আজও পাদ্রিপাড়ার গলি দিয়ে যাওয়া হল না।
ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে টোটোকে বললাম – লালবাগান। ভেতরে ঢুকতে হবে না, মুখেই নেমে যাব।
টোটো টুনু ঘোষ সরণি দিয়ে চলতে শুরু করল।
আসলে যাওয়া হল না নয়, আমিই তাকে বললাম না। ঐ পথে যাওয়া হয়নি কত দিন! প্রায় ষোলো কি আঠেরো বছর। সেই যে ছিয়ানব্বুইয়ে মাধ্যমিক দিলাম তারপরই যেন লায়েক হয়ে গেলাম। তখনই সাইকেল কেনা হল। অ্যাটলাস…। আমার মানে সব বন্ধুদের পথ গেল বদলে। আমরা আর খানা-খন্দ গর্তে ভরা এঁকাবেঁকা সরু পথে হাঁটতেই ভুলে গেলাম।
মাধ্যমিক পাশের পর আমাদের শার্টের রং গেল পালটে। প্যান্টের ডিজাইনও। সাইকেল চালাতে চালাতে উড়ি রং-বেরঙের প্রজাপতির সামনে পাশে কিংবা পেছনে। তারপর সেই রঙিন বিকেল মিলিয়ে যাওয়ার সময়ই রঙিন প্রজাপতি এক একটা গলির মুখে এসে মিলিয়ে যায়।
আমরা আবার আপন পথেই ফিরে আসি বাড়িতে।
সেই সমরকাকুর সাম্রাজ্য। বিশাল মাঠ। বাগান। মন্দির। তিনটে বিরাট বিরাট পুকুর। লোকে টিকিট কেটে মাছ ধরত বাগানের পুকুরে। জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। অজস্র ঘর। অনেক ঘরে আমরা ঢুকিইনি।
সমরকাকুর দুই মেয়ে সুমিতা আর অমিতা আমাদের সঙ্গেই প্রাইমারিতে পড়ত। ওদের বাড়ির অনুষ্ঠানে আমাদের নিমন্ত্রণ থাকত। বাসব, জয়ন্ত, ডলি, রাইমা, আমি–সবাই যেতাম বিকেল বেলায়। বাড়ির উঠোনে ব্যাডমিন্টন, গোল্লাচু কিংবা চোর-পুলিশ খেলতাম।
(২)
সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে দেখতাম পাঁচিলের ধারে কত হলুদ কলকে ফুল ফুটেছে। আকাশের অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যেত জেট প্লেন। বিস্ময়ে দেখতাম সরু ধোঁয়ার রেখা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। ডলিও বুকে হাত রেখে আমার পাশে শুয়ে বলত – দেখেছিস, কী সুন্দর চাঁপা ফুল ফুটেছে? দাঁড়া কুড়িয়ে আনি।
ফ্রকের কোঁচরে করে আট-দশটা কাঠ চাঁপা এনে হাঁটু মুড়ে পাশে বসে আমার নাকের সামনে ঘোরাত। রাইমা, সঞ্জনা, বাসব সবাই ছুটে আসত। ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আমি অবাক হয়ে দেখতাম কেমন নিঃশব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে জেট প্লেনের ধোঁয়াটা।
আবার খেলা শুরু করতাম। সুমিতা ঘর থেকে একটা ক্যাম্বিস বল আনত। বিস্কুটের মতো সাতটা টালির টুকরো ওপর ওপর সাজিয়ে পিট্টু খেলতাম।
আমাদের তখন ক্লাস থ্রি। বিকেল ফুরিয়ে আসার আগেই বাড়ি ফিরে আসতে হয়। সুমিতাদের বাড়ির সামনে একটা লম্বা ঝিল। ঝিলের শেষে কেউ হেঁটে গেলে মনে হত লিলিপুট। ঝিলের পাড়ে ধোপাদের জলের মধ্যে খুঁটি পুঁতে কাঠ লাগিয়ে কাপড় ধোলাইয়ের পাঠাতন করা। বাড়ি ফেরার সময় আমরা সবাই এক একটা পাঠাতনে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতাম।
