক্ষক বলেছে, প্রথমে মাটি তৈরী করো, খুব ভালোভাবে মাটি ছেনে ভেতর থেকে সব বাতাস আর ময়লা বের করে ফেলে দাও। নইলে পোড়ানোর সময় তোমাদের মাটির সন্তানেরা ফেটে যেতে পারে। আমার মা দুইহাতে মাটি ছানতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি একটা বড় ঢেলা পেলেন সেখানে। হাতে আটকায় এমন সবকিছু ফেলে দাও: শিক্ষকের কথা শুনতে শুনতে মায়ের হাতে ঠেকলো কিছু একটা, একটি ভাঙা কাঁচের টুকরো, মাটির পুতুলের শরীরে একটা নিখুঁত ছোট্ট হৃদয় যেন। মাটির ঢেলাটিকে ছুড়ে ফেলে দিতে লজ্জা হচ্ছিলো আমার মায়ের, তাই শেষমুহূর্তে মা ওটাকে আমার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। সৃজনশীল কাজে নিয়মের ব্যতয় করেছিল মা সেদিন, এর জন্য মা এখনো অনুতপ্ত হন। “তুমি ইট পোড়াবার চুল্লীতে ফেটে চৌচির হয়ে গেলে, তুমি পুরো ব্যাচটাকেই নষ্ট করে দিলে। আর সেই থেকে এখনো তুমি তেমনই আছো।” আমার সম্পর্কে আমার মায়ের কথাগুলোর অর্থ এমনই দাঁড়ায়।
মা: “তুমি এতোদিন কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে! আমি জানতাম তুমি নিজেই ফিরে আসবে। তাই আর পুলিশকে জানিয়ে বিরক্ত করিনি।“
আমার মনে পড়ে না আমি বাড়ি থেকে কোথাও গিয়েছিলাম কিনা। আমি তো বাড়িতেই আছি। আমার মা হয়তো রাস্তার সেই দুষ্ট ছেলেটি, যে মানুষের জানালায় ভাঙা ইট ছুড়ে মারে, তার সাথে গুলিয়ে ফেলেছে আমাকে। “তুমি কি স্টিভ এর কথা বলছো,” আমি জিজ্ঞেস করি।
মা: “হ্যাঁ, সেই ছেলেটিও তোমার মতোই। আর আমি নিশ্চিত জানতাম, দু একদিনের ভেতর তুমিও খাটের নিচ থেকে সুরসুর করে বেরিয়ে আসবে।“
আমি: “তোমার দুশ্চিন্তা হয়নি আমাকে নিয়ে? কেউ যদি আমাকে গুম করে ফেলতো? আমি যদি কোথাও মরে পড়ে থাকতাম?”
মা: “না, আমার মনে ভয় ছিল যে তুমি হয়তো জীবনে কোনদিন বাড়ির বাইরেই পা দিতে পারবে না। আমি সেইসব দুর্ভাগা মায়েদের একজন, যাদের বাচ্চারা মায়ের পুরো জীবনটাই বরবাদ করে দেয়। অপদার্থ সন্তান।“
এইভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে আমার পরিচিত মা`টি কোথায় যেন হারিয়ে যেতে লাগলো। ঘরের দেয়ালের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকলো। অথবা ছাদের কাছাকাছি কোথাও উঠে গিয়ে ভাসতে থাকলো মায়ের ধ্যানজ্ঞান সব কিছু। কিন্তু সেখান থেকে আবার ফিরেও আসে মা আমার কাছে। আমি যখন খুব জ্বরে বিছানায় পড়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম শীতে, তখন আমার মা বিছানার চাদর আর লেপের কভারটি বদলে দিলেন। আমার কপালে ঠান্ডা হাত রেখে বলেন, “হুম।” মা অজানা কোন দেশের আজব ধরণের গান করে শোনায় আমাকে। ট্রেতে রুমাল ভাঁজ করে তাজা ফুল সাজিয়ে নিয়ে আসে আমার সামনে। মা আপ্রাণ চেষ্টা করে আমাকে কিছু খাওয়ানোর। বলে, “দোকানে যাচ্ছি, তোমার কিছু লাগবে?”
একসপ্তাহ পর আমি সুস্থ হলাম। উঠে দাঁড়ালাম আবার। আমার মা কনসারভেটরিতে সিগারেট টানছিলো। “ওহ তুমি? বিছানায় পড়ে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছো তো? লেজি কাউ।“
“মা,” আমি অনুরোধ করি, “আমাকে একটা গান শোনাও।“
“যাও ভাগো। তুমি জানো আমি গান গাইতে পারি না।“
মায়ের বোন, আমার খালা লিন, দেখতে একদম আমার মায়ের মতোই। শুধু আরো লম্বা, তার উঁচু হিল জুতোর কারণে। তিনি খুব নরম মনের একজন ভালো মানুষ। তার চারপাশে বাতাস সোনার মতো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করে। “তোমার খালা একজন পরী,” আমাকে বলে মা। “তুমি কি উড়তে পারো,” আমি জিজ্ঞেস করি। “আরে না,” খালা বলে, “আমি কিছুতেই ছোট বাচ্চাদের মিথ্যা বলে ভোলাতে পারবো না দিদি।“
এরপর খালাকে আমি রান্নাঘরে পেয়ে কোণঠাসা করে ফেললাম।
– “তুমি যদি পরী হয়ে থাকো, তাহলে তুমি পৃথিবীতে কেন?”
– “যে কথাটি তোমার জানা দরকার সেই কথাটি জানাতে এসেছি আমি। তোমার মা আর আমি, ছোটবেলায় আমাদের জীবনটা খুব সহজ ছিল না। আমরা বিভিন্ন পরিবারে পালক সন্তান হয়ে থেকেছি, বড় হয়েছি। সেসময় অনেককিছু ঘটেছে আমাদের জীবনে। তাই, তোমার মা যদি সব সময় সুস্থ মায়ের মতো আচরণ না করে…. তুমি বুঝতেই পারছো আমি কি বলছি! আসলে ওর দোষ না।“
কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক