উৎসব সংখ্যা গল্প: স্বপ্নপূরণ । গৌতম বিশ্বাস
বাপ নিধিরাম বলতো,” আমি থাকতি থাকতি সপ কিছু ভালো কইরে শিখ্যে নে বাপ।না হলি মাঝ দরিয়ায় গে দিক খুঁজ্যে পাবি নে।”
জগাই তখন নিতান্তই বালক।সে খায় দায় আর মাঠঘাট,বনবাদাড়,গাঙপাড় ধরে হেঁটে বেড়ায়।ইচ্ছে হলে কোথাও খানিক বসে থাকে।বসে বসে আকাশ দ্যাখে।মাঠ দ্যাখে।গোরু,ছাগল,পাখপাখালি দ্যাখে।আকাশের মেঘ দ্যাখে।মেঘের গায়ে রোদের ছড়িয়ে পড়া দ্যাখে।তখন তার অফুরন্ত সময়।সময় মত দু’বেলা ভাত বেড়ে মা ডাক ছাড়ে,” কইরে বাপ,কই গেলি?খাইয়ে যা।”
এত সবের পরেও মনটা তার খারাপ হয়ে যায়।তার বয়সি ছেলেরা তার সঙ্গে ঠিক মত মেশে না।খেলা করে না।কথা বলে না।একেকটা সময় কেউ কেউ তো মুখের ওপর বলেই দেয়,” তোর সাথে খেলবো না।”
” ক্যান?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে জগাই।
” তোর বাপ চুরি করে।তুই চোরের ছেল্যে।চোরের ছেল্যের সাথে খেলবো না।”
শুনে মনটা খারাপ হয়ে যায় জগাইয়ের।বুকের ভেতর থেকে ঠেলে ওঠা কষ্টটা কোনওমতে পাথর চাপা দিয়ে সে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় গাঙপাড়, মাঠ,কিংবা যেখানে খানিক ঝোপ জঙ্গল। তারপর সে আকাশের সাথে কথা বলে।ফুল,পাখিদের সাথে কথা বলে।ইচ্ছে হলে গান গায়।ইচ্ছে হলে বসে থাকে।তখন কেবল তার মনে হয় দুনিয়ায় এত কাজ বাদ দিয়ে তার বাপ কেন চুরিই করে।
তাই বাপ যখন তাকে সবকিছু শিখে নেওয়ার কথা বলতো,তখন জগাই বলতো,” আমি চুরি করবো না।”
তাদের তিন পুরুষের ঐতিহ্য এ ভাবে ছেলের কারনে শেষ হয়ে যাবে এটা একদমই ভাবতে পারতো না নিধিরাম।চোখজোড়া কপালে তুলে তাই সে বলতো,” কস কী বাপ?চুরি করবি নে?তাহলি খাবি কী?ট্যাকা পাবি কই?”
জগাই বলতো,” ক্যান?দুনিয়ায় কী চুরি ছাড়া আর কাম নাই?”
” আছে।তয় চুরি হল গে আমাগের তিন পুরুষির পেশা।আমাগের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যডারে তুই নষ্ট কইরে দিবি বাপ?”
ফুলমতি এসে তখন ঠিক পাশে দাঁড়াতো ছেলের।বলতো,” তুমি কেমুন বাপ কও দেহি?এইটুকুন ছেল্যেরে চুরি কত্তি শেখাচ্ছো?”
” তাতে দোষের কী হল শুনি?”
” দোষ হল না?চুরি করা বুঝি ভালো কাম?”
” অত ভালো মন্দ ভাবতি গেলি প্যাট চলবে ক্যামনে?”
” সে তুমার ভাবতি হবে না।প্যাট দেছেন যিনি,আহার দেবেন তিনি।গায়-গতরে ঠিকমতন থাকলি কোন মানুষডা না খাইয়ে মরে শুনি?এই যে মাঠঘাট, খ্যাত খামারে এত কাজ – জগাই বড়ো হইয়ে এট্টা কিছু ঠিকই জোগাড় কইরে নিতি পারবে।”
খুব বেশি কথা আর বাড়াতো না নিধিরাম।অল্প স্বল্প গাঁইগুঁই করতো কেবল।তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে সেও আকাশ দেখতো।দূরের মাঠ দেখতো।সন্ধে নেমে আসা ঝোপঝাড় দেখতো।
এক সন্ধেবেলায় দাওয়ায় বিছানো খেঁজুর পাতার মাদুরে বসে ফুলমতি বলেছিল,” জগাইরে ইসকুলি ভত্তি করায়ে দেও।বয়াস তো কম হল না।এক্কেবারে মুখ্যু না থ্যিকে এট্টু পড়ালেহা শিখুক।”
বৌয়ের মুখে এমন কথা শুনে একপ্রকার আঁৎকেই উঠেছিল নিধিরাম,” কও কী?ইসকুল?ইসকুলি গে কী হবে?”
অবাক হয়ে নিধিরামের মুখের দিকে তাকিয়েছিল ফুলমতি,” কী হবে মানে?পড়ালেহা শেকপে।”
” পড়ালেহা?পড়ালেহা শিখ্যে হবে ডা কী?চোরের ছেল্যে কুথাও জজ বেরিস্টার হইচে শোনছো?”
” জজ বেরিস্টার না হোক,প্যাটে খানিক বিদ্যে বুদ্ধি তো হবে।”
” বয়াস হলি সে এমনিই হবে।”
” তুমার বুদ্ধি তুমার কাছে থাক।ওরে ইসকুলি ভত্তি করাবা তাই করাবা।”
অগত্যা এক সকালে ছেলেকে নিয়ে গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুলে গিয়ে হাজির নিধিরাম।ছেলেকে ভর্তি করাবে শুনে নিবারন মাষ্টার খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন নিধিরামের দিকে।কতদিন,কতবার করে তিনি নিধিরামকে বলেছেন,” শোন রে নিধি,ছেলেটার বয়েস হয়ে গেছে,ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দে।”
নিধিরাম কেবল হেসেছে।নিবারন মাস্টার বলেছেন,” হাসিস কেন?আমি কী তোকে হাসির কথা বললাম?”
” ইজ্ঞে না ছার,সে জন্যি হাসি নে।”
” তাহলে?”
” হাসি এই জন্যি যে চোরের ছেল্যে শেকপে পড়ালেহা।দুনিয়াডা কী পাল্টায়ে গেল?”
” না রে,দুনিয়া পাল্টায়নি।সমাজ পাল্টেছে। পরিবেশ পাল্টেছে। এখন সবাই চায় ছেলে মেয়ে লেখাপড়া শিখুক।হিসেব করে বাঁচতে শিখুক।তুই ই কেবল – “
এমন কত কথাই না বলতেন নিবারন মাষ্টার। এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিত নিধিরাম।সেই নিধিরাম হঠাৎই ছেলেকে ভর্তি করাতে এসেছে দেখে অবাক না হয়ে পারেননি মাষ্টার। পাশের বেঞ্চিটায় নিধিরামকে বসতে বলে জিজ্ঞেস করেছিলেন,” তা ব্যাপার কি রে নিধি,হঠাৎ তোর মাথায় সুবুদ্ধি এলো যে?”
নিধিরাম বলেছিল,” ওর মা এমন কইরে ক ‘ লো – “
” বাঃ, শুনে খুব ভালো লাগলো রে।সব মায়েরাই যদি এমন হত।”
” আপনে ওরে ভত্তি করায়ে নেন ছার।”
” সেই তুই ছেলেকে স্কুলে দিলি,অথচ দু’দুটো বছর নষ্ট করে।এতদিনে ছেলেটা কত এগিয়ে যেত জানিস?”
জগাইকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে নিয়োছিলেন নিবারন মাষ্টার। বলেছিলেন,” পড়ালেখা জানলে দুনিয়ায় কাজের কোনও অভাব নেই রে জগাই।মন দিয়ে পড়াশোনাটা কর।”
” না,পড়াশোনা হয়নি জগাইয়ের। হাজার হোক চোরের ছেলে তো।স্কুলে সবাই তাকে এক অন্য চোখে দেখতো।তেমন করে কেউ মিশতো না।খেলতো না।কথা বলতো না।আর বললেও বলতো,” তোর বাবা না চোর?ছ্যাঃ ছ্যাঃ,হ্যাঁ রে জগাই তুইও বুঝি বড়ো হয়ে চুরি করবি?”
শুনে খুব কান্না পেত জগাইয়ের।একটা কষ্ট ঠেলে উঠতো বুকের ভেতর।স্কুল মাঠটার এক কোনায় বড়ো শিরীষ গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতো আকাশটার দিকে।সেখানে তখন হয়তো একটা পাখি ডানায় রোদ মেখে উড়ে যাচ্ছে কোথাও।কিংবা ফালি মেঘ আনমনে ভেসে যেতে যেতে আচমকাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
খুব বেশিদিন অবশ্য এই কষ্টটা সইতে হয়নি জগাইয়ের।হঠাৎ করে বাপটা মারা যেতেই তারও পড়াশোনায় ইতি।
হ্যাঁ,একদিন রাতে চুরি করতে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরা হয়নি নিধিরামের।কারা যেন মেরে ফেলে রেখে গিয়েছিল গাঙপাড়ে।খবর পেয়ে মায়ের সঙ্গে ছুটে গিয়েছিল জগাইও।তারপর মা-ছেলেতে কত কান্না।
না,আর পড়াশোনা হয়নি জগাইয়ের।দু’টো পেট চালাতেই হিমশিম অবস্থা মায়ের।ছেলেকে পড়াবে কী?নিবারন মাষ্টার অবশ্য বাড়ি বয়ে এসে বলেছিলেন,” পড়াশোনা টা ছাড়িস নে জগাই।বইখাতা যা লাগে আমিই না হয় – “
ততদিনে সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার ফুলমতির।একটাই কেবল ভাবনা – কি করে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারবে।কি করে শরীরের পোশাক জোগাড় করবে।
নিবারন মাষ্টারের কথা শুনে ফুলমতি বলেছিল,” ছেল্যেডার কপালে পড়ালেহা নাই ছার।না হলি এই বয়াসে কারুর বাপ মরে?”
” সে আমি সবই বুঝি।তবুও বলবো জগাই পড়াশোনাটা করুক।”
না,নিবারন মাষ্টারের কথায় সায় দিতে পারেনি ফুলমতি।বরং সে চেয়েছিল ছোট থাকতেই কাজ করতে শিখুক ছেলেটা যাতে একটু গায়ে পায়ে হলেই সংসারের হাল টেনে নিয়ে যেতে পারে। জগাইয়ের নিজেরও আর স্কুলে যেতে ভালো লাগছিলো না।এমনিতেই পড়াশোনা মাথায় ঢুকতো না তার।তার ওপর সবাই কেমন যেন দূরছাই করতো তাকে।বাপের গায়ের ‘ চোর ‘ অপবাদটা জোর করে যেন তার গায়ে লাগিয়ে দিচ্ছিলো ওরা।যেটা একদমই ভালো লাগতো না জগাইয়ের।ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল ফুলমতিও।তাই এক সন্ধেবেলায় কাজ থেকে ফিরে এসে বলেছিল,” না রে বাপ,আর ইসকুলি গে কাম নাই তোর।না হলি চোর চোর শুনতি শুনতি কবে সত্যি সত্যি চোর হইয়ে যাবি।”
এ সবই অবশ্য অনেকদিন আগেকার কথা।তারপরে কত দিন,মাস,বছর পেরিয়ে গেছে।ছোট্ট জগাই বড়ো হয়েছে।গায়ে পায়ে মাংস লেগেছে।শরীরে ফুটে উঠছে যৌবনের ইশারা।সারাদিন অন্যের বাড়িতে মা কে খাটতে দেখে একদমই ভালো লাগে না তার।সারাদিন কতই না খাটে মা টা তার।রোদ,জল,ঝড়,বৃষ্টি- সারাবছর খেটেই চলেছে।বাপের মুখটা সেভাবে আর মনে পড়ে না।কিন্তু মা কে দেখে কষ্ট হয়। বুকের ভেতর একটা যন্ত্রণা কেবল কুরে কুরে খায় তাকে।আর এই ব্যাথা সইতে না পেরে অবশেষে আজ দিনান্তের কাজ শেষে সন্ধে ফুরোলে রাতের খাওয়া শেষ করে মা যখন বিছানায় গিয়ে শুয়েছে সে সময় হঠাৎ করেই মায়ের হাতটা ধরে জগাই বললো,” তুমারে আর কাজ কত্তি দেবো না।”
সারাদিনের ক্লান্তির শেষে সবে তার চোখ দু’টি জড়িয়ে এসেছে এমন সময় এমন কথা শুনে চমকে উঠে ছেলের মুখের দিকে তাকালো ফুলমতি,” কস কী বাপ?তাহলি খাবো কী?”
জগাই আরও একটু শক্ত করে মায়ের হাতটা চেপে ধরে বললো,” ইবার থ্যিকে আমি কাজ করবো।”
কাঁচ ভাঙা লন্ঠনের মৃদু আলোয় ঘরের ভেতরে তখন এক অন্যরকমের পরিবেশ।অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকালো ফুলমতি।ছেলেটা যে কবে এতখানি বড়ো হয়ে গেছে টেরও পায়নি সে।কিংবা মায়ের চোখ দিয়ে দেখতেই পারেনি।অথচ এতদিন এমন একটা স্বপ্ন ই সে দেখে এসেছে।ছেলেটা বড়ো হবে।সংসারের দায়িত্ব নেবে।খেটেখুটে নতুন করে সাজাবে এই সংসার।বাড়িঘর।
ফুলমতিকে অমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে জগাই জিজ্ঞেস করলো,” অমন কইরে কী দ্যাহো?”
ফুলমতি বললো,” তুই কত বড়ো হইয়ে গিছিস।”
” হঃ,আমি বড়ো হইয়ে গিছি।তাই তো তুমারে আর মানষের বাড়ি কাজ কত্তি দেবো না।অনেক করছো।আর না।”
” তা কী কাজ করবি বাপ?কিছু ভাবছিস?”
” হঃ,ভাবছি।”
” কী?”
” উঠোনের ওই আমগাছডা বেচ্যে দেবো।যে ট্যাকা পাবো তাই দে একখান নাও কেনবো।আর একগাছি জাল।”
” নাও?জাল?ই সপ দে তুই কী করবি?”
জগাইয়ের চোখে ভেসে উঠলো গাঙ।নৌকোয় বসে জাল ফেলা।সেই জালে উঠে আসা মাছেদের গায়ের আঁশে ছলকে ওঠা রোদ।সে বলতে লাগলো,” আমি গাঙে যাবো।মাছ ধরবো।সেই মাছ বেচ্যে ট্যাকা আনবো।সেই ট্যাকায় নতুন কইরে সাজাবো আমাগের এই বাড়িখান।নতুন একখান ঘর দেবো।ঘরের সামনে থাকপে ফালি উঠোন।উঠোনের পাশে দু’ডো আম-কাঁঠালের গাছ।আমার বাপ দাদার পরিচয় ছেল চোর।আমার গা থ্যিকে সেই পরিচয় আমি মুছ্যে দেবো।আমার নতুন পরিচয় হবে জগাই মাছমারা।তুমারে আর কেউ চোরের বৌ কবে না।কবে মাছমারার মা।চোরের থ্যিকে মাছমারা তো অনেক ভালো তাই নে মা?”
জগাইয়ের কথা শুনতে শুনতে নিজের কথাগুলো হারিয়ে যাচ্ছিলো ফুলমতির।মনে হচ্ছিলো জীবনে এতখানি সুখ আগে কোনওদিন পায়নি।এতদিন পরে এতখানি সুখের ছোঁয়ায় কখন যেন চোখ দু’টো জলে ভরে এসেছিল তার।ঘরের ভেতরের আবছা আলো-আঁধারির মধ্যেও মায়ের চোখের সে জল স্পষ্টই দেখতে পেল জগাই।অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,” তুমি কান্দছো মা? ক্যান কান্দছো?”
ছেলেকে হাত বাড়িয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিতে নিতে ফুলমতি বললো,” আজ যে আমার সুখির দিন রে বাপ।”