১৫ আগষ্ট কবি, সম্পাদক ও সাংবাদিক গিরীশ গৈরিকের জন্মতিথি। ঐ দিনটি বাংলাদেশের জাতিরপিতার প্রয়াণদিবস, শোক ও বেদনার দিবস হওয়ায় প্রতিবছর ১৮ আগষ্ট তাঁর জন্মতিথি পালন করা হয়। ইরাবতী পরিবার কবিকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
মা সিরিজ- ২৪
ছেলেবেলায় প্রেসার-কুকারের বাঁশি শুনে ক্ষুধা পেতো
হাত ধুয়েই বসে যেতাম কাঠের পিঁড়িতে।
মা স্টিলের থালা ভরে নিয়ে আসতে মাংসভাত
খাওয়া শেষে না হতেই পেটের ভেতর শুরু হতো বজ্রপাত
হাত না ধুয়েই এক দৌড়ে মন্দিরে বসে-ত্যাগের প্রার্থনায় রত হতাম
মন্দির থেকে ফিরে এলে মা আমায় জল দিয়ে পবিত্র করতেন।
আথচ! আজ সেই প্রেসার-কুকার আমার মস্তিষ্কের ভেতর রান্না করে
বাঁশি বাজাতে বাজাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে
হায় প্রেসার-কুকার তুমি আমার মস্তিষ্ক হয়ে গেলে।
মা সিরিজ-২৬
মাঝে মাঝে এমন হয়—আমার ডানহাত বামহাতকে
এবং বামহাত ডানহাতকে খুঁজে পায় না।
এমনকি তারা প্রায়ই ঝগড়া করে
ঝগড়া করার কারণ—কে কার চেয়ে বেশি অপরাধ করেছে
আর কে বেশি করেছে পুণ্যের কাজ।
বামহাত ডানহাতকে শাসিয়ে প্রায়ই বলে:
তুই এক বিধবার কুমারী স্তন চাপাচাপি করেছিস।
প্রতি-উত্তরে ডানহাত বামহাতকে বলে:
আমি না হয় চাপ দিয়েছি,
তুইতো তার নরম ত্রিভুজে এঁকেছিস প্রেম।
এরূপ ঝগড়া যখন হাতাহাতিতে রূপান্তরিত হয়
আমি তখন এক দৌড়ে বটবৃক্ষের নিচে এসে দাঁড়াই।
বটবৃক্ষ আমার মায়ের নাম। তার আঁচল ছায়ায়
আমার সকল দুঃখ বিনাশ করি।
আর ডানহাত বামহাত ঝগড়া ভুলে সহদোর ভাই হয়ে যায়।
ডোম সিরিজ
একুশ.
গন্ধের আনন্দে-গন্ধের অভিশাপে ছুটে আসে মাছি
মৃতদেহ কিংবা মলের গন্ধে মাছি-ফুলের গন্ধেও মাছি
এই মাছি ও মৌমাছি হয়ে বেঁচে রয়-মানব হৃদয়।
মৌমাছির মল চাকের ভেতর জমে জমে মোম হয়ে যায়
এসব মোম আলো হয়ে জ্বলে জীবনের অন্ধকারে
তাই ভাবি আমার কবিতা মাছি, না কি মৌমাছি।!
গভীর অন্ধকারে মোমবাতি হাতে
ঘোলা নদীর অস্পষ্ট জীবন নিয়ে বয়ে চলি—চোখের জ্বলে।
বৃষ্টির আনন্দে ব্যাঙের মতো ডেকে উঠি প্রণয় আখ্যানে
তবু কোথাও কেউ নেই—শুধু রাজপথে পড়ে আছে আমার মৃতদেহ।
আমার এ মৃতদেহ—আমিই আবার ডোম হয়ে কাটি
আর অনুসন্ধান করি, এই দেহের কোথায় লুকিয়েছিল বাংলাকবিতা।
বাইশ.
নিঝুম নদীতীরের সাথে ঢেউয়ের অভিমান বেজেই চলে
তীর প্রায়ই বলে: ঢেউ তুমি আমাকে অভিমানে স্পর্শ করো না।
আমরা সেই শান্ত নদীতে হাঁসের মতো ভেসে চলি—ধীরে ধীরে।
তবু সন্ধ্যা হলেই নিঝুম দীপের শ্মশান থেকে শব্দ আসে
. চৈ-চৈ-চৈ-চৈ।
আর আমরা সেই শব্দে প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক করে ডেকে উঠি।
আমরা ডাকতে ডাকতে দূরে বহুদূরে ভেসে যাই
যেখান থেকে চৈ-চৈ ধ্বনি আর শোনা যায় না।
চতুর্দিকে অবারিত রক্তমেঘ আর ধূ-ধূ জলরাশি
আমরা এই জলরাশির গভীরে কেন অনন্ত নিঃসঙ্গতায় ডুবতে পারি না!
আমরা কেন নবলব্ধ আকাশে মানুষের মতো উড়তে পারি না।
তাই আমার এই হাঁস জনমের বেদনা-ফাঁস করে গেলাম কবিতায়
যে কবিতা পাঠ করলেই শুনতে পাবেন : চৈ-চৈ-চৈ-চৈ।
গোধূলি
শূন্যঘরে একটি সাপ ও একটি বেজি পাশাপাশি বসবাস করে
তাদের মাঝে বিভেদের হাই তুলে—দাঁড়িয়ে কাচের দেয়াল।
সাপটি যখন আগুনের ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে—
তখন বেজিটি রণকৌশল বদলে হিংস্র হয়ে ওঠে।
তাদের এই দ্বন্দ্ব-কাচের দেয়ালে প্রতিদিন প্রতিভাত হয়।
মানুষের ক্ষুধার মাঠ ফসলের জলে ডুবে গেলে—
সাপ ও বেজিদ্বয় সেই জলে তাদের দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখে।
রাতের শেষে চাঁদ ডুবে গেলে কখনো তারা দ্বন্দ্ব ভুলে
জীবন থেকে জীবাশ্মের গান গায় আর নিরবে কাঁদে।
কাচের দেয়ালের মাঝে আলো আর অন্ধকার খেলা করে
অন্ধকারের সাথে আলোর মিলন ঘটলেই—
অন্ধকার কেঁদে কেঁদে আলোকিত হয়ে যায়।
এভাবে আলোর সাথে অন্ধকারের যে দ্বন্দ্ব—
সেই দ্বন্দ্ব সাপ ও বেজির রক্তে কথা কয়।
তাই সাপের রক্ত যতটা শীতল, বেজির রক্ত ততটাই উত্তপ্ত।
এভাবে তুমি আর আমি সাপ ও বেজি হয়ে খেলা করি—
পৃথিবীর আলোকিত অন্ধকারে—বিভেদের দেয়াল জুড়ে।
নোমান্স ল্যান্ড
চৌধুরী বাড়ির ছায়া আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসে
আমাদের বাড়ির ছায়া কখনো চৌধুরী বাড়ির দিকে তাকায়ও না
কেননা আমাদের ছোট্ট জন্মান্ধবাড়িটি-অন্ধকারের জাতভাই।
চৌধুরী বাড়ির কুকুর আমাদের বাড়ি আসে
আমাদের বাড়ির কুত্তা চৌধুরী বাড়ি যায়।
এভাবে চৌধুরী বাড়ির অনেক কিছু আমাদের বাড়ি আসে
অথচ-চৌধুরী বাড়ির মেয়েটি আমাদের বাড়ি আসতে পারে না,
আমার মতো ছোটলোকও যেতে পারে না চৌধুরী বাড়ির দুয়ারে।
হায়! সময়ের অন্ধ জাঁতাকল—
আমি কেন মানুষ না হয়ে কুত্তা হলাম না?
কোকিলের লাল চোখ ও কাকের নীল ডিম
তোমাকে মনে করার মতো
আর কোনো মন অবশিষ্ট নেই
এ যেন তুমি বাংলা স্বরবর্ণের লি-ই কার
কোনো ধ্বনি বা শব্দে যার ব্যবহার শূন্য থেকে শূন্যতম
কিংবা গভীর কুয়াশায় হেঁটে চলা তোমার পায়ের ছাপ
ডিম থেকে বাচ্চা পেতে হলে বুকের উত্তাপ প্রয়োজন
অথচ তুমি বরফ ভালোবেসে ঘুমিয়ে রাখলে শিশু পৃথিবী
আর আমার মনের মাঝে ঢুকিয়ে দিলে খনি গর্ভের অন্ধকার
ভগ্নাংশে আমি ইঁদুর দাঁতে খনন করে চলেছি তোমার মনোখনি
তবু তোমার মুগ্ধতায় মুখ ধুয়ে দেখেছি
শ্যাওলার সবুজ গন্ধে ভরে গ্যাছে আমার ঋগ্বেদের ছোট্ট দিঘি
অবশেষে ডান হাতের বুড়ো আঙুল হারিয়ে ভেবেছি
একটি অঙুলের মৃত্যু মানে—একটি হাতের মৃত্যু নয়
ঘোর
যারা এখানে একদিন প্রেমিক সেজে এসেছিল
তারা আজ অন্তরীণ—জলের সংসারে
জল যেভাবে ডোবায় ফসলের ক্ষেত
তারও অধিক ডোবায় ব্যর্থ প্রেমের চক্ষুপুকুর
যেমনি ডুবে থাকে ধুকপুক বুক নিয়ে অপ্রকাশিত কবিতার খাতা
আমার যে হাত তোমায় আঘাত করে
সে হাত আজ অভিশপ্ত হোক
বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাক আমার প্রণয়কুটির
যে কুটিরে তোমার উজ্জ্বল হাসির শব্দ নেই
সে কুটির হোক সাপ ও ব্যাঙের সন্ধিস্থল
তোমার যে স্পর্শ আমার শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়
আজ সে স্পর্শ হোক হিমালয়ের মতো শীতল
কিংবা মরুভূমি জয়ের মতো উষ্ণ
জন্ম: ১৫ আগস্ট ১৯৮৭, গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামে। শিক্ষা: হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকসহ স্নাতকোত্তর। পেশা: সাংবাদিকতা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা-২০১৬’, ‘মা আদিপর্ব-২০১৭’ , ‘ডোম-২০১৮’ ও ‘মেডিটেশনগুচ্ছ-২০২০’। সম্পাদনা: ‘বৈঠকখানায় নির্মলেন্দু গুণ-২০২০’। প্রধান সম্পাদক: www.poemvein.com। সংগঠন: ‘গীতাঞ্জলি সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি’ ও ‘বাংলাদেশ কবিতা মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক’।
E-mail:[email protected]
https://www.facebook.com/girish.bangali.9
01723920014