| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

‘গভীর নির্জন পথে’—এক অনন্ত অভিসারের ধারাভাষ্য । তুষার বসু

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Gabhir Nirjan Pathe book gitoranga-specialএক-একটা বই থাকে যা পড়ার পর পাঠকের অতীতলব্ধ জ্ঞান-চেতনার জগৎ নড়ে ওঠে৷ এক-একটা বই থাকে যা লেখার আগে লেখকের সুদীর্ঘ যাপনচিত্র একটা স্থিতপ্রত্যয়ী ভাবনায় দৃঢ়নিবদ্ধ থাকে৷ এই দুই বিপরীত মেরুর মধ্যে চলে এক অনিবার্য আকর্ষণ-বিকর্ষণের খেলা৷ তার থেকে যা সৃষ্টি হয় তাকে কেউ বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ বলতে পারেন, আমি তাকে ভূমানন্দ বলতে পারি৷ সেই আনন্দময় দিব্যলোকে বিচরণের প্রবল ইচ্ছায় মাঝে-মাঝেই খুলে বসি সেই বইটির এক একটি পৃষ্ঠা, যেমন খুশি, অগ্রপশ্চাৎ না পড়েই৷ মুহূর্তে ডুবে যাই বইটির ভিতর, বোধহয় ঠিক বলা হলো না, আমি হেঁটে যাই ‘এক গভীর নির্জন পথে’৷ আমায় দিশা দেখান সদ্যপ্রয়াত লেখক সুধীর চক্রবর্তী মহাশয়৷ প্রায় দীর্ঘ দু’দশক ধরে তাঁর অন্বেষণ৷ বাউল-ফকিরের দল খুঁজে বেড়ান তাঁদের মনের মানুষকে, আর সুধীরবাবু তাঁদেরকেই মনের মানুষ করে নিয়ে তাঁদের খুজে চলেন এক ভিন্নতর গভীর নির্জন পথে৷ অত্যন্ত আন্তরিক এক অসামান্য মায়াবী ভাষায় তাঁর সেই পথচলা আর খুঁজে চলার আখ্যান নকশী কাঁথায় বুনে রাখেন সুধীরবাবু৷ কি বলে যে এই লেখার জাতিগোত্র নির্ণীত হবে সে বিষয়ে ধন্ধে থাকেন স্বয়ং লেখকই৷ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সুপরিচিত অধ্যাপক হয়েও এই অপারগতা তিনি অকপটে স্বীকার করেন৷ অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বন্ধু নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে সহমত হয়ে লেখাগুলিকে প্রবন্ধ বলে মেনে নিয়েছেন৷ কিন্তু এই গ্রন্থের লেখাগুলি কি প্রবন্ধ? শুরু হয়েছিল প্রবন্ধের হাত ধরেই৷ কখন যেন সেই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে লেখাগুলি নিজের খেয়াল খুশিতে ছুটতে শুরু করেছে, লেখকও হয়তো বুঝতে পারেননি৷ তাই আমার ভাবনায় এগুলি ঠিক প্রবন্ধ নয়, জীবন অন্বেষণের দলিল৷

এই বাংলাদেশে বহুকাল ধরে ধর্মচর্চা আর জীবনচর্যা নানান পথে বাহিত হয়ে আসছে৷ সেই পথেই গড়ে উঠেছে জানা-অজানা বহুবিধ সম্প্রদায়৷ প্রায় দেড়শো বছর আগে উইলসন সাহেব এবং তাঁকে অনুসরণ করে অক্ষয়কুমার দত্ত তাদের নিয়ে লিখে ফেলেন দুটি গ্রন্থ৷ তারপর থেকে সময় চলে গেছে আপন গতিতে৷ সমাজ এবং সংস্কৃতির ধারাও বদলেছে৷ হয়তো সেই সময়ের হাত ধরে বদলে গেছে প্রচলিত লোকধর্মের ছাঁদ৷ আমরা কেউ খবরও রাখিনি৷ তেমনভাবে চর্চিত হয়নি তাদের কথা, যারা শীলিত সমাজের চোখের আড়ালে রয়ে গেল নিজ নিজ ধর্মাচরণ আর নিজ নিজ সমাজ নিয়ে৷ কেমন আছে তারা, কেমনভাবে বেঁচে আছে, বাঁচিয়ে রেখেছে নিজস্ব পরিবৃত্ত! এক উৎসাহী তরুন গবেষক অন্তরের তাগিদে ঘুরে বেড়ান তাদের পদচিহ্ন ধরে বাংলার ঐ গ্রামছাড়া রাঙামাটির পথে পথে৷ তিনি ধরে রাখেন সেই বিচিত্র ভুবনের অন্তর্গহন বাণী, সারা দেশে ছড়ানো-ছিটানো বিচিত্র সব গৌণধর্ম আর তার সাধক-সাধিকা, রহস্যসংকুল তাদের দেহতত্ত্ব ও সাধনা, সাংকেতিক ভাষার ব্যবহার, দ্ব্যর্থক গান আর জীবনযাপনের কবোষ্ণ বৃত্তান্ত বাংলাগদ্যের অলিখিত-পূর্ব ভাষায়৷ আকাদেমিক লোকসংস্কৃতিচর্চার আড়ালে, সমাজ-বিজ্ঞান ও সমাজ-নৃতত্ত্ববিদ্যার সমান্তরালে অন্তঃশীলা প্রবাহে রয়ে গেছে এক মায়াবী বিশ্ব৷ গ্রামে গ্রামে আর গানে গানে গাঁথা সেই লোকায়ত যাপনের আখ্যান যেন জাদু-বাস্তবতার ঢঙে রূপ পেয়েছে বইটির ছ’টি অধ্যায়ে৷ উঠে এসেছে এমন সব মানুষ, চেনা সমাজে যাদের কোনও প্রতিরূপ খুঁজে পাওয়া যায় না৷ শোনা গেছে এমন সব গানের ভাষ্য ও বয়ান যা এতোদিন প্রায় অশ্রুত ছিল৷ আর এসবই আমরা পাচ্ছি এমন এক স্বাদু গদ্যের বয়ানে যা পাঠকের চোখে পরিয়ে দিচ্ছে এক মায়া-কাজল৷ মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা নিয়ে একটানা পড়ে ফেলতে হয় সেই ভাষ্য, যেতে হয় এক অনন্ত অভিসারে গভীর নির্জন পথ ধরে৷

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত