একটা শব্দও লিখতে না পেরে মানসিক যন্ত্রন্নায় ছটফট করছেন কবি আপ্লুত। মাথার মধ্যে কিলবিল করছে টুকরো টুকরো শব্দ, কিন্তু সেসব শব্দ জমাট বাঁধছে না। কবি কখনও বসছেন ল্যাপটপের সামনে। কী-বোর্ড স্পর্শ করে কখনো এলোমেলো করে ফেলছেন মাথার চুল। আবার কখনো পেন নিয়ে আঁকড় কাটছেন কাগজে। পরক্ষণেই ছিঁড়ে ফেলছেন কাগজটা টুকরো টুকরো করে। কখনো এক লাইন লিখছেন, কখনো দুই লাইন। তারপরই আবার ভালো না লাগায় ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কেটে দিচ্ছেন লেখাগুলো। সে পাগল পাগল অবস্থা।
কবির পাগল পাগল অবস্থা দেখে অভ্যস্ত কবিতা বড় কাঁচের কাপের এক কাপ চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি নিয়ে কবির স্টাডি রুমে প্রবেশ করলেন। কফির কাপ সেন্টার টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বললেন, “কফিতে চুমুক দাও, মাথার জ্যাম কেটে যাবে।”
কবি কবিতাকে দেখে ক্ষণিক থমকে গেলেন। তারপর কবিতার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলেন।
কবিতা কবিকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, “কি দেখছ, ওভাবে? গরম গরম কফিটা খেয়ে নাও।”
ঘরের বাইরে মাঘের কাঁপুনি। ঘরের ভেতর রুম হীটারের উষ্ণতা। কবির লেখার সময় কবিতা এই ঘরে প্রবেশ করেন না। একমাত্র যখন কবি শব্দের কবিতাকে খুঁজে পায় না তখনই কবিতা কফির কাপ হাতে এই ঘরে ঢোকেন। কবি আপ্লুত তখন কবিতার মধ্যে কি খোঁজেন। দু’চোখে কবিতাকে চুষে নিতে চান। কবিতা আস্তে আস্তে আপ্লুত-র পাশে বসে ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। আপ্লুত কফিতে চুমুক দেন।
আপ্লুত-র মধ্যে এত উন্মাদনা আগে ছিল না। গত বছর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “আমি নেই” পুরষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই আপ্লুত-র মধ্যে সেরাটা পরিবেশনের উৎকন্ঠা জাগ্রত হয়েছে। তারফলে কোন লেখাই তার মনোঃপূত হচ্ছে না। আপ্লুত লিখতেই থাকছেন আর নষ্ট করতেই থাকছেন।
কবিতা আপ্লুতকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। ওঁর কবিতা যেভাবে পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছে তাতে ওঁর একটা দুটো লেখা একটু কমজোরি হলেও কেউ সেভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন না। সব সৃষ্টি কি আর একইরকম হয়? হয় না। যেমন কোন সৃষ্টিই নিখুঁত হয় না, তাহলে ভগবানের শ্রেষ্ট সৃষ্টি মানুষের মধ্যেও কোনরকম খূঁত থাকত না। ওই সমীকরণ দেবতা জানেন না, তা মানুষ কি বুঝবেন – বহুল প্রচলিত একটা কথা।
আপ্লুত লেখার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। চাকরি করতে গি্য়ে লেখার সময় পাচ্ছিলেন না। কবিতা একটা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা। এই বছরের শেষে অবসর নেবেন। সংসার কবিতার দক্ষতাতেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। খুব দরকার না পড়লে সচরাচর আপ্লুতকে বিরক্ত করেন না কবিতা।
আপ্লুত প্রতিদিন সকাল বিকেল পাঁচ ঘন্টা করে দু’বেলা লেখা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন। লেখেন, আবার নষ্টও করেন ওই সময়ের মধ্যেই। যদিও ওঁর পরিশ্রম সার্থক হয়, ওঁর বই প্রকাশিত হওয়ার পর। প্রথম সংস্করণ বিক্রী হয়ে যায় সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। কবিতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে তাই আপ্লুত মন প্রাণ দিয়ে লড়াই করেন।
কবিতা আপ্লুত-র অনুপ্রেরণা আবার কবিতা ভালোবাসাও। তবে কবিতা সোহাগ করার সময় আপ্লুত-র কবিতাকে সতীন বলেন, ঠাট্টা করে। আপ্লুত তখন আঁকড়ে ধরেন কবিতাকে।
নতুন প্রকাশক, সমাজের ওপর কিছু কবিতা লিখতে বলেছেন আপ্লুতকে। কবিতা সংকলন প্রকাশিত হবে এবার পুজোয়। আপ্লুত এখন সেই নিয়েই ব্যস্ত। লেখার হাত চিরকালই ভালো আপ্লুত-র। বেসরকারি সংস্থার বেচুবাবুর কাজ করতে গিয়ে কবিতা সৃষ্টিতে ব্যাঘাত হওয়ার কারণে চাকরিটা ছেড়ে সম্পুর্ন ভাবে সাহিত্য সেবায় মন দিয়েছেন আপ্লুত জীবনের প্রথম ভাগেই। এই সিদ্ধান্তে কবিতারও সায় ছিল। তাই দেরি না করে আপ্লুত সম্পূর্ণভাবে কবি হয়ে গিয়েছিলেন।
সমাজকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বড় অসুবিধার সম্মুখিন হতে হচ্ছে কবিকে। কি লিখবেন আর কেন লিখবেন? কিভাবে লিখবেন আর কোথা থেকে লিখবেন? এইসব ভাবতে ভাবতেই পাগল পাগল অবস্থা । অনেক কষ্টে খান দুয়েক কবিতা লেখা শেষ করে কবিতাকে শোনাতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছেন আপ্লুত। কবিতার কবিতা পছন্দ হয় নি। কবিতাগুলোয় নাকি সমাজের সমস্যাগুলো নিয়ে কোন বার্তা নেই। এমন লেখা নাকি ঠিক যুৎসই হবে না। ফলে চিন্তা বেড়েছে আপ্লুত-র। তাই আবার নতুন করে শুরু করছেন। আবার নতুন করে লিখছেন – সমাজের কবিতা।
সংকলনের নাম ঠিক হয়েছে বলে মেল করেছিলেন প্রকাশক। মেল খুলে আপ্লুত দেখেছিলেন তাতে লেখা সংকলনের নাম – “সামাজিক”। অর্থাৎ যার মানে দাঁড়ায় – সমাজ সম্বন্ধীয়। আপ্লুত নতুন করে ভাবতে বসেন। আলোচনা করেন কবিতার সঙ্গে। কিন্তু কবিতা আসে না কী-বোর্ডের অক্ষরে। আপ্লুত-র মনে শঙ্কা জাগে, তবে কি শব্দভাণ্ডার শুন্য হয়ে গেল কবির? নাকি এবার অবসর নেওয়ার সময় হল? চিন্তার কোষে, কল্পনার নিউরনে কি দেখা দিল ভাঁটা? বয়সের মরিচায় কি জর্জরিত হল মস্তিষ্কের ভাবনা? যদিও কবিতা মেনে নিতে চান না। তবু শঙ্কিত কবির বুক কাঁপে। কবিতা যে তাঁর প্যাশন। কবিতা তাঁর ভালোবাসা। কবি রাত জাগেন। কবির খিদে পায় না। ঘুম আসে না। মাথার মধ্যে কেমন ভোঁ ভোঁ করে। মনে পড়ে কবির বিবাহিত জীবনের প্রথম ভাগের কথা, যখন….
যখন একটা সন্তানের জন্য কবিতা মাথা খুঁড়ছে শিব মন্দির থেকে কালী মন্দির। নামী ডাক্তারের কাছ থেকে অনামী ডাক্তারের কাছে। একটা সন্তানের জন্য নানারকম টেস্ট, ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নানারকম পুজো-আর্চা। তুকতাক্, মাদুলি, ঝাড়ফুঁক, জলপোড়া। শেষে সিদ্ধান্ত আধুনিক পদ্ধতীতে বাবা-মা হওয়ার। যুক্তিটা আপ্লুতই দিয়েছিলেন। রাজী হননি কবিতা। ক্রমশঃ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছিলেন নিজে থেকেই। তারপর…
যখন সন্তানের আশা প্রায় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন দুজনে। চিকিৎসাবিদ্যার ম্যাজিকে কবিতার গর্ভে সন্তান এসেছিল। শুরু হয়েছিল নতুন সংগ্রাম। কষ্টে পাওয়া সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবার প্রচেষ্টায় একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন দুজন পুরুষ ও নারী। সাবধানতা, নিয়ম মেনে চলা, কেয়ারিং, দশমাস ধরে চলেছিল সংগ্রাম।
নির্দিষ্ট সময়ে ‘সংগ্রাম’ এসেছিল কবিতার কোল আলো করে। ছেলের নামটা আপ্লুতর মস্তিষ্ক প্রসূত। সায় দিয়েছিলেন কবিতা। সংগ্রাম করে পৃথিবীতে আসা সংগ্রাম কালের নিয়মে বেড়ে উঠেছিল সুস্থ ভাবে। পড়াশুনো শেষ করে উড়ে গিয়েছিল বিদেশ। সেখানেই আজ সে সেট্ল। সেখানেই সে অ্যাঞ্জির স্বামী, রকি আর রোজির পিতা।
বাবা মায়ের সঙ্গে স্বাক্ষাৎ সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভিডিও কলের মাধ্যমে, সারাদিনে একবার। সংগ্রাম এখন অনেক দূরের বাসিন্দা। তবু আপ্লুত কিভাবে ভোলেন কবিতার সেই মা-হওয়ার সংগ্রাম। ছেলেকে জন্ম দেওয়ার সংগ্রাম।
কবিতার জন্ম দেওয়ার ব্যাপারটাও আপ্লুতর কাছে তো সেরকমই কিছু। আর আপ্লুত মনে করেন এই ব্যাপারটা শুধু তাঁর নয়, তাঁর মত সব কবি, সাহিত্যিকদেরই একই অনুভূতি। শিল্পীরা মা-য়ের মতনই। একজন মা-ও তো সবচেয়ে বড় শিল্পীই।

স্কুল জীবন থেকেই লেখার শুরু। ছোট, বড়, মাঝারি ও অনলাইন পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি। লেখাকে পেশা হিসেবে নয়, নেশা হিসেবে আঁকড়ে ধরে, লেখায় মগ্ন থাকাই ভালোবাসা। ভালো লাগে শব্দ সাজিয়ে সাহিত্যের মালা গাঁথতে। ভালোলাগে নানান ধরনের বই পড়তে । ছোটগল্প বা অণুগল্প খুব প্রিয়।