চকবাজার ট্র্যাজেডির পূর্বাপর

নিমতলী ট্র্যাজেডির ৯ বছর পর চকবাজার ট্র্যাজেডি। আমাদের ভুলোমন, অবহেলা আর দায়িত্বহীনতার আরেকটি খেসারত দিতে হলো ৭১টি তাজা প্রাণের বিনিময়ে । ২০ ফ্রেরুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা।ঘটনার পরে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ৬৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়। স্বজন হারানোর ব্যাথা কী সেটা যে স্বজন হারায় সেই–ই বুঝে। চকবাজারের আগুনে যে ৭১ জনের জীবন প্রদীপ নিভে গেল তাঁদের কতজন সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা? ঠিকমতো অনুসন্ধান করলে ২–৩ জনকে পাওয়া যেতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দারা উচ্চমূল্যে রাসায়নিকের গোডাউন, কারখানা ভাড়া দিয়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় নিজস্ব অথবা ভাড়া করা ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। রাসায়নিকের ঝাঁঝালো আগুন তাঁদের ছুঁতে পারেনি।
আগুনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, মারা গিয়েছেন তাঁদের বেশিরভাগই জীবিকার প্রয়োজনে সেখানে ছিলেন। চুড়িহাট্টার সরু রাস্তায় যানজটে পরে রিক্সাতেই প্রাণ হারিয়েছে মা–ছেলে। বোনের বিয়ের বাজার করতে গিয়ে পুড়ে মরেছে নর্থ সাউথের শিক্ষার্থী। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে আর আড্ডায় মগ্ন থাকতে থাকতেই পুড়ে মরেছে তিনবন্ধু। দাঁতের ডাক্তার দেখাতে গিয়ে সিটি কলেজের স্নাতকত্তোর পর্বের এক শিক্ষার্থী মারা গিয়েছেন। যিনি সরকারি চাকরির আশায় ছিলেন।
এত সব মৃত্যুর ভিড়েও গণমাধ্যমে বার বার আলোচিত হয়েছে ফাতেমা তুজ জোহরা বৃষ্টি ও তাঁর বান্ধবী রেহনুমা তাবাসসুম দোলার নিখোঁজ এবং তদপরবর্তী ঘটনা নিয়ে।
২০ শে ফ্রেরুয়ারি রাতে নিজেদের আবৃ্ত্তি সংগঠনের ‘অমর একুশের‘ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চকবাজার থেকে শিল্পকলায় গিয়েছিলেন বৃষ্টি ও দোলা।
অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার পথে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে পুড়ে প্রথম নিখোঁজ হন বৃষ্টি ও দোলা। পরে ডিএনএ পরীক্ষার পর গত ৭ই মার্চ বৃষ্টির লাশ সনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বৃষ্টি ও দোলার নিখোঁজ থাকার ঘটনায় কোন কুল কিনারা করতে পারছিলো না পুলিশ ও র্যাব । মেয়ের সন্ধান পেতে র্যাব পুলিশের দরজায় অনেক ধর্ণা দিয়েছেন বৃষ্টি ও দোলার বাবা, মা। বৃষ্টি ও দোলার নিখোঁজের ঘটনায় ফায়দা নিয়েছে জালিয়াত চক্র। ছড়িয়েছে অনেক গুঞ্জনের ডাল পালা। আগুনের ঘটনার পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি বৃষ্টির বাবা জসিম উদ্দিনের মোবাইলে বৃষ্টির নম্বর থেকে একটি কল করা হয়। বলা হয়, মেয়েকে ফেরত চাইলে এক লাখ টাকা পাঠান। জসিম উদ্দিন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে জালিয়াতচক্র আগে ৫০ হাজার টাকা পাঠাতে বলে। জালিয়াতচক্র একটি মোবাইল নম্বরে ‘নগদ’ ওয়ালেট –এ টাকা পাঠাতে বললে তিনি ৫০ হাজার টাকা পাঠান। এরপর থেকে ওই ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। একই কায়দায় দোলার বাবার কাছ থেকেও জালিয়াতচক্র দোলাকে ফেরত দেওয়ার কথা বলে টাকা দাবি করে। সেসময় তিনি লালবাগ থানার ওসির সামনে থাকায় প্রতারণার হাত থেকে বেঁচে যান।
২৬ ফ্রেরুয়ারী একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিসিটিভি ফুজেটে দোলা ও বৃষ্টিকে দেখা যায়। চকবাজার থানার উল্টো দিকের গলিতে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিসি ক্যামেরায় ওই ফুটেজ রক্ষিত আছে বলে জানিয়েছেন দুই পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা দেখেছেন, দুই বন্ধু এগোচ্ছেন রিকশায়। হাসিমুখে দোলা কিছু একটা বলছেন বন্ধুকে। দুজনেরই কোলের ওপর ব্যাগ। পরনে শাড়ি। ঘড়িতে সময় তখন রাত ১০টা বেজে ২৫ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড। চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ১০টা ৩১ মিনিটে।
সেই সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়ার পর আশংকা আর আর্তনাদের বদলে দুটি পরিবারে নেমে এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস, বাবা মেয়ের বন্ধুকে বললেন, তোমরা সবাইকে জানিয়ে দাও, আমার মেয়ে কারও হাত ধরে পালিয়ে যায় নি। তাকে কিডন্যাপ করা হয় নি। তার সাথে খারাপ কিছু হয় নি। সে চকবাজারের আগুনে পুড়ে মারা গেছে।
অগ্নিকান্ডের কবলে পরে নিখোঁজ হওয়া দুটি মেয়ে হারানোর যন্ত্রণাকে ছাড়িয়ে গেছে সমাজের মুখরোচক গল্প। তাইতো সিসিটিভি ফুটেজে ঘটনাস্থলের কাছে মেয়েদের দেখেও বাবা কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছেন “তোমরা সবাইকে জানিয়ে দাও, আমার মেয়ে কারও হাত ধরে পালিয়ে যায় নি। তাকে কিডন্যাপ করা হয় নি। তার সাথে খারাপ কিছু হয় নি। সে চকবাজারের আগুনে পুড়ে মারা গেছে‘ কি নিমর্ম আমাদের সমাজ ।
৮ই মার্চ আন্তজার্তিক নারী দিবস। মহা সমারোহে আমরা নারী দিবস পালন করছি। শহরজুড়ে সেমিনার হচ্ছে সিম্প্রোজিয়াম হচ্ছে। নারীর সাফল্যের গালভরা গল্প হচ্ছে। চারিদিকে নারীর গুণগান, জয়ধব্বনি আর স্তুতি বাক্যের পঙতি উড়ছে। কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গী সেটা কি পাল্টেছে? একটুও পাল্টায়নি। সমাজ পাল্টালে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টালে মুখরোচক গল্প ফাঁদার বদলে সেই সমাজ নিশ্চয়ই সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিতো। সহমর্মিতার হাত নাই-ই বাড়াতে পারি সমস্যা নেই, তবে মুখরোচক গল্প যেন না ফাঁদি ।

কথাসাহিত্যিক