| 6 অক্টোবর 2024
Categories
গল্প সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

তিলক

আনুমানিক পঠনকাল: 19 মিনিট

লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে আন্দাজে তুষুদির দরজায় একটা টোকা মারার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। দরজায় তুষুদি নিজেই দাঁড়িয়ে। চারদিকে অন্ধকার, কিন্তু তুষুদির পিছন থেকে, ইনভারটারে জ্বালানো তীব্র টিউব লাইটের আলো, আমার চোখকে একেবারে ধাঁধিয়ে দিল। তুষুদির পিছনে আলো। আলোটা নিপুণ কারিগরের মতো তুষুদির চিকন দেহটাকে একেবারে যেন নিপাট অন্ধকারকে কুঁদে বের করে এনেছে। এই বয়েসেও এমন তম্বী শরীর, আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একেবারে ফিটফাট। অরুণ বলত, তৈরি তুষু। পূর্ণ বলত, ব্যাটারি। এভার রেডি। দেখলাম, ঠিক তাই।

তুষুদি একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি! সত্যিই ভাবতে পারিনি। এসো।

আলোর মুখোমুখি হতেই তুষুদির সালঙ্কারা চেহারাটা জ্বলজ্বল করে উঠল।

ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, কোথাও বেরুচ্ছিলে নাকি?

তুষুদি খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, না না। বেরোব আর কোথায়? তারপরই তার মুখখানা উদ্বেগে ভরে উঠল। অ্যাই, তোমার না হার্টের অসুখ? লিফ্‌ট ছিল?

বললাম, না তো।

তা হলে উঠলে কী করে?

বললাম, একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে। যাই বলো, বুক যেন ফেটে গিয়েছে।

তুষুদি খপ করে আমার হাতখানা চেপে ধরে হিড় হিড় করে একেবারে ওর শোবার ঘরে টেনে নিয়ে গেল।

উজবুক কোথাকার। তোমার কাণ্ডজ্ঞান আর কবে হবে? এই দশতলায় সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলে।

তুষুদির হাতের মুঠো গনগনে গরম। আমার হাতে যেন ফোস্কা পড়ে যাবে। তুষুদিকে হঠাৎ অমন উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।

অপরাধীর মতো বললাম, তুষুদি জুতো। পায়ে জুতো। দাঁড়াও, জুতোজোড়া খুলি। তোমার ঘর নোংরা হয়ে যাবে।

তুষুদি সে কথায় কান দিল না। টানতে টানতে আমাকে ওর শোবার ঘরের বিছানার উপর ঠেলে ফেলে দিল। তারপর আমাকে শুইয়ে দিয়ে নিজেই আমার পায়ের থেকে এক এক করে দু’পাটি জুতো খুলে পাখাটা ফুল স্পিডে চালিয়ে দিল। কিন্তু পাখাটা তেমন জোরে ঘুরল না। তুষুদি জুতোজোড়া বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে সেখানে রেখে দিল। তারপর সে ও ঘরের আলোটাও নিবিয়ে দিয়ে এ-ঘরে এসে হাজির হল। এবার পাখার গায়ে জোর এল।

তুষুদির বিছানায় চারদিকে গহনা ছড়িয়ে আছে হাত আয়নাটা তুলে নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরে তুষুদি রাগে গরগর করতে করতে বলে উঠল, স্টুপিড, আগে নিজের মুখখানা দেখ ভাল করে। সোমেনও এই কাণ্ড করতে গিয়েই মারা পড়ল। লিফ্ট বন্ধ দেখে ওর আর তর সইল না। হেঁটে সিঁড়ি ভাঙতে গেল। অন্ধকার সিঁড়িতে কতক্ষণ পড়ে ছিল, তাও জানিনে। কে যে ওকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিল, তাও না। আমি তো তখন যন্ত্রণায় বেহুঁশ।

শুয়ে শুয়েই দেখতে লাগলাম, কথা বলতে বলতে তুষুদির গলা ভারী হয়ে এল। চোখ দুটো কেমন খালি হয়ে গেল। তুষুদির হাত তখনও কাজ করে চলেছে একটার পর একটা আমার জামার বোতাম খুলে দিল তুষুদি। আমি তুষুদির হাত দুটো ধরে ফেললাম। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কপালে হাত দিলাম। হাত ছোঁয়ানো যায় না। উঠে বসতে গেলাম। তুষুদি আমার বুকে ওর দু’হাত রেখে চেপে আবার শুইয়ে দিল।

ভারী গলায় বলল, উঠো না। এখন উঠো না। একেবারে বেড রেস্ট। কিছুক্ষণ চুপ করে বিশ্রাম নাও। কথা যা বলার পরে বোলো। আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছিনে।

বললাম, তুষুদি, তোমার গায়ে যে প্রচণ্ড জ্বর।

সে তো চব্বিশ ঘণ্টাই আছে। কী আর করা যাবে।

তুষুদি আমার চাইতে বয়েসে বড় কি না, এ নিয়ে কখনও তর্কে প্রবৃত্ত হইনি। তবে তুষুদির ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে ওর বয়েস আমার চাইতে এক বছরের বেশি লেখানো আছে। সেটাও আমি আগে জানতাম না। ম্যাট্রিক পাশ করার পর, একদিন নিরিবিলি পেয়ে তুষুদিকে আমি প্রেম নিবেদন করেছিলাম, তুষুদি মুখে কিছু বলেনি সেদিন, ঘরে ঢুকে ওর ম্যাট্রিক পরীক্ষার সার্টিফিকটটা এনে আমাকে দেখিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, এটা দেখে রাখ ভজু। তারপর থেকে আমি মনের কথা মনেই পুষে রেখেছিলাম। আজ বাষট্টি বছরে এসে কেন জানি না, সেই কথাটাই এখন মনে পড়ল।

তুষুদির প্রেমিক কি কেবল আমিই ছিলাম? সে এক লম্বা তালিকা। কবি, ব্যবসায়ী, উঠতি ডাক্তার, ফিল্ম প্রডিউসার, পার্টির কমরেড, চিত্রশিল্পী, আমার মতো ভ্যাগাবন্ড, তুষুদির সহপাঠী, এমনকী একজন আই সি এস-ও ছিল সেই তালিকায়, এমন গুজবও ছিল।

তুষুদি খানিকটা শান্ত হয়ে বিছানায় এসে বসল। হাত আয়নাটা তুলে নিয়ে নিজের মুখটা বেশ খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

কী দেখছ, জিজ্ঞেস করলাম। বয়েসটাকে তো একই জায়গায় বেঁধে রেখে দিয়েছ। কিচ্ছুই তো বদলায়নি মনে হচ্ছে।

চামচা স্বভাব তোমার আর গেল না দেখছি। এখন আর তেল ঢেলে কী হবে? পেটে তো জল জমছে। আজ ট্যাপ করিয়ে এলাম। আমি দেখছি, নাকের ফুটোয় ফাঁদি নথটা ঢুকবে কিনা। বড্ড ভারী। তবু আজ আবার ওটা পরতে ইচ্ছে করছে।

ব্যাপার কি, আজ তোমার ফুলশয্যে, সেটা তো জানতাম না।

তুষুদি একমনে নাকে নথটা ঢুকোবার চেষ্টা করে চলেছে। আমার কথার বিশেষ জবাব দিল না। বার বার নাকে নথটা ঢুকোবার চেষ্টা করছে।

নাঃ, তুষুদি যেন খানিকটা হতাশ, বলল, নাকের ফুটোটা বোধ হয় বুজেই গিয়েছে। এই গহনা কটা সারা জীবন ধরে কী কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছি, আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আর জানতেন তিলু মাসি। ওঁর কাছেই গচ্ছিত রেখেছিলাম। তাই আছে।

নাকে বার কয়েক খোঁচাখুঁচি করে হাল ছেড়ে দিল তুষুদি। নাকের ডগাটা লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। এই বুঝি ঝরঝর করে রক্ত গড়িয়ে পড়বে।

নাঃ, আবার বোধহয় এই বয়সে নাক ফোঁড়াতে হবে। তুষুদি এবার নিজের সঙ্গেই কথা বলছে, নাকি আমার সঙ্গে? ঠিক বোঝা গেল না। ওর চোখে চোখ পড়তেই দেখলাম, সে দুটো ভরা বর্ষার দিঘির মতো টলটলে হয়ে উঠেছে এবং তাতে পড়েছে স্বপ্নের এক খণ্ড ছায়া।

তুষুদি বলল, নথটার ওজন কত জানো? পাক্কা দেড় ভরি। চেন সমেত। সৌম্যর ঠাকুমার নথ। আমার নাকে নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার বাপর বাড়িতেও গহনা পরার রেওয়াজ ছিল। বাবা মেয়েদের খুবই ভালবাসতেন, আমাদের সব বোনের জন্যই নানারকম গহনা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন নথ পরার ফ্যাশান আমাদের সমাজে ছিল না। আমাদের কারও তাই নথ ছিল না। তখন কেবল নাকের ফুল। কী করে যে ওঁরা এই ভারী ভারী নথ পড়তেন, আমার কাছে সেটা একটা রহস্য। সৌম্যর ঠাকুমা নথ পরাতে গিয়ে দেখেন, আমার নাকের ফুটোয় সেটা ঢুকছে না। তক্ষুনি নাপতেনির ডাক পড়ল। নাকের ফুটো বড় করতে হল। সে এক এলাহি ব্যাপার। নাকের ব্যথায় ঘুমতে পারিনি ক’দিন। কিন্তু নতুন বউ। তায় আবার বিয়ে নিয়ে অত খিটকেল। কিছু বলতেও পারিনে। সৌম্য কলকাতায় তো নিদারুণ কমরেড তখন। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে একেবারে ভিজে বেড়ালটি। তখন আমি তো আর সৌম্যর বউ নই, জমিদারবাড়ির বড় ছেলের বউ। আমাকে তাই পরতে হল সেই নথ। আমার ঘাড় নথের ভারে একেবারে নুইয় পড়ল। মাথা সোজা রাখতে অনেক কসরত করতে হয়েছিল। সেই নথ পরে শ্বশুরবাড়ির মেয়ে মহলে যেদিন হাজির হলাম, সেদিন কী প্রশংসার ছড়াছড়ি। ওঁরা কী বলেছিল জানো? বলেছিল, সৌম্যর চোখ আছে। এ তো মেয়ে নয় গো, এ যে সাক্ষাৎ প্রিতিমে ঠাকরুন। কিন্তু সেই সৌম্যই আমার উপর হাড়ে চটে গেল। এ সব পরে সং সাজছি কেন? যার জন্য চুরি করি, সেই বলে চোর।

হঠাৎ তুষুদি চুপ করে গেল। নথটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুষুদির ঘোর কেটে গেল।

তোমার কোনও অস্বস্তি হচ্ছে না তো? সহজ স্বাভাবিকভাবে তুষুদি বলল, বুকে চাপ টাপ বোধ করছ না তো?

তুষু।

তুষুদি আমার ডাক শুনে আমার মুখের দিকে চাইল। আমি যে ওকে তুষু বলে ডাকলাম, সেটা শান্তভাবে মেনে নিল।

বললাম, তুষু, আজ তোমাকে একটা কথা বলি। হিসেবটা ঠিক করে রাখাই ভাল।

কোন হিসেব? তুষুদি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

তোমার মনে আছে কিনা জানিনে, তুমি একবার আমাকে তোমার ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট দেখিয়ে এজ প্রুফ করে নিয়েছিলে।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। তুমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলে, তোমার বয়েস আমার চাইতে বেশি।

কবে? কেন?

তোমার যখন মনে নেই, তখন আর সে কথা তুলে লাভ নেই। তবে, যেহেতু আমার মনে ওটা খচ-খচ করে, তাই মনে হয়, হিসেবটা ঠিক করে রাখাই ভাল। কেন না, আজ তুমিও যেমন জানো, মরণের সঙ্গে তুমি ঝুলন খেলা খেলতে শুরু করেছ, তেমন আমিও জানি যে, আমার ঝুলনও শুরু হয়ে গিয়েছে। সোমেনের যা হয়েছিল, আমারও তা যে কোনও দিনই, যে কোনও সময়েই, হতে পারে। আজও হতে পারত। তাই আমার মনে হয়, হিসেবের ফাঁকিটা মিটিয়ে ফেলাই ভাল।

আমি তো কখনও কাউকেই কিছুতে ফাঁকি দিইনি, ভজু।

না না, তুষু তুমি ফাঁকি দিতে যাবে কেন? ফাঁকিটা ছিল আমার সার্টিফিকেটে আসলে আমি তোমার চাইতে বয়সে বড়। আমার ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে কারচুপি ছিল। আমি তো স্কুলে মাইনে দিতে পারতাম না। তাই পরীক্ষার পর উপরের ক্লাসের খাতায় আমার নাম প্রায়ই উঠত না। সেই জন্যই ম্যাট্রিক পাশ করতে আমার সময় লেগেছিল। কিন্তু বয়েসটা লুকনো ছিল।

তুষুদি হা হা করে হেসে উঠল।

বলল, তুমি পাকা চোর অতিশয়। এই বুড়ো বয়েস পর্যন্ত আমার কাছে খোকা সেজেই থেকে গেলে! তাই সেদিন তোমার বুড়োটে চেহারা দেখে অমন অবাক হয়েছিলাম। যাই বলো, আমার কিন্তু ধারণা ছিল, তুমি বয়েসে আমাদের চাইতে ছোট ছিলে। তাই তখন তোমার কথা আমার কাছে ফাজলেমি বলে মনে হত। দেখ কাণ্ড!

তুষুদি হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

আজ আর আমাদের বয়েস-ফয়েসের হিসেব মিলিয়ে কী হবে?

কী আর হবে? কিছু না।

কিছুই না? তবে এ কথা বললে কেন?

হিসেবটা পরিষ্কার হয়ে থাকল। আমার দুটো পাখা গজাবে। আর কী? এখন দুজনেই দুজনকে ঠিক জায়গাটা থেকে দেখতে পাব।

তুমি তো আমাকে দেখতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ। দিব্যি।

বেশ ভাল ভাবেই দেখতে পাচ্ছ তো?

একেবারে পরিষ্কার।

বেশ, কী দেখছ?

তুমি তোমার নাকে সৌম্যর ঠাকুমার ফাঁদি নথটা লাগাবার আশা ছাড়নি। চেষ্টা করে চলেছ।

তুষুদি আমার হাতে নথটা তুলে দিল।

দেখো ভজু, নথটার ওজনটা একবার দেখো।

সতিই বেশ ভারী ওজনের নথ। তালুর উপর নথটাকে কয়েকবার নাচিয়ে সেটা আবার তুষুদিকেই ফেরত দিলাম।

বললাম, নিজের নাক কাটার পক্ষে জিনিসটা খুবই উপযোগী। এ শখ আবার জাগল কেন?

তুষুদি হাসতে হাসতে বলল, কারণ যাই থাক, তবে এতে যে কারও যাত্রা ভঙ্গ হবে না, সে গ্যারান্টি তোমাকে দিতে পারি।

তুষুদি বলল, ভাবতে পারো, আমি একদিন এটা নাকে পরে কনে বউ হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। কবে যে নাকের ফুটোটা বুজে গেল! এই ভজু, তুমি আমার নাকটা ফুটো করে দেবে? ফুটো আছে এই দেখো।

তুষুদি নাকটাকে একেবারে আমার মুখের কাছে নামিয়ে আনল। ওর গরম নিশ্বাস আমার নাক-মুখে যেন ছ্যাঁকা দিয়ে দিল।

বললাম, তুষু, তোমার যে প্রচণ্ড জ্বর।

আমার দু’ হাতের তালুর মধ্যে ওর মুখখানাকে ধরে ফেললাম। আমার চোখের সামনে ওর চোখ দুটো কী প্রখর ভাবেই না জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

বললাম, তুষু, এত জ্বর গায়ে নিয়ে এসব এখন না করলেই নয়?

তুষুদি বলল, তোমার হাত দু’খানা কত ঠান্ডা।

তুষুদি আমার খোলা বোতামের ভিতর দিয়ে ওর একখানা হাত আমার বুকে বুলিয়ে নিল।

তোমার শরীরটাও আশ্চর্য রকম ঠাণ্ডা। এ যে মর্গের শরীর। তুমি বেঁচে আছ তো ভজু? সোমেনকে যখন হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পেলাম, তার শরীরটা ঠিক এমনিই ঠান্ডা লেগেছিল। সেই ঠাণ্ডা আমার হাতে এখনও লেগে আছে।

তুষুদি একটু সরে গিয়ে আমাকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে দেখে নিতে লাগল। একটা বিষণ্ণতার ছায়া এক লহমায় তুষুদির মুখের উপর দিয়ে ঘুরে গেল। কিন্তু এক লহমাই। পরক্ষণেই তুষুদি হেসে ফেলল।

সত্যি, মাঝে মাঝে আমার কী যে হয় না আজকাল। কথাবার্তা কেমন এলোমেলো হয়ে ওঠে। আমার সামনে এমন জলজ্যান্ত তুমি, আর আমি কি না তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বেঁচে আছ তো? কোনও মানে হয়? বলো?

দেখো তুষু। তুমি এবারে বিশ্রাম নাও। শুয়ো থাকো। সত্যিই জ্বরে তোমার গা পুড়ে যাচ্ছে।

তুমি কি ভাবছ, আমি বিকারের ঘোরে প্রলাপ বকছি? আমি এখন বেশ ভাল আছি। একজন কেউ থাকলে আমার আর খারাপ লাগে না। একা একা… ওহ সে অসহ্য ব্যাপার। লোকজনের মধ্যে হইচই করে থাকতেই আমার ভাল লাগে। দেখেছ তো আমাকে সৌম্যর সংসারে। আমাদের সেই নফরচাঁদ লেনের বাড়িতে। কত কষ্টেই না কাটিয়েছি। দেখেছ তো? মানুষ ওভাবে থাকতে পারে, বলো? কিন্তু আমি ঠিক দিন কাটিয়ে গিয়েছি। আমার মুখে হাসি ছাড়া কখনও কিছু দেখেছ। বলো?

মিথ্যে কথা বোলো না তুষু। আমি তোমার চোখে জল দেখেছি তোমার ফুলশয্যার পরেই। তুমি বারান্দায় বসে বসে এক হাতে কেবলই পিঠের কাপড় টানছিলে, আর এক হাতে কয়লার তোলা উনুনেপাখার বাতাস করছিলে। তোমার কনে বউয়ের সাজ তখনও মোছেনি ভাল করে। তোমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছিল। চোখ করমচার মতো লাল।

আচ্ছা, সেটা কাঁদা হল?

তবে সেটা কি মুখে হাসি ফুটে থাকা হল?

কাঁচা কয়লার ধোঁয়া চোখে ঢুকলে কার চোখ শুকনো থাকে বাবা, শুনি? জীবনে কখনও উনুন ধরিয়ে খেতে হয়নি। জীবনে মানে বিয়ের আগের জীবনে। সৌম্যর ঘরে এসেই হাত পোড়াতে হল।

সেদিন অবিশ্যি এই হতভাগাই উনুনটা ধরিয়ে দিয়েছিল।

তা ঠিক। আমাকে সরিয়ে তুমিই উনুনের পাশে গিয়ে বসেছিলে। কী শিভালরি। একেবারে ব্ল্যাক নাইট আমার।

কেউ দাম দিলে না।

বেচারা!

জানো, জীবনে আর কারওর জন্য উনুন ধরাইনি আমি।

বুদ্ধির কাজ করেছ।

কেন?

সে বেচারার তা হলে সেদিন আর রান্না হত না। আমাকে বাড়িওলার ঠিকে ঝিকে পয়সা দিয়ে ডেকে এনে সেদিন তোমার শিভালরির মান রক্ষা করতে হয়েছিল। খাবার কিনে আনতে হয়েছিল।

কত দিয়েছিলে? খাবারের দাম ছাড়া।

ঠিক মনে নেই। বোধহয় দু’ পয়সা।

সে যে অনেক, তুষু।

সেদিন আমার কাছে সেটা অনেকই ছিল।

ভাগ্যি সেদিন তুমি আমাকে জরিমানা করনি। আমি সেদিন বউবাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। পকেটে একটা পয়সাও ছিল না।

তাই দু’দিন আমাদের ওখানে কাটিয়ে এলে। নির্লজ্জ কোথাকার। একখানা মাত্র ঘর। আর আমরা নবদম্পতি।

নির্লজ্জ না হয়ে উপায় ছিল না যে। আমাদের ওখানে পুলিশে হানা দিয়েছিল। কিন্তু আমি তো বারান্দায় রাত কাটিয়ছি।

সৌম্য সে জন্য আমার উপর খুব বিরক্ত হয়েছিল। তুমি তার কমরেড। তুমি বারান্দায় রাত কাটাচ্ছ। এটা সে সহ্য করতে পারছিল না। দু’রাত মুখ ফিরিয়ে সে শুয়ে রইল। আমাকে সে ছোঁয়নি পর্যন্ত। কিন্তু কমরেডই হও আর যাই হও, স্বামীর বিছানায় অন্য পুরুষ নিয়ে শোবার প্রবৃত্তি আমার হয়নি। সাফ কথা।

ক’ ঘণ্টারই বা ব্যাপার। তোমাদের খাটে বসে আড্ডা মেরেই তো রাতটা প্রায় কাবার করে আনতাম। কনসোলেশনের জন্য খানিকটা সময় তোমাদের একান্তে ছেড়ে দেওয়া হত।

মরি মরি মরি। কী অসাধারণ কাণ্ডজ্ঞান!

তোমার সেই জীবনে আবার একবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না তুষু?

না। একবারও না। কী কষ্টই না পেয়েছি।

পুরনো দিনের কষ্টকে তোমার কষ্ট বলে মনে হয়?

হয় হয়। মিথ্যে কাব্যি করে লাভ নেই। পেটে ছেলে বড় হচ্ছে। ঘরে ভাত নেই। হাত পুড়িয়ে রাঁধতে

হচ্ছে। আবার টাকা রোজগারের জন্য রোজ চুঁচড়ো কলকাতা করতে হচ্ছে। না ভজু, সেই দিনগুলোয় ফিরে যেতে আমার কোনও ইচ্ছেই হয় না। আজও যে যন্ত্রণা ভোগ করছি রোজ, সেও অসহ্য। এই রোগের যন্ত্রণাও সহ্য করা যায় না। একটা গান শুনেছিলাম, আমি চার যুগে হই জনম দুখিনী। মাঝে মাঝে মনে হয়, গানটা যেন আমার জন্যই লেখা। কেবল হেরে যাব বলে মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখি।

আমার কিন্তু একবার মনে হয়েছিল, তুষু, ফিরে যাই সেই দিনগুলোয়, সেই সব দিনে, যখন তোমার জীবনে কেউ আসেনি। একেবারে নিপাট নিভাঁজ ছিল তোমার জীবনটা। কী সরলই না ছিলে তুমি। সংসারের কোনও জটিলতাই তোমাকে স্পর্শ করত না। সেই তখনকার দিনে ফিরে যাই। তোমাতে আমাতে আর একবার মুখোমুখি হই। তোমাকে বোঝাই, তুষু, আমার বয়েসটা সত্যিই তোমার চাইতে বেশি। তখন আমাদের মনটার মতো আমাদের শরীরটাও ছিল একেবারে তরতাজা। রোগ ব্যাধি কোনও কিছুরই কোনও দাগ পড়েনি কোথাও।

যা বলেছ। তবে এখন যেখানে ফিরে যেতে চাইছ, সেখানে একটা আপেল গাছ অবশ্যই থাকা চাই। তুমি আর আমি তার তলায় গিয়ে দাঁড়াব। দুটো ডুমুরের পাতা হলেই আমাদের লজ্জা নিবারণ হয়ে যাবে। তারপর অপেক্ষা করব কখন সেই সর্পবেশী শয়তানটা আসবে আমাদের প্রলোভন দেখাতে। কিন্তু এবার আর আমরা তার মনভোলানো কথার খপ্পরে পড়ব না। কিছুতেই নিষিদ্ধ আপেল খাব না। তা হলে আর আমাদের কখনও নির্বাসন হবে না এই যন্ত্রণাময় ধুলোর পৃথিবীতে। কী বলো? ভজু? বাবা আদম?

তুমি, তুমি একটা যাচ্ছেতাই…

তুষু দমকে দমকে হাসতে লাগল।

তোমার মুখটা একবার এই আয়নায় দেখে নেবে, ভজু?

কেন বলতো?

তোমার মুখটা কতটা বোকা বোকা হয়ে যায়, সেটা তা হলে দেখতে পেতে।

স্বপ্ন দেখলে সকলের মুখই বোকা বোকা লাগে।

তুমি বুঝি মুখের সামনে আয়না ধরে স্বপ্ন দেখ?

না। আজকাল জেগে জেগেই আমাকে স্বপ্ন দেখতে হয়। ব্যথাট্যাথাগুলো রাতেই চাগাড় দিয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে বুকের ব্যথায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমাকে তখন উঠে বসতে হয় বিছানায়। তাতেও না কমলে মশারির বাইরে গিয়ে দাঁড়াই ব্যথা চেপে জানালার কাছে চলে যাই। একঘণ্টা, কখনও দেড়-দু’ঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আর রাতটা তখন কেমন ঘন হয়ে আসে। তখন আমার স্বপ্ন দেখার সময়।

তুষু আবার তার গহনাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আরম্ভ করেছে।

তোমার সঙ্গে সেদিন যখন দেখা হল রবীন্দ্রসদনে, সেই আবছা অন্ধকারে, আমার মনে হল, এই রকমই একটা স্বপ্ন বুঝি দেখছি কিন্তু আলো জ্বললে দেখলাম স্বপ্ন নয়, সত্যিই তুমি। তোমার কথা শুনেছিলাম, নানা সময়ে নানা বন্ধুর মুখে। তোমার ব্যাধির কথাও শুনেছি কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হল, কিছুই যেন হয়নি তোমার।

কেন, আমি যে তোমাকে বললাম অত কথা।

সে তো কথা। কিন্তু তোমার মুখ চোখ শরীর তো তার সাক্ষী দিল না।

তা অত লোকের মাঝখানে কি কাঁদুনি গাইব? তোমার বউকে দেখে সেদিন আমার খুব ভাল লেগেছে। খুবই ভালমানুষ।

কিন্তু ডুমুরের পাতার বদলে সেদিন শাড়ি পরে ওখানে গিয়েছিল, এই যা।

ধ্যাৎ, যত বাজে রসিকতা। তোমার বউ তোমাকে সহ্য করে কী করে?

সেটা আমার কাছেও একটা রহস্য।

তোমাকে সেদিন রবীন্দ্রসদনে দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।

আমিও তুষু।

অন্ধকারে তোমরা যখন গাঁ ঘেঁষে এসে বসলে, আমি ভাবলাম কে না কে?

সেই অন্ধকারেও তুমি যে জেল্লা ছাড়ছিলে, তা দেখে আমার কিন্তু এক নিমিষের জন্য মনে হয়েছিল, কে, তুষু নয় তো। কিন্তু তুমি যে তুষুই সেটা নিচয় করে বুঝতে পারিনি। তুমি কি আজকাল একটা সেন্টই মাখো?

কেন বলো তো?

সেইদিনও তোমার শরীর থেকে এইরকম গন্ধই বের হচ্ছিল।

হ্যাঁ, এটা এখন আমার ফেভারিট সেন্ট। চার্লি। এমন কিছু এক্সক্লুসিভ নয়। যাই হোক, আমার ভাল লাগে।

আমার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠতে দেখে তুষুদি জিজ্ঞেস করল, কী হল? হাসছ যে?

একটা পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। তুমিই আমাদের জীবনে প্রথম সেন্ট মাখা মেয়ে। তুমি কাছ দিয়ে হেঁটে গেলেই তোমার শরীর দিয়ে এমন একটা মোলায়েম গন্ধ বের হত যে আমার শরীরটা শিরশির করতে থাকত। তোমার জন্য, না তোমার গায়ের ওই মাদকতাময় গন্ধটার জন্য, কীসের জন্য যে তোমার উপর আমার ভালবাসাটা পড়েছিল, এখন আর ঠাহর করতে পারিনে।

ফের বাঁদরামি হচ্ছে! গায়ে কিন্তু কাঁটা বিধিয়ে দেব, বলে দিচ্ছি।

আমি আর হাসিটা চাপতে পারলাম না। বেশ জোরেই হেসে উঠলাম।

তুষুদি ঘোরতর সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইল।

দেখো, তোমার মতলব কিন্তু ভাল নয় বলেই মনে হচ্ছে একটাও বাজে কথা কইবে না, বলে দিচ্ছি।

কথাটা যে আমার নয়। অরুণের। বলতে দোষ কী? সে তো তোমার প্রেমিক ছিল, না কী?

নিশ্চয়ই ছিল। আমার দুঃখের মুহূর্তগুলো সেই ওরাই তো হালকা করে দিত। অরুণ আর তার জুড়িদার পূর্ণ। আজ আর আমাদের পৃথিবীতে অরুণ নেই। পূর্ণ তো কবেই কেটে গিয়েছে। পূর্ণটাই বেশি জ্বালিয়েছে। ঘরে চাল নেই ডাল নেই, সৌম্য কখনও পার্টির ধান্ধায়, কখনও চাকরির ধান্ধায়, টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্ধেয় উনুনের সামনে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। হুট করে পূর্ণর উদয় হল। বলল, প্রেয়সী, আহা, কী সুন্দরই না তামাকে দেখাচ্ছে। পয়সা থাকলে ইলোপ করতাম তোমাকে। তা যখন নেই, অগত্যা তুমি একটা গান শোনাও। এই আমার শেষ অনুরোধ। কারণ এর পরে গিয়েই আমি আত্মহত্যা করব।

তুষুদির মুখ চোখ থমথমে হয়ে এল। পরক্ষণেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

তুষুদি বলল, তোমরা ছিলে সিনেমার বদহজম। প্রত্যেকেই নিজেকে মনে মনে এক একজন প্রমথেশ বড়ুয়া বলে মনে করতে। পূর্ণকে বললাম, আত্মহত্যা না করে কয়েক সের চাল ডাল জোগাড় করে আনো দেখি। ওর একই কথা। এখন আমার কাছে আত্মহত্যাও যা, আর তোমার সংসারের জন্য চাল ডাল জোগাড় করে আনাও তাই। সেই তো চুরি আর না হয় পকেট মারতে হবে। জেল অনিবার্য। যাক গে যাক, মজুরিটা তো আগে দিয়ে দাও। গান শোনাও তুষু। বলে পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল। ওর গায়ে ধাক্কা মারতে গিয়ে দেখি জ্বরে ওর শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে। ধুম জ্বর। বললাম, এ কী! পুর্ণ বলল, কিছু নয়। শরীরটা গরম হয়ে উঠেছে আকাঙ্ক্ষিত রমণীকে কাছে পেলে প্রত্যেব পুরুষের যা হয়ে থাকে। কী ফাজিল ছিলে তোমরা। গান গাইতে হল। গাইতে গাইতে আমার মনটাও একেবারে হালকা হয়ে গেল। চাল ডাল সংসারের কথা ভুলেই গেলাম। সৌম্য ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল। তার সামনেই পূর্ণ বলে উঠল, তোমার কী সেক্স তুষু! তুমি একটা হিরের খনি। একেবারে আনট্যাপড। এবারে আমি পূর্ণর গালে ঠাস করে একটা চড় মারলাম। অসভ্য, বাঁদর। পূর্ণ হাসতে হাসতে বলল, সৌম্য, দেখলে তো, সত্যি কথা বলার কী ফল। কী একখানা মেয়েই যে বিয়ে করেছ। বলে বিনা ভূমিকায় উঠে চলে গেল।

তুষুদির মুখ চোখ আবার গম্ভীর হয়ে এল।

কিন্তু অরুণ তোমার নাম দিয়েছিল, গন্ধগোকুল। তোমার সাড়া আমরা তোমার সেন্টের দৌলতেই পেয়ে যেতাম। আর আমরা চুলবুল করতাম।

গন্ধগোকুল! তুষুদি আবার হাসতে লাগল। কী পাজি! কী পাজি! তা এতই যখন গন্ধগোকুল, তখন আমার কাছেই বা এত ঘুর ঘুর করতে কেন? গোলাপ কি চাঁপা, এমন কী অগুরু, এমন কেউ ছিল না, এই কলকাতা শহরে?

সেটা আজকের কলকাতা নয় তুষু। সেদিনকার কলকাতায় আমাদের জীবনে কটা নারীই বা ছিল। ভেবে দেখ তুমি? তুমি ছিলে, ২০২-এর রাণুদি, আর বেহালার পটেশ্বরী ঠাকরুন। যাঁর পা-টুকু স্পর্শ করতে পারলেই আমাদের জীবন ধন্য হয়ে যেত। এ ছাড়া সারা কলকাতা শহরই তো তখন আমাদের কাছে খাঁ খাঁ করত। রমণীর কী দুর্ভিক্ষই না গিয়েছে আমাদের জীবনে। তুমি, রাণুদি আর পটেশ্বরী ঠাকরুন, এই তিনজন মিলে আমাদের মনে যে নারীর ছকটা এঁকে দিয়েছিলে তোমরা, সেই ছকটা বয়ে বয়েই তো আমাদের সন্ধে ঘনিয়ে এল।

সেই অরুণ তো হারিয়ে গেল।

পূর্ণ তার ঢের আগে। তার গা ভরা জ্বর আর ফুসফুস ভরা গ্যালপিং টিবি-র বীজাণু নিয়ে আমাদের সকলের আগে সেই না চলে গেল।

ওদের কথা জানি, ভজু। কিন্তু তুমি? তুমি কোথায় ছিলে? তুমিও তো হারিয়ে গিয়েছিলে?

আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম তুষু।

হ্যাঁ, তুমিও হারিয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু কোথায় ছিলে এতদিন?

কেন, এই কলকাতা শহরে।

তুমি কলকাতা শহরে ছিলে! এত বছর ধরে! এই কলকাতাতেই!

কত বছর হবে, বলো তো? তা চল্লিশ বছর তো বটেই।

তোমার ছেলের বয়স চল্লিশ হল?

হল বইকি।

সত্যিই তুষুদি আমাকে অবাক হয়ে দেখতে লাগল।

অবাক হবার কী আছে?

অবাক হবার কিছু নেই? তুমি বলছ কী ভজু? চল্লিশ বছর ধরে তুমি আর আমি এই শহরে আছি, অথচ একবারও আমাদের দুজনের দেখা হল না!

এই শহরটা জঙ্গল তুষু। মানুষের জঙ্গল। সুন্দরবনের চাইতেও মারাত্মক। এখানে যে হারিয়ে যেতে চায়, তাকে খুঁজে বের করা সত্যিই মুশকিল।

তুমি আমার কাছ থেকে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলে? সত্যি?

সেটা কি উভয়ত নয়, তুষু? ভেবে দেখ?

তুষুদি বিছানার দিকে মুখ নামিয়ে চুপ করে বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ। হঠাৎ ঘরে বিজলি এসে গেল। তুষুদি নেমে গিয়ে ইনভারটারের চার্জটা ঠিক করে দিয়ে আবার আমার কাছে এসে বসল।

সত্যিই ভজু, এটাকে একটা অবাক কাণ্ড বলতেই হবে। কত কী ঘটে গেল এতগুলো বছরে। অ্যাঁ?

হ্যাঁ, তা তো বটেই। পার্টির ব্যান উঠে গেল। দিনরাত পুলিশে ধরার জুজুর ভয়টা কেটে গেল আমাদের। পার্টি করা আর তেমন বিপজ্জনক ব্যাপার রইল না। পার্টিতে প্রবেশেও আর কোনও কড়াকড়ি রইল না। উঠতি যৌবনের সেই আদর্শবাদের রোমান্তিকতা কোন দিন যেন মুছে গেল। তার চাইতে বড় হয়ে উঠল পরিবার প্রতিপালনের সমস্যা। আমি পার্টি ছেড়ে দিলাম।

আমারও ঠিক তাই ভজু। ছেলেটা যখন এসেছে, তখন বড় করবার দায়টা যে আমারই, এটা যেদিন বুঝতে পারলাম, একটা সরকারি চাকরি পেলাম, সেদিন আমিও বললাম, এবার আমাকে এ সংস্পর্শ ছাড়তে হবে। সৌম্য হ্যাঁ না কিছুই বলল না, যদিও আমি রাজনীতি নিয়ে কোনও দিনই জড়িয়ে পড়িনি, কিন্তু বস্তির মহিলাদের মধ্যে অনেক কাজ করেছি। তাই তাঁদের কাছে আমার কথাটা বললাম। ওঁরা সহানুভূতির সঙ্গেই ব্যাপারটা বুঝলেন। আমার মুক্তি পেতে দেরি হল না।

তোমাকে ভাগ্যবতীই বলতে হবে তুষু। আমাকে কিছু বদনামের ভাগী হতে হয়েছিল।

তাই বুঝি।

হ্যাঁ, তাই। ঠিক কী হয়েছিল জানিনে। যথন দেখলাম, পুরনো বন্ধুরা আমাদের কুষ্ঠরোগীবৎ পরিত্যাগ করে যাচ্ছে, কেউ চিনতেই পারছে না, তখনই বুঝলাম সায়গলের গানটা কত সত্যি।

সায়গলের কোন গান?

সেই যে, এবার হারিয়ে যাবার লগন এল, হারিয়ে যাব, সেই গানটা?

তাই হারিয়ে গেলে।

গেলাম।

যুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, তারপর দেশ ভাগ, উদ্বাস্তু, তার সঙ্গে স্বাধীনতা পেলাম আমরা।

আর পেলাম কংগ্রেস সরকার।

তা অবিশ্যি পেলাম। সৌম্যর তখনও বিশ্বাস জন্মায়নি যে, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।

হ্যাঁ, ওদের কাছে এ আজাদি অনেক দিন পর্যন্ত ঝুটা ছিল।

আমি তখন সামান্যই একটা সরকারি চাকুরে। ওতে আমার কিছু যেত আসত না।

আমি সাতঘাটের জল খেয়ে তখন এক বুর্জোয়া কাগজের যৎসামান্য এক প্রতিবেদক। কিন্তু আমার যেত আসত।

আচ্ছা, এ কী সম্ভব, এই কলকাতার পথ ধরে দুজনেই যাতায়াত করেছি, অথচ কোনও দিন আমাদের দেখা হয়নি। ট্রাম পুড়েছে, বাস পুড়েছে তবুও আমাদের দেখা হয়নি?

হয়তো হয়েছে। তুমি ভিড় ভর্তি বাসে উত্তরমুখো চলেছ। আমি ভিড় ভর্তি বাসে দক্ষিণে চলেছি। কোনও এক কমন স্টপেজে দুটো বাস পাশাপাশি থেমেছে, আমার নজরে এসেছে তুমি জানলার পাশে বসে আছ।

তুমি ডাকোনি!

ভাল করে ঠাহর করতে করতেই হয়তো বাস ছেড়ে দিয়েছে। আর ডাকা হয়নি।

কেন ডাকোনি ভজু?

আমি জরুরি কোনও অ্যাসাইনমেন্ট যাচ্ছিলাম হয়তো। তুমি কেন দেখনি, তুষু?

এটা একটা ভয়ানক শক্ত প্রশ্ন ভজু। নয় কী বলো? হয়তো ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হয়তো অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিলাম কিছু।

তা হয়তো সত্যি। হয়তো কেন, সত্যিই তো বটে।

এবার আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। তুমি ঠিক ঠিক জবাব দেবে তো?

কেন দেব না, তুষু? আজ আমরা দুজনেই এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছি যে, সব প্রশ্নেরই জবাব দেওয়া যায়। বয়েস বাড়ার এইটেই তো মস্ত সুবিধে কিনা।

সে কি এই কারণে যে, তুমি জেনে গিয়েছ যে, ডাক্তার আমাকে জবাব দিয়ে দিয়েছেন।

সেটা যে নয়, তা বলি কী করে? তবে সেটা হয়তো সবটা সত্যি নয় তুষু। আমি আমাদের বয়সের কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম।

তুষুদি উৎসাহ পেয়ে বলল, আচ্ছা, এতদিনের মধ্যে তোমার কি একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?

এটা জেনে এখন তোমার কী এমন সিদ্ধিলাভ হবে তুষু?

তুমি কোনও সংকোচ কোরো না। তুমি যাই বলো, তাতে আমার কিছু ভয়ানক ক্ষতি হবে না। অবিশ্যি তুমি যদি বলতে না চাও, আমার তো জোর নেই। ওটা নিছক একটা কৌতূহল।

তুষুদির চোখটা আমার মুখের দিকে জ্বলজ্বল করে চেয়ে আছে।

না তুষু, মনে পড়েনি। ব্যাপারটা আজ আমার কাছেই আশ্চর্য লাগছে। কিন্তু সত্যিই তো, এখন যত ভাবছি, ততই আমার মনে হচ্ছে, কেন মনে পড়েনি।

সত্যি বলছ? একেবারে এই ক’ বছরের মধ্যে আমাকে মনেই পড়েনি তোমার?

তুষুদির মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেল।

সত্যি বলছি, তোমার কথা মনে পড়েনি। অর্থাৎ তেমনভাবে মনে পড়েনি, যেমনভাবে মনে পড়লে একটা পুরুষ একটা নারীর কাছে ছুটে না গিয়ে পারে না। আজ আমি যেমন তোমার কাছে এসেছি। কাল সারারাত ধরে তোমার কথা মনে পড়েছে। কাল বুকে বেশ ব্যাথা উঠেছিল। না, ও নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। ইসকিমিয়ার ব্যথার আসলে কোনও প্রতিষেধক নেই। কিন্তু কাল সেই ব্যথা যত উঠেছে, তত আমার মনে হয়েছে, তুষুর সঙ্গে দেখাটা সেরে ফেলা জরুরি। আর হয়তো সময় নাও হতে পারে। তাই দেখ, তুমি যেমন ঠিকানা দিয়েছিলে টিকিটের গায়ে লিখে, সেই ঠিকানায় আজ পৌঁছে গেলাম। এতদিন তোমাকে এমনভাবে কেন যে মনে পড়েনি তুষু এখন সেটা ভেবেই আমি অবাক হায় যাচ্ছি। আমি অবশ্য তোমাকে জিজ্ঞেস করব না, এর মধ্যে আমাকেও তোমার মনে পড়েছিল কি না?

জিজ্ঞেস করার আর দরকার নেই ভজু। এ তো জানা কথা, তোমাকে আমার তেমন করে মনে পড়লে, আমিই খুঁজে পেতে তোমাকে বের করে নিতাম। কিন্তু ভেবে দেখ, ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত, না? ভারী অদ্ভুত!

তুষুদি অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ফাঁকা চোখে আমার দিকে অনেকক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইল।

সেদিন আমরা যদি রবীন্দ্রসদনে না যেতাম, তবে হয়তো ইহজন্মে আমাদের দেখা নাও হতে পারত। তাই না?

বুঝতেই পারলাম, তুষুদি প্রশ্নটা আমাকে করছে না। করছে ওর নিজেকেই।

এইভাবেই একদিন মরে যেতাম ভজু। আর দেখাই হত না আমাদের। অথচ এখন দেখো, সামনাসামনি বসে আছি তো আমরা, কথাটাকে কত অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে, চল্লিশ বছর ধরে আমাদের দু’জনের মধ্যে একবারও দেখা হয়নি?

ব্যাপারটা আমারও অবাক লাগল এবার। সত্যিই তুষুদির সঙ্গে আমার যে এতদিনের ছাড়াছাড়ি আজ এখানে এসে অবধি সেটা একবারও অনুভব করিনি। অথচ এটাও তো ঠিক, রবীন্দ্রসদনে থিয়েটার দেখতে না গেলে তুষুদির সঙ্গে দেখা হত না। অন্ধকারের ভিতরে যার পাশে এসে বসলাম সেদিন, সেই যে তুষুদি, এটাও প্রথমে বুঝতে পারিনি। নাকে সেন্টের একটা তীব্র গন্ধ লেগেছিল বটে। তা আজকাল অমন সেন্ট প্রাতটি মাহিলাই মেখে থাকেন।

ইন্টারভ্যালে আলো জ্বলে উঠতেই দেখি তুষুদি আমার দিকে চেয়ে আছে।

তুষুদি আগে বলল, এ কী ভজু, তোমার চেহারা এত খারাপ হয়ে গিয়েছে। একেবারে বুড়ো মেরে গেছ। ব্যাপার কী? কোনও অসুখ-টসুখ হয়েছিল নাকি?

বললাম, ক’দিন আগেই হাসপাতাল থেকে এসেছি।

কী হয়েছিল?

হার্টের অসুখ যা হয়। বলেই আমার স্ত্রীর সঙ্গে তুষুদির আলাপ করিয়ে দিলাম।

তুমি কিন্তু সেই রকমই আছ প্রায়। সেই তম্বীকায়া শিখরিদশনা পক্কবিম্বাধরোষ্ঠি।

ঠাট্টার অভ্যাস তো ছাড়তে পারনি দেখছি। তবে হ্যাঁ, গায়ে গত্তি বিশেষ লাগতে দিইনি। আর এই বয়েসে শিখরিদশনার ক্রেডিটটা তো আমার নয়, পুরোপুরি ওয়াটারলুর বারীন রায়ের। আর ঠোঁটে-পালিশের যুগে প্রত্যেকটা মেয়ের ঠোঁটই তো বাবা এক একটা পক্কবিম্ব। আমি শরীরে পালিশ না মেরে রাস্তায় বেরুতে পারিনে, আগেও পারতাম না, এখনও পারিনে। কিন্তু বাইরে কোঁচার পত্তন হলে কী হবে, ভজু, ভিতরটা একবার ঝাঁঝরা হয়ে গিয়ছে।

তুষুদি কানের কাছে ঠোঁট এনে বলল, ক্যানসার। একেবারে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বশরীরে। ডাক্তারের কাছে যেতে এত দেরি হয়ে গেল যে, তখন আর কিছু করার নেই। বাঁদিকের ব্রস্টটা বাদ দিয়ও রোখা গেল না। এখন কেমোথেরাপি করতে করতে প্রাণ বেরিয়ে যায়। তুষুদি কথাগুলো ফিসফিস করে এমনভাবে বলল, যেন রোগটা ওর নয়, অন্য কারওর রোগের বিবরণ দিচ্ছে।

শুনে থ হয়ে গেলাম। কথা বলতে বলতে তুষুদির হাতে আমার হাত ঠেকে গেল। বেশ গরম। তুষুদি ঠাট্টা করছে না।

একদিন এসো না আমার বাসায়। কথা-টথা বলা যাবে। কিছু একটা নিয়ে থাকতে হবে তো। সর্বক্ষণই তো যন্ত্রণা।

তোমার বাসা তো আমি চিনিনে। ঠিকানাটা দাও।

তুষুদি বলল, কাগজ আছে?

সেই সময়েই আলো নিবে গেল।

নোট বই, কাগজ কিভুই ছিল না সেদিন। ছেঁড়া টিকিটের উলটো পিঠেই তুষুদির ঠিকানাটা লিখে রেখেছিলাম। আর অবাক হয়েছিলাম সেদিন তুষুদির কাণ্ড দেখে। থিয়েটার ভাঙবার পর মঞ্চে উঠে গিয়ছিলাম আমরা। তুষুদি যতক্ষণ ছিল, হইচই করে মঞ্চটা মাতিয়ে রেখেছিল। একেবারে সেই আগের তুষু। যেন ওর বয়েস একটুও বাড়েনি। যেন ওর শরীরে রোগ বালাই বলতে কিছু নেই। পর পর ক’টা রাত আমাকে বসে কাটাতে হয়েছিল বিছানায়। সারা রাত ধার সেই মুহর্তগুলোতে কেবল তুষুদির কথাই ভেবেছি। কেবল সেই পুরানা দিনর কথাই মনে পড়েছে। আর প্রতিদিন মনে হয়েছে, তুষুদিকে দেখে আসি। আশ্চর্য, চল্লিশ বছরের মধ্যে যে ইচ্ছে হয়নি, সেই ইচ্ছেটা এখন প্রবল বেগে গুঁতো মারতে লাগল আমাকে। ইচ্ছের গুঁতো এমনই যে, আজকাল যা একেবারে করি না, সেই কাজই করতে হল। লোডশেডিং-এ লিফট অচল দেখে একটু একটু করে তুষুদির দশতলার সিঁড়ি ভাঙতে হল।

প্রায় সারাক্ষণই তো একা থাকতে হয়। তুষুদি বলল। তাই নিজেকে সাজাই। নয় তো বন্ধুবান্ধব কেউ এলে আড্ডা দিই। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ আসে। সৌমাও আসে আজকাল। ওর বউও আসে। বেশ ভাল মেয়ে। আমার তো ওকে খুব ভাল লাগে।

তুমি একটু বসো আমি আসছি। কিছু খাবে? চা কি কফি?

আমি কিন্তু উনুন ধরিয়ে দিতে পারব না, তা বলে দিচ্ছি।

তুষুদি হেসে ফেলল। আজকাল আর কসরত করে উনুন ধরাতে হয় না। সিলিন্ডার গ্যাসের উনুন দেশলাই জ্বাললেই ফস করে ধার যায়। কত সুবিধে হয়ে গেল মানুষের। না?

তাই বই কি।

সেই জন্যই তো ভজু, বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। শুধু সেই জন্য। নইলে আমার আর কী, বলো? যেদিন আমার অপারেশন হল, জানো…

তুষুদি আবার বিছানার উপর বসে পড়ল।

সেদিন জ্ঞান হবার পর… যখন মনে পড়ল… আমার বাঁদিকের স্তনটাকে কেটে ওরা ফেলে দিয়েছে… কেমন একটা অদ্ভুত শূন্যতাবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল… তার মধ্যেই আমার কী মনে হচ্ছিল জানো, কত লোকেরই ওটার উপর নজর ছিল… আমার পারিবারিক শুচিতাবোধ… শরীর সস্পর্কে অযথা একটা সচেতনতা… কী দরকার ছিল এই শুচিবাইয়ের… অন্য কেউ যদি ওটাকে ব্যবহার করতই… সত্যিই কি তেমন কোনও ক্ষতি হত… আমার ছেলেকেও বুকের দুধ খাওয়াতে পারিনি… এখন তো ওটা একটা আবর্জনার সমান হয়ে গেল। তাই না ভজু?… আমার কেবলই মনে হাচ্ছিল… কত লোককেই তো বাঞ্চিত করেছি… সেই জন্যই কি আমার এমন হল?

তুষুদি উঠে গিয়ে চা করে নিয়ে এল।

কিছু খাবে? রাত হয়েছে কিন্তু।

সময়ের কথা মনে ছিল না। ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। একবার মনে হল উঠি। কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছিল না।

বললাম, না, খাবার ইচ্ছে নেই। চাতেই চলবে। বাড়ি যাবার কথা ভাবছিলাম।

বসো না। সঙ্গে গাড়ি আছে তো?

মিথ্যে কথা বললাম।

আছে।

তবে আর কী? রাতেই কলকাতায় যাতায়াতের বেশি সুবিধে।

নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। তোমার কথা কিছুই জানা হল না।

আমার আবার কী কথা। এক রকম করে টিকে আছি।

টিকে থাকাটাকে তুমি বুঝি খুব ছোট করে দেখ? দেখ এই বয়েসে আর আঁতলগিরি ভাল লাগে না। বেঁচে থাকার মতো সুন্দর ব্যাপার আর কী আছে? ও সব আমারও ছিল। বুঝলে? কত রকম বায়নাক্কা। এখন মৃত্যুর পিঠের উপর চড়ে বসে আছি তো। তাই বেঁচে থাকার মর্মটা বুঝেছি। যতদিন পারো ভজু, বেঁচে থাকার চেষ্টা করো।

তোমার মুখেই কেবল এ কথা মানায় তুষু। কেন না, বাঁচতে তুমি ভয় কর না। কখনও করনি।

তোমায় মিথ্যে বলব না ভজু, কথাটা আমার খুব ভাল লাগল। কারণ কথাটা সত্যি। ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য কী লড়াইটাই না আমাকে সারা জীবন ধরে করে আসতে হয়েছে। তুমি খানিকটা জানো। তুমি দেখেছ তো, যতদিন বাপের বাড়িতে ছিলাম, হয়তো তোমার মনে থাকতে পারে, পোশাক আশাকের দিকে আমার কোনও লক্ষই ছিল না। বিয়ের পর দিন এক গা গহনা পরে, বেনারসি শাড়িতে শরীরটাকে মুড়ে বাবার ওই বড় বাড়িটা থেকে সৌম্যর এক ঘরের ভাড়াবাড়িতে এক গাদা দানের জিনিস নিয়ে যখন এসে পৌঁছলাম, সে কী হাস্যকর পরিস্থিতি। বলো। তোমরা তো ছিলে। মঙ্গলা মাসি তো হাউ মাউ করে কান্নাই জুড়ে দিল, বাবা আমাকে হাত পা বেঁধে সাগরে ভাসিয়ে দিল বলে। আমি তক্ষুনি তাকে জোর করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। তখন আমার কীই বা বয়েস। অত জিনিস দেখে সৌম্য এসে রাগে কী রকম গরগর করছিল। দেখেছিল তো? সৌম্যর সেই রাগ আমার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেই ভয় আর আমার কাটল না। তখনই বুঝেছিলাম, হার মানলে আমাকে চলবে না।

তুষুদি গভীর ভাবনার মধ্যে তলিয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে যেন জেগে উঠল।

আমি তোমাকে তখন ঠাট্টা করলাম বটে ভজু, কিন্তু আমরা কেউই অতীতটাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারিনে।

সেইটে নিয়েই তো আমাদের জীবন। অতীত বর্তমান কোনওটাকেই ফেলা যায় না।

তুষুদি বলল, তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বাবাকে দেখতে পেলাম। এক লহমায় দেখে ফেললাম, বাবা অস্থির হয়ে বারান্দায় পায়চারি করছে। আমার বিয়ের দিন যে রকম করছিল। জেগে জেগেও কি স্বপ্ন দেখা যায়?

