গত সংখ্যা পড়তে https://irabotee.com/guptahotta/
ততক্ষণে চারপাশের মানুষ জন বাউন্ডারীর উপর দিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করে দিয়েছে ভেতরে। ছোট খালার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। রাশেদকে ফেলে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেন। রাশেদ একটুও আগায় নি। যেমন বসে ছিল তেমন সিড়িটাতেই বসে আছে। তার কোলের উপর পায়রা দুটো। ছটফট্ করছে । অসহায় তাদের চাউনি। ওদের পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণা খানিকটা কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। সদর দরজাটা খুলে আগলে দাঁড়ান দারোয়ান মুন্সী ভাই। বাইরে অনেক লোক।এত লোকের ভীড় আগলে দাঁড়ানো মুন্সী ভাইকে কিভাবে যে অভারলুক করে দুটো ছেলে ঢুকে পড়ে ভেতরে। খালার সামনে এসে দাঁড়ায়। রাশেদের কোলের পায়রাগুলোর দিকে তাকায় । ভীষন অসহ্য সূক্ষ্ণ তাদের চোখ। তীক্ষ্ণ তাদের নজর। চোখগুলো ঠিক স্বাভাবিক লাগেনা রাশেদের। বুকের ভেতরটা কেমন যেন একটা অজানা ভয় খেলে যায় । খালাকে যেন তারা দেখেইনি। বিন্দুমাত্র ভয় পায়নি। অমন জাদরেল আর মেজাজী ছোট খালাকে রাশেদের এমনি এমনিই ভয় ভয় করে। পারতে তার সামনে পড়তে চায়না রাশেদ। সেই খালার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলে দুটো নির্ভীক।
-পায়রা দুটো দিতে বলুন ওকে।
রাশেদের কোলের পায়রাগুলোর দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলে । খালার চোয়াল কঠিন হতে শুরু করে। চিৎকার করে ওঠেন
-তোমরা ওদের গুলি করেছ?
ছেলে দুটো খালার প্রশ্নের কোনোরকম তোয়াক্কা না করেই বলে
-ও দুটো আমাদের। দিয়ে দিন
বলে রাশেদের কোলের দিকে হাত বাড়ায়। পরক্ষণেই খালা সজোর চিৎকারে হাত গুটিয়ে নেয়
-বেরোও। বের হয়ে যাও.. এক্ষুণি বের হও
-আর কখনো এভাবে গুলি করবেনা। ওরা এখানে নির্ভয়ে থাকে। চলাফেরা করে। কেউ ওদের আঘাতও করেনা। মারেওনা। ওরা আমাদের ঘরের লোক। আর কখনো তোমরা এভাবে ওদের গুলি করবেনা
ছেলেগুলো বেশি কথা বলেনা। আবার রাশেদের কোলের দিকে দেখিয়ে বলে
-অকারণ ঝামেলা করবেন না। ওগুলো দিন। ওগুলো আমাদের।
রহিম আর রাগ সামলাতে পারেনা
-ওই ..আফনেরা কেডা? কওহাইন দেহি? হ্যা? কেডা আফনেরা?
-এলা যাওহাইন। পায়রা দিতামনা। ওরা আমাগো অনেক আদরের। খুব খারাফ কাম করছুইন। ফায়রাগুলারে ক্যান গুলি করছুইন? ক্যান মারসুইন ওগোরে।
বলে একজনের গায়ে সজোরে ধাক্কা দিতে যায়। একটি ছেলে কোনোমতে নিজেকে আগলাতে গিয়ে রহিমকে সজোরে একটা ধাক্কা দেয়ে। ওমনি রহিম মাটিতে গড়িয়ে পড়ে যায়। কেমন তড়পাতে থাকে। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারেনা। খালা সচকিত হয়ে ওঠেন রহিমকে নিয়ে।
-মুন্সী..এদের বের করে দাও। দরজা বন্ধ করে দাও
খালার কথা শুনে তীক্ষ্ণ বিষাক্ত অলুক্ষুণে চোখে তাকায় একবার ছেলেদুটো খালার দিকে । আর একবার পায়রাগুলোর দিকে।
ঠিক তখনই ছোট খালার ছেলে ফাইয়াদ ভীড় ঠেলে ভেতর বাড়িতে ঢুকে পড়ে। উত্তেজিত তার গলার স্বর
-কী হয়েছে এখানে? মা কি হয়েছে গো?
আর বলতে বলতেই চোখ পড়ে রাশেদের কোলের রক্তমাখা আহত পায়রাগুলোর দিকে।অমনি রাগে গজগজ করতে শুরু করে
-কারা ? কারা গুলি করেছে ওদের..
ছেলেদুটো তখনও কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফাইয়াদের দিকে। অমনি ফাইয়াদ দু’ঘা লাগিয়ে দিতে যায় । প্রথম ছেলেটি হাত দিয়ে ঠেকায়
-ঠিক করছেন না। একদম ঠিক করলেন না ?
-কী বলেছিস? এই বাড়িতে ঢুকে গুলি করেছিস? আবার গলা উঁচু করে কথা বলছিস?
ফাইয়াদের শেষের কথাগুলো পাত্তাই দিলনা । অমন ভাব করে ঘুরে দাঁড়ায় ছেলেদুটো। চোখে আর বুকে আগুন নিয়ে সামনে আগায়
রাশেদের বুকের ভেতরে সব রক্ত কেন যেন জমাট বাঁধছে। হিম হিম ঠাণ্ডা অনুভব সেখানে। খালা রহিমের মাথাটা কোলে নিয়ে মুখটা উঁচু করে জল খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। সবাই ব্যস্ত রহিমকে নিয়ে। রাশেদ পায়রাগুলোকে কোলে নিয়ে ছেলেগুলোর দিকেই চেয়ে ছিল। এবং এবার সে স্পষ্টই দেখতে পেল। সব লোকের মাঝখান দিয়ে ছেলে দুটো ঠিক হেঁটে গেলনা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। হ্যা। ঠিক। স্পষ্ট দেখেছে রাশেদ। কোনো ভুল নেই।
-রহিম.এই রহিম। কিছুটা ভালো লাগছে তোর?
-হ আম্মা। সব ঠিক। কেমনে জানি মাথাটা ঘুরান দিছিল। আফনে চিন্তা করউইন না য্যান।
বলতে বলতে রহিম উঠে দাঁড়ায়
-মুন্সী খেয়াল করো
বলে রহিমের দিকে নির্দেশ করে খালা ভেতর বাড়ির দিকে পা ফেলেন
-তোমরা ? তোমরা সবাই এখানে কী করছ?
-ভেতরে যাও সবাই। ভেতরে যাও
রাশেদ ততক্ষণে খেয়াল করে তার পেছনে ভেতর বাড়ি থেকে পর্দার আড়ালে উঁকি দিয়েছিল বাড়ির সবগুলো খালাত বোন। সাহস করে বাইরে আসতে পারছিল না। মায়ের চোখে রাগ ঝরে পড়ছে দেখে কেউ কথা বলবার আর সাহস পায়না।
-রাশেদ। কিছুক্ষণ থাক তুই রহিমের কাছে।
মাথা নাড়িয়ে রাশেদ সম্মতি দেয়।
-আর মুন্সী তুমি ওই নারকেল আর তাল গাছটার কাছে একটা গর্ত খুঁড়ে দাও।
-রাশেদ .. এই রহিম। পায়রাগুলোকে ওখানে খুব যত্ন করে পুঁতে দিস।
একবার পায়রা দুটোর শরীরে হাত বুলান খালা । তখন আর ওদের শরীরে মৃত্যু যন্ত্রণা নেই। শান্ত হয়ে পড়েছে ওদের ডানা। খালার চোখে কি এই শেষ গোধূলি আলোয় খানিকটা জল মুক্তোর দানার মত একটা ঝিলিক দিয়ে ওঠে! নাকি! কি এক অজানা ভয় খালার চোখে! রাশেদ কী খালার দৃষ্টির ভুল ব্যাখ্যা পড়ছে। না। অত ছোট বয়স থেকে ছোট খালাকে দেখছে রাশেদ। রাশেদ একদমই ভুল দেখেনি। ওদিকে তাকিয়ে দেখে মুন্সী ভাই ততক্ষণে তাল গাছ আর নারকেল গাছের মাঝখানে একটা কবর খুঁড়ে ফেলেছেন।
-চল রহিম..
পায়রাগুলো কোলে নিয়ে রাশেদ ওদিকেই আগায়।
যখন সম্পূর্ণ হয়েছে শেষকৃত্য, সন্ধ্যা ঘনায়মান তখন। আবছা আলো দূর করে সম্পূর্ণ আঁধার পৃথিবীকে গ্রাস করতে আর মাত্র কিছুক্ষণ বাকি। অদূরে দাঁড়ানো ঘন অন্ধকার।
পরের অংশ আগামী শুক্রবার…