নারকেল গাছ তাল গাছের মাথার উপর কমলা রং কত্ত বড় সূর্যটা ছোট হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। পুকুরে কমলা আভা। জল ফড়িং ছোঁ মেরে যায়। কমলা রঙ গোল হয়ে ছড়াতে ছড়াতে আমাদের সামনে চলে আসে। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠি।
রাইমা বলে – এবার চল। মা বকবে।
জয়ন্ত বলে – একটু দাঁড়া না। সূর্যটা একে বারে ডুবে যাক।
ডলি বলল – তোরা থাক। আমরা চললাম।
আমরা সবাই পথে পড়ে থাকা একটা মাঝারি সাইজের ইঁটকে ফুটবলের মতো মারতে মারতে বাড়ি ফিরি।
একদিন ইঁটটা রাইমার গোড়ালিতে গিয়ে লাগল। রাইমা কেঁদে উঠে বলল, কাল থেকে তোদের সঙ্গে আর খেলব না।
সত্যিই রাইমা দু দিন এল না। স্কুলেও যায়নি। পরের দিন খেলতে গিয়ে দেখি রাইমা আসেনি। আমাদের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই গেলাম ওদের বাড়ি।
(৩)
রাইমার জ্বর। কাঁথা চাপা দিয়ে শুয়েছিল। খুব খুশি হল ওকে দেখতে গেছি বলে। বলল – তোরাই শুধু আমাকে দেখতে এলি। মামা জেঠুমারা কেউ আসেনি।
সঞ্জনা, অমিতা, সুমিতা, ডলি, অঞ্জলি করে চাঁপা আর কলকে ফুল নিয়ে গেছিল ওর জন্য। সব বাটির জলে ভাসিয়ে টেবিলে রাখল।
বাসব ওর পায়ে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করল–তোর সেদিন খুব লেগেছিল? ব্যথা?
বিনুনি দুলিয়ে রাইমা বলল, একটুও না। আমি তোদের সঙ্গে মজা করেছিলাম।
হাসতে হাসতে মজায় মজায় ঘরের মধ্যে বিকেল ফুরিয়ে এল। জানলা দিয়ে কমলা রঙের আকাশ দেখা যাচ্ছে। আমরা বেরিয়ে এলাম জয়নগরের মোয়া খেতে খেতে।
হাঁটতে লাগলাম পুটুস ফুল, আনন্দ ফুল, শ্যাওড়ার ঝোপের পাশ দিয়ে। গাছের ডালে ডালে পাখির কলরব। সূর্যের সামনে দিয়ে উড়ে যায় কাক।
হঠাৎই অমিতা বলল, – সন্ধে হয়ে গেছে। এবার ভাঙা মন্দিরের বনে শিয়াল ডেকে উঠবে।
ভয়ে আমরা দৌড়তে শুরু করলাম।
এসবই অমিতাদের। সমরকাকুদের… সবই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। এই মন্দির যে কত বছরের আমরা জানি না। এখানে খেলি, ঘুরে বেড়াই শুনে ঠাম্মা বলেছিল – ওখানে মামদো ভূত থাকে। মন্দিরের পাশের পুকুরে চান করতে নেমে কত মানুষ ডুবে গেছে তার হিসেব নেই।
ভাঙা পরিত্যক্ত সুড়কি ঝরা মন্দির বনের মাঝে। মন্দিরের চূড়ার গায়ে বড় বড় হয়ে উঠেছে বট অশ্বত্থ গাছ। সমরকাকু বলেছিলেন, ভেতরে তক্ষক আছে। ডাকে মাঝে মাঝে। মন্দিরের চার পাশে জমিতে মাঝে মাঝে গর্ত মতো হয়ে আছে। ওখানে নাকি ত্রিশূল পোঁতা থাকত ।
এই পথে সুমিতারা আসতে চায় না। সত্তর দশকের উত্তরের নকশাল আন্দোলনের হাওয়া আছড়ে পড়েছিল এই অঞ্চলেও। অমিতা এক বৃষ্টির বিকেলে বলেছিল, পুলিশ গভীর রাত্রে নকশালিষ্টদের ভ্যানে করে এনে পেছন থেকে গুলি করে মেরেই জঙ্গলে ফেলে দিত। ওর মেজ কাকাকে তাই করেছিল। পরের দিন কাকার দেহটা পাওয়া যায়।
সুমিতাদের সদর দরজার সামনে এসে আমাদের দৌড় থামল।
সমর কাকুর গলির একটা সরকারি নাম আছে। বিপ্লবী উপেন ব্যানার্জি লেন।
(৪)
এই নাম কেউ জানে না। এখানে পড়ে আছে আমার শৈশবকাল, কৈশোর বেলা। প্রথম চুম্বনের আবেশ। প্রথম যৌবনের সাম্রাজ্য।
সকলেই বলে এ অঞ্চলটা পালটে গেছে। পিচের রাস্তা হয়েছে। ফুটবল খেলার মাঠে ফ্ল্যাট উঠছে। মন্দিরটা মাটিতে মিশে যাচ্ছে যেন।
ভয় করে শুনতে আমার। ছেলেবেলাকে ভুলতে ইচ্ছা করে না। বন্ধুরা সবাই হারিয়ে গেছি। ছেলেবেলার স্বপ্নের গল্পগুলো ভুলে গেছি। ভুলে যাচ্ছি সত্তরের দশকে সেজমামার উধাও হয়ে যাওয়া কিম্বা খুন হওয়া। মা-মাসিরা আজও বলে – দেখিস, সেজদা এক দিন ফিরে আসবে।
দিদাও সে কথা বলতে বলতে একদিন ঘুমের মধ্যে মারা গেছে।
সমর কাকুর মাঠ আমায় ডাকে। ঘুমের মধ্যে ডাকে। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে পলিত কেশ সমর কাকুর আমায় ডাকে, – আয়। আয়…
আমি বলি – যাব। নিশ্চয়ই যাব… `
ক্লাস ফাইভে উঠতেই সব কিছু কেমন হয়ে গেল। মেয়েরা চলে গেল ঊষাঙ্গিনী অথবা শিক্ষামন্দিরের মতো স্কুলে। ছেলেরা গেলাম কানাইলাল, অরবিন্দ কিংবা রক্ষিতে। আমার সঙ্গে জয়ন্ত আর বাসব এল কানাইলালে।
[চলবে]

কথাসাহিত্যিক
স্কুলজীবনথেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করে শূণ্য দশকের গোড়ায় পাকাপাকিভাবে সাহিত্যে চলে আসা। ইংরাজি সাহিত্যের ছাত্র। একটি দৈনিকে বেশ কিছু বছর সম্পাদকীয় বিভাগে থাকার পর এখন প্রকাশনা সংস্থায়। আনন্দবাজার, এইসময়, বর্তমান, প্রতিদিন, তথ্যকেন্দ্র, একদিন, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, দৈনিক স্টেটসম্যান, গৃহশোভা, অদ্বিতীয়া প্রভৃতি বাণিজ্যিক পত্রিকার পাশাপাশি অসংখ্য প্রথম সারির লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে লেখা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ তিনটি – ‘তুলির শেষ টান’, ‘বর্ষাপুরুষ’, ‘সামাজিক’। লিখেছেন চারটি উপন্যাসও। গল্প থেকে তৈরি হয়েছে চারটি সিনেমা। তুলি-রং এবং বই পড়ায় অবসর যাপন। বিশ্বাস করেন, যতদিন মানুষ, ততদিন গল্প। যতদিন গল্প, ততদিন স্বপ্ন। এবং সব স্বপ্ন আগামীর নির্মাণ ও উত্তরণে।
বেশ স্বাদু গদ্য। স্মৃতিনির্ভর জীবনের রসদ এসব লেখকের।