আমি তো তাই দেখি। কিন্তু আমার এখন মনে হচ্ছে, তোমার বিশ্রাম নেওয়া দরকার। অনেকক্ষণ কথা বলেছ। আমার বোধহয় এখন যাওয়া উচিত।

বসো বসো। তুমি আসবে আমি ভাবতেই পারিনি। আমার কষ্টের কথা ভাবছ? তোমার কি ধারণা, তুমি চলে গেলেই আমার কষ্টের লাঘব হবে। তুমি যতক্ষণ আছ, ততক্ষণই বরং আমার কষ্টটা তেমন বোধ হবে না। আমি তো ঘুমুতে পারিনে। আগে আগে ঘুমের জন্য ইঞ্জেকশন নিতাম। এখন ছেড়ে দিয়েছি। ক’টা দিনের জন্য আর এত ফোঁড়াফুড়ি কেন? এমনি সাজ-সজ্জা করতে করতেই একদিন যদি একেবারে ঘুমিয়ে পড়তে পারি, সেইটেই কি সব চাইতে ভাল নয়। বলো?

তুষুদি গহনাগুলোকে একটা একটা করে তুলে দেখাতে লাগল।

অনেক গহনা ছিল আমার। বাবা দিয়েছিলেন। সৌম্যর বাড়ি থেকেও অনেক পেয়েছিলাম। প্রথম দিকে বেশ কিছু সংসারের কাজেও লাগিয়ে দিয়েছি শুধু এই কটা যা হোক করে বাঁচিয়েছি। বিশেষ করে সৌম্যদের বাড়ি থেকে যেগুলো পেয়েছিলাম। ওগুলো খরচ করলে পাছে বাবার নিন্দে হয়, তাই। মেয়েদের যে কত কিছু ভাবতে হয়, তোমরা সেটা আন্দাজ করতেই পারবে না। তা ছাড়া এই

গহনাগুলো এমন সাবেকি বলেই এগুলোর উপর আমার বেশি মায়া পড়ে গিয়েছিল। কী অদ্ভুত কারিগরি, দেখো ভজু, দেখো। কত সূক্ষ্ম কাজ! এখন ভাবছি কি জানো, এগুলোর নকল তৈরি করাব।

কেন? এগুলো তো ভালই।

তুষুদির মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল।

আরে ভাল বলেই তো মুশকিল। আমার ইচ্ছে গহনাগুলো পরেই আমি চিতেয় গিয়ে উঠি। একেবারে ফুল ড্রেসে। কিন্তু ওটা আমার পাগলামি ভেবে আমার মরার পর কেউ যে ওগুলো খুলে নেবে না, সে গ্যারান্টি তুমি দিতে পারো? আর সত্যিই তো, এগুলো অমনভাবে নষ্ট করেই বা লাভ কী? তাই ভাবছি অবিকল এই প্যাটার্নের ভাল রোল্ড গোল্ডের সেট বানিয়ে নেব। আর সেইগুলো গায়ে পরে আবার বিয়ের কনে সাজব। সৌম্যদের দেশে গ্রামের লোকেরা কনে বউয়ের শ্বশুরবাড়ি যাওয়াকে নাইয়র যাওয়া বলে। এইটেই আমার শেষ নাইয়র হবে।

তুষুদি ছেলেমানুষের মতো হাসতে লাগল।

তুমি তো দেখছি, যাবার আয়োজন সব সেরেই রেখেছ।

আমার ব্যাপারটাই যে এ রকম। আমার পালকি আর কে সাজিয়ে দেবে বল? তাই নিজেকেই সব করে-কম্মে নিতে হচ্ছে। কিন্তু আমার প্ল্যানটা তোমার কেমন লাগল? বেশ রিয়ালিস্টিক। নয়?

আমার মনে হয় রোল্ড গোল্ড সম্পর্কে যা ভেবেছ, সেটা ঠিকই ভেবেছ। শেষ যাত্রায় একটু আয়রনি থাকা ভাল। তোমার কথা শুনে আমার একটা ইচ্ছে জেগেছে বলব?

বলো না?

তোমার নাকে আমি আজ নথটা পরিয়ে দিয়ে যেতে চাই।

সত্যিই তুমি দেবে পরিয়ে?

তার বদলে আমাকেও একটা জিনিস তোমাকে আজ দিতে হবে। যদি অবিশ্যি নথটা পরাতে পারি।

কী তোমাকে দিতে হবে, বলো?

সে হবেখন। তার আগে, আমাকে বলো তো, নথটা তোমার নাকে পরাব কী করে? তুমি তো বলছিলে তোমার নাকের ফুটো বুজে গিয়েছে।

আমি তোমাকে একটা কুলকাঁটা এনে দিচ্ছি। ওটা আমি স্টেরিলাইজ করে রেখে দিয়েছি। নাক বেঁধানো নিজে নিজে হয় না। তুমি সেই কাঁটাটা আস্তে করে আমার নাকে বিঁধিয়ে দেবে। ভয় নেই। ফুটো আমার আছে। সেটা তোমাকে শুধু খুলে দিতে হবে।

তুষুদি তক্ষুনি একটা কুলকাঁটা এনে আমার হাতে তুলে দিয়ে নাকটা আমার কাছে এগিয়ে আনল। আমি তুষুদির নাকটা আলোর দিকে ঘুরিয়ে দেখলাম, সত্যিই একটা অস্পষ্ট বিনধ্ তাতে আছে। আমি অতি সন্তর্পণে তার ভিতর দিয়ে কাঁটাটা ঢুকিয়ে বিনধ্টা বড় করে দিলাম। নাকের ওই অংশটা লাল টকটক করতে লাগল।

তুষুদি সেখানে একটু মলম ঘষে দিল। তারপর সেই ভারী ফাঁদি নথটা পরে খোঁপার সঙ্গে নথের চেনটা টান টান করে লাগিয়ে নিল। তারপর ঘোমটা টেনে আয়না দিয়ে মুখখানাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে বলল, আজ একটু ব্যাথা লাগছে। কাল পরশু ঠিক হয়ে যাবে। যাক, তুমি আমার একটা বড় সমস্যা মিটিয়ে দিলে। এবার বলো, তোমার কী চাই?

চুপ করে তুষুদিকে দেখতে লাগলাম। আজ একেবারে রাজেশ্বরী। বললাম, তোমাকে চুমু খাবার জন্য পূর্ণর, অরুণের আর আমার একটা সাধ বরাবর ছিল। ওদের সে সাধ মেটেনি। আজ আমি যদি ওদের হয়ে তোমার কাছে সেটা চাই, তুমি দেবে?

তুষুদি আমার মুখের দিকে সোজা চেয়ে থাকল। তারপর কথা না বলে আমার গলাটা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে একটা চুমু খেল। হঠাৎ তারপর কপালে একটা।

তারপর বলল, বাঁদর। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

গল্পটি দেশ, শারদীয় ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